ছোট গল্প - বাঁশি

ছোট গল্প - বাঁশি

চাকরি সূত্রে বসিরহাটে আসার পর মালতিপুরের কাছে একটা ভাড়া বাড়িতে ছিলাম বেশ অনেক গুলো বছর।
সেখানকার পাট শেষ করে গত দিন দুই হলো আমার নিজের হাতে তৈরি নতুন বাড়িতে উঠে এসেছি। মালতিপুর রেলষ্টেশন পেরিয়ে দিঘির পারে একটা ছোটো সাঁকো, সাঁকো পেরোলে প্রাইমারি স্কুল তার পাশে খেলার মাঠ, ওদিকে একটা মসজিদ, সেটা ছাড়িয়ে দশ মিনিট হাঁটা পথে মেইন রাস্তার বাঁ পাশে আমার বাড়ি। ইতিউতি লোকবসতি। কোথাও পাকা ইঁট, কোথাও বাঁশ টালির, দরমার ব্যারা দেওয়া, মাটির গায়ে আলপোনা আঁকা কুঁড়েঘর। একটা পড়ে থাকা অবৈতনিক স্কুল। বল খেলার মাঠ। উল্টোহাতে আলের পথ চলে গেছে বহূ দূর দিয়ে। দু-পাশে ধান সবজি ক্ষেত। ক্ষেত পেরোলে ইঁট ভাটা। চুল্লির ধোঁয়া উড়তে দেখা যায় দিনের আলোয়। পাশে একটা জলা মতো জায়গা। গাছপালা জংলা আগাছার আড়ালে ঢাকা। রাস্তা, মাঠঘাট, ধানক্ষেত ছাড়িয়ে খুঁটি বাঁধা হাইটেনশন তার চলে গেছে মাথার অনেক ওপর দিয়ে যতদূরে চোখ যায়। এই প্রকৃতি কতটুকু জড়িয়ে রেখেছে আমায় জানি না। তবে থাকতে যখন হবে, অভ্যেস করে নিয়েছি। মানুষ তো অভ্যেসেরই দাস।
 
তাছাড়া এ জায়গাটা আমি আর আমার স্ত্রী তনুকা দুজনে মিলে পছন্দ করে কিনেছি। ভাড়া বাড়ির মতো ওরকম বাজার অঞ্চলের ঘিঞ্জি পরিবেশ নয়। এ বাড়ির জানলা খুললেই ভোরের টাটকা হাওয়ার স্বাদ কোমল স্পর্শ বুলিয়ে দেয় শরীর মনে। সবুজের স্নিগ্ধ সমারোহ, বিস্তীর্ণ প্রান্তর...টেনে নিয়ে যায় বহুদূরে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা রেলগাড়ির হর্ণ আগের বাড়ির মতো কান ঝালপালা করে তোলে না, বরং ঐ ছুটে চলা যেন তার মতো করে চিলেকোঠার ছাদে দাঁড়িয়ে দেখা শৈশবের সেই রেলগাড়ির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় আমায় প্রায়শই। কোথায় যেন হু হু করে ভেতরটা। সময়, দৃশ্যাবলী বড় তাড়াতাড়ি ছেড়ে চলে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে না কিছুই কারো জন্য। তার মাঝেই যেটুকু দেখা, যেটুকু বিভোর হওয়া, যেটুকু মনে থাকা, যেটুকু অপেক্ষা....।  কাল সেকেন্ড স্যাটার্ডেটা কতক্ষণে যে আসবে! তল্পিতল্পা নিয়ে কতক্ষণে রওনা দেবো..! 
 
বাড়ির পথে চেয়ে চেয়ে ভোরের আলো তপ্ত হয়ে ওঠে একটু একটু করে ধান গাছের শিসের আগায়। উল্টোমুখো রেলগাড়ীর সময় মাপা হুইসিলের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলতে হয় আমাকেও। 
বাইরে চেনা গলায় কে ডাকে,' আসতে পারি?'
ইস্তিরি করা জামাটা গায়ে গলাতে গলাতে দরজার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারি।
আমার পুরোনো পাড়ার বাড়িওয়ালা রমানাথ সুর। একেবারে এই সময়েই আসতে হয়! তবু বলতে হলো, 'আরে আসুন! হ্যাঁ, তা ভালো আছেন তো? ওপাড়ার সবাই ভালো? '
'ঐ এক প্রকার। আপনি চলে গেছেন...পাড়াটা কিরকম ফাঁকা ফাঁকা লাগে এখন। একজন মানুষ যে কিনা একসাথে এতদিন, এতবছর কাটিয়ে দিল...তার থাকা আর না থাকা... দুইয়ে অনেক তফাত, বুঝলেন না..?'
চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে আড়চোখে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে  দায়সারা উত্তর দিই, 'হ্যাঁ, তা অবশ্য...যাবো সময় পেলে। '
'খুব ব্যস্ত? হবেই তো হবেই তো... অফিস যাবেন...ভুলেই গিয়েছিলাম...সরি এ সময় চলে এসে...বাবুর এই খেলনাটা রয়ে গিয়েছিল ঘরে...নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছেন....মাটিতে পড়ে ছিল...হয়তো লাগেজপত্র টানাটানি করতে গিয়ে কোনোভাবে...। '
রমাকান্ত বাবু ব্যাগের ভেতর থেকে জিনিসটা বের করে আমার টেবিলে রাখলেন। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হয়তো বা হেসেও ফেললাম মনে মনে। একটা বহু বছর আগেকার ব্যাটারি চালিত ইলেকট্রনিকস রেলগাড়ী। 
আমার ছেলে বাবুর নয়। ওটা আমারই অনেক ছোটোবেলাকার খেলনা। চিলেকোঠার ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে রেলগাড়ি দেখতে দেখতে কি মনে হয়েছিল, বাবার কাছে আবদার করেছিলাম.. 'আমাকে একটা ট্রেন কিনে দেবে?'
 পরের দিন কিনে এনে দিয়েছিলেন বাবা। রেললাইনের স্পাইরাল পথ ধরে এঁকেবেঁকে চলা ছয় কামরার ট্রেন। বগিগুলোর ভেতর মিটমিট করে আলো জ্বলতো। চলা পথে একটা হালকা কু ঝিকঝিক শব্দ হতো। ধোঁয়া উড়তো অল্প অল্প। আমি হাততালি দিয়ে নিজের মনে বলে উঠতাম...'বাঁশি বাজছে...বাঁশি...ট্রেন আসছে...সবাই সরে যাও..!' 
আমার উল্লাসে ঢাকা পড়ে যেত সে বাঁশির শব্দ টুকু....। 
 
  রেলগাড়ীর আসা যাওয়া দেখতে দেখতে আমার ছেলে... সেও এখন ঘড়ির কাঁটা চিনতে শিখে গেছে। কিন্তু এটা আগে তো এখানে কখনো দেখিনি! তনুকা কিংবা বাবু, কেউ কখনো বারও করেনি। কিভাবে এলো তাহলে? কে নিয়ে এলো? রীমা নেই। বাবুকে নিয়ে গেছে কাছেই আন্টির কাছে পড়াতে। আমার নিজেরও এ নিয়ে বেশি কিছু ভাবা কিংবা অবাক হবার মতো একফোঁটা সময় এখন হাতে নেই। ট্রেনের হুইসিলের আগে যে ভাবেই হোক ষ্টেশনে পৌঁছাতেই হবে। নইলে নির্ঘাত লেট। 
রমানাথ বাবু বললেন, 'মাটিতে পড়ে গেছিল তো। ঠিকঠাক চলে কিনা একটু দেখে নেবেন।'
ব্যস্ত হাতে পারফিউমটা নিয়ে জামায় স্প্রে করতে করতে একটু হেসে বলি, 'তিন চার বছরের বাচ্চাদের খেলনা...ও আর এখন চলা না চলা একই। আসবেন মাঝে মাঝে। আজ আর সময় দিতে পারলাম না...।'
'আপনিও যাবেন। ভালো লাগবে।'
'দেখি সময় সুযোগ করে ...।'
অফিস ব্যাগটা বগলদাবা করে তালা চাবি নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালাম। 
 
দুটো বাজার সাথে সাথে অফিস স্টাফেদের চেয়ারগুলো এক এক করে খালি হয়ে যেতে শুরু করে। মেইন গেট বন্ধ। আবার আধঘন্টা পর কাজ শুরু। আমার পাশের চেয়ারে বসা মধুসূদন দা একটা লম্বা আড়মোড়া ভেঙে বলেন, 'চলো হে অভিমুখে। চিকেনের কেমন গন্ধ ছড়াচ্ছে হেঁসেল থেকে। চিপ ক্যান্টিনের নতুন ছোকরা রান্নাটা মনে হচ্ছে বেড়ে করেছে!'
'আপনি লাইনটা রাখুন।'
'ওদিকে ফোন করবে বুঝি?'
হাসলাম। মধুসূদন দা জানেন আমার প্রতিদিনের এই অভ্যাসের কথা। জানাটাই স্বাভাবিক। 
ডায়াল করতে হলো না। তার আগেই দেখি তনুকার ফোন কল।
'কী হয়েছে? বাবু ঠিক আছে তো? শরীর টরীর...।'
'হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে। বলছিলাম, ঐ খেলনা রেলগাড়িটা টেবিলের ওপর কে রেখে দিয়েছে গো?'
'আরে আমারও তো প্রায় সেই একই প্রশ্ন। ওটা ব্যারাকপুর থেকে মালতিপুরে এলো কি করে? তুমি নিশ্চই...!'
'সে তো মা সেবার আমার হাতে দিয়ে দিলেন। বললেন," বউমা এটা নিয়ে যাও। রেখে দিও। ওর বাবা কিনে দিয়েছিলেন। স্মৃতিচিহ্ন।"
ভাড়াবাড়িতে এনে ভেতরের তাকের কোণে রেখে দিয়েছিলাম...।'
'আজ সকালে রমানাথ বাবু এসে দিয়ে গেছেন। মালপত্র আনা নেওয়ার সময় কোনোভাবে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। চলছে?'
'তোমার চালাবার শখ হয়েছে বুঝি?'
'আচ্ছা পরে কথা হবে। মধুসূদন দা ডাকছেন। লাঞ্চ করতে যেতে।'
অন্যমনস্ক ভাবে মোবাইলটা পকেটে ভরে রাখলাম। 
কেন জানি না হঠাৎই যেন মন বলছে বড়, জিনিসটা একবার চালিয়ে দেখতে। 
কত কিছুই তো স্মরণে থাকে না। হাওয়ার মতো ভেসে বেড়ায়। এ বেলার ছবি ও বেলায় বিবর্ণ হতে হতে একসময় ঝাপসা হয়ে যায়। হুইসিলের অপেক্ষায় আজ আর থেমে নেই জীবন। তবু মোড়ের মাথার ঐ মনিহারি দোকানটা থেকে দুটো ব্যাটারি কিনে আনতেই হবে মনে করে...গ্রামে গঞ্জে দোকান যে বড় কম।।
 
ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait