ভালো থেকো, ভালোবাসা

ভালো থেকো, ভালোবাসা

সকাল থেকে ফোনটা বোবা। অফিস এর ফোন যে দু-একটা টা আসেনি তা নয়। কিন্তু যার মেসেজ আসার প্রতীক্ষায় দীপ সারাসকাল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তারই তো কোন পাত্তা নেই। অফিস এর এই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসেও শরীরে একটা দমবন্ধকর অবস্থা অনুভব করছে দীপ। কলকাতার এক বিখ্যাত MNC র দায়িত্বপূর্ণ পদস্থ দীপঙ্কর সরকার, ওরফে দীপ। কত রকমের কত ঝামেলা তার একুশ বছরের চাকুরী জীবনে সে সামলেছে। অফিস এ তার কর্মদক্ষতা সুপরিচিত। আর আজ…… অবস্থাটা ২ মাস আগেও এরকম ছিল না।

সেদিনও ছিল সোমবার, কাজের ফাঁকে ফেসবুকের এর নোটিফিকেশন ঘাঁটতে গিয়ে হটাৎ নজরে পড়েছিল একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট-এ। কি ছিল ওই চোখ দুটির সারল্যে নাকি ওই নিষ্পাপ হাসিটায় কে জানে – দীপ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নিয়েছিল। প্রথম মেসেজটাও সেই করেছিল। উত্তর পেতে দেরি হয় নি। স্বাভাবিক ছন্দবদ্ধতায় তাদের কথোপকথন এগিয়েছিল। ফেসবুক এর মেসেঞ্জার থেকে হোয়াটস্‌অ্যাপ-এ উত্তরন তাই সময় লাগে নি। সায়নির সঙ্গে কথাবলাটা একটা অভ্যাসে পরিনত হয়েছিল দীপের। অভ্যাস না ভাললাগা না অন্য কিছু… কে জানে। ভাবনার সুতো ছিন্ন হল ফোনের আওয়াজে। না সায়নি নয়, অঙ্কিতা।

— “দীপ, প্লীজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো কিন্তু”।

— ” হুমমম… চেষ্টা করব।”

— “আজ কোন অজুহাত নয়। সবার সামনে অপদস্থ হতে আমি চাই না। আজ আমাদের দশ বছরের অ্যানিভার্সারির পার্টিতে হোসট্‌ যদি লেট করে, তাহলে কেমন লাগবে বলো তো?”

— “বলছি তো.. আসবো… রাখছি।”

এবার ফোনটা রেখে চোখটা বন্ধ করল দীপ। মাথাটা দপ দপ করছে। অঙ্কিতা তার স্ত্রী… তার জীবনের দোসর। কিন্তু মন কি বোঝে অঙ্কিতা? বরাবরই পার্টি এড়িয়ে চলা দীপকে যে লোক লৌকিকতা পছন্দ করে না সেটা অঙ্কিতা কি জানে না? আজ তো তারা সবাই নিজেদের মতো করে সেলিব্রেট করতেই পারতো. কিন্তু না, অঙ্কিতা অবুঝ অনড় থেকেছে নিজের জেদে. অবশেষে দীপকেই মাথা হার মানতে হয়েছে. ভাবতে ভাবতে একটা সিগারেট ধরিয়ে জানলার সামনে দাঁড়ালো দীপ. সায়নীকে একটা ফোন করবে কি? নাকি তার উত্তরের প্রতীক্ষা করবে-

ADVERTISEMENT

বড্ড অস্থির লাগছে আজ। কি দরকার ছিল তার মনের কথা সায়নীকে বলার কাল রাতে?

কিন্তু যতক্ষণ এ মেসেজটা ডিলেট করতে গেছিলো ততক্ষনে মেসেজটা সীন হয়ে গেছে। আরেকটা আশঙ্কা দীপের মাথায় হঠাৎ খেলে গেলো – সুমিত মেসেজগুলো দেখেনি তো? সুমিত সায়নীর বর।

খুব মিস করছে দীপ এখন সায়নীকে -ওর কথা বলার ভঙ্গি, মতপ্রকাশ করার ক্ষমতা, সাবলীলতা, মন বোঝার ক্ষমতা আর হাসির শব্দ-এই সব কিছু ভীষণ প্রিয় দীপের. না… এখুনি ওর গলার আওয়াজটা একটু শোনা দরকার। একটা ফোন… নাকি হোয়াটস্যাপ করবে… “হোয়াটস্‌অ্যাপই করি”।

এই ভেবে হোয়াটস্যাপ টা খুলে সায়নীর কন্টাক্টটা বার করল দীপ।
কিন্তু একি ! ডিপি কোথায় গেলো সায়নীর
ফাঁকা একটা অবয়ব… লাস্ট সীন ও তো নেই. কেমন হলো এটা… সায়নী কি তাকে ব্লক করে দিলো?
সায়নী এটা পারলো?
মুহূর্তে একটা কালো পর্দা নেমে এলো দীপের চোখের সামনে।

চেয়ারটা ধরে না বসলে হয়তো পরেই যেত। জলটা ঢক ঢক করে খেয়ে কোনোমতে স্থির হলো সে। এটাই কি সায়নীর উত্তর তাহলে।

না তাই বা কিকরে হয়? এত ভুল হবে একজনকে চিনতে? নাকি সুমিত… তার মানে কি সায়নীর গায়ে সে আবার হাত তুলেছে? সায়নী ঠিক আছে তো? মুহূর্তে একটা দুশ্চিন্তা ভর ভর করলো দীপের মধ্যে। নাহ! সায়নীর গলা একবার হলেও তাকে শুনতে হবে। এক্ষুনি…

এখন লাঞ্চ ব্রেক। সায়নী এই সময়টা ঘরে টিভি দেখে। সুমিত অফিসে থাকবে। এখুনি ফোনটা করতে হবে। নিচে নেমে এসে একটা ফাঁকা চা এর দোকানে দাঁড়ালো দীপ। কাঁপা কাঁপা হাতে সায়নীর নাম্বার ডায়াল করলো মোবাইলে। ওই তো রিং হচ্ছে… পরিচিত কলার টিউন-‘আগুনের পরশমনি’- বেজে চলেছে… একবার, দুবার।

-“হ্যালো ” “কিরে, তুই সকাল থেকে কোথায় হারিয়ে গেছিস?”- আর্তনাদ এর মতো কি শোনালো দীপের গলা?

কিন্তু অপর প্রান্ত তো পুরো স্বাভাবিক। “হারাবো কেন? ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিলাম রে।”

–“তাহলে কোনো মেসেজ নেই কেন?”

–“কালকের মেসেজটার একটা তো উত্তর দিবি? জানিস আমার কতো চিন্তা হচ্ছিলো তোকে নিয়ে. হোয়াটস্যাপে আমাকে ব্লক করেছিস কেন?” একনাগাড়ে কথাগুলি বলে হাপাতে লাগলো দীপ।

–“সরি দীপ, কিন্তু তোর সঙ্গে কথা বলা আর হবে না হয়তো।”

–“মানে?” নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছিলো না দীপ।

–“মানেটা খুব সোজা। আমি তোর কাছে বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম, প্রেম তো জীবনে আছেই আমার।

–“সায়নী, তুই আমাকে ভালোবাসিস না? একদিনের জন্য, এক মুহূর্তের জন্যেও ভালোবাসিস নি?”

“ভালোবাসি তো দীপ.. তোর প্রাণবন্ত স্বভাব, তোর হেঁড়ে গলার গান, তোর বাজে জোকস্‌, তোর আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা, আগলে রাখার চেষ্টা। কিন্তু দীপ আমার জীবনের প্রথম আর শেষ প্রেম সুমিত… ওই আমার সব”।

“আর আমি? সায়নী।”

–“তুই আমার খুব ভালো বন্ধু। তোর বন্ধুত্বের মধ্যেই তো আমার পূর্ণতা। কিন্তু প্রেম সম্পর্কটা জটিল করে দেবে, প্রত্যাশা বাড়াবে, সেই প্রত্যাশা পূরণ করার সামর্থ আমার নেই রে দীপ… “

“প্লিজ সায়নী… আমি তোকে খুব ভালোবাসি… তুই না থাকলে আমাকে এত ভালো বুঝবে কে বল? প্লিজ প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না।”

বুকের কোথাও কি কিছু খালি হয়ে গেলো সায়নীর?

–“সরি দীপ, এটা সম্ভব নয়। তুই যা চাইছিস সেটা আমি দিতে পারবো না। রাখছি… ভালো থাকিস।”

–"সায়নী শোন্… প্লিজ.."

কাঁপা হাতে ফোন রেখে দিলো সায়নী। অবিরল চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা তার। স্ক্রীনসেভার এ দীপের হাসিমাখা মুখটা কি কিছু বলতে চাইছে তাকে?

–“আমি তোমারো বিরহে রাহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরস মাস।
যদি আরো কারে ভালোবাসো, যদি আর ফিরে নাহি আসো,
তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো।
আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো……”               


0 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 17th Sep, 20 09:58 am

খুব ভালো লাগলো...

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait