_ শ্লোক তোর গার্ড কোথায়? একদল কিশোর কিশোরী শ্লোককে ঘিরে রয়েছে। যে প্রশ্ন করছে সে একপায়ে ফুটবলটা আটকে শ্লোকের দিকে একদিকে তাকিয়ে আছে।
_ আজ খেলবি আমাদের সাথে বল। কে কে খেলবে শ্লোকের সাথে, হাত তোলো? সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে করতে আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেলো। রোহনের মুখে বিদ্রুপের হাসি খেলে গেলো।
_ দেখলি তো? তোর কোন বন্ধু নেই। তোর কোন বন্ধু থাকতে পারে না। তবু তুই তোর " এ" ফর অ্যপেল " বি" ফর বল ছেড়ে ঠিক বিকেলে পাহারাদারের সাথে খেলতে আসিস? তোকে অনেক বার বলেছি পার্কের যেখানে পারিস তুই বস গে যা। কিন্তু আমাদের খেলার জায়গায় তোর ইন্ট্রি আমি বরদাস্ত করতে পারবো না।সো প্লিজ গেট লস্ট।
শ্লোক বন্ধুর কথার উত্তরে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করলে ও বলতে পারছে না। রাগে কান লাল হয়ে যাচ্ছে । মুখটা ফ্যাকাসে। সে কোনমতে বলে ওঠে,
__ আই হ্যাভ টু গো রাইট নাও, আই হ্যাভ টু গো একই কথা বারবার রিপিট করতে করতে ওর মুখ দিয়ে লালা ঝরছিলো।
ADVERTISEMENT
__ বেবি সিটার কই? ইস্! জামাটা তো ভিজে গেল। মুখ দিয়ে চুকচুক আওয়াজ করতে করতে রোহন বললো। হঠাৎ শ্লোক ওর দিকে ঘুরে ওর নাক লক্ষ্য করে ঘুষি চালালো।
ডোরবেলের আওয়াজে রুমেলী আইহোলে দিয়ে যাকে দেখলো, তাকে দেখে দরজা খুলতে গিয়ে একটু ভেবে বিরক্ত হয়ে খুললো।
_ আমি কি একবার রোহনকে দেখতে পারি? অনুসূয়া হাতে প্যাকেট নিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে বললো।
_ ছেলে নাক ফাটিয়েছে আর মা এসেছে জিনিস নিয়ে সহানুভূতি দিতে। কি অদ্ভুত ফ্যামেলি! ছেলেকে সামলাতে পারেন না তো পাগলা গারদে বা ওদের জন্য তো আজকাল অনেক হোমটোম রয়েছে। সেখানেই রাখতে পারেন। এই সব স্পেশাল চাইল্ডদের জন্য তো আমাদের সুস্থসবল ছেলেমেয়েগুলো তো মার খেতে পারে না।
অনুসূয়ার মুখটাতে কে যেনো কালি ঢেলে দিলো।
__ আসলে, বাহাদুর বোধহয় কাছেপিঠে কারোর সাথে গল্প করতে গিয়েছিলো। সেই ফাঁকে কখন যে হয়ে গেলো। কিন্তু শ্লোক ভীষন ওবিডিয়েন্ট বয়, কি এমন হলো যাতে ও এতো ভায়োলেন্ট হয়ে গেলো?
_ আসলে কি জানেন মিসেস দত্তা। আপনাদের বাচ্চা তো ঠিক সুস্থ নয়। যখন তখন এইরকম কান্ড করতে পারে। আপনারা বাবা মারা এতোটাই কেয়ারলেস যে এদের স্বাভাবিক বাচ্চা বলে ট্রিট করার চেষ্টা করে যান। এই নিয়ে রোহনের সাথে সেকেন্ড টাইম এ্যটাক হলো এরপর যদি ওকে রোহনের ত্রিসীমানায় দেখি তাহলে আই উইল গো সি উ অ্যাট দা কোর্ট। রোহন ঘুমোচ্ছে। আপনি এখন আসতে পারেন। মুখের ওপর বন্ধ করে দেওয়া দরজার ওপারে প্যাকেট হাতে করে অনুসূয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। ভাবছিল আজ থেকে তিন বছর আগে নামী ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে একসাথে শ্লোক আর রোহন পড়তো। শ্লোক পড়াশোনায় ভীষন ভালো, কিন্তু ও ছোট থেকেই অটিস্টিক। চেহারায় কোন বিকৃতি নেই। শুধু বড়ো ইন্ট্রোভাটড। নিজের ফিলিংস শেয়ার করতে পারে না, কথা ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারে না। কোন নতুন জিনিস একসেপ্ট করতে পারে না। মাথাটা গোঁজ করে থাকে। কেও ছুঁলে ও পছন্দ করে না। এমনকি মায়ের ছোঁয়াতে ও বিব্রত বোধ করে। দুবছর বয়সে ওর এই এভনরমাল আচরণ দেখে ওরা ডাক্তার দেখায়।ডাক্তার জানায় ওদের শ্লোক অটিজিমের শিকার। কিন্তু শারীরিক কোন সমস্যা না থাকায় ও নর্মাল স্কুলে পড়তে পারে।
সত্যি শ্লোকের মাথা ভীষন শার্প, একবার কোন কথা শুনলে মাথায় রেখে দিতে পারে, আর পারে ছবি আঁকতে। ছবি আঁকতে আঁকতে ও বিভোর হয়ে যায়। নামকরা স্কুলে শ্লোককে ভর্তি করা হয়, রীতিমতো টাফ এডমিশন টেষ্ট দিয়ে। শ্লোকের বাবার সাথে স্কুলের ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির খাতির ছিলো তাই শ্লোকের মেধার বিচারে ওকে ভর্তি করা হয়। সব ঠিকঠাক ছিলো। শুধু শ্লোকের সাথে কেও মিশতো না। ও নিজেকে এক্সপ্রেস করতে পারতো না তাই টিফিন টাইমে কেও ওকে খেলায় নিতো না। ও তখন খাতা জুড়ে ছবির বন্যা বইয়ে দিতো। গোল বাধলো ক্লাস সিক্সে। শ্লোক বরাবর ক্লাসের ফার্স্ট বয়, অথচ রোহন ভালো সুডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও কোনমতে তার ধারেকাছে আসতে পারে না। নম্বরের আকাশ পাতাল ফারাক থাকে ফার্স্ট আর সেকেন্ডের মধ্যে। রোহনের মা বরাবর ওর পড়ার ব্যাপারে পজেসিভ।
পরীক্ষার সময় ক্লাসে ঢোকার আগে রুমেলীর ছেলেকে পইপই করে বলা
_ চেক করবি, বানান ভুল করবি না। ভালো করে কোয়েশ্চেন পেপার ফলো করবি। সিকোয়েন্স মেন্টন করবি। এইরকম হাজারো কথা। পরীক্ষা দিয়ে বেরোনো পর ছেলেকে ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। এমনকি কোন কোয়েশ্চেনের ভুল অ্যানসার দিলে ওখানেই রোহনকে চড় থাপ্পর খেতে হতো। অন্য গার্জেনরা এই নিয়ে হাসাহাসি করতো। রোহনের বাবা বড় বিজনেসম্যান, রুমেলির একটা শাড়ির বুটিক আছে। একটা মেয়ে ছিলো, পাঁচবছর বয়সে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়। তারপর এই রোহন, তাই ওর ব্যাপারে রুমেলির অসম্ভব রকমের এক্সপেক্টেশন।
ভদ্রমহিলা অসম্ভব সুন্দরী আর ভয়ানক অহংকারী।রুমেলি একদিন বাচ্চাকে স্কুল ছাড়তে এসে অনুসূয়ার সাথে যেচে আলাপ করেছিল
_ আপনি মিসেস দত্তা। আমাদের পাড়ায় থাকেন তো? আপনার ছেলে অটিস্টিক তাই না? কি করে ম্যানেজমেন্ট কমিটি এই ছেলেকে স্বাভাবিক ছেলেদের সাথে পড়তে দিতে পারে। এখন হয়তো গাদা গাদা নাম্বার পাচ্ছে কিন্তু পরে দেখবেন মাথা একদম কাজ করবে না। তখন আমাদের ছেলেদের সাথে কম্পিটিশনে পিছিয়ে যাবে। কথাগুলো সামনে দাঁড়ানো অনুসূয়ার বুকে শেলের মতো বিঁধছিলো।সে সাধারণত কারোর সাথে রাফ বিয়েভ করে না ।
এই মুহূর্তে করে ফেলল
_ আমার না একটা কাজ আছে। বলেই সোজা গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে জোরে দরজাটা বন্ধ করে রুমেলির সামনে দিয়ে চলে গেলো। অপমানে রুমেলির মুখটা কালো হয়ে গেল। সব রাগ গিয়ে রোহনের ওপর পড়লো।
__ কি পারিস কি তুই? ওই ফুটবল খেলা ছাড়া। একটা পাগল ছেলে তোর থেকে সবসময় বেশি নম্বর পেয়ে ফার্স্ট হয়। ইন্টার স্কুল ড্রইং কম্পিটিশনে ও ট্রফি পায়।
_ মা, আমি তো ফুটবলে আমাদের টিমে ক্যাপ্টেন। একটু বড় হই দেখবে, আমি ইন্টার স্কুল স্পোর্টসে চ্যাম্পিয়ান হবো। এখন তো সিনিয়াররা ওই টিম খেলে।
_ রাখ তোর ওই ফুটবল। নাম্বারের বেলায় তো আন্ডা! কাল থেকে বিকেলে তোর ফুটবল খেলা বন্ধ । বিকেলে ম্যাথ পেপার সলভ করবি। রোহানের বুকটা হুহু করে খেলতে না পারার জন্য। দিনে দিনে ও ফাস্ট্রেটেড হয়ে সবাইকে লেগপুলিং করে আনন্দ পায়, মনে হয় যেন মায়ের ওপর বদলা নিচ্ছে। মায়ের কাছে কথা শুনতে শুনতে ওর অজন্তাতেই শ্লোকের ওপর ভীষন রাগ জমতে থাকে। একদিন টিফিন টাইমে ও ক্লাসে ওয়াটার বটল নিতে এসে দেখে শ্লোক লাইফ সায়েন্সের প্রজেক্ট করছে। কাল সাবমিশন।
রোহন আঁকতে পারে না, ওর ড্রইংস্যার এঁকে দিয়েছে, ও লিখে আজ জমা দিয়েছে।রোহন ঝুঁকে শ্লোকের খাতার দিকে তাকায়। কি নিখুঁত ভাবে সব ডায়াগ্রাম আঁকছে, মুক্তোর মতো লেখা। পেজগুলো সব ওর ডেস্কে ছড়ানো ছিটানো। রোহন আচমকা ওর পাতাগুলো পেছন থেকে টেনে নিয়ে ছিঁড়তে লাগলো। শ্লোক ততক্ষণে ওর দিকে বিস্ফোরিত চোখে দেখে রোহন ওর সাধের প্রোজেক্টর পাতাগুলো কুচিকুচি করে দিচ্ছে। রাগে অন্ধ হয়ে শ্লোক কিছু বলার চেষ্টা করলে ও পারলো না। তখন এগিয়ে এসে রোহনকে ঠেলে দেয়। রোহনের মাথাটা টেবিলের কোনায় লেগে রক্ত বেরিয়ে যায়। ব্যাস ওই স্কুলে শ্লোকের পড়াশোনার ইতি টানতে হয় রোহনের মায়ের কমপ্লেনে। তারপর শ্লোককে ওর বাবা মা ভর্তি করে স্পেশাল চাইল্ডদের স্কুলে। বেশ চলছিলো। আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। শ্লোককে রোহন এখন ও সহ্য করতে পারে না। দেখলেই নানাভাবে টিস করে, কারন শ্লোককে স্কুল থেকে বার করে দিলেও রোহনের সেইদিনের ওই প্রজেক্টের কাগজ ছেঁড়ার জন্য ওকে ছমাস স্কুল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল।
এই ঘটনার পর অনুসূয়া ছেলেকে নিয়ে অন্য পাড়ায় চলে গেল, যাতে আর জীবনে ওকে রোহানের মুখোমুখি হতে না হয়। বছর ঘুরে থাকে।আই. সি. এস. সির রেজাল্ট বেরোলে দেখা যায় শ্লোক পেয়েছে নিরানব্বই শতাংশ। খবরের কাগজ ,নিউজ চ্যানেল শ্লোকের নিউজ কভার করে। কিভাবে একজন অটিস্টিক বাচ্ছা এইরকম তাক লাগানো রেজাল্ট করতে পারে নৈপথ্য থাকা গল্পের সন্ধানে মিডিয়া শ্লোকের বাড়িতে আসতে থাকে। ঘরের মধ্যে আপনমনে ছবি আর বইয়ের মধ্যে থাকা শ্লোক রাতারাতি জনসমাজে ফেমাস হয়ে যায়। একদিন অনুসূয়া পিৎজা হাট থেকে শ্লোকের হটফেবারিট পিৎজা কিনতে গিয়ে ওই পাড়ার মিসেস বাসুর সাথে দেখা। ওর মেয়ে ও শ্লোকের সাথে পড়তো।
__ কি গো? আমাদের আর তো পাত্তা দেবে না। ছেলে এমন ফাটাফাটি রেজাল্ট করেছে, টিভি খুললেই তো এখন শ্লোকের মুখ। তবে এখন বোধহয় ও জড়তা কাটাতে পারে নি তাই না? দেখছিলাম ও আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কথা বলছে।
আমার মেয়ে তো রেজাল্ট ওই একরকম করেছে। স্কুলেই সায়ান্স পাবে, তাই রক্ষে। না হলে এখন হন্যে হয়ে ঘুরতে হতো অন্য স্কুলে। তারপর গলা নামিয়ে বলে_ রোহনের কথা কিছু জানো?
অনুসূয়া মাথা নাড়ে, সত্যি ওই পাড়া ছাড়ার পর ওদের সাথে আর দেখা হয় নি।
_ মায়ের প্রেশারে ছেলের তো নাইন থেকে অবনতি হতে থাকে। মাঝে মাঝে শরীর খারাপ হয়।গুচ্ছের টিউশন আর বাড়িতে সর্বক্ষন পড়ার ফলে ওর ব্রেন কাজ করে না। প্রচন্ড অ্যগ্রসিভ মেন্টালিটির হয়ে যায়। এবারে তো পরীক্ষায় বসতে চাইছিলো না, টেষ্টে ও খারাপ করেছিলো। ওর মতো স্টুডেন্ট সেভেন্টি ফাইভ পার্সেন্ট পেয়েছে ভাবা যায়। সায়ান্স তো দূরে থাক। স্কুলে থাকবে কিনা বলা যায় না। ও নাকি ডিপ্রেশনে চলে গেছে। কোথাও বেরোয় না। কারোর সাথে কথা বলে না।ওর মা নিয়মিত সাইক্রিয়াটিকিসের কাছে ছোটাছুটি করছে। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে বাবা। অনুসূয়ার মিসেস বাসুর কথাগুলো আর মাথায় ঢুকছিলো না।
আজ দরজা খোলার পর অনুসূয়া যাকে দেখলো তাকে চিনতে ওর কষ্ট হলো। একি চেহারার হাল হয়েছে রুমেলীর। চোখদুটো ঢুকে গেছে, গালগুলো বসে গেছে। মনে হচ্ছে এক লহমায় বয়স অনেকটা বেড়ে গেছে। অনুসুয়া আর শ্লোককে দেখে রুমেলি ভূত দেখার মতো চমকে গেলো। অনুসূয়া হেসে বললো__শ্লোক এলো রোহানের সাথে দেখা করতে। কতদিন দেখা হয় নি।
রুমেলি চুপচাপ ওদের বসার ঘরে বসালো।
_ রোহন কোথায়?
রুমেলি ইশারায় সিঁড়ির দিকে আঙ্গুল তুললো। এবার হাফ শার্ট পরা ফর্সা একহারা চশমা চোখের শ্লোক ওদের অবাক করে দিয়ে হাতে ধরা একটা চওড়া প্যাকিং করা বাক্স নিয়ে ওপরে উঠে গেলো। রুমেলি ওর ওপরে উঠার দিকে লক্ষ্য করে বলে উঠলো_ শ্লোক তো এখন সেলিব্রেটি।তাই না? দুজনেই এরপর চুপ
একটা একটা মূহুর্ত যেন এক যুগ বলে মনে হচ্ছিল। শুধু ঘরের ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ ঘরের নিস্তব্ধতা বাড়াচ্ছিল। হঠাৎ ওপর থেকে আসা জোরে হাসির আওয়াজে দুজনেই প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সামনের ঘরটাতে উঁকি দিয়ে দেখলো। রোহনের টেবিলের ওপর রাখা একটা ফ্রেমবন্দি ফটো, যা শ্লোকের আঁকা। রোহন দুহাত তুলে ফুটবল ক্যাচ করছে। ছবিটা এতো জীবন্ত যে ওটা ফটো বলে ভুল হবে। রোহন আর শ্লোক হাতধরাধরি করে আপনমনে হেসে চলছে। শ্লোক যে তার ষোলো বছর বয়স অব্দি কারোর হাত সেইভাবে ধরে নি।দৃশ্যটাতে রূমেলির এতদিনের জমে থাকা এক্সপেটেশন , কষ্ট, যন্ত্রনার পাহাড়কে গলিয়ে নদী করে দিলো। যা ওর চোখ থেকে উষ্ণপ্রসবনের মতো ঝরছিলো। আজ ওর ওই মাতৃহৃদয় উস্কোখুস্কো চুলের চশমা পরা ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিলো।
0 comments