ভালোবাসার বাসা

ভালোবাসার বাসা

প্রথম পুরুষ –

ঈশান আজ খুব খুশি। ওর সব স্কুলের বন্ধুরা বেড়াতে যাবে। এক সপ্তাহের ট্যুর। ২৫ শে ডিসেম্বর থেকে ২রা জানুয়ারী পর্যন্ত। সব্বার guardian যাবে, teachers রা যাবে, বন্ধুরা যাবে সে এক বিরাট ব্যাপার ছোট্ট ঈশানের। কদিন ধরেই আর্জি পেশ হচ্ছিল মার কাছে। শেষ দিকে তো প্রায় অভিমান-অভিযোগে সেন্টিমেন্টাল অত্যাচারের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। আজ মায়ের approval পেয়ে আনন্দে প্রায় পাগলের মতো, স্কুল এর পথে যেতে যেতে মাকে তার উপর্যুপরি ক্রমবর্ধমান plan গুলো শোনাচ্ছিল। মা সুরভী ও মাথা নেড়ে হেসে হেসে সব সায় দিচ্ছিল। আর কোনো উপায়ও ছিল না বোধহয়। স্কুল এর ঠিক গেটে মা ঈশানের হাতে দশ হাজার টাকার খাম দিয়ে,বলল— ‘এটা সাবধানে নাও, teacher কে জমা দিয়ে দেবে। বলবে মা-বাবার কাজের চাপ আছে তো তাই তুমি একাই যাবে বেড়াতে। তাছাড়া তোমার বন্ধুরা থাকবে, teachers রা থাকবেন কোনো অসুবিধা হবে না।’
‘এতক্ষণের বোনা স্বপ্নজালগুলো নিমেষে উধাও হয়ে গেল তার ফ্যাকাশে মুখে শুধু বলল ঈশান—
‘তুমি যাবে না মাম্মাম?’

দ্বিতীয় পুরুষ –

GST, TAX এর file গুলো ঘাঁটছিল অনুরাগ। বড্ড জটিল করেছে tax system সরকার। কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে মাঝে মাঝেই phone করছিল tax consultant কে। তার উপর এই মন্দায় বেশ কয়েক বার ধাক্কা খেয়ে তার ব্যবসা জৌলুস হারিয়েছে। সেটাকেই দাঁড় করাবার চেষ্টায় দিন রাত কাটছে তার। বেশ চিন্তিত লাগছে ইদানিং তাকে।বিছানায় পাশে এসে বসল সুরভী।  
— ‘কিগো 9টা বাজতে যায় এখনো ready হওনি, বুবান স্কুল যাবে না ?তোমারও তো অফিস আছে।’

ADVERTISEMENT

— ‘এই বেরোবো’একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল অনুরাগের দিকে।’
— ‘কি আছে এতে?’ বলে প্যাকেট খুলল অনুরাগ,এতো তোমার বিয়ের গয়না গুলো না ? কি হবে এগুলো? ‘
— ‘বলছিলাম তোমার এই বিপদে যদি একটু পাশে দাঁড়াতে পারি, কি করব গয়নার? এগুলো তুমি ব্যবসার কাজে লাগাও।’
— ‘না না, তা হয় না, তুমি এগুলো তুলে রাখো। শেষে কিনা স্ত্রীর গয়নায় হাত …..ছিঃ ছিঃ’!
— ‘দেখ সময়ে যদি কাজে নাই লাগলো তবে এগুলোর দরকার কি ? কথা বাড়িও না এগুলো নাও।’
‘কথা বাড়ায়নি অনুরাগ ,অনেক ভেবে ওগুলো তুলে নিয়েছিল সে।’

তৃতীয় পুরুষ –

মন দিয়ে paper টা পড়ছিলেন রতনবাবু। স্ত্রী-বিয়োগের পর এই তার অর্ধেক দিনের সাথী। বিকেলটায় পার্কের দিকে যান পাঁচ বন্ধুর গল্প চলে। তারপর সন্ধেটায় নাতি ঈশানের সাথেই কাট। বয়স হয়েছে ,ব্যবসা ছেলের হাতে, আর সংসার বৌমার হাতে দিয়ে দিব্বি নিচিন্তি। স্কুলড্রেস পরে লাফাতে লাফাতে এসে পেছন থেকে জাপটে ধরল ঈশান।
— ‘দাদুয়া জানো আমি বেড়াতে যাবো মা বলেছে।’
— ‘বাঃ তাই নাকি দাদু বেশ কথা তো,খুব মজা করবে’একটা বড় মাপের টিফিন কৌটো হাতে ঘরে ঢুকল সুরভী’
— ‘বুবান দাদুকে বিরক্ত করো না, তোমার স্কুলের সময় হচ্ছে না ? টেবিলে খাবার রেখে এসেছি খেয়ে নাও যাও’ ছুটে বেরিয়ে গেল ঈশান 
— ‘নিন বাবা’ বলে টিফিন টা এগিয়ে দিল সুরভী।
–‘কি আছে মা এতে ?’
— ‘দেখেছেন বাবা ভুলে গেছেন আজ কর্নেল জেঠুর জন্মদিন না ? একটু পায়েস রেঁধেছি,সবাই আনন্দ করে খাবেন।’
— ‘একদম ভুলে গেছি মা, সব মনে আছে দেখছি তোমার বেশ বেশ’।

— ‘আর বাবা এটাও রাখুন’  বলে একটা খাম এগিয়ে দিল সুরভীজিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উপরে তাকাতেই সুরভী বলল।
— ‘খালি হাতে যাবেন বাবা ? সেটা ভালো দেখায় না।এটা দিয়ে সামান্য কিছু কিনে নেবেন কেমন ?’ সুরভী চলে যেতে দেখলেন তাতে 10 হাজার টাকা ।

এবং নারী—

ঈশানকে স্কুলে ছেড়ে বাস ধরল সুরভী। নাঃ আজ সে Uber নিলো না। ভিড় বাসে কোনোমতে একটা seat পেয়ে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে চললো – Phone টা  হাত থেকে পড়ে screen ভেঙে গেছে তার। কোনোমতে phone receive আর dial করা যাচ্ছে। mail – whats app তো নয়ই। service center এ বলল এই model এর phone repair হচ্ছে না আর। বাড়িতে থাকলে অনুরাগের ফোনে কাজ চালাচ্ছে অন্ততঃ Mail-whats app গুলো। সবসময় ল্যাপটপ খোলা যায় না। একটা phone না কিনলেই নয়। কিন্তু …..
সামনে মৌ কাকিমার মেয়ের বিয়ে। অত সম্ভ্রান্ত পরিবার। সামান্য হলেও একটা সোনার নেকলেস, বা একগাছা সোনার চুড়ি আর জামাইকে একটা আংটি বা দামি ঘড়ি না দিলেই নয়। কিন্তু এই সোনার বাজারে অতগুলো টাকা …..আর ওই বা কি পরে যাবে? গা ভর্তি গয়নাগুলো তো সব দিয়ে এলো অনুরাগকে। ওর জন্য একটা ভালো ব্লেজার-প্যান্ট না হলেই নয়। হাত তো একদম খালি। যে কটা টাকা মাইনে পায় সবই তো প্রায় শেষের পথে…..নাঃ আর ভাবতে পারছে না সে….stoppage শেষে দৃঢ় চোয়ালে IT সেক্টরের দিকে পা বাড়ালো সে।

Lunch টা পুরোটা খেতে পারল না সুরভী। গা গুলিয়ে উঠলো। মাথা টাও চক্কর দিচ্ছে। Lunch এর পর একটু কাজ করেই senior কে বলে ছুটি করিয়ে নিলো সে। যাওয়ার সময় ডাক্তারবন্ধু দেবপর্ণাকে phone করে নিল সে শরীরটা ভাল বুঝছে না। ভালো করে চেক করলো দেবপর্ণা। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করাতে revolving chair টা ঘুরিয়ে নিলো সে। মুখ ফিরিয়েই বলল আর একটু ভেবে তোকে বলবো। কিছুই মাথা-মুন্ডু বুঝলো না সুরভী।

পুনশ্চ –

মন দিয়ে drawing করছিল ঈশান।
অফিস শেষে সুরভী বাড়ি ফিরতেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল।
— ‘মাম্মাম একটু ম্যাগি বানিয়ে দাওনা।’
— ‘দেব বাবু এই এলাম একটু ফ্রেশ হয়ে নিই কেমন?’
— ‘আচ্ছা একটু দাঁড়াও’ বলে ছুটে ভেতরে গিয়ে টাকার খামটা নিয়ে এলো,মায়ের হাতে দিলো সে।
— ‘একি বুবান তুমি টাকা জমা দাওনি?’
— ‘আমি বেড়াতে যাবো না মাম্মাম আমি তোমার আর বাবাই এর সাথে চিড়িয়াখানা যাবো।’
বলেই ছুট্টে ভেতরে চলে গেল–‘আ-আরে শোন কি আশ্চর্য…..’

সন্ধ্যা হতেই একমুখ হাসি নিয়ে ফিরলেন রতনবাবু,হাতে একটা প্যাকেট।
সুরভী কে দিয়ে বললেন
 –‘নাও মা এটা ধরো।’
–‘কি বাবা এটা?’ খুলে বললো 
–‘এতো mobile’
–‘হ্যাঁ গো এটা ব্যাটা কর্নেল সেন কে দিতে গেছিলাম,ব্যাটা রেগে মিলিটারি দৃষ্টিতে এমন তাকালে যেন ওখানেই পারলে shoot করে দেয় ! স্মার্ট phone নাকি দু চোখের বিষ ! ওটাই নাকি যুগকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে। তা দোকানে ফিরিয়েই দিতাম তারপর ভাবলাম তোমারও তো phone টা ভেঙে গেছে এটা নয় তুমিই রাখো। এতে হবে তো মা ?’ ছলছল চোখের জল লুকিয়ে সুরভী বলল
— ‘খুব হবে বাবা’
চলে যেতে গিয়ে থেমে রতনবাবু বললেন 
‘হ্যাঁ মা তোমার পায়েস ওরা খুব তৃপ্তি করে আঙ্গুল চেটে খেয়েছে ! ব্যাটাচ্ছেলেরা আমায় দিয়েছে এইটুকু ! আমায় আরেকদিন বানিয়ে দিয়ো তো মা !’
বাঁধন হারা সুরভী সামলে নিয়ে বলল
‘দেব বাবা।’
রাত্রে খাওয়ার পর ঈশান দাদুর ঘরে চলে গেল শুতে। 
আয়নার সামনে সুরভী অনুরাগকে টেনে এনে বলল 
— ‘চুপটি করে দাঁড়াও এখান।’
— ‘আরে শ্রীমতি কেন?’
— ‘আবার কথা !’
প্যাকেট থেকে ব্লেজার টা বের করে পিঠে ঠেকিয়ে মাপ নিচ্ছিল,বলল 
– ‘কি পছন্দ তো?’
– ‘কি ব্লেজার না মালকিনকে?’
– ‘ধ্যাৎ খালি অসভ্যতা !’
– ‘কিন্তু এক হাতে তো তালি বাজে না’

– ‘মানে?’
আয়নার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল সুরভীকে,বলল
-‘চুপটি করে দাঁড়াও এখানে। আর চোখ বন্ধ।’ –
‘কেন?’
‘আহঃ পতি পরম গুরু তর্ক করতে নেই। চোখ বন্ধ মনে বন্ধ ব্যাস !’
চোখ বুজল সুরভী,ঠান্ডা ধাতব কিছুর স্পর্শ লাগল গলায়,চোখ চাইলো-
‘আরে এটা তো সেই….’-
‘পছন্দের হারটা Aniversery তে দিতে পারিনি,তোমার সব old মডেলের গয়না পাল্টে নিলাম,ওগুলো আর চলে ?গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো আরকি !’
বিস্ময় খুশিতে ভাষা সরছিল না সুরভীর,কোনোমতে বলল
–‘ক-কিন্তু তোমার ব্যবসা !’
–‘ভরসা আছে তো আমার উপর?’
–‘একটুও না !’
কান্না চাপতে পেছন ফিরল সুরভীঅনুরাগ বলল
-‘হ্যাঁ শোনো প্যাকেট এ একটা আংটি,আর একটা pearl-set আছে ওগুলো নিজের ভেবে বসোনা যেন ! ওগুলো মৌ কাকিমার মেয়ে-জামাইয়ের জন্য।
‘আনন্দ-বিস্ময়-গর্বের দোলায় সুরভী বিহ্বল হয়ে পড়লো।’ অনুরাগ বলল
 –‘একটা অনুরোধ, একটু আপন ভেবো!’
–‘ক-কেন কি হয়েছে ?
–’শরীর খারাপ একবার phone করে বলতে পারতে না?
–‘দেবপর্ণা phone করেছিল তোমায় ?’
–‘আজ্ঞে!!’ কাছে এসে কাঁধে মাথাটা রেখে বলল ‘এরকম দূরে দূরে থাকলে হবে? যে আসছে তাকে দুজন মিলে সামলাতে হবে না ?’ লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল সুরভী । সব রাগ গিয়ে পড়লো দেবপর্ণার ওপর হঠাৎ surprise দেওয়ার বদ-অভ্যেসটা গেল না ওর !!

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait