মহাভিনিষ্ক্রমণ

মহাভিনিষ্ক্রমণ

রাত্রি দুই প্রহর, বিশ্রামকক্ষের কপাট আস্তে আস্তে খুললেন রাজপুত্র গৌতম। যেন শব্দ না হয়। কক্ষের অভ্যন্তরে স্ত্রী গোপা ও শিশুপুত্র রাহুল গভীর নিদ্রায় আছন্ন। সকল মোহের উর্ধে উঠে গৌতম আজ পথে নামতে চলেছেন। তিনি আজ যে পথের পথিক হতে চলেছেন তা বড় নির্মম, বড় কঠিন। আজ ই হয়ত শেষ দেখা। আর হয়ত কোনদিনই ফিরবেন না সংসারে। আবাল্য পরিচিত এই স্বজন পরিবেষ্টিত সুখবেষ্টনীর মধ্যে আর হয়ত কোনদিনও পদার্পণ করবেন না।

ঘুমন্ত শিশুটির মুখটি গৌতমের কাছে অপার্থিব মনে হলো। চিরতরে বিদায় নেবার আগে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালেন। এই নারী, যিনি কৈশোরকালে তাঁর জীবনটিকে রাঙ্গিয়ে দিয়েছিলেন। এই শিশু যে জানে, যে মাতার কাছে তবুও সে মাঝে মধ্যে শাসনের বেড়াজালে পড়ে যেতে পারে কিন্তু পিতার কাছে সে সম্পূর্ণ নিরাপদ, তার সব খেলার সঙ্গী, তার আধো আধো অর্থহীন কথার নিবিষ্ট শ্রোতা তার পিতা-এদের টান উপেক্ষা করে চলে যাওয়া বড় সহজ কথা নয়।

তবু যেতে হবে। মানুষের যে কষ্টের সন্ধান তিনি পেয়েছেন তার কাছে রাজকীয় এই বিলাস ব্যসন বড় তুচ্ছ বোধ হচ্ছে তাঁর কাছে।

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

আজন্ম রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে লালিত গৌতম। তাঁর জন্মের সময় তাঁর মাতা গৌতমী মারা যান। কুলপুরোহিত ঋষি অসিত এসে বলে যান এ ছেলের সন্ন্যাসযোগ রয়েছে। তাই তাঁর পিতা শুদ্ধধন তাঁকে রাজপ্রাসাদের গন্ডির মধ্যেই রেখেছিলেন। তবে রাজপুত্রের কাজ ও কিছু কম ছিল না। পঠন পাঠন, সঙ্গীত ও চিত্রশিক্ষা, অস্ত্রশিক্ষা সব কিছুই প্রাসাদ অভ্যন্তরেই চলত। চিত্রাঙ্কন, মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে তোলা, ফুলগাছ গুলি তে জলসেচন, মূল্যবান রত্নাদী সহকারে স্ত্রী পুত্রের জন্য মণিমালিকা তৈরী করা–এইসব নানা কাজ সেরে যখন পাঠে মন দিতেন তখন তাঁকে ভিনগ্রহের মানুষ মনে হত। পুত্রের অনেক দুষ্টুমি তখন চোখ এড়িয়ে যেত। স্ত্রীর অনেক ডাকাডাকির পর চোখ মেলে তাকাতেন। আশ্চর্য সে দৃষ্টি।

এ হেন রাজপুত্রের একদিন হঠাৎ শখ হলো নগর পরিক্রমার। নগরে যারা থাকে তারা কি করে, কি খায়, কি পরে? এইসব চিন্তায় আলোড়িত হলো তাঁর মন। কিন্তু কেনো হঠাৎ এ হেন চিন্তা? এর কারণ একজন খেলনা বিক্রেতার সাথে পুত্র রাহুলের কথোপকথন। গৌতম একদিন সঙ্গীতচর্চা করছেন তখনই কানে এল রাহুলের চিত্কার। তার খেলনা চাই। গৌতমের আদেশে একজন মলিন পোশাক পরিহিত ব্যক্তি প্রাসাদ অভ্যন্তরে আসার আদেশ পেল। গৌতমের বাইরে এলেন। রাহুলের সেই খেলনার ঝুড়ির সব খেলনাই পছন্দ। রাজশিশুর আবদার, সেই ব্যক্তিকে নিজে হাতে পারিশ্রমিক দেবে! একটি স্বর্ণমুদ্রা সেই ব্যক্তিকে দেয়া হলো। কিন্তু এতটা পারিশ্রমিক তার স্বপ্নের অতীত! একঝুড়ি কেনো, এমন দশঝুড়ি খেলনাও এই পারিশ্রমিকের সমান নয়। আর সে গরীব মানুষ, সোনা নিয়ে কি বা করবে? তার হাতে স্বর্ণমুদ্রা দেখলে বরং লোকজন তাকে চোর মনে করতেই পারে! তাকে বরং কিছু পয়সা দিয়ে বিদায় করা হোক এমনটি সে দাবী করল!

কিন্তু অন্য একটি মানুষের মনে তখন প্রশ্নের আলোড়ন! কে ওই লোকটি? এত মলিন বসন, জীর্ণশীর্ণ কে ও? স্বর্ণমুদ্রা ওর কাছে থাকলে সবাই ওকে চোর ভাববে? কেনো? ও কি খায়? কেনো মলিন পোশাক পরে?থাকে কোথায়? গৌতম যাঁদের চেনেন তাঁদের সাথে তো ওই লোকটির কথাবার্তা আদবকায়দায় কোনো মিলই নেই ? কেন? নাহ্! এইসব প্রশ্নের উত্তর তাঁকে জানতেই হবে! তাঁকে সরেজমিনে দেখতে হবে চোর কারা? কেনই বা তারা চুরি করে? তাঁর নগরীর প্রজারা কিভাবে জীবনযাপন করে এসব তাঁকে জানতেই হবে।

পিতা শুদ্ধধন কে লুকিয়ে সারথিকে সঙ্গে নিয়ে গৌতম চললেন নগর পরিক্রমায়। কিন্ত পথে তিনি কি দেখলেন? দেখলেন কলহ-সংকীর্ণতা -মিথ্যা-দলাদলি! দেখলেন মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রম!দেখলেন অভাব অনটন অনাহার। এইসব কিছুর সাথে আবাল্য অপরিচিত তাঁর মনে হাহাকারের তরঙ্গ উঠল। কিন্তু আরো কিছু তাঁর দেখা বাকি ছিল! দেখলেন ব্যাধি, জরা ও অবশেষে মৃত্যু!

গৌতমের কোমল মন আত্মধিক্কারে ভরে উঠল!মানুষের এত কষ্ট তিনি তো জানতেন না! সারথিকে জিজ্ঞাসা করলেন জরা ব্যাধি ও মৃত্যুর মর্মার্থ। সারথি উত্তর দিলো, মানুষ যত সুখ বা দুঃখের মধ্যে থাকুক না কেনো, ব্যাধি এসে তাকে আক্রমণ করবেই। এরপর যৌবন পেরিয়ে জরা অর্থাত্ বার্ধক্য আসবেই। শেষপর্যন্ত মৃত্যুর করাল ও অবশ্যম্ভাবী থাবা মানুষের জীবনে ইতি টেনে দেবে। এটাই নাকি নিয়ম!!

এক অপরিসীম গ্লানিতে আছন্ন হলো কুমার গৌতমের হৃদয়। বহু রাত এরপর প্রায় বিনিদ্র অবস্থায় কাটালেন। ক্রমে তাঁর এই বোধ জাগ্রত হতে লাগলো যে মৃত্যুই যদি মানুষের জীবনের ধ্রুব সত্য হয় তাহলে নিরন্তর কর্ম করে যেতে হবে। কারণ কর্ম না করলে কর্মপাশ কাটে না আর তা না কাটলে মুক্তিও হয় না। আর মুক্তি না হলে আবার জন্ম, আবার কষ্ট, আবার মৃত্যু এই চক্র নিরন্তর চলতে থাকবে। তাই এইসব অসহায় নিপীড়িত মানুষ গুলোকে মুক্তির পথ দেখাতে হবে তাঁকে! প্রথমে নিজেকে ত্যাগী হয়ে জগতকে ত্যাগের মহিমা বোঝাতে হবে। আর সেজন্য সর্বাগ্রে এই রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পথে নামতে হবে। অনেক কাজ! এই খুদ্র পরিসর থেকে বেরিয়ে এক বৃহত্ কর্মযজ্ঞে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে অকাতরে।

গৌতম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন। আজ প্রভাতেও স্নান সেরে প্রাসাদের সুউচ্চ প্রাকার থেকে সূর্যোদয় দেখেছেন। হয়ত এই শেষবার। আজও স্ত্রীর সাথে সহজভাবেই অন্যান্য দিনের মত বাক্যালাপ করেছেন, পুত্রের সাথে খানিক খেলেছেনও বটে। সব ই শেষবারের মত। তবে আজ সব মোহের উর্ধে তিনি। এই কয়দিন নিজের মনের সাথে অবিরত যুদ্ধে আজ তিনি জয়ী। পিতা বা স্ত্রী কাউকেই বুঝতে দেন নি তাঁর মনের ভাব। আজও দেবেন না।

রাত্রে পিতার সাথে দেখা করে তাঁকে প্রণাম করে এলেন রোজকার মত। পুত্র যখন কিছুতেই তাঁকে ছেড়ে শুতে যাবে না অথচ তার মা তাকে নিয়ে যাবেনই, জোর করে ছোট ছোট হাত দুটি সরিয়ে দিতে হলো বক্ষ থেকে। বুকটা টনটন করে উঠল গৌতমের। অনেক কষ্টে এই ক্ষনিকের মোহপাশ থেকে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। স্ত্রীর কাছ থেকে একটু সময় চেয়ে নিলেন। বললেন একটি চিত্র অংকনের কাজ শেষ করে তবেই বিশ্রামকক্ষে যাবেন। খুব স্বাভাবিক আবদার। গোপার মনে কোনো সন্দেহ জাগল না, তিনি রাহুল কে নিয়ে চলে গেলেন বিশ্রামকক্ষের দিকে।

এতটা সময় ধরে ঘুমন্ত স্ত্রী পুত্রের মুখের দিকে চেয়ে অতীতের এই কথাগুলি ভাবছিলেন সিদ্ধার্থ। কত মুহুর্ত যে কেটে গেল তার হিসাব রাখে নি কেউ। আর সময় নেই। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁকে প্রাসাদ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে হবে। নির্মম নিষ্ঠুর এই সংসারের মায়াজাল তাঁকে ছিন্ন করতেই হবে। বাইরে রথ নিয়ে তাঁর চিরবিশ্বস্ত সারথি অপেক্ষারত। সে কিছুটা এগিয়ে দেবে তাঁকে নগরীর পথে।

নগর পার হয়ে ঘন জঙ্গলের পথে খালি পায়ে গৈরিকবসন পরিহিত এক নবীন সন্ন্যাসী হেঁটে চলেছেন। পশ্চাতে পড়ে রইলো রাজ্য, রাজপ্রাসাদ, স্ত্রী, পিতা, পুত্র বিলাসবৈভব—সবকিছু। সময় এসেছে এক বৃহত্ কর্মযজ্ঞের। মানুষের সেবায় বিলিয়ে দিতে হবে নিজেকে। আর এর মধ্যে দিয়েই রাজপুত্র সিদ্ধার্থ বা গৌতম হয়ে উঠবেন ভগবান বুদ্ধ। ইতিহাস আর আমরা তার সাক্ষী হয়ে রইলাম। আর রইলো ওই ভোরের আকাশের ধ্রুবতারা, যে চিরকাল এই অমৃত জীবনের স্বাক্ষর বহন করে চলবে।

 

ছবি : ইন্টারনেট


1 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 24th Jun, 21 11:22 pm

অপূর্ব। সেই পুরনো কাহিনীকে নতুন করে পাওয়া।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait