লক ডাউনের পরে

লক ডাউনের পরে

আমার দক্ষিণের একরত্তি বারান্দায় আজ রোদ্দুরটা কেমন ঝলমল করছে নাহ, গত আড়াই মাস সকালে চায়ের কাপ নিয়ে আমি এখানেই বসি। অন্যদিনের থেকে আজকের সকালটা কী একটু অন্য রকম! পাখিগুলো একটু কম ডাকছে কী! বাড়ির সামনে ঠেলা করে সব্জি বেচতে আসতো যে বাপ আর ছেলে, আজ কই এলো না তো! টিং টং করে বেল বাজলো, বাড়িতে আবার কে এলো এই সময়! বেলটা তো বাজেই না প্রায়, গাড়ির হর্ন, বেলের টিং টং কোনো আওয়াজই শুনিনা কতদিন। উঠে দরজা খুলতে দেখি গৌরী, কেমন কুণ্ঠিত মুখে দাঁড়িয়ে। একি চেহারা হয়েছে রে তোর! গেটটা খুলি। ওকে ডাকি, আয়ে গৌরী  ভেতরে। তখনও দেখি বাইয়ে দাঁড়িয়ে ও। কী রে, আয়। বৌদি আমি তো টেরেনে করে এলাম গো। তুমি আমায় কাজে নেবে? 

হঠাৎ যেন আমি বাস্তবে ফিরে এলাম। সত্যি তো। আজ থেকে  তো লক ডাউন উঠে গেল। কত জনের সঙ্গে ভীড় ঠেলে এসেছে মেয়েটা। তার ভেতরে কার কার করোনা আছে, ও কী জানে!! শুধু হাত মুখ ধুলেই কী ভাইরাস গুলো মরবে! কোলাপসিবল গেটের দুপাশে আমরা দুজন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। গৌরীর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে দেখি রাজু, ও আমার জামাকাপড় ইস্ত্রি করে,  না মানে করত। বিজয়গড়ের কাছে বাড়ি। ওটা তো রেড জোন এখন। ভাবতেই শিউরে উঠলাম মনে মনে। আমি আমতা আমতা করে বললাম , রাজু কোথাও তো যাইনা, ইস্ত্রির জামা কাপড় তাই নেই এখন। জমলে,  ফোন করে ডাকব তোমায়, কেমন!  আর গৌরী তুই আরো একমাস পরে আয়ে, আমি তোর মাইনে দিয়ে দিচ্ছি, বুঝতেই পারছিস বাড়িতে ছোট মেয়ে আমার।  এই রোগটা তো বোঝা যায়না  কোথা থেকে হয়ে যায়! মাইনেটা হাতে নিয়ে গৌরী বললো, একমাস পরে আবার ফেরাবে না তো বৌদি!  সত্যি বলতে কি এর উত্তর আমার জানা নেই। তাই চুপ করে রইলাম। মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে গৌরী, জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হওয়া চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে মুখের ভেতরটা পানসে হয় গেল।

ADVERTISEMENT


একটা অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতি হলো। এবার তো সিনেমা হল, স্কুল, বাস, মেট্রো, অটো, টোটো, ট্যাক্সি, মন্দির মসজিদ সব জায়গায় মানুষ আবার আগের মত স্বচ্ছন্দ্য বিচরণ করবে, কিন্তু সেই সঙ্গে ভাইরাসও। উড়বে, গিয়ে বসবে মানুষের চুলে, কানের লতি, গলায়, ঘাড়ে, জামায়  আর দিব্যি আমার আপনার বাড়িতে ঢুকে পড়বে। মাস্ক পরে বাজার করতে রাস্তায় নেমে দেখি হাজার হাজার মানুষ, শয়ে শয়ে গাড়ি। আর মাস্ক শিল্ড, মাস্ক পরা মানুষজন, গা বাঁচিয়ে বা গা ঠেকিয়ে আলুটা পটলটা ডিমটা সব্জিটা কিনছেন। আর আমি দেখছি আমার চারপাশ ঘিরে ধরেছে ভাইরাসে, আমি বাজার করতে পারছি না। সব্জি ফল ফুল সবেতেই থিক থিক করছে ভাইরাস। আমার সর্বাঙ্গে গেঁড়ে বসে যাচ্ছে ভাইরাসগুলো। আমি প্রায় ছুটছি বাড়ির দিকে, বাড়ি ঢুকে আমায় চান করতে হবে, ধুয়ে ফেলতে হবে সব। পোশাক, বাজারের ব্যাগ, চশমা, ঘড়ি, মাস্ক সব ধুয়ে ফেলতে হবে। আমায় সবাইকে নিয়ে একটা ভাইরাসহীন জীবন তো কাটাতেই হবে। বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে সবাইকে। কিন্তু মনের  ভেতরে যে ভয়ের, অবিশ্বাসের, আশঙ্কার আর দুশ্চিন্তার ভাইরাসটা  আছে, কোন স্যানিটাইজার দিয়ে সরাবো ওকে, কোন সাবানে ধুয়ে মুছে সাফ করব!!

 

0 comments

Illora Chattopadhyay

Illora Chattopadhyay

জন্মসূত্রে বড় হওয়া উত্তরপাড়ায়। সংস্কৃত সাহিত্যে এম.এ পাশ করার পর ১৫ বছর হুগলী জেলার একটি গ্রামীন আধাসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা । সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করলেও প্রিয় বিষয় বাংলা। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা চিরকালীন। মাঝে কিছুদিন পত্র পত্রিকায় বইয়ের রিভিউ লেখা। তারপর দীর্ঘদিনের বিরতি। প্রাণের টানে আবারও ফিরে আসা সাহিত্যের প্রাঙ্গণে। তবে এবারে শুধু আর পুস্তক আলোচনা নয়, তার সঙ্গে মৌলিক লেখালেখির শুরু। মূলত সোশাল মিডিয়ায়। তারপর থেকে বিভিন্ন ওয়েবম্যাগ, কাগজের পত্রপত্রিকাতে নিয়মিত লিখে চলা।যদিও নিজেকে লেখক নয়, পাঠক মনে করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি।

FOLLOW

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait