ডিপ্রেশন, অর্থাৎ মানসিক অবসাদ কেন হয়? যখন কারো মনে হয় তার এমন কিছু পাওয়া উচিত ছিল যা সে পায় নি, যা করা উচিত ছিল তা করা হয়ে ওঠে নি, বা যে যে ভুলগুলো অতীতে করা হয়েছে তা যদি শোধরানোর উপায় থাকত–তখনই মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিশদে জানলে দেখা যায় ছোটো থেকে বড় হওয়ার মুহূর্তে যদি কারো সাথে সর্বদা অন্যায় হতে থাকে, সে যদি সুবিচারের বদলে সামাজিক অসম্মানের শিকার হতে থাকে, বন্ধুদের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে বা সংসারের আর পাঁচটা মানুষের সাথে ওঠাবসার ক্ষেত্রে যদি পক্ষপাত এর শিকার হতে থাকে, তখন বড় হয়ে তার মনে সেই যথেষ্ট পরিমাণে না পাওয়া ভালবাসার জন্য এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়!
যেমন এক পরিবারে দুটি ভাই। দুজনেই পড়াশোনায় ভাল হবে এমন কিন্তু কোনো কথা নেই৷ একজন পড়াশোনায় ভাল তো আরেকজন হয়ত আঁকায় ভাল। কিন্তু পড়াশোনায় ভাল যে ছেলে তাকে একটু বেশি গুরুত্ব সহকারে সমাজের সামনে নিয়ে আসা হয়। সে বেশি ফোকাসড হয়। এতে দ্বিতীয় বাচ্ছাটির মনে ছোটো থেকেই একটা শূন্যতা তৈরী হয়। যদিও দক্ষতার দিক থেকে বিচার করলে ভাল পড়াশোনা করা বা ভাল আঁকা বা ভাল খেলাধুলা করা—-সবকিছুই কিন্তু বিশেষ গুণের মধ্যেই পড়ে। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রায় বলি লেখাপড়া মন দিয়ে না করলে কিছুই হবে না। অবশ্যই আংশিক হলেও এ কথা সত্যি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে শুধুমাত্র পড়াশোনার জন্য সবকিছুকে বিসর্জন দিতে হবে। এই বিশেষ কোনো একটি দিকে নজর দিতে গিয়ে যখন বাচ্ছার অন্য দক্ষতার দিকগুলি আমরা অবহেলা করতে শুরু করি, বা তাদের নজর ঘোরানোর চেষ্টা করি, সমস্যাটা তখন থেকেই শুরু হয়।
আমরা ভ্রান্তিবশত সর্বদাই আমাদের সন্তান সন্ততির ভবিষ্যত নির্মণের ওপর এতই গুরুত্ব দিই যে তাদের চরিত্রগঠনের দিকটি সর্বদাই উপেক্ষা করে থাকি। কিন্তু শৈশব থেকে যদি তাদের চরিত্র নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া যায় তাহলে হয়ত এই ঘোর অজ্ঞানজাত অবসাদ, যা তমগুণজাত একটি অসুখ, তা তাদের মনের ওপর ক্রিয়া করতে ব্যর্থ হবে। হতে বাধ্য। কিরকম? ছোট থেকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে সদ্গ্রন্থ। যেমন রামায়ণ, মহাভারত। এই গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করে এত বিভিন্ন রকম চরিত্রের মুখোমুখি তারা আসবে, এত বিরোধ বা এত বীরত্ব তারা অবলোকন করবে যে তারা নিজেরাই ভাল কি আর মন্দ কি—-তা খুব ভালভাবে বুঝতে পারবে। আমাদের দেশের বা অন্যান্য দেশের যাঁরা জাতীয় বীর, যেমন ছত্রপতি শিবাজী, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, আব্রাহাম লিঙ্কন, এঁদের জীবনী তাদের নিয়মিত চর্চা করাতে হবে। তবে তো তারা নিজেদের জীবনে লড়াই করার শক্তি পাবে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় একদা তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে লিখেছিলেন, “আগুন দিয়েই আগুন জ্বালানো যায়, ছাই এর ঢিবিতে মশাল গুঁজে কে কবে আগুন জ্বালে”?
সুতরাং এমন কোনো জীবনের নিদর্শন শিশুদের সামনে রাখতে হবে যা পড়ে বা দেখে তারা নিয়ত উদ্বুদ্ধ হতে পারে। লিওনার্দো দা ভিনসির ‘মোনালিসা’ দেখে যে শিশু ওইরকম কিছু আঁকার চেষ্টা করে, বা মহারানা প্রতাপের জীবনী পড়ে যে শিশু আপন মনে একটা কঞ্চিকে তলোয়ার বানিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে, তাকে এসব করতে দিন। এতে প্রকৃতপক্ষে তার চরিত্রই উন্নত হবে। তবে দেখতে হবে, কোনোভাবেই যেন সে কোনো হিংসা বা হানাহানির মনোভাব পোষণ না করে। না বাড়িতে, না বন্ধুদের সাথে। এরকম কিছু দেখলে তাকে বুঝিয়ে নিরস্ত করতে হবে, এ কাজ তার অভিভাবকেরই। দুর্যোধনের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে এবং তার বাবা মা প্রশ্রয় দিয়ে তার জীবনটাকে কিভাবে শেষ করে দিয়েছিল, এই নিদর্শনের সাথে যখন শিশুর অভিভাবক অনেক আগে থেকেই পরিচিত হবেন, তখনই তাঁদের মনে অর্জুন বা যুধিষ্ঠিরের চরিত্রের নির্মল সাত্বিকতা পরিপূর্ণ স্থান করে নেবে, যা ভবিষ্যতে ওই শিশুকে সাহায্য করবে এই কঠিন দুনিয়ার সাথে লড়াই করতে এবং কখনো হেরে না যেতে। প্রয়োজন আত্মধ্যান। ‘আমি কে?’ তার বিশ্লেষণ!
ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলছেন,
“নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা।
ন চাভাবয়ত শান্তিরশান্তস্য কুতো সুখম॥”
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা। অধ্যায় :২।শ্লোক:৬৬)
অর্থাৎ, যিনি অজিতেন্দ্রিয় তাঁর আত্মবিষয়ীনী প্রজ্ঞা হয় না, তাঁহার আত্মধ্যানও নাই। আত্মধ্যানহীন ব্যক্তির মনে শান্তি থাকে না, অশান্ত ব্যক্তির সুখ কোথায়?
মূল বিষয়টি হচ্ছে, আমি যা পাচ্ছি তার মধ্যে যদি সুখ না খুঁজে পাই, আমি নিজে কি চাই তা যদি নিজেই ঠিকমত না জানি, তাহলে সেই অজ্ঞানবশত আমি ভুল কাজ করতে থাকব, ভুল পথে হাঁটতে থাকব নিরন্তর। এর থেকে আসবে অবসাদ। সেই অবসাদ কাটানোর মন্ত্র আমাকে নিজেকেই ঠিক করে নিতে হবে! মানুষ নিজেই পারে নিজের অন্তর্নিহিত দেবত্বকে প্রকাশ করতে, সদ্গুরুকে শুধু দিকনির্দেশ করে দিতে হয়। সেই সদ্গুরু বাবা, মা, শিক্ষক যে কেউই হতে পারেন। হতে পারেন সে মানুষ নিজেই।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “বিশ্বাস, বিশ্বাস, বিশ্বাস! নিজের ওপর বিশ্বাস, ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস”।
অবসাদ কাটিয়ে সাফল্য খুঁজে পাওয়ার এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ দাওয়াই।
0 comments