নজরুল ইসলামের জীবনে প্রেম এসেছিল বারবার। তিনি বাস্তবজীবনে যেমন ছিলেন প্রেমিক পুরুষ, তেমনি তাঁর জীবনে ও মানসপটে বেশ কয়েকজন নারীরও আনাগোনা ছিল। নজরুল ব্যক্তিগত জীবনে যাঁদের প্রেমে পড়েছিলেন, তাঁরা হলেন নার্গিস, ফজিলাতুন্নেসা, আশালতা(প্রমীলা) সেনগুপ্ত, রানু সোম, উমা মৈত্র, কানন দেবী, এবং জাহানারা। নজরুল তাঁদের নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য গান, কবিতা আর প্রেমপত্র। আর সেসব গল্প বলার আগে প্রথমেই আসে নার্গিসের প্রতি নজরুলের সেই চিঠি, -
“তুমি আমাকে আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না। সাথে সাথে আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতেও পারতাম না।’’
আবার কোথাও লিখেছেন, ‘‘দুনিয়ায় যত রকম আনন্দ আছে তার মধ্যে এই বিচ্ছেদের ব্যথাটাই সব থেকে আনন্দের।’’
নার্গিস:
১৯২১ সালের মার্চ কি এপ্রিল মাস। কবি নজরুল তাঁর বন্ধু আলী আকবর খানের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন কুমিল্লার দৌলতপুরে। সেখানে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে। নজরুল ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সবাইকে গান শুনিয়েছিলেন। নজরুলের গানের সুর মাতিয়ে দিল সৈয়দা খাতুনকে আর সৈয়দা খাতুনের রূপ মুগ্ধ করে ফেলল নজরুলকে। কবি প্রেমে পড়ে গেলেন প্রথম দর্শনেই। তিনি তাঁর নাম দিলেন নার্গিস। নার্গিস ইরানি এক সাদা গুল্মপুষ্পের নাম। দৌলতপুরে থাকা অবস্থাতেই সিদ্ধান্ত নিলেন, নার্গিসকেই তিনি বিয়ে করবেন। বিয়েও হয়ে গেল কয়েক দিনের মধ্যে। কিন্তু ইতিহাস রচনা করল এক দুঃখের নাটক। বিয়ে হলো ঠিকই, বাসর আর হলো না। কোনো এক অজানা অভিমানে বাসর রাতেই নজরুল বাড়ি ছেড়ে যান। দৌলতপুর থেকে চলে আসেন কুমিল্লায়। কিন্তু কবির সেই অভিমানের কারণ কবি কোনো দিন কাউকে মুখ ফুটে বলেননি। ইতিহাসও তা স্পষ্টভাবে খুঁজে বের করতে পারেনি। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের আর কোন যোগাযোগ হয় নি। ১৯৩৭ সালে নজরুলকে নার্গিস একটা চিঠি লেখেন। চিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে কবি বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। নজরুল তাকেই চিঠি পড়তে বলেন। চিঠি পড়া শেষে শৈলজানন্দ নজরুলকে উত্তর লিখতে বলেন। নজরুল একটি গান লিখে দেন-
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই কেন মনে রাখো তা’রে।
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।
আমি গান গাহি আপনার দুখে
তুমি কেন আসি’ দাঁড়াও সুমুখে,
আলেয়ার মত ডাকিও না আর নিশীথ –অন্ধকারে।
ফজিলাতুন্নেসা:
ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে কবির পরিচয় হয় ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কবি তখন মুসলিম সাহিত্যসমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন ঢাকায়। কবি একটু-আধটু জ্যোতিষবিদ্যা জানতেন। কাজী মোতাহার হোসেন সে কারণে কবিকে নিয়ে যান ফজিলাতুন্নেসার বাসায়। ব্যস! শুরু হয়ে গেল হাত দেখা। প্রথমে হাতে হাত, পরে চোখে চোখ। কবির মন প্রেমে টালমাটাল হয়ে উঠল। কবি চলে গেলেন ঢাকা ছেড়ে। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা থেকে গেলেন তাঁর মন জুড়ে। তার পর থেকে নজরুল লিখে চললেন একটার পর একটা প্রেমপত্র।
নজরুল তাঁর স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন ‘সঞ্চিতা’ ফজিলাতুন্নেসাকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। ২৮-৩-’২৮ তারিখে ফজিলাতুন্নেসাকে লেখা নজরুলের সেই চিঠি: ‘আমার আজ পর্যন্ত লেখা সমস্ত কবিতা ও গানের সর্বাপেক্ষা ভাল যেগুলি-সেইগুলি চয়ন করিয়া একখানা বই ছাপাইতেছি সঞ্চিতা নাম দিয়া।… আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানী। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশ্যে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ সঞ্চিতা আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এজন্য আপনার আর সম্মতিপত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার জন্য কি সম্মান করিব? সুদূর ভক্ত কবির এই একটি নমস্কারকে প্রত্যাখ্যান করিয়া পীড়া দিবেন না–এই আমার আকুল প্রার্থনা।’
কাজী নজরুল ইসলাম অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁর ‘সঞ্চিতা’ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেছিলেন। কেন, তা বোঝা কঠিন।
তার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু কবিতা ও গান। যেমন ‘এ মোর অহঙ্কার’। এতে কবি প্রিয়াকে না পাওয়ার বেদনাধারা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার/তোমায় আমি করব সৃজন, এ মোর অহঙ্কার। কিংবা “পরজনমে দেখা হবে প্রিয়/ ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও”।
প্রমীলা:
নার্গিসের বিয়ে বাসর থেকে পালিয়ে আলী আকবরের সাথে কুমিল্লায় গিয়ে প্রথম যে বাড়িতে নজরুল উঠেছিলেন, সেই বাড়ির কর্ত্রী বিরজা সুন্দরী দেবী কবিকে পূত্রবৎ স্নেহ করতেন, কবিও তাঁকে মা বলে ডাকতেন। এবং পরে আরও কয়েকবার সেখানে যান। এই সময়েই প্রমীলার সঙ্গে কবির প্রেমের গোড়াপত্তন। প্রমীলা অর্থাৎ তার কন্যা আশালতার সঙ্গে কবির পরিচয় ও প্রণয় ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে ওঠে। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র জন্য নজরুলকে পুলিশ ২৩ নভেম্বর ১৯২২ তারিখে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে। ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে কারামুক্ত হয়ে নজরুল আবারও ফেরেন প্রমীলার নীড়ে। নজরুল এই সময়ে প্রমীলার প্রতি নিজের মুগ্ধতা নিয়ে লিখলেন-
নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়
কে যায় কে যায় কে যায়
যেন জলে চলে থল-কমলিনী
ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়।
প্রেম নিবেদনের তিন বছর পর নজরুলের জীবনে সেই মধুরতম মুহূর্তটি ঘনিয়ে আসে বাংলা ১৩৩১ সালের ২২ বৈশাখ মোতাবেক ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল শুক্রবার। প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তখন প্রমীলার বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের ২৩।
প্রমীলার প্রতি কবির প্রেমের কথা তাঁর ‘বিজয়িনী’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছিল । ‘বিজয়িনী’ ছাড়াও নজরুল প্রমীলাকে নিয়ে ‘প্রিয়ার রূপ’, ‘দোদুল দুল’ সহ আরও অনেক কবিতা রচনা করেন। ‘ দোদুল দুল’ কবিতায় কবি প্রমীলার রূপের বর্ণনা এভাবে তুলে দেন- ‘মৃণালু হাত/নয়ানু পাত/গালের টোল,/চিবুক দোল/সকল কাজ/করায় ভুল/প্রিয়ার মোর/কোথায় তুল?/কোথায় তুল?/কোথায় তুল?/কাকঁল ক্ষীণ/মরাল গ্রীব/ভুলায় জড়/ভুলায় জীব,/গমনু দোল/অতুল তুল্।’ দোলন চাঁপা কাব্যগ্রন্থে সবার আগে এই কবিতাটি রয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থটি ১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়। প্রেমিকা প্রমীলা তার কাছে রানীর মতো। তিনি নিজেকে সমর্পন করে লিখলেন,
হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে
নার্গিস, প্রমীলা, ফজিলতুন্নেসা এই তিন নারীই নজরুলের কাছ থেকে প্রেম বলতে আমরা যা বুঝি তা পেয়েছিলেন। এছাড়া আরও কয়েক জন নারীর প্রতি নজরুলের দুর্বলতার কথা জানা যায়। এবারে তাদের সম্পর্কে কিছু আরোকপাত করা যাক।
রানু সোম:
প্রথম সন্ধ্যায় গুরু দর্শনের রেশ কাটিয়ে না উঠতেই কিশোরী প্রতিভা পরের দিন সকালে পুনরায় চমকিত হলেন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। দরজায় তখন দাঁড়িয়ে নজরুল ইসলাম। হাসতে হাসতে বললেন, ‘এসে পড়লাম বুঝলে? বেলা বাড়তে দিলে কি আর উপায় আছে? সব ছেলেরা ঠিক ভিড় করবে, ধরে নিয়ে যাবে কোথাও। এখান থেকে ফিরে গিয়ে কাল রাত্তিরে একটা গান লিখেছি, এক্ষুণি শিখিয়ে দিতে হবে। নাও, নাও, শিগগির চা খেয়ে নাও। আবার ভুল হয়ে যাবে।’
সেই সাত সকালেই শুরু হয়ে গেলো রানুর অর্থাৎ প্রতিভার গান শেখার পালা। যিনি পরবর্তিতে কবি বুদ্ধদেব বসুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রতিভা বসু নামে পরিচিতি লাভ করেন। রাতের লেখা গানটি তুলতে লাগলেন কবি.....
‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন সোনার গাঁয় / আমার ভাটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায়।’
প্রতিভা জানাচ্ছেন, ‘এই গানটি লিখেছেন রাতে। দেখা গেলো তখনো তার বয়ান ও সুরারোপ সম্পূর্ণ হয়নি, আমাকে শেখাতে শেখাতেই বাকিটা ঠিক করে নিলেন। পকেট থেকে কলম বেরুলো, কাটাকুটি কাগজ বেরুলো, গলা থেকে সুর বেরুলো, গানে সম্পূর্ণতা এলো। দিন তিনেক বাদে আর একটি গান তৈরি হলো, ‘এত জল ও-কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল কে।’
যখন গানে বসতেন অবিশ্রান্ত চা খেতেন বলে আমার মা মাঝে মাঝেই অপ্রত্যাশিতভাবে এককাপ চা এনে দিতেন হাতে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠতেন, ‘নাহ তোমার মতো মেয়ে হয় না’- সেদিন গেয়ে উঠলেন, ‘এতো চা ঐ পেয়ালায় এমন করে আনলে বলো কে? এইটুকু থেকেই পরের দিন ওই গান রচিত হয়ে এলো।’
এভাবেই তাদের মধ্যে সুন্দর গুরু-শিষ্য সম্পর্ক গড়ে উঠল। কিন্তু নিন্দুক মহলে তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে নানা কাণা-ঘুষা শুরু হয় । মুসলমান যুবক কবি প্রতিদিন হিন্দু যুবতীকে গান শেখানোর আড়ালে ঘনিষ্ট হচ্ছেন, এই অপবাদ চাপিয়ে নজরুলকে হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে সজনীকান্ত সেন তার ‘শনিবারের চিঠিতে’ একটি প্যারোডি লেখেন যার নাম ছিল, ‘কে বিদেশি বন-উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে’। রানু সোম কবিকে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করেছিলেন। প্রেমের কোনও সম্পর্ক এখানে গড়ে উঠেনি বলে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহল মনে করেন।
এমনই এক গানের জলসায় ১৩৩৫ সনের ৭ আষাঢ় রানুদের বাড়িতে বসেই ‘শ্রীমতি রানু সোম কল্যাণীয়াসু’ কে উদ্দেশ্য করে লিখলেন,
‘মাটির ঊর্ধ্বে গান গেয়ে ফেরে/ স্বরগের যত পাখি/ তোমার কণ্ঠে গিয়াছে তাহারা/ তাদের কণ্ঠ রাখি’
এখানে লক্ষণীয় যে, ১৩৩৫ এর ৭ আষাঢ় উক্ত কবিতাটি রচনার পরের বছর ১৩৩৬ এর অগ্রহায়ণে কলকাতার ডি.এম. লাইব্রেরি কবির ‘চোখের চাতক’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করে। এটি কবি প্রতিভা বসুকে উৎসর্গ করে ‘উৎসর্গ-পত্রে’ লিখেছেন, ‘কল্যাণীয় বীণাকণ্ঠী/ শ্রীমতি প্রতিভা সোম/ জয়যুক্তাসু।’
উমা মৈত্র:
ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্র (ডাক নাম নোটন)। কবি তাকেও গান শেখাতেন। গান শিখাতে গিয়ে নজরুল কি নোটনের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন কিনা তার উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে কবি জীবনে নার্গিস-প্রমীলা-ফজিলতুন্নেসার সাথে সাথে উমা মৈত্রের নামও উচ্চারিত হয়েছে। ধারণা করা হয় উমা মৈত্রের স্মৃতি কবি তার ‘শিউলিমালা’ গল্পটিতে ধরে রেখেছেন। গল্পটির কিছু অংশ এরূপ- “শিউলি আমার কাছে গান শিখতে লাগল। কিছুদিন পরেই আমার তান ও গানের পুঁজি প্রায় শেষ হয়ে গেল। মনে হল আমার গান শেখা সার্থক হয়ে গেল। আমার কন্ঠের সকল সঞ্চয় রিক্ত করে তার কন্ঠে ঢেলে দিলাম। আমাদের মালা-বিনিময় হল না-হবেও না এ জীবনে কোন দিন- কিন্তু কন্ঠ বদল হয়ে গেল। আর মনের কথা সে শুধু মনই জানে।… একমাস ওদের বাড়িতে ছিলাম। কত স্নেহ, কত যত্ম, কত আদর। অবাধ মেলা মেশা- সেখানে কোন নিষেধ, কোনো গ্লানি, কোন বাধা বিঘ্ন, কোন সন্দেহ ছিল না। আর এসব ছিল না বলেই বুঝি এতদিন ধরে এত কাছে থেকেও কারুর করে কর স্পর্শ-টুকুও লাগে নি কোনদিন। এই মুক্তিই ছিল আমাদের সবচেয়ে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। কেউ কারো মন যাচাই করিনি। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসার কথাও উদয় হয় নি মনে। একজন অসীম আকাশ, একজন অতল সাগর। কোন কথা নেই-প্রশ্ন নেই, শুধু এ ওর চোখে, ও এর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে”।
জাহানারা বেগম:
জাহানারা বেগম চৌধুরী ওরফে মীরা পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে ‘বর্ষবাণী’ নামে একটি বার্ষিক পত্রিকার সম্পাদিকা। তার সাথে নজরুলের প্রথম পরিচয় হয় ১৯৩১ সালে দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে। সেইবার দার্জিলিংএ আরো উপস্থিত ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মৈত্রয়ী দেবী, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র ও তার মেয়ে উমা মৈত্রসহ আরো বিখ্যাত কয়েকজন। নজরুলের একটি গানের খাতা জাহানারা বেগমের কাছে ছিল যাতে ছিল ৮ টি কবিতা ও ৭ টি গান। নজরুলের জীবনকালে এগুলো অপ্রকাশিত থেকে যায়। জাহানারা বেগম চৌধুরী মৃত্যুর আগে এগুলো প্রকাশের অনুমতি দিয়ে যান। সেখানে কয়েকটি কবিতায় জানাহারাকে নিয়ে রচনা করা কয়েকটি কবিতা পাওয়া যায়। তবে নার্গিস-প্রমীলা বা ফজিলতুন্নেসার মত কবি জাহানারাকেও ভাল বেসেছিলেন কিনা সেই প্রশ্ন আজও প্রশ্নই রয়ে গেছে।
কানন দেবী:
শিল্পী কানন দেবীকেও কবি নজরুল গান শিখিয়েছিলেন। তার সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক নিয়েও নিন্দকেরা নানা মুখরোচক কাহিনী রটনা করেছিলেন। কানন দেবীকে নিয়ে একটি সংবাদ রটানো হয়েছিল এমন যে, কবিকে কলকাতার কোথাও না পেলে কানন দেবীর বাড়িতে অবশ্যই পাওয়া যাবে। কলকাতার পত্রিকা ‘শনিবারের চিঠির’ সম্পাদক সজনীকান্ত কানন দেবীকে নিয়েও রসালো কাহিনী প্রচারে পিছিয়ে রয়নি। অথচ, বাস্তব হয়ত ভিন্ন ছিল বলে মনে করা হয়।
‘ব্যথার দান’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন-“মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্য করলুম।” কবির এই মানসীর পরিচয় আজও রহস্যাবৃত।
নজরুল আজীবন বড় প্রেমের কাঙাল ছিলেন। প্রেম নাকি কবিমানসের প্রধান প্রেরণা । তাই প্রেম তার জীবনে এসেছিল বারবার-কখনো ঝড়ের মতো, কখনো নিভৃতে । বাক্ ও বোধ শক্তি হারাবার আগে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে নজরুল ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির’ বিশেষ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম, সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ বস্তুত এমন অভিমান নিয়েই নজরুল দীর্ঘ ৩৪ বছর নীরবে কাটিয়ে ৭৭ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন।
ঋণ: নজরুল রচনাবলী/ইন্টারনেট/‘নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা’ - মুজাফ্ফর আহমেদ
ADVERTISEMENT
0 comments