জীবন নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ‘মহামারী’

জীবন নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ‘মহামারী’

রোজ ঘুম ভাঙ্গে এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে। কোনো বেল বাজে না বাড়িতে কতদিন। আর আগে বেল বাজলে রেগে যেতাম, কতবার খুলবো!! এখন সকাল হয় অদ্ভুত নৈশব্দে। কাগজ আসে না, কাজের দিদি বেল বাজায় না, ইস্ত্রি নিতে আসে না । কর্তার অফিস যাওয়ার তাড়া নেই, সন্তানের স্কুল নেই, পাড়া প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়া নেই। বাজার মুখী বাবা নেই। শুধু আছে অসুখের আলোচনা আর বাজারের দর।
বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকে, সকালে অভ্যেস বশত খোলা হয় আর রাতে নিয়ম মেনে বন্ধ হয়।

জানলায় দাঁড়ালে ফাঁকা রাস্তা, শূন্য ফ্লাইওভার । শহর জুড়ে নেমে আসে চুপিসারে সন্ধ্যে। ছাদে দাঁড়িয়ে পাখিদের নিশ্চিন্ত ঘরে ফেরা দেখি। ওদের মুক্তি ,ওদের স্বাধীনতা আজ আমাদের কাছে ঈর্ষনীয়। দূষণ কমে যাওয়ায় উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া ব্রিজ দেখা যায়, ছোটবেলার মত। মাঝের কয়েক বছরে ধুলো আর ধোঁয়াসায় কোথায় হারিয়ে গেছিলো যেন।

ADVERTISEMENT

মহামারীর আইসোলেশনে আমরা। একাকিত্বে। নিজের মুখোমুখিতে। নিজের সঙ্গে। নিজেদের কাজ করে, বলা যায় বাড়তি অনেক কাজের পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন বসি, সামনে কিছু দেখিনা তখন। এই বন্দীত্ব একসময় আমায় মুক্তি দেবে। জীবন দেবে। নতুন করে বাঁচতে দেবে। আমরা সবাই বাঁচতে চাই। তাই ঘরের দরজায় খিল দেওয়া। এই বিরাট ভ্যাকুমে মনে পড়ে কত কথা। শব্দহীন যাপনে মনের কোণে ভয়েরা উঁকি দিচ্ছে রোজ। আবার সব ফিরে পাবো তো! অথচ কিছুই নিয়ে আসিনি। এসে অর্জন করেছি সব। তাই হারানোর ভয়। সুখ হারানোর ভয়, শান্তি হারানোর কষ্ট। এরপর কী! আবার ফিরবে তো প্রেম, স্নেহ, ভরসা, বিশ্বাস, সুখ!

কিছুদিন একা হয়ে গেলে,কত ভাবনা আসে। ছোটবেলার দুপুর মনে পরে। ছোটবেলায় লোকজন কম ছিল, ফ্ল্যাট হয়নি এখানে। তাই গরমের দুপুর ছিল নিঝুম, খাঁ খাঁ। তখনও নিজের সঙ্গে দিব্যি একা হয়ে যেতাম। কই খারাপ লাগতো না তো, দুমাস পরের ভোর কেমন হবে সেটা নিয়ে ভাবতাম না তো। হামের দুপুর, পক্সের দুপুর মশারির ভেতরে একা হয়ে কাটানো। আবার সুস্থ হলে স্কুল যাব, এই ভেবে সব ভুলে থেকে যেতাম। আর এখন যে অসুখ করেনি, সেই অসুখের ভয়ে সন্ত্রস্ত আমরা। ঈশ্বরকে তো দেখিনা, ভূত আছে কী নেই বিশ্বাস করি বা করিনা। তবু ভয়ে ভক্তি, বিশ্বাসে ভক্তি আসে। এই অসুখ কী তার থেকেও বেশি কিছু চায়, বেশি কিছু বোঝায়! কী জানি!

এই অনিশ্চিত সময় আমাদের কাছে আজ চ্যালেঞ্জের মত। অনবরত মৃত্যুর হার, আক্রান্ত মানুষের পরিসংখ্যান আলোচনায় উঠে আসে বারবার। আতিপাতি করে খুঁজতে থাকি, সংখ্যা কমলো কিনা। হারিয়ে যাবে জীবন থেকে দুই কি তিনমাস নাকি আরো বেশি কিছু। একটা কাল বৈশাখীর পর পৃথিবী শান্ত হতে সময় নেয়। ঘর বাড়িময় ধুলো হয়। সেই ধূলো ঝেড়ে আবার সব পরিষ্কার হতে সময় লাগে। এই মহামারীর ঝড় থামতে আর থেমে যাওয়ার পর সামলাতে ও বহুদিন লাগবে। সেই থেকে যাওয়া, নেই _না হওয়ার জন্যই আপ্রাণ লড়াই আমাদের।
যাদের সঙ্গে থাকতে, মিশতে, হাসতে কাঁদতে চেয়েছি, কথা বলে হাল্কা হতে পেরেছি, স্নেহে, ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছে যারা, তারা আর আমরা যেন থেকে যাই, তাই এত ভাবনা, ভয়, দুরু দুরু বুক ।

সদর্থক থাকাই একমাত্র উপায়, সাবধানে থাকা একমাত্র ঔষধি। দূরে থাকা জীবনদায়ী। এতদিন আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকার পর, নিজের আর অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর পর, চায়ের দোকানের আড্ডার পর , বাজারে দাঁড়িয়ে রাজনীতির পর স্বভাব বদলের চোখ রাঙানি তাই
দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে।

এই স্টেজ থ্রি আসা না আসার সন্ধিক্ষণে আশায় বুক বাঁধি রোজ। আবার সব আগের মত হবে। বারান্দায় দাঁড়ালে কাগজ ওয়ালা ছেলেটি অব্যর্থ লক্ষ্য ভেদ করবে, মর্নিং ওয়াক করতে বেরুনো মানুষগুলো দ্রুত হেঁটে পেরিয়ে যাবে ক্যালোরি, সুগার কমানোর বন্ধুর পথ। প্রেসার কুকারের সিটি আর মেয়ের টিফিন গোছানো দিয়ে আবার শুরু হবে মেয়ের নতুন ক্লাস। বাজার ভর্তি সেই রোজের মানুষগুলো স্ট্যাচু স্ট্যাচু খেলা ছেড়ে সচল আবার। কাজের দিদি, রান্নার মাসীদের না হেঁটে ছুটে চলা রাস্তায়, কর্পোরেট সেক্টরের ২২থেকে ৫২ আবার অফিস মুখী। স্কুলবাড়ি আবার মুখর, ডি এর হিসেব, পে কমিশন এর মুন্ডুপাত, মিড ডে মিলের খিচুড়ির গন্ধ বাতাসে। গান নাচ কবিতা গল্পে মশগুল জীবন আবার ছন্দ পাবে। কামিনী ফুলে ভরে যাবে রাস্তা, মোড়ের কৃষ্ণ চূড়ায় লাল আগুন আকাশ রাঙিয়ে দেবে।
 

0 comments

Illora Chattopadhyay

Illora Chattopadhyay

জন্মসূত্রে বড় হওয়া উত্তরপাড়ায়। সংস্কৃত সাহিত্যে এম.এ পাশ করার পর ১৫ বছর হুগলী জেলার একটি গ্রামীন আধাসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা । সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করলেও প্রিয় বিষয় বাংলা। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা চিরকালীন। মাঝে কিছুদিন পত্র পত্রিকায় বইয়ের রিভিউ লেখা। তারপর দীর্ঘদিনের বিরতি। প্রাণের টানে আবারও ফিরে আসা সাহিত্যের প্রাঙ্গণে। তবে এবারে শুধু আর পুস্তক আলোচনা নয়, তার সঙ্গে মৌলিক লেখালেখির শুরু। মূলত সোশাল মিডিয়ায়। তারপর থেকে বিভিন্ন ওয়েবম্যাগ, কাগজের পত্রপত্রিকাতে নিয়মিত লিখে চলা।যদিও নিজেকে লেখক নয়, পাঠক মনে করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি।

FOLLOW

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait