লকডাউন

লকডাউন

আজ অনেক দিন পর এত বিশ্রাম। কিন্তু ঝিলের বিশ্রাম নেওয়া হচ্ছে না, কারন তার মন যে তাকে বিশ্রাম নিতেই দিচ্ছে না। জানলার ধারে বসে ঝিল নিজের কথা ভাবছে। নিজের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঝিল বাইরের পরিবেশের দিকে তাকিয়ে গাছের পাতা নড়া, মেঘলা আকাশের মধ্যে নিজের আনন্দকে খুঁজে পেয়েছে তা সে নিজেও জানে না। কেমন সুন্দর মেঘলা বৃষ্টিঝরা আকাশের শেষের প্রহর, পাখি গুলো কোনমতে বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছে, আকাশের মেঘগুলো আরও গভীর কালো হয়ে আসছে। ও কেমন চোখ বুজে অনুভব করছে। কত কিছু মনে পড়ছে সেই ছোট বেলার কথা, কিভাবে যেন ওই বাইরের মেঘলা আকাশ, ঝিলের মনের ভিতরটা একেবারে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে, যেন কালো মেঘের ঘনঘটা ওর মনেও আস্তে আস্তে বাসা বাধছে।

ঝিল খুব কষ্ট করে বড় হয়েছে। তার বাবা সামান্য চাকরি করতেন। মা গৃহ বধু। জীবনে পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার জেদ ছিল ঝিলের। তাই দীর্ঘ বারো বছর লড়াই করে বাঁচতে হয়েছে তাকে। অবশ্য যুদ্ধের পর ও জয়ী হয়ে নিজের পায়ের তলায় শক্ত মাটি করেছে। তাহলে ঝিলের মনে এমন আচ্ছন্নতা আসছে কেমন ভাবে। ও তো জীবন যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। 

ADVERTISEMENT

তাহলে এই লকডাউনের দীর্ঘ বিশ্রামই তার মনকে বারংবার উতলা করে তুলছে? আকাশের কালো মেঘ দেখে ঝিলের মনের ভিতরটা আবার নিরাশায় ভরে গেল। আর তখনই তার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল। তার অবশ্য একটা কারণও আছে। অন্য সময় হলে হয়ত মন এত উদাস হত না। কিন্তু এখন অফুরন্ত সময় তাই সব মনে চলে আসছে। একদিকে অফিস এর কাজ, অন্যদিকে তার মন এভাবে উদাস হয়ে যাওয়া যেন প্রতিনিয়ত তাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।

হটাৎ ফোনে একটা SMS এল, “কেমন আছো”।
 
প্রথমটায় ঝিল খুব অবাক হল, তারপর দ্বিধা কাটিয়ে বলল, – “আপনি কে”? ওপার থেকে SMS এল, চিনতে পারছো না”?

ঝিল একটু ভেবে উত্তর দিল – “না, ঠিক চিনতে পারছি না”।

SMS টা ছিল Whats Up এ। তাই ওপারের লোকের ছবি দেখা যাচ্ছে। তারপর ওপারের জন উত্তর দিল – “আমি নীল”। এবার ঝিলের মনটা একটু নাড়া দিয়ে উঠল। সে চিনেও না চেনার ভান করে, একটা অবাক সাইন দিয়ে বলল,- “হ্যাঁ, তাইতো কি করে পেলে আমার নাম্বার”।

নীল বলল, “তুমি এখন প্রতিষ্ঠিত,  তাই তোমার নাম্বার পাওয়া সহজ”।

ঝিল বলল, “আমি প্রতিষ্ঠিত ঠি্‌কই, কিন্তু সেলিব্রিটি নই যে সবাই আমার নাম্বার পেয়ে যাবে”।
 
এবার নীল বলল, “জানো তোমায় অনেক খুঁজেছি ? ফেসবুকের প্রোফাইল থেকে তোমার নাম্বারটা জোগাড় করে নিলাম। ব্যাস তার পরেই মেসেজ করলাম”।

ঝিল উত্তর করল – “হটাৎ করে আমায় খুঁজে, মেসেজ করলে যে” ?

নীল একটু গদগদ হয়ে বলল – “তুমি তো আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। তুমি কি জানো তোমার যাবার পর আমি তোমায় অনেক খুঁজেছি, শুধুমাত্র একটা কথা জিজ্ঞাসা করার জন্য যে, আমি কি এতটাই খারাপ ছিলাম”।

ঝিল বলল, – “এখন এইসব কথার কোন মূল্য নেই। শোন, আমার অনেক কাজ, এখনি আমি কাজে বসব”।

হটাৎ বাইরে একটা কড়াৎ করে বিদ্যুৎ পরার আওয়াজে ঘরটা কেঁপে উঠল, মনে হল আজ রাতে বেশ ঝড় উঠবে, চারিদিকটা কেমন ঝিম মেরে শান্ত হয়ে আছে। শুনেছি, প্রবল ঝড় ওঠার আগে এমনই শান্ত হয়ে যায় চারিদিকটা। ঝিল ফোনটা সঙ্গে সঙ্গে লক করে জানলার ধার থেকে উঠে সরে গেল।

ওদিকে নীল মেসেজ করছে, – “আমার অনেক কিছু বলার আছে ঝিল, আর ক্ষমা চাওয়ার আছে”।

ঝিল বলল, – “কিসের ক্ষমা চাওয়ার আছে তোমার, আর কি বা বলবে? আমার কিন্তু আগের মত কোন কথাই মনে নেই, আমি সব ভুলে গেছি। নীল তুমি কিএই লকডাউনে কাউকে পাচ্ছ না। তাই আমার কাছে এসেছ সময় কাটাতে। আমি কিন্তু ব্যস্ত মানুষ, আমার সময় নেই তোমার জন্য, OK, Bye”।

তারপর কাজে ব্যস্ত হল ঝিল। কিন্তু কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না কোন কাজে। শুধু বারবার অতীতে ফিরে যাচ্ছে।

ওদের পাড়ায় পূজো হত। আশপাশের গ্রামের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় পূজো। গ্রামের সেখানেই ঝিলের সাথে নীলের প্রথম দেখা। ঝিল তখন খুব ছোট, ক্লাস সিক্স এ পড়ে, নীলের তখন ক্লাস নাইন। ধীরে ধীরে ওদের সাক্ষাৎ কবে যে বন্ধুত্বে পরিনত হয়, তা ওরা জানতে পারেনি। তবে অবাক বিষয় হল তারা একই পাড়াতেই থাকত, কিন্তু এর আগে ওরা একে-অপরকে কখনও দেখেনি। যাইহোক পুজোর কটা দিন বেশ ভালই কাটল ঝিল আর নীলের। নীল অপেক্ষা করত প্যান্ডেলে, আর ঝিল সেজেগুজে দেখা করত নীলের সাথে।

দশমীর দিন নীল বলল– “আর হয়ত আমাদের দেখা হবে না”।

ঝিলও মেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল। পূজোর শেষে তারা একে অপরকে ভুলে গেল। এইভাবে এক বছর কেটে গেল।

আবার ঝিল পরের পূজোর প্যান্ডেলে ওকে খুঁজতে লাগলো। আবার নীলও ওকে খুঁজেছিল। পুনরায় ওদের দেখা হল আবার রঙ্গিন হয়ে উঠল ওদের পূজো। এইভাবে তিনটে পূজোর মাথায় নীল ঝিলকে প্রপোস করে বলল, – “আমি তোমায় খুব ভালোবাসি”।

আসলে ঝিল প্রস্তুত ছিল না যে, নীল এইভাবে তাকে প্রপোস করবে। প্রথমটায় মুখ নিচু করল ঝিল, তারপর ছুটে গিয়ে পূজো প্যান্ডেলের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এদিকে নীল পিছন পিছন এসে ঝিলের হাতটা ধরল।

নীল ঝিলকে একটা চিঠি দিল। আর বুকের কাছে টেনে বলল, – “বাড়ি গিয়ে পড়ো, কেমন”।

এদিকে ঝিল চিঠিটা নিয়ে ছুটে বাড়ি চলে গেল। বাড়িতে ঢুকে কোনরকমে ঘরের মধ্যে গিয়ে দরজা দিয়ে চিঠিটা আস্তে আস্তে খুলল, নীলের লেখার ওপর ২ বার হাত বুলিয়ে,  শুয়ে, বসে, দাড়িয়ে, জানলার কাছে গিয়ে চিঠিটা প্রায় ২২ বার পড়ল।

ওই লাইনটা ওর মনে খুব ধরেছে, – “আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি “।

এদিকে চিঠিটা কোথায় রাখবে খুঁজে না পেয়ে, আগুনে পুড়িয়ে ফেলল। তারপর পোড়া কাগজগুলো নিয়ে একটা শিশিতে ভরে রাখল ওর কাছে। যাতে কেউ যেন না দেখতে পায়। নইলে বাড়ির লোক ত বকাবকি করবে। এইভাবেই প্রেমটা চলতে লাগল ওদের। নীল, ঝিল দুজনেই পড়াশুনায় ভালো ছিল। আর মন দিয়ে পড়াশুনাও করত একে অপরকে যোগ্য করে তোলার জন্য। ঝিল মাধ্যমিক পাশ করে গেল আর নীলের মা হটাৎ মারা গেল। ঝিল ভেবেছিল, নীল হয়ত ওকেই বিয়ে করবে এবার, কারন ওদের পরিবারে একটা মেয়ের দরকার। কিন্তু নীল আস্তে আস্তে ঝিলের থেকে দূরে সরে গেল। ঝিল বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। এইভাবে আরও একবছর কেটে গেল। নীল আর ঝিলের কোন সম্পর্ক রইল না।

হটাৎ একদিন নীল বলল, – “ঝিল আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই”। ঝিল ভীষণ খুশী হয়ে নীলের কথায় রাজী হল। আসলে নীলের অপেক্ষায়ই ছিল ঝিল। এবার ওরা প্রেমিক প্রেমিকার মত পার্কে দেখা করল।

আর নীল বলল, – “আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই ঝিল”। শুনে খুব খুশী হল ঝিল। তার আনন্দ আর বাঁধ মানে না। আবার কয়েকদিন কেটে গেল। একদিন ঝিল ঘুম থেকে উঠেছে, আর শুনতে পেল, নীল বলে যে ছেলেটা ওদের পাড়ায় থাকে, কাল রাতে বিয়ে করেছে।

ঝিল কি শুনেছে বুঝতে পারল না, তাই আবার জিজ্ঞেস করল – “কে বিয়ে করেছে “? আবার একই উত্তর।

সেই দিনটা আজও ঝিল ভুলতে পারে না। সেই দিন সবার আড়ালে গিয়ে চুপ করে কাঁটাতে হয়েছিল ঝিলকে। কারন ওদের সম্পর্কটা কেউ জানত না, ওরা দুজন ছাড়া। তাই কাউকে ঝিল বলতে পারল না,কি হারিয়ে গেল ওর। প্রায় অনেকদিন ঝিল নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল একটু একটু করে। তারপর নিজে থেকে আবার কেমন উঠে দাঁড়ালো।

আর নিজের কাছে নিজেই প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হল যে নিজেকে প্রমান করবে। “নীল আমি তোমার যোগ্য ছিলাম, তুমি আমার যোগ্য ছিলে না। আর তুমি যা অন্যায় করলে তার ফল তোমায় ভগবান দেবেনই। তুমি দেখে নিও”। এই বলে ঝিল আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।

কাজ শেষ হলে ঝিল আবার ফোনটা হাতে নিল। আর নীলের ছবিটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। এতদিন পর আবার নীল এল ঝিলের কাছে ?

আর ঝিল মনে মনে বলতে লাগলো, – “আমি ত সব ভুলে গেছিলাম, কেন তুমি ফিরলে”।

হটাৎ আবার “SMS” এল, “কি করছ ঝিল”– নীল বলল।

ঝিল বলল, – “কিছু না আমি অন্য মেসেজ পড়ছি”। নীল বলল, – “আমার কথাটা একটু শোন প্লীজ”।

ঝিল বলল- “কি বলবে বল”।

নীল এবার বলল, – “আমি জানি তুমি খুব সুখি। একটা সুন্দর জীবনে আছ। তোমার একটা সুন্দর মেয়ে আছে। আর আমার কেউ নেই যাতে আমি সুখী হব”।

ঝিল বলল – “কেন গো”?

নীল বলল – ” আমি তোমাকে ভালবাসতাম তাই তোমাকে নিয়ে সুখি হতে চেয়েছিলাম। তবুও আমি সুজাতার সাথে সংসার করছি। কিন্তু আমাদের কোন সন্তান নেই”।

ঝিল কি বলবে বুঝতে পারছে না। শুধু বলল- “সব ঠিক হয়ে যাবে “।

নীল বলল – ” ভগবান আমায় শাস্তি দিয়েছেন ঝিল। আমি তোমার ওপর অন্যায় করেছি, আসলে নিজের অজান্তেই হয়ে গেছে তা। আমি তোমাকেই ভালবাসতাম আর আজও বাসি। আর আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। তবে আমি তোমাকে অনেক দিন ধরে খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। আজ পেলাম। আমি এটা বলতে চাই যে সেইদিন বন্ধুরা কি করে জেনেছিল যে আমি তোমাকে ভালোবাসি আর বিয়েও করব। ওদের সবার দুর্বলতা তুমি ছিলে। এদিকে আমিও তোমায় ভালবাসি আর বিয়ে করব জেনে, জোর করে আমাকে সুজাতার সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। আমি অবশ্য পরে জেনেছিলাম ঝিল। কিভাবে সব হয়ে গেল তা আমিও বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি পালিয়ে আসবার চেষ্টা করেছিলাম বিশ্বাস কর ঝিল। কিন্তু পারিনি। সেইদিন আমি শুধু তোমায় মনে করেছি। আর মনে মনে ভেবেছি তুমি আমায় ভুল বুঝবে আর কোনদিন ক্ষমা করবে না। আর সেই দিন থেকে আজও তোমার অপেক্ষা করছি। সেই ছোটবেলার পূজোর মত আমাদের জীবনটা অপেক্ষায় কেটে গেল ঝিল”।

“ঝিল আমায় ক্ষমা করো মন থেকে। আর আমি তোমাকে আগের কথা মনে করিয়ে দিলামএর জন্য ক্ষমা করো, আর আমাকে ব্লক করে দিও”। ঝিল চুপ করে সব কথা পড়ল। আর ব্লক করে দিল।

আর মনে মনে বলতে লাগল – “লকডাউন আমায় মনের শান্তি ফিরিয়ে দিল। এতদিন আমায় শুধু কষ্ট দিয়ে এসেছে যে নীল, সে নিজেও ঠকেছে। প্রকৃতপক্ষে ভাগ্যই আমাদের ঠকিয়েছে। তবে ভাগ্য এমন পরিহাস না করলে বোধ হয় আমি প্রফেসার হতে পারতাম না। শুধু তোমাকে না পাওয়ার আঘাতই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে । Thank u নীল “।

এই লকডাউনে আমি আমার নীলকে ফিরে পেলাম। আমার ভালোবাসা ঠকে যায়নি। জিতে গেছে। আর লকডাউন না হলে আমি Whats Up করতাম না। কারন লকডাউনে আমি Whats Up ডাউনলোড করেছিলাম। সময় কাটাবো, আর সবার সাথে গল্প করব বলে।        

 

 

 
  •  

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait