বিস্মৃত ভাষা আন্দোলন পুরুলিয়া

বিস্মৃত ভাষা আন্দোলন পুরুলিয়া

২১’ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলা ও বাংলা ভাষা কে রক্ত, জীবন দিয়ে আগলে রাখার থেকে আরেক নাম ‘অমর ২১’, আমরা সবাই জানি বাঙ্গালীর অন্তরাত্মায় প্রোথিত মাতৃভাষা দিবস। আমি এমনি ভাষা আন্দোলন এর কিছু কথা বলবো যা আজ বিস্মৃত প্রায়, বঙ্গভুক্তির সময়ে পুরুলিয়া জেলার ভাষা আন্দোলন। রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম না হলেও হিন্দী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলা বাঁচানোর জন্য টুসু গান কে সাথি করে, অহিংস সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে এই অধিকার স্থাপনের আন্দোলন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

পুরুলিয়া তখন ছিলো বিহারের মানভূম জেলায়, ১৯৩১ সালের আদমসুমারি তে দেখা যায় পুরুলিয়ার ৮৭ শতাংশ নরনারী বাংলা ভাষী, আর তার ফল হিসেবে ১৯৩৫ থেকে হিন্দিভাষী বিহারের নেতৃবৃন্দ ছলে, বলে কৌশলে উদ্যোগী হয় পুরুলিয়ার বাংলা ভাষার প্রভাব খর্ব করতে। এই আগ্রাসন উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। হিন্দি ভাষা জোর করে চাপানো হয়, রাতারাতি গড়ে ওঠে কয়েকশ হিন্দি প্রাথমিক স্কুল, আদালতে কাজকর্ম শুরু হয় হিন্দিতে, এহেন অবস্থায় ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের জন্য সোচ্চার হয় মানভূম। লোক সেবক সংঘের নেতৃত্বে আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ নয় বছর ধরে চলেছিলো এই আন্দোলন। জেলার সব স্তরের মানুষের মধ্যে এই আন্দোলন ছড়িয়ে যায়, টুসু সত্যাগ্রহ ছিলো এক গুরুত্বপূর্ণ দিক, মানভূমের লোকসংগীত হয়ে উঠল রাজনীতির গান, টুসু গান ছিলো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের শিকড়ে গাঁথা, আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই কে খুব দক্ষতার টুসু গান দিয়ে আন্দোলন মুখী করা গিয়েছিল। ১৯৫৬ সালের ২০এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত ১০০৫ জন কর্মী (১০জন মহিলা সহ ) অতুল্য ঘোষের নেতৃত্বে পূণ্চা থানার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে পদ যাত্রা শুরু করে কলকাতা পর্যন্ত, সেখানে আইন অমান্য করে ৭ মে আন্দোলনকারীরা কারা বরণ করেন, তেরো দিন পর তাঁরা মুক্ত হন, জেলফাটকে তাঁদের সংবর্ধনা দেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত, দেশপ্রিয় পার্কে এক বিরাট জন সভায় তাঁদের অভিনন্দন জানানো হয় ।

ADVERTISEMENT


আন্দোলন চলতে থাকে অহিংস ভাবে, কিন্তু গুন্ডা বাহিনী দিয়ে বিহার সরকার বাংলা ভাষী আন্দোলনকারী মানুষদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। প্রতিবাদে পুরুলিয়া বনধ ডাকা হয়, অরন্ধন দিবস পালন করা হয়।
তৎকালীন লোকসভা সদস্য ভজহরি মাহাত, লোককবি জগবন্ধু ভট্টাচার্য , অরুণ চন্দ্র ঘোষ প্রমূখ ব্যাক্তি রাজনৈতিক ভাব যুক্ত কয়েকটি প্রতিবাদী টুসু গান লেখেন।
“শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে নারবি ডাং দেখাই।
তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি
বাংলাভাষায় দিলি ছাই।
ভাইকে ভুলে করলি বড়
বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই।”

 


এছাড়াও আছে যেমন ….
“আমার বাংলাভাষা প্রাণের ভাষারে
( ও ভাই ) মারবি তোরা কে তারে।
এ ভাষাতেই কাজ চলছে
সাত পুরুষের আমলে।
এই ভাষাতেই মায়ের কোলে
মুখ ফুটেছে মা বলে।।
এই ভাষাতেই পর্চা রেকর্ড
এই ভাষাতেই চেক কাটা
এই ভাষাতেই দলিল নথি
সাত পুরুষের হক পাটা। “

এই রকম অনেক টুসু গান পুরুলিয়ার ভাষা সংগ্রাম কে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছিলো।

এর পর ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রতিবাদ, অন্যায়ের সাথে আপোষহীন সংগ্রামের রূপ দেখে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডা.বিধানচন্দ্র রায় ১৯৫৬ সালের ৩মে দিল্লি গিয়ে বিশেষ শলাপরামর্শ করেন ,এরপর ১৯৫৬ এর ১৬ আগস্ট সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় ভূমি হস্তান্তর বিল। পুরুলিয়া সদরের ষোলোটি থানা আর পুর্ণীয়ার কিছু অংশ ১লা নভেম্বর ১৯৫৬ থেকে বংলায় যুক্ত হয়। পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তির আরো ভাষা আন্দোলন সামান্য এই কটা কথায় পুরোপুরি ব্যাক্ত করা যায়না তথ্যগত বা অন্য কোনো ভূল ত্রুটি হয়ে থাকলে ক্ষমা প্রার্থনীয়।



পরিশেষে যাদের জন্য এই আন্দোলন সফল হয়েছিলো তারা হলেন ঋষি নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত , লাবণ্য প্রভা দেবী, অতুল্যচন্দ্র ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ , কাননবিহারী ঠাকুর, লোকসেবক সংঘের মানুষজন আর সর্বোপরি পুরুলিয়া জেলার আপামর জনসাধারণ যাঁরা মাতৃভূমি, মাতৃভাষা কে কালিমালিপ্ত হতে দেয়নি, তাদের সবাই কে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait