শ্রীচৈতন্য বলেছেন কলিযুগে ভগবানের দিব্য নাম কীর্তন করা ছাড়া আর কোন ধর্ম নেই। এই দিব্য নাম হচ্ছে বৈদিক মন্ত্রের সার। চৈতন্যদেব প্রবর্তিত নাম কীর্তনের কথা বলতে গেলে যেমন আসে, -
“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে”
তেমনি রবীন্দ্রনাথের ভাবনাতেও নামের মাহাত্ম্য স্বীকৃতি পেয়েছে, -
“তোমারি নাম বলব নানা ছলে,
বলব একা বসে আপন মনের ছায়াতলে॥
বলব বিনা ভাষায়, বলব বিনা আশায়,
বলব মুখের হাসি দিয়ে, বলব চোখের জলে॥
বিনা প্রয়োজনের ডাকে ডাকব তোমার নাম,
সেই ডাকে মোর শুধু শুধুই পূরবে মনস্কাম”।
চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে ধর্মে, সাহিত্যে সর্বোপরি নাম-সংকীর্তনের মাধ্যমে একসময় বাঙালি জাতির মধ্যে যে মহাভাব জেগে উঠেছিল, রবীন্দ্রনাথ আশা প্রকাশ করে লেখেন, - “তাই আশা হইতেছে- আর একদিন হয়তো আমরা একই মত্ততায় পাগল হইয়া সহসা একজাতি হইয়া উঠিতে পারিব, বৈঠকখানার আসবাব ছাড়িয়া সকলে মিলিয়া রাজপথে বাহির হইতে পারিব, বৈঠকি ধ্রুপদ খেয়াল ছাড়িয়া রাজপথী কীর্তন গাহিতে পারিব”।
শ্রীচৈতন্যদেবের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং জীবনাদর্শে রবীন্দ্রনাথ কতটা মুগ্ধ ছিলেন তা বোঝা যায় ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ প্রবন্ধে শ্রীচৈতন্যদেব সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যে। এই প্রবন্ধে শ্রীচৈতন্যদেবের গৌরবময় কর্মকুশলতা স্মরণ করে তিনি লেখেন, “বহুকাল পূর্বে একদা নবদ্বীপের শচীমাতার এক প্রবল দুরন্ত ছেলে এই আশা পূর্ণ করিয়াছিলেন”।
চৈতন্যদেব যেমন আপন তেজে বঙ্গবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন – এই তেজ আত্মশক্তিজাত। রবীন্দ্রনাথও তেমনি আপন তেজে বঙ্গবাসীকে কূপমণ্ডুকতা থেকে বেরিয়ে মননচর্চায় যোগ দিতে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
মহাপ্রভু আর বিশ্বকবি। দুই মহাপুরুষের জীবনেও কি আশ্চর্য মিল। অপূর্ব দেহকান্তি নিয়ে গৌরাঙ্গ বিশ্বম্ভর জন্মগ্রহণ করেন সেকালের কলকাতা নবদ্বীপে। আর রবির আলোর মত উজ্জ্বল রবীন্দ্রনাথের জন্ম একালের জোড়াসাঁকোর কলকাতায়। দুজনেরই আদি নিবাস বর্তমান বাংলাদেশে। চৈতন্যদেবের আয়ুস্কাল ৪৮ বছর। তার অর্ধাংশ কেটেছে বাংলাদেশে। বাকি অর্ধাংশ অন্যত্র। ২৪ বছর বয়সে তিনি নবদ্বীপ ছেড়ে পুরি শ্রীক্ষেত্রকে নতুন কর্মক্ষেত্র করে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন আশি বছর। তিনিও জীবনের ঠিক অর্ধাংশ কলকাতায় কাটিয়ে ঠিক ৪০ বছর বয়সে নতুন কর্মযজ্ঞ শুরু করেন শান্তিনিকেতনে। চৈতন্যদেব নিজে সাহিত্যস্রষ্টা না হয়েও বাংলা সাহিত্যে নতুন জোয়ার আনেন তাঁর মহিমান্বিত প্রভাবে। তাঁর জীবন অবলম্বন করে গড়ে ওঠে বিশাল জীবনী সাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলী পায় নতুন প্রেরণা। তাঁর আবির্ভাবের পরেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গৌরবের সূচনা। ঐশ্বর্যবান বাংলা সাহিত্য সম্ভারের গৌরচন্দ্রিকা সেই সুসময়েই। রবীন্দ্রনাথেরই ভাষায়, “চৈতন্য বঙ্গভাষায় তাঁহার প্রেমাবেগ সর্বসাধারণের অন্তরে সঞ্চারিত করিয়া দিয়াছিলেন” (শিক্ষার হেরফের)।
সেকালের বাংলা সাহিত্য যেমন চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তিরসে আপ্লুত, একালের বাংলাসাহিত্য তেমনি রবিকরোজ্বল। সাহিত্যের পর সঙ্গীত। চৈতন্যদেব আর রবীন্দ্রনাথ আমাদের উপহার দিয়েছেন দুটি সম্পদ – কীর্তন আর রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গর্ব এই দুটি জিনিস নিয়ে। দুটিই বাংলার প্রাণ। তাছাড়া, দুজনেই উপলব্ধি করেছিলেন, সঙ্গীত যেখানে নিঃশেষ, সেখানের শুরু নৃত্যের। ভাষাহীন সুরহীন নৃত্য-ছন্দ স্বর্গের সুষমা আনে। দুজনেই যেন বলেছেন, “নৃত্যরস চিত্ত মম উছল হয়ে বাজে”। তাই বারবার দেখি মহাপ্রভু কৃষ্ণনাম করতে করতে ভাবাবেশে নৃত্য শুরু করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথও অন্ধ বাউল বা ঠাকুরদার ভূমিকায় নেমে গানের সুরের সঙ্গে মঞ্চে হঠাৎ নৃত্যের ছন্দ তোলেন। নাচকে এমন মর্যাদা চৈতন্যদেব আর রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ দেননি।
আরও পড়ুন - রবীন্দ্রনাথের সাংবাদিকতা
চৈতন্যদেব ব্রাহ্মণ হয়েও ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামেন পতিত উদ্ধারিতে, নামগান প্রচার করেন সবার অধম সবহারাদের মাঝে। রবীন্দ্রনাথও জন্মগতভাবে উপবীতধারী বাহ্মণ, তবু অনায়াসে ঘোষণা করেন, ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন’। দুজনেই মধুর রসের পথিক, কিন্তু বলিষ্ট মতের প্রচারক। দুজনেই ছিলেন দীর্ঘদেহী গৌরাঙ্গ। দু’জন দুই পথের পথিক হয়েও দুইভাবে বিপ্লবী। এই বিপ্লব প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী না হয়েও সুদূরপ্রসারী। আনন্দময় উৎসবকে দুজনেই প্রাধান্য দিয়েছেন জীবনে। তাঁর মধ্যে বসন্ত ঋতুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দুজনের। একজন বলেন দোললীলা, আরেকজন বলেন বসন্তোৎসব। দুজনেরই যিনি উপাস্য, তাঁর বর্ণ শ্যামল। একজনের শ্যামল কৃষ্ণ, আরেকজনের শ্যামল প্রকৃতি।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর দিব্যজীবন এবং তাঁর বৈষ্ণবদর্শন প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। অনেকের ধারণা, রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-ধারণা যেন শুধু উপনিষধ কেন্দ্রিক। উপনিষধ নিশ্চয়ই তাঁর প্রেরণার অন্যতম উৎস, কিন্তু বৈষ্ণব দর্শন ও সাহিত্য যে তাঁকে কতটা প্রেরণা দিয়েছিল, সেই সম্পর্কে অনেকেই অবহিত নন। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, উপনিষদ আর বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি তাঁর ঋণের কথা। ১৯২১ সালে বন্ধু ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, - “বৈষ্ণব সাহিত্য এবং উপনিষদ বিমিশ্রিত হইয়া আমার মনের হাওয়া তৈরি করিয়াছে। নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন যেমন মিশে তেমনি করিয়া তাহারা মিশিয়াছে”।
শ্রীচৈতন্যের জীবনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় সেই বাল্যকাল থেকে। বিভিন্ন সময়ে তিনি চৈতন্যদেবের জীবনী পরম আগ্রহে বারবার পড়েছেন। ১৯১০ সালে লেখা একটি চিঠিতে বলছেন, “বৈষ্ণবকাব্য এবং চৈতন্যমঙ্গল প্রভৃতি কাব্য অবলম্বন করে চৈতন্যের জীবনী আমি অনেক বয়স পর্যন্ত বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে আলোচনা করেছি”। ১৯৩৬ সালে হেমন্তবালা দেবীকে আর একখানা চিঠিতে লিখেছেন, -
“কল্যাণীয়াসু, প্রথম বয়সে বৈষ্ণবসাহিত্যে আমি ছিলুম নিমগ্ন, সেটা যৌবনচাঞ্চল্যের আন্দোলনবশত নয়, কিছু উত্তেজনা ছিল না এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু ওর আন্তরিক রসমাধুর্য্যের গভীরতায় আমি প্রবেশ করেছি। চৈতন্যমঙ্গল চৈতন্যভাগবত পড়েছি বারবার। পদকৰ্ত্তাদের সঙ্গে ছিল আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। অসীমের আনন্দ এবং আহ্বান যে বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্য্যে ও মানবপ্রকৃতির বিচিত্র মধুরতায় আমাদের অন্তরবাসিনী রাধিকাকে কুলত্যাগিনী করে উতলা করচে প্রতিনিয়ত, তার তত্ত্ব আমাকে বিস্মিত করেচে। কিন্তু আমার কাছে এই তত্ত্ব ছিল নিখিল দেশকালের— কোনো বিশেষ দেশে বিশেষ কালে বিশেষ পাত্রে কতকগুলি বিশেষ আখ্যায়িকায় আবদ্ধ করে একে আমি সঙ্কীর্ণ ও অবিশ্বাস্য করে তুলতে পারিনি”।
তাই আমরা দেখতে পাই প্রেমিক চৈতন্য, বিপ্লবী চৈতন্য, মানবদরদী চৈতন্য এবং বাঙালি জাতির ভাষার ও সাহিত্যের উদ্বোধক চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতি রবীন্দ্রনাথ এত শ্রদ্ধাশীল।
রবীন্দ্রনাথ চৈতন্যদেবকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, আইন অমান্য আন্দোলন, বিক্ষোভ মিছিলের সংগঠন, আপামর জনসাধারণকে পরম স্নেহে বুকে তুলে নেওয়া, প্রেমধর্মের প্রচার ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর রচনাবলীতে মহাপ্রভু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“আমাদের আশ্বাসের কারণও আছে। আমাদের বাঙালির মধ্য হইতেই তো চৈতন্য জন্মিয়াছিলেন। তিনি তো বিঘাকাঠার মধ্যেই বাস করিতেন না, তিনি তো সমস্ত মানবকে আপনার করিয়াছিলেন। তিনি বিস্তৃত মানবপ্রেমে বঙ্গভূমিকে জ্যোতির্ময়ী করিয়া তুলিয়াছিলেন। তখন তো বাংলা পৃথিবীর এক প্রান্তভাগে ছিল, তখন তো সাম্য ভ্রাতৃভাব প্রভৃতি কথাগুলোর সৃষ্টি হয় নাই, সকলেই আপন-আপন আহ্নিক তর্পণ ও চণ্ডীমণ্ডপটি লইয়া ছিল-তখন এমন কথা কী করিয়া বাহির হইল।
‘মার খেয়েছি নাহয় আরও খাব।
তাই বলে কি প্রেম দিব না? আয়। '
এ কথা ব্যাপ্ত হইল কী করিয়া? সকলের মুখ দিয়া বাহির হইল কী করিয়া? আপন-আপন বাঁশবাগানের পার্শ্বস্থ ভদ্রাসনবাটীর মনসা-সিজের বেড়া ডিঙাইয়া পৃথিবীর মাঝখানে আসিতে কে আহ্বান করিল এবং সে আহ্বানে সকলে সাড়া দিল কী করিয়া? একদিন তো বাংলাদেশে ইহাও সম্ভব হইয়াছিল। একজন বাঙালি আসিয়া একদিন বাংলাদেশকে তো পথে বাহির করিয়াছিল। একজন বাঙালি তো একদিন সমস্ত পৃথিবীকে পাগল করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছিল এবং বাঙালিরা সেই ষড়যন্ত্রে তো যোগ দিয়াছিল। বাংলার সে এক গৌরবের দিন। তখন বাংলা স্বাধীনই থাকুক আর অধীনই থাকুক, মুসলমান নবাবের হাতেই থাকুক আর স্বদেশীয় রাজার হাতেই থাকুক, তাহার পক্ষে সে একই কথা। সে আপন তেজে আপনি তেজস্বী হইয়া উঠিয়াছিল”।
চৈতন্যদেবের সংগ্রাম ছিল সমস্ত ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে। তাঁর অস্ত্র ছিল প্রেমধর্ম। সাম্য ও ভক্তির মিশ্রনে গঠিত তাঁর প্রেমধর্ম হরিনাম সংকীর্তনের সন্মোহনী শক্তিতে আকৃষ্ট করেছিল সর্বশ্রেনীর, বিশেষ করে পতিত অবহেলিত সমাজের লোকদের। এই বলিষ্ট অথচ প্রেমময় ভাববন্যার বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ বলেন,
“আসল কথা, বাংলায় সেই একদিন সমস্ত একাকার হইবার জো হইয়াছিল। তাই কতকগুলো লোক খেপিয়া চৈতন্যকে কলসীর কানা ছুঁড়িয়া মারিয়াছিল। কিন্তু কিছুই করিতে পারিল না। কলসীর কানা ভাসিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে এমনি একাকার হইল যে, জাতি রহিল না, কুল রহিল না, হিন্দু-মুসলমানেও প্রভেদ রহিল না। তখন তো আর্যকুলতিলকেরা জাতিভেদ লইয়া তর্ক তুলে নাই। আমি তো বলি, তর্ক করিলেই তর্ক উঠে। বৃহৎ ভাব যখন অগ্রসর হইতে থাকে তখন তর্কবিতর্ক খুঁটিনাটি সমস্তই অচিরাৎ আপন-আপন গর্তের মধ্যে সুড়্সুড়্ করিয়া প্রবেশ করে। কারণ, মরার বাড়া আর গাল নাই। বৃহৎ ভাব আসিয়া বলে, সুবিধা-অসুবিধার কথা হইতেছে না, আমার জন্য সকলকে মরিতে হইবে। লোকেও তাহার আদেশ শুনিয়া মরিতে বসে। মরিবার সময় খুঁটিনাটি লইয়া তর্ক করে কে বলো”।
প্রেমধর্মের আদর্শনিষ্ঠা ও তাঁর বহুমুখি আবেদন রবীন্দ্রনাথকে সারাজীবন মুগ্ধ রেখেছিল। ‘সমূহ’ গ্রন্থের ‘দেশহিত’ প্রবন্ধ বাংলাদেশের স্বাদেশিকতার আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি চৈতন্যদেবের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, -
“চৈতন্যদেব একদিন বাংলাদেশে প্রেমের ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন । কাম-জিনিসটা অতি সহজেই প্রেমের ছদ্মবেশ ধরিয়া দলে ভিড়িয়া পড়ে এইজন্য চৈতন্য যে কিরূপ একান্ত সতর্ক ছিলেন তাহা তাহার অনুগত শিষ্য হরিদাসের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ব্যবহারে প্রমাণিত হইয়াছে । ইহাতে বুঝা যায় চৈতন্যের মনে যে প্রেমধর্মের আদর্শ ছিল তাহ কত উচ্চ, তাহা কিরূপ নিষ্কলঙ্ক । তাহার কোথাও লেশমাত্র কালিমাপাতের আশঙ্কায় তাহাকে কিরূপ অসহিষ্ণু ও কঠিন করিয়াছিল। নিজের দলের লোকের প্রতি দুর্বল মমতাকে তিনি মনে স্থান দেন নাই—-ধর্মের উজ্জ্বলতাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার প্রতিই তাহার একমাত্র লক্ষ্য ছিল”।
আরও পড়ুন - অমরত্বের আর এক নাম সুভাষ
চৈতন্য বাঙালি জাতিকে সংযুক্ত করেছিলেন বিশ্বচেতনার সঙ্গে। অখণ্ড ভারতবোধ জাগ্রত করার পশ্চাতেও তাঁর দান অনেক। তিনি দক্ষিণভারত ও উত্তরভারতকে যুক্ত করেছিলেন পূর্ব ভারতের সঙ্গে। কোনও রাষ্ট্রীয় শক্তির সাহায্যে নয়, প্রেমধর্মের মাধ্যমে। সাম্য, মৈত্রী ও ভালবাসা ছিল তাঁর প্রেমধর্মের মূলমন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ তাই লেখেন, “চৈতন্য যখন পথে বাহির হইলেন তখন বাংলা দেশের গানের সুর পর্যন্ত ফিরিয়া গেল। তখন এককণ্ঠবিহারী বৈঠকি সুরগুলো কোথায় ভাসিয়া গেল? তখন সহস্র হৃদয়ের তরঙ্গ-হিল্লোল সহস্র কণ্ঠ উচ্ছসিত করিয়া নুতন সুরে আকাশে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল। তখন রাগরাগিণী ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হইল, একজনকে ছাড়িয়া সহস্রজনকে বরণ করিল। বিশ্বকে পাগল করিবার জন্য কীর্তন বলিয়া এক নূতন কীর্তন উঠিল। যেমন ভাব, তেমনি তাহার কণ্ঠস্বর - অশ্রুজলে ভাসাইয়া সমস্ত একাকার করিবার জন্য ক্ৰন্দনধ্বনি”।
১৯১১ সালের ১৪ই মার্চ চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি উপলক্ষে একটি ভাষণ দেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, - “একদিন চৈতন্য আমাদের বৈষ্ণব করেছিলেন। সে বৈষ্ণবের জাত নেই কূল নেই। আর একদিন রামমোহন রায় আমাদের ব্রহ্মলোকে উদ্বোধিত করেছেন। সেই ব্রহ্মলোকেও জাত নেই দেশ নেই”।
আর সেই বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই। বয়স তখন বারো, তেরো, তখন থেকেই পদাবলী তাঁর প্রাণ। সেই কারণেই অলস, অন্যমনে কিশোর কবি হঠাৎ লিখে ফেলেন, “গহনকুসুম কুঞ্জমাঝে”। সেই হঠাৎ রচনা থেকেই সৃষ্টি ‘ভানুসিংহের পদাবলী’। যে দুটি বৈষ্ণব পদে তিনি সুর দিয়েছেন, তাও বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দদাসের। ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর’ এবং ‘সুন্দরী রাধে আওয়ে বনি’। জ্ঞানদাসের “রজনী শাঙন ঘন, ঘন দেয়া গরজন” পদটি সাহিত্য আলোচনায় বহুবার দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহার করেছেন। শুধু তাই নয়, তার অনুকরণে সোনার তরীর ‘বর্ষাযাপন’ এবং সানাই গ্রন্থের ‘মানসী’ কবিতাটাও লিখেছেন। বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের পদাবলী সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচনা। তিনি লেখেন - “বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডিদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতি বিরহে কাতর হইয়া পড়েন, চণ্ডিদাসের মিলনেও সুখ নাই। বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে সার বলিয়া জানিয়াছেন, চণ্ডিদাস প্রেমকেই জগৎ বলিয়া জানিয়াছেন। বিদ্যাপতি ভোগ করিবার কবি, চণ্ডিদাস সহ্য করিবার কবি”!
রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীতে এত মগ্ন ছিলেন যে, তাঁর যৌবনেই ‘পদরত্নবলী’ সংকলন করেছিলেন। একটি চিঠিতে লিখেছেন, “বৈষ্ণব পদাবলীতে বর্ষার যমুনাবর্ণনা মনে পড়ে। প্রকৃতির অনেক দৃশ্যই আমার মনে বৈষ্ণব কবির ছন্দঝঙ্কার এনে দেয়। তার প্রধান কারণ এই প্রকৃতির সৌন্দর্য্য আমার কাছে শূন্য সৌন্দর্য্য নয়— এর মধ্যে একটি চিরন্তন হৃদয়ের লীলা অভিনীত হচ্চে—এর মধ্যে অনন্ত বৃন্দাবন। বৈষ্ণব পদাবলীর মৰ্ম্মের ভিতর যে প্রবেশ করেছে, সে সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে সে বৈষ্ণৰ কবিতার ধ্বনি শুনতে পায়” ।
শিলাইদহ থেকে আর একটা চিঠিতে দুঃখ করে লিখছেন, - “বরাবর বৈষ্ণব কবি ও সংস্কৃত বই আনি। এবার আনিনি। সেইজন্যে, ঐ দুটোর আবশ্যক বেশি মনে হচ্ছে”।
বৈষ্ণব পদাবলীর প্রেম ও প্রকৃতি বর্ণনার যে অনুভাবনা ধীরে ধীরে কবির মনে দানা বেঁধেছে, তারই স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশ দেখা যায় ‘মানসী’-র বেশ কয়েকটি কবিতায়, -
“আজও আছে বৃন্দাবন মানবের মনে।
শরতের পূর্ণিমায়
শ্রাবণের বরিষায়
উঠে বিরহের গাথা বনে উপবনে।
এখনো সে বাঁশি বাজে যমুনার তীরে।
এখনো প্রেমের খেলা
সারা নিশি, সারা বেলা,
এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয়কুটিরে”।
কখনও বলেছেন, “বর্ষাঋতুর মতো মানুষের সমাজে এমন এক-একটা সময় আসে যখন হাওয়ার মধ্যে ভাবের বাষ্প প্রচুররূপে বিচরণ করিতে থাকে। চৈতন্যের পরে বাংলাদেশের সেই অবস্থা আসিয়াছিল। তখন সমস্ত আকাশ প্রেমের রসে আর্দ্র হইয়া ছিল। তাই দেশে সে-সময় যেখানে যত কবির মন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া ছিল সকলেই সেই রসের বাষ্পকে ঘন করিয়া কত অপূর্ব ভাষা এবং নূতন ছন্দে কত প্রাচুর্যে এবং প্রবলতায় তাহাকে দিকে দিকে বর্ষণ করিয়াছিল”।
পঞ্চভূত গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব ধর্মের একটা ব্যাখ্যাও করেছেন, বলেছেন, - “বৈষ্ণবধর্ম পৃথিবীর সমস্ত প্রেম-সম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিতে চেষ্টা করিয়াছে। যখন দেখিয়াছে মা আপনার সন্তানের মধ্যে আনন্দের আর অবধি পায় না, সমস্ত হৃদয়খানি মুহূর্তে মুহূর্তে ভাঁজে ভাঁজে খুলিয়া ঐ ক্ষুদ্র মানবাঙ্কুরটিকে সম্পূর্ণ বেষ্টন করিয়া শেষ করিতে পারে না, তখন আপনার সন্তানের মধ্যে আপনার ঈশ্বরকে উপাসনা করিয়াছে”।
রবীন্দ্রনাথ আর একটু এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, -
“সেদিন রাধিকার ছবির পিছনে
কবির চোখের কাছে
কোন্ একটি মেয়ে ছিল,
ভালোবাসার-কুঁড়ি-ধরা তার মন।
মুখচোরা সেই মেয়ে,
চোখে কাজল পরা,
ঘাটের থেকে নীলশাড়ি
"নিঙাড়ি নিঙাড়ি' চলা”। (শ্যামলী: স্বপ্ন)।
সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের বৈষ্ণব কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ওই একই কথা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, -
“দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
প্রিয়জনে-- প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই,
তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা!
দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা"।
শুধু ধর্মের ব্যাখ্যা নয়, বৈষ্ণবপদাবলীর ভাব, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন আলোচনা করেছেন। গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতীর নাম তাঁর কবিতার পঙক্তিতে প্রবেশ করেছে অনেকবার। আবার কীর্ত্তন গান সম্পর্কে ২৯ জুলাই ১৯৩৭ সালে দিলীপ কুমার রায়কে এক চিঠিতে বলেছেন, - “কীর্তনগীত আমি অনেক কাল থেকেই ভালোবাসি। ওর মধ্যে ভাবপ্রকাশের যে নিবিড় ও গভীর নাট্যশক্তি আছে সে আর-কোনো সংগীতে এমন সহজভাবে আছে বলে আমি জানি নে। সাহিত্যের ভূমিতে ওর উৎপত্তি, তার মধ্যেই ওর শিকড়, কিন্তু ও শাখায় প্রশাখায় ফলে ফুলে পল্লবে সংগীতের আকাশে স্বকীয় মহিমা অধিকার করেছে। কীৰ্তন-সংগীতে বাঙালির এই অনন্যতন্ত্র প্রতিভায় আমি গৌরব অনুভব করি”।
কীর্ত্তনগান ভালো লাগার আরেকটি কারণ আবিস্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছেন, - “কীর্তনের আরও একটি বিশিষ্টতা আছে। সেটাও ঐতিহাসিক কারণেই । বাংলায় একদিন বৈষ্ণব ভাবের প্রাবল্যে ধর্মসাধনায় বা ধর্মরসভোগে একটা ডেমোক্রাসির যুগ এল । সেদিন সম্মিলিত চিত্তের আবেগ সম্মিলিত কণ্ঠে প্রকাশ পেতে চেয়েছিল । সে প্রকাশ সভার আসরে নয়, রাস্তায় ঘাটে । বাংলার কীর্তনে সেই জনসাধারণের ভাবোচ্ছসি গলায় মেলাবার খুব একটা প্রশস্ত জায়গা হল”।
এছাড়া চৈতন্যদেবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণে। প্রথমের চোখে পড়ে উভয়ের দেহসৌষ্ঠবের দিকে। চৈতন্যদেবের বিপুল জনপ্রিয়তার একটি অন্যতম কারণ অবশ্যই তাঁর দেহকান্তি। চৈতন্যচরিত কাব্যগুলি অনুসরণ করলে দেখা যায় শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন ‘সিদ্ধপুরুষের প্রায় পরম-গম্ভীর’। তাঁর ‘সিংহগ্রীব গজস্কন্ধ’, আজানুলম্বিত ভুজ কমল নয়ন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তাই তো রামানন্দ তাঁকে দেখে বলেছিলেন, -
“সূর্যশত সমকান্তি অরুণ বসন
সুবলিত প্রকাণ্ড দেহ কমল লোচন”
আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোরার রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে, “তাহার গায়ের রঙটা কিছু উগ্র রকমের সাদা … মাথায় সে প্রায় ছয় ফুট লম্বা, হাড় চওড়া, দুই হাতের মুঠা যেন বাঘের থাবার মতো বড়ো … তাহার মুখের গড়নও অনাবশ্যক রকমের বড়ো এবং অতিরিক্ত রকমের মজবুত; … ওষ্ঠাধর পাতলা এবং চাপা; তাহার উপরে নাকটা খাঁড়ার মতো ঝুঁকিয়া আছে। দুই চোখ ছোটো কিন্তু তীক্ষ্ণ”; …
গোরার দেহসৌষ্ঠব রচনায় অবশ্যই আমরা চৈতন্যদেবের প্রভাব লক্ষ্য করতে পারি। তাই তো গোরার ‘হোমের আগুনের’ মত চেহারা দেখে বিস্মিত হরিমোহিনী বলেছিল, “তোমার কথা অনেক শুনেছি বাবা! তুমিই গৌর? গৌরই বটে! ওই-যে কীর্তনের গান শুনেছি—
“চাদের অমিয়া-সনে চন্দন বাটিয়া গো
কে মাজিল গোরার দেহখানি”l
চৈতন্যদেবের মত রবীন্দ্রনাথের চেহারাতেও এমন অমোঘ আকর্ষণ ছিল যাকে এড়িয়ে যাবার সাধ্য কারও ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শী রঘুনাথ দাসের কাছে চৈতন্যদেব ‘হেমাদ্রী’ রূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন। 'গোরা' উপন্যাসের গৌরমোহনের মতোই রবীন্দ্রনাথের চেহারাও ছিল ‘রজতগিরির মতো’ এবং ‘তাহাকে না দেখিয়া থাকিবার জো নাই, সে সকলের মধ্যে চোখে পড়িবেই’। ১৮৯৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে যাবার সময় একবার নবীনচন্দ্রের আহ্বানে রানাঘাটে নামেন। এই উপলক্ষে নবীনচন্দ্রের ‘আত্মজীবনী’তে বত্রিশ বছর বয়সের রবীন্দ্রনাথের একটি বর্ণনা আছে, “দেখিলাম সেই ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দের নবযুবকের আজ পরিণত যৌবন। কি সুন্দর, কি শান্ত, কি প্রতিভান্বিত দীর্ঘাবয়ব। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, স্ফুটনোন্মুখ. পদ্মকোরকের মত দীর্ঘ মুখ, মস্তকের মধ্যভাগে বিভক্ত কুঞ্চিত ও সজ্জিত কেশশোভা…
সুবর্ণোদর্পণোজ্জ্বল ললাট, ভ্রমরকৃষ্ণ গুম্ফ, শ্মশ্রু শোভান্বিত মুখমন্ডল … দীর্ঘ ও সমুজ্জ্বল চক্ষু; সুন্দর নাসিকায় মার্জিত সুবর্ণের চশমা”।
কেবল দৈহিক সৌন্দর্যই নয়, গোরার সঙ্গে গৌরাঙ্গের জীবন ও কর্মধারার সাদৃশ্যও লক্ষ্য করতে পারি। নবদ্বীপের নিমাইয়ের ন্যায় রবীন্দ্রনাথের গোরাও ছোটবেলা থেকে পাড়ায় ও স্কুলে ছেলেদের সর্দারি করত। তার দুরন্তপনায় সকলে অতিষ্ট হয়ে উঠত। আবার বয়সকালে যে কোনও সভায় বক্তৃতা দিতে, নিমাইয়ের মত নেতৃত্বদানে এবং প্রতিপক্ষকে যুক্তি-তর্কে পরাস্ত করতে গোরা ছিল সিদ্ধহস্ত।
প্রথম দিকে গোরার মনে জাতপাত নিয়ে গোঁড়ামি ছিল। হিন্দু-সংস্কার, আচার-আচরণ, সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। কিন্তু গোরা যখন ভ্রমণে বেরিয়ে ভদ্র শিক্ষিত কলকাতা সমাজের বাইরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেশের প্রকৃত অবস্থা ও মানুষের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করল তখন তার যাবতীয় সংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির উদ্ধে মানুষের স্নেহ-ভালবাসা, আবেগ-অনুভূতি, মানবিকতার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই ক্ষুধা-তৃষ্ণায় নিতান্ত ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও দুর্বৃত্ত অন্যায়কারী মাধব চাটুজ্জের বাড়িতে গোরা অন্নগ্রহণ, এমনকি জলস্পর্শ পর্যন্ত করেনা। সে চলে যায় সেই নাপিতের বাড়ি, যেখানে পিতৃহারা মুসলমানের ছেলে মানুষ হচ্ছে, যে নাপিত হিন্দুর হরি ও মুসলমানের আল্লার মধ্যে কোনও তফাৎ দেখে না। এইভাবে গোরার মধ্যে প্রকৃত ভারতবোধের উন্মেষ ঘটে।
এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় শ্রীচৈতন্যদেবের কথা। ষোড়শ শতকে চৈতন্যদেবের মধ্যেই আমরা প্রথম হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-পন্ডিত-বৈষ্ণব, উচ্চ-নীচ জাতি সকলকে একত্রিত করার মত নেতৃত্ব দানের শক্তি লক্ষ্য করে থাকি। তাঁর নেতৃত্বেই সেদিন নবদ্বীপের অসংখ্য মানুষ একত্রিত হয়ে কাজীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বিরাট শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল। যা ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম গণ-আন্দোলন। ঘটনাটা ছিল - মহাপ্রভু যখন প্রবল হরিনাম আন্দোলন শুরু করেছেন কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ ধর্ম ভয়ে ভীত হয়ে নবদ্বীপের শাসক চাঁদ কাজীর কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। কাজী উচ্চস্বরে নাম-সংকীর্তনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য সেই নির্দেশ অমান্য করে সংকীর্তন চালিয়ে যেতে থাকেন। কাজী তখন সেই সংকীর্তন বন্ধ করার জন্য তাঁর পেয়াদা পাঠান এবং তাঁরা সেই সংকীর্তনকারীদের কয়েকটি মৃদঙ্গ ভেঙে দেয়। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতে প্রথম আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা এখান থেকেই হয়েছিল। কাজীর আইন অমান্য করে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সহযোগে বিশাল শোভাযাত্রা শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে নবদ্বীপের রাজপথে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে কাজীর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে। ভীতসন্ত্রস্ত কাজী শ্রীচৈতন্যের আশ্বাস পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে দু’জনের মধ্যে হিন্দু শাস্ত্র ও কোরান সম্পর্কে আলোচনা হয়। শুধু তাই নয়, সেই সময়ে জগাই-মাধাইকেও কৃষ্ণ নাম দ্বারা উদ্ধার করেন। কাজীদলনের পর নগর ভ্রমণে বেরিয়ে নিমাই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ তাঁতী, গোয়ালা, গন্ধবণিক, মালাকার, শঙ্খবণিক, তাম্বুল প্রভৃতি বৃত্তিজীবীদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে অন্তরঙ্গতা স্থাপন করেন।
“নগরে আসিয়া করে বিবিধ বিলাস
সভার সহিত করে হাসিয়া সম্ভাষ”
এমনকি খোলাবেচা শ্রীধরের বাড়িতে তার দুয়ারে পড়ে থাকা লোহার পাত্র থেকে জল পান করেন, -
“নৃত্য করে মহাপ্রভু শ্রীধর অঙ্গণে
জলপূর্ণ পাত্র প্রভু দেখিলা আপনে॥
ভক্ত প্রেম বুঝাইতে শ্ৰীশচীনন্দন।
লৌহপাত্ৰ তুলি লইলেন ততক্ষণ॥
জল পিয়ে মহাপ্ৰভু সুখে আপনার।
কার শক্তি আছে তাহা নয় করিবার”॥
তাই রবীন্দ্রনাথ কাব্যে জানান, “যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা।” এবং বৈষ্ণবধর্মের উদারতার মন্ত্রে দীক্ষিত রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসে ‘গোরা’-র মুখ দিয়ে বলেন, - “আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই, যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না, যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন- যিনি ভারতবর্ষের দেবতা”।
বৈষ্ণব ধর্মে ভালবাসা যেমন মানুষে মানুষে, তেমনি ভগবানে ও মানুষেও। বৈষ্ণবদের মতে ঈশ্বর আনন্দস্বরূপ। তিনি আনন্দময় ভগবানরূপে ভক্তের সঙ্গে লীলা করতে ভালোবাসেন। ভক্ত যেমন ভগবানকে চায়, তেমনি লীলারস আস্বাদনের জন্য ভগবানেরও প্রয়োজন ভক্তকে। এই তত্ত্বটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানের দুটি পঙক্তিতে নিবেদন করেছেন সরলতম ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, -
“তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর, তুমি তাই এসেছ নীচে।
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে”।
অনেকে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ও চৈতন্যদেব বিপরীত মনের মানুষ। জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দবিরহ ও ঈশ্বরানুভবকে চৈতন্যদেব ভাবোন্মদনায় প্রকাশ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সমজাতীয় অভিজ্ঞতাকে কাব্যে, গানে প্রতীক-প্রতিমানে প্রকাশ করেছেন। চৈতন্যদেব সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, আর রবীন্দ্রনাথ তো বলেই দিয়েছেন, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’, মোহই তাঁর মুক্তি, প্রেমই তাঁর ভক্তি। তাই তো ‘বৈষ্ণব কবিতা’-য় লিখলেন, -
“সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান”…
ঋণঃ রবীন্দ্ররচনাবলী। একত্রে রবীন্দ্রনাথ – অমিতাভ চৌধুরি। ইন্টারনেট।
Enter your email address to reset your password.
The very name 'SWADES' denotes the philosophical essence and ideological standpoint of our vision. We envisage serving our 'Swades' by providing news, special stories and literary works of the new generation writers which would cater to the interest of the Nation.
Swades Times © 2020 , All rights Reserved
0 comments