আজ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে রুচিরা। কলেজে আজ নবীনবরণ অনুষ্ঠান। সবাই শাড়ি পরে যাবে। অগত্যা তাকেও শাড়ি পরতে হবে। মায়ের দেওয়া লাল শাড়িটা পরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায় । পিতৃহারা মেয়ের দিকে তাকিয়ে মা একটু অবাক হয়ে যায়। এত বড় হয়ে গেল মেয়েটা, শাড়িতে বেশ মানিয়েছে। প্রতিদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নিজেকে যত্ন নেবারও সময় নেই। বাবা চেয়েছিল বাংলায় অনার্স নিয়ে মেয়ে পড়বে। কিন্তু রুচিরার ইচ্ছা দর্শন। এখন সে দ্বিতীয় বর্ষের দর্শন বিভাগের ছাত্রী।নবীনবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয় সুকমল স্যারের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। দর্শকের আসনে রুচিরা। তার একপাশে বন্ধু সুখময় আর অন্যদিকে বান্ধবী অহনা। মনোযোগ সহকারে নবীনবরনের তাৎপর্য অনুধাবন করছিল রুচিরা। হঠাৎ সুখময়ের হাতের স্পর্শ অনুভব করে সে । গায়ে শিহরণ জেগে ওঠে।সে তাড়াতাড়ি হাতটা সরিয়ে নেয়। একটু বিরক্ত হয়েই সুখময়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে ইচ্ছাকৃত নয়, অন্যমনস্কভাবেই ঠেকে গেছে।
ADVERTISEMENT
অনুষ্ঠান শেষ হয় বেশ অনেকটা রাতেই। অহনা বলে সে একাই চলে যাবে।তাকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে সুখময় দেখে রুচিরা একাই হেঁটে চলেছে। সে ছুটে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে
“চল আমি তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”
রুচিরা বলে, “না না এই তো কাছেই আমার বাড়ি, আমি একাই চলে যেতে পারবো।”
সুখময়ের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে দুজনে হাঁটতে লাগলো। একে অপরের মুখের দিকে তাকায় কিন্তু কোনো কথা বলতে পারে না। রুচিরাকে পৌঁছে দিয়ে সুখময় চলে যায়।রুচিরা মনে মনে ভাবে সুখময় কী কিছু অনুভব করেছে,নাকি তার মনের ভুল।
বেশ কিছুদিন ধরে মা লক্ষ্য করছিল রুচিরা একটু অন্যমনস্ক। কিছু জিজ্ঞাসা করলে একটু ভেবে উত্তর দেয়। মেয়ে বড় হয়েছে তাই মা আর কিছু জিজ্ঞাসা করে না। রুচিরা খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় বসে। তার মনের মধ্যে সেদিনের পর থেকে কেমন যেন অস্থিরতা চলতে থাকে।চোখে মুখেও চঞ্চলতার ছাপ।সে কবিতা ,গল্পে প্রেমের কথা পড়েছে। তাহলে তার জীবনেও কী এমন কোনো ঘটনা ঘটতে চলেছে। একটু অন্যমনস্কভাবে ফেসবুকে কলেজের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও দেখছিল। পোস্ট করেছে বন্ধুরা। হঠাৎ চোখে পরে একটা লেখা। সুখময় লিখেছে। লাল শাড়ি পড়ে রুচিরাকে আজ বেশ অন্যরকম লাগছিল। লেখাটা পড়ে রুচিরার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। কালই সুখময়কে সে জিজ্ঞাসা করবে কেন এমন উক্তি সে করেছে।পরের দিন কলেজে একটু আগেই পৌঁছে যায় রুচিরা। মনটা ছটফট করতে থাকে। দূরে আকাশি রঙের জামা পড়ে সুখময়কে আসতে দেখে। তাড়াতাড়ি হেঁটে গিয়ে বলে “এই সুখময় কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, এখন আসার সময় হল?”
সুখময় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ,বলে “কেন? আমি কি তোকে আগে আসতে বলেছি নাকি? আর তাছাড়া তুই আমার জন্য অপেক্ষাই বা করছিস কেন?” রুচিরা একটু লজ্জা পায়। বলে
“কেউ এখনো আসেনি তো তাই ভাবলাম…।”
“কি যে বলিস ,তোর কথার মানে বোঝা দায়” বলে সুখময় হাসতে লাগলো।কিন্তু রুচিরার মন কিছুতেই মানতে চাইছে না। কালই সে বলে দেবে তার মনের কথা সুখময়কে।
বাড়ি এসে খেতে বসে না খেয়ে উঠে যায়। শুধু মনে কল্পনা জাল বিস্তার করে।
রাতে শুয়ে অনেক ভেবেছে কিভাবে বলবে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় উপহার দিয়ে সুখময় কে তার ভালোলাগার কথা জানাবে।সকালে মায়ের কাছ থেকে হাজার টাকা নেয়। মা প্রশ্ন করলে বলে” ফিরে এসে বলব।” তারপর হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। ঘড়ি কিনে কলেজের উল্টোদিকের রাস্তায় গাড়ি থেকে নামে। মনে একরাশ স্বপ্ন। রাস্তা পার হতে গিয়ে লক্ষ্য করে কলেজের সামনে কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। কৌতূহলবশত তাড়াতাড়ি রাস্তা পার হয়ে ভিড় সরিয়ে তাকিয়ে দেখে সুখময়ের জামা রক্তে ভিজে গেছে। মাথার চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে পড়ে আছে। একটা গাড়ি ব্রেক ফেল করে সুখময়কে চাপা দেয়। রুচিরার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। এমন দৃশ্য সে আগে কখনো দেখেনি। কোনো কথা বলতে পারে না শুধু চোখ বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।
বাড়ি এসে সোজা চলে যায় বাথরুমে। দরজাটা বন্ধ করে অঝর ধারায় কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষন পর বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোফায় গিয়ে বসে। তাকে দেখে চমকে ওঠে মা ।সকালের দেখা রুচিরাকে তার অচেনা লাগে। রুচিরার এই পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে,রুচিরা কোন উত্তর না দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তারপর একটু সামলে ঘটনাটা মাকে জানায়। শুনে মা দীঘনিঃশ্বাস ফেলে,বলে”আবারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।”
রুচিরার মনে পড়ে যায় তার চন্দনা পিসির কথা।পিসির গায়ের রঙ ছিল একটু চাপা, তবে মুখশ্রীতে বেশ লাবণ্য ছিল।বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল। গ্রামেরই এক সেলাই স্কুলে সেলাই শিখত। প্রতিদিন যাবার সময় দেখে রাস্তায় খেঁজুরগাছের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ভদ্রলোক। গ্রামের রাস্তা ফাঁকা তাই পিসির নজরে পরে যেত। একে অপরের দিকে তাকাতো কিন্তু কোনো কথা হতো না। মাঝে মাঝে শুধু হাসতো।একদিন কৌতূহলবশত পিসি ভদ্রলোকের কাছে জানতে চায়, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ। ভদ্রলোক বলে তার জন্যই দাঁড়িয়ে থাকে। পিসি কারণ জানতে চাইলে হেসে উত্তর না দিয়ে চলে যেত। এইভাবে একটু একটু করে দুজনের মধ্যে পরিচিতি বাড়ে। ভদ্রলোকের নাম নভোজিত। প্রাইভেট টিউশন করে তার সংসার চলে। শান্ত স্বভাবের এই মানুষটিকে পিসিরও পছন্দ হয়। কিন্তু এইভাবে প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বললে গ্রামের মানুষ সন্দেহ করবে।তাই একদিন পিসি নভোজিতকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। নভোজিত ঠিক করে তাদের সম্পর্কের কথা জানাবে চান্দনা পিসির বাড়িতে। পরের দিন পিসি অপেক্ষা করতে থাকে। সময় এগিয়ে যায় তবু নভোজিত আসে না। মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। বাইরে বেরিয়ে গিয়ে এক প্রতিবেশীর মুখে শোনে রাস্তা দিয়ে আসার সময় বিষাক্ত সাপের ছোবলে নভোজিতের মৃত্যু হয়েছে।
নিজেকে সামলাতে না পেরে এক ছুটে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। বাড়ির লোক অবাক হয়। দরজা ভেঙে বার করে আনে পিসির ঝুলন্ত মৃতদেহ।রুচিরা একটু ভাবে ,দুটো ঘটনাই তো দুর্ঘটনা, নাকি অন্য কিছু! রুচিরা শিক্ষিত ।তাই যুক্তির দ্বারা নিজের মনকে বোঝাবার চেষ্টা করে ,জীবনে চলার পথে অনেক সমস্যাই আসে। সমস্যা থেকে নিজেকে সামলে নেওয়ার নামই তো জীবন। তাই সুখময়কে ভোলার জন্য নিজের কেরিয়ারের দিকে মন দেয়।
এইভাবে বেশ কয়েকটা বছর কেটে যায়। রুচিরা এখন স্কুল-শিক্ষিকা। স্কুলের সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ। তার ব্যবহার, স্বভাব ও সহনশীলতা সকলের মনকে এক নিমেষে জয় করে নিতে পারে। কয়েকদিন ধরে রুচিরা লক্ষ্য করে ভূগোলের শিক্ষক তথাগতবাবু একটু বেশি যেন তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কখনো পেন উপহার দেন, কখনো ক্যাডবেরি আনেন। রুচিরা একটু অস্বস্তি অনুভব করে কিন্তু কিছু বলতে পারে না। যদি উনি রাগ করেন। কারণ মন থেকে কেউ কিছু দিলে ফেরত দেওয়ার মানসিকতা রুচিরার নেই। কিন্তু বারবার এই উপহার নিতেও যেন কেমন লাগে। তাই রুচিরা ঠিক করে তথাগতবাবুকে এবার বলবে তিনি যেন যখন-তখন তাকে উপহার না দেন।
রুচিরা স্কুল থেকে বেরোতে যাবে সেই সময় তথাগতবাবুর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি বলেন “রুচিরাকে তার কিছু কথা বলার আছে। একটু সময় দিতে পারবে কিনা জিজ্ঞাসা করেন।” কারণ জানতে চাইলে বলেন, “কালই না হয় বলবো”।
রুচিরা কি বলবে বুঝতে না পেরে সময়টা জানতে চায়। তথাগত বাবু বলেন, “কাল তোমাকে স্কুলে একটু আগে আসতে হবে।”
রুচিরা রাজি হয়ে যায়।বাড়িতে গিয়ে রুচিরা ভাবে তথাগতবাবু তাকে কী বলতে চান। সুখময়কে সে এখনো ভুলতে পারিনি। আবার এ কথাও ভাবে জীবনটাকে নতুনভাবে দেখলে ক্ষতি কি। মনে মনে ভালোলাগা অনুভব করে। অনেকদিন পর আবার তার মুখে প্রশান্তি দেখা যায়।পরের দিন সকালে হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে স্কুলের পথে রওনা দেয় রুচিরা। বাস থেকে নেমে স্কুলের কাছাকাছি যেতে শুনতে পায় কোলাহল। স্কুলের সামনে ভিড়। প্রথমে ভাবে হয়তো কোন ছাত্র বা ছাত্রীর সমস্যা হয়েছে ,অভিভাবকরা অভিযোগ জানাতে এসেছেন, তারপরই সুখময়ের কথা মনে করতেই বুক কেঁপে ওঠে। আবারো কি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। না না তা কেন হবে ,ওটাতো ছিল নেহাত-ই একটা দুর্ঘটনা। তবুও মন মানতে চায় না। তাই আসতে আসতে স্কুলের দিকে এগিয়ে চলে। কাছে যেতেই কানে আসে একটা কথা। সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। কেউ বলে ওঠে “ওই তো ভূগোল পড়াতেন। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কাউকে দেবেন বলে উপহার কিনে নিয়ে আসছিলেন। পিছন থেকে একটা টাটা সুমো তাকে ধাক্কা দেয়। ছিটকে পড়ে মাথায় চোট লাগে এবং তখনই মারা যান।”
কাউকে কোন কথা না বলে রুচিরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। আজ আর তার চোখে জল নেই। মুখ শুকিয়ে গেছে। তাকে দেখে মা ভয় পায়। কারণ কিছুটা অনুমান করতে পারে। তাই আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা না করে নীরব থাকে।রুচিরাঅনেকক্ষণ তার ঘরে একা বসে ছিল। কথা বলেনি। রাত বাড়ে। মা তাকে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে, সে মায়ের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। মায়ের বুককেঁপে ওঠে।রুচিরা নিথর পাথরের মত বসে থাকে।
সেদিনের পর থেকে রুচিরা আর কথা বলে নি।সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে।জিজ্ঞাসা করলে শুধু চেয়ে থাকে।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে হেঁটে গেলে জোরে জোরে হাততালি দেয় আর মুখে শব্দ করে। আজ আর তার কথা কেউ বুঝতে পারে না।
0 comments