সমাজতন্ত্রী বিবেকানন্দ

সমাজতন্ত্রী বিবেকানন্দ

আমরা কমবেশি প্রায় সবাই স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক মানসিকতা নিয়ে বেশ কৌতুহলী। আচ্ছা, স্বামী বিবেকানন্দ কি হিন্দুত্ববাদী ছিলেন? এই প্রশ্নও মাথায় ঘুরপাক খায় বৈ কি। আবার, বাম মনোভাবাপন্ন মানুষরা বলে থাকেন যে, ‘স্বামী বিবেকানন্দ একজন আদ্যন্ত বামপন্থী ছিলেন। কেননা, তিনি আদ্যন্ত সাম্যবাদী মানুষ ছিলেন। আর, গরীব তথা দরিদ্র মানুষের সেবাকার্যকে ঈশ্বরের সেবা বলেছিলেন।এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো যে, স্বামীজীর আপন ভাই শ্রীভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট। ভারতে কমিউনিজমের অন্যতম প্রবক্তা শ্রীমানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় সহ অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতা এমনকি রাশিয়ান নেতা লেনিন-এর সাথেও তাঁর বিশেষ পরিচয় ছিল বলে জানা যায়। যদিও তিনি কখনোই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিআই-এর আনুষ্ঠানিক সদস্য ছিলেন না। কিন্তু সিপিআই-এর সাথে ছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পরবর্তীকালে এমনকি বর্তমান সময়েও স্বামীজী সম্পর্কে বাম ও নব্য বামেদের মূল্যায়ণ মোটেও সঠিক ছিল না এবং এখনও তা পুরোপুরি নির্ভুল নয়। বামেদের একাংশের কাছে স্বামীজী হলেনভণ্ড সন্ন্যাসীআমেরিকার দালালস্বামীজী নিজেই সাম্যবাদ (যা বামপন্থা বা কমিউনিজমের পরাকাষ্ঠা) -এর ব্যাপারে আশাহত হয়ে বলেছিলেন, ''...যথার্থ সাম্যবাদ জগতে কখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নাই এবং কখন হইতেও পারে না।'' আচ্ছা, মানুষে মানুষে এই যে প্রভেদ, এই যে ভেদাভেদ এর কারণ কি?

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

 

স্বামীজী এর কারণ হিসেবে বলেছেন, "প্রধানতঃ মস্তিষ্কের ভিন্নতা। আজকাল পাগল ছাড়া কেহই বলিবে না যে, আমরা সকলে একরূপ মস্তিষ্কের শক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি। ভিন্ন ভিন্ন শক্তি লইয়া আমরা জগতে আসিয়ছি। কেহ বড় কেহ বা সামান্য হইয়া আসিয়ছি, জন্মের পূর্বে নির্ধারিত পরিবেশ অতিক্রম করা যায় না।" অর্থাৎ, যাঁরা বলে থাকেন যে, "আমরা সবাই এক" তাঁদের উদ্দেশ্যে স্বামীজী বুঝিয়ে গেছেন যে তাঁরা কাল্পনিক রাজ্যে বসবাস করছেন। সবাই কখনও এক হবে বা এক হতে পারে এমনটা ভাবাটাই অস্বাভাবিক। কেননা, প্রত্যেকেরই নিজস্ব নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে, দোষ-গুণ রয়েছে। এই পৃথিবীতে সবাই আলাদা আলাদাভাবে এসেছি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমরা সবাই মানুষ কিন্তু আমরা কেমন তৈরি হব কিন্তু আমরা কেমন তৈরি হব তা আমাদের চারপাশের পরিবেশও নিয়ন্ত্রণ করে। জন্মের আগে নির্ধারিত পরিবেশের প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না।

 

অন্যদিকে, যাঁরা কট্টর গো-রক্ষক অথচ দুঃস্থ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাবার অভিপ্রায় যাঁদের নেই তাঁদেরকেও নিতান্তই 'গো-সন্তান' বলে আখ্যা দিয়েছেন। সে এক অন্য গল্প। যাঁরা ধর্মীয় মৌলবাদী বা কট্টরপন্থী সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, স্বামীজীর মতে তাঁরা "মজ্জাগত দূর্বলতা সম্পন্ন, বিকৃতমস্তিষ্ক অথবা বিচারশূন্য ধর্মোন্মাদ।" তাহলে, স্বামীজীর মতাদর্শ কি ছিল। এ ব্যাপারে, স্বামীজী নিজেই বলে গেছেন, "...আমি একজন সমাজতন্ত্রী (Socialist), তার কারণ এই নয় যে, আমি ঐ মত সম্পূর্ণ নির্ভুল বলে মনে করি, কেবল 'নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল'– এই হিসেবে।" অর্থাৎ, স্বামীজী অন্য কোনও উপায়ান্তর না দেখে বা তেমন ভালো মতাদর্শ না পেয়ে সভাজতন্ত্রেই ভরসা রেখেছিলেন। স্বামীজীর মতে যে কটা প্রথা জগৎ জুড়ে চলছে তাদের কোনও না কোনও ত্রুটি ধরা পড়ছে। স্বামীজীর মতে, "অন্তত আর কিছুর জন্য না হলেও অভিনবত্বের দিক থেকে এটিরও (সমাজতন্ত্রেরও) একবার পরীক্ষা করা যাক। একই লোক চিরকাল সুখ বা দুঃখ ভোগ করবে, তার চেয়ে সুখ-দুঃখটা যাতে পর্যায়ক্রমে সকলের মধ্যে বিভক্ত হতে পারে, সেইটাই ভাল।"

 

অর্থাৎ, এখানে তিনি একের বা সমাজের সুখ-দুঃখের বিষয়টির সমান বিতরণ চাইছেন যা সমাজতন্ত্রের অন্যতম মূল কথা। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে পৃথিবীর অনেক নামকরা মহাপুরুষই সমাজতন্ত্রের পক্ষে সায় বা সমর্থন জানিয়েছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মহাবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (যিনি ১৯৪৯ সালের মে মাসে লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত প্রবন্ধ 'Why Socialism?'), বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিখ্যাত রম্য লেখক ও সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন, বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর পাবলো পিকাসো, বিখ্যাত প্রতিবন্ধী লেখিকা ও রাজনৈতিক কর্মী হেলেন কেলার, বিখ্যাত আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র সহ অনেকেই। স্বামীজীও তাঁদের ব্যতিক্রমী নন। 

 

স্বামীজী ছিলেন নিজে একজন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী। তবুও তিনি জড় সভ্যতা বা বস্তুবাদের বিপক্ষে ছিলেন না। তিনি নিজে জানাচ্ছেন– "আমরা নির্বোধের মতো জড় সভ্যতার বিরুদ্ধে চিৎকার করিতেছি। না করবই বা কেন? হাত বাড়াইয়া না পাইলে 'আঙুর টক' বলিব না তো কি!" অর্থাৎ, বস্তুবাদ বিরোধীদের তিনি 'শেয়াল ও আঙুর'-এর সেই গল্পটা টেনে ব্যঙ্গই করেছেন। শেয়ালটি গল্পে যেমন গাছে ঝোলা আঙুরগুলো না ধরতে পেরে সেই আঙুরগুলো টক বলে উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিল ঠিক তেমনি জড় সভ্যতার বিরোধীদের অবস্থাও তেমন। আচ্ছা, 'জড় সভ্যতা'-র বিরোধিতা করবই বা কেন? জড় সভ্যতাও তো দরকার। এ জগতে চলতে গেলে বস্তুবাদও তো দরকার। কেননা, স্বামীজীর কথায়, "বাহ্য সভ্যতা আবশ্যক, শুধু তাহাই নহে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তুর ব্যবহারও আবশ্যক, যাহাতে গরীব লোকের জন্য নূতন নূতন কাজের সৃষ্টি হয়।" অর্থাৎ, বাস্তবিক জগতে 'বস্তু'-কে কিন্তু অস্বীকার করা যায় না।

 

স্বামীজীও ব্যক্তিগত জীবনে খুব আয়েশি ও খাদ্যপ্রেমী ছিলেন। তিনি সন্ন্যাসী হয়েও বস্তুবাদ বা জড়বাদকে অস্বীকার করেননি কোনও দিন। একবার খুব সম্ভবত কোনও এক সাধু স্বামীজীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি কোন সম্প্রদায়ের পুরী না নাথ সম্প্রদায়ের? স্বামীজী উত্তরে বলেছিলেন যে তিনি 'কচুরী' সম্প্রদায়ের। স্বামীজীর খাদ্যপ্রেম সর্বজনবিদিত। উনি খুব ইলিশ মাছ খেতে ভালোবাসতেন। আমিষ-নিরামিষ এর বাছবিচারে বলতেন যে, "(আমিষ খাবার) খুব খাবি বাবা যা পাপ লাগবে তা আমার।" এদেশের যুবকদের ক্ষীণ চেহারা তাঁকে ব্যথিত করত তাই শরীর সতেজ রাখতে  আমিষ খাওয়ার কথা বলতেন।   যুবকদের বলতেন‌ যে গীতাপাঠের চেয়ে ফুটবল খেললে স্বর্গের কাছাকাছি বেশি পৌঁছতে পারবে। স্বামীজী যুবকদের পুজো-আর্চা, ঘর বন্ধ করে কেবলমাত্র ধ্যান করে যাওয়া নয় বরং রাস্তায় নেমে দরিদ্র অসহায় মানুষের সেবা তথা দেশসেবা করতে বলতেন। তিনি একটি গল্পে বলেছিলেন যে, সংসারে থেকেও সাধনা করে আধ্যাত্মবাদী হওয়া সম্ভব আর তার জন্য জঙ্গলে সাধু হয়ে সাধনা করতে হয় না। বরং এ সমাজ চালনার ক্ষেত্রে একজন সাধু বা সন্ন্যাসীর থেকেও অনেক বেশি অবদান রাখে সংসারী মানুষজন। দিনরাত অন্য কোনও কাজ না করে কেবলমাত্র ঠাকুরের জপনাম করার পক্ষপাতি ছিলেন না তিনি। নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ের বইও পড়তেন তিনি। আজ তাঁর প্রতিষ্ঠিত মঠ ও মিশন শিক্ষা,স্বাস্থ্য, আর্তের সেবা তথা জীবসেবা, দেশসেবা ও আধ্যাত্মবাদ সমস্ত বিষয়েই দেশে ও বিশ্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। শ্রীমা সারদাদেবীর কাছে যখন কেউ সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য আসতেন তখন কাউকে কাউকে শ্রীমা বলতেন যে সবাই সন্ন্যাস নিলে এদের (সাধু-সন্ন্যাসীদের) দেখবে কে? তাই বস্তুবাদও দরকার, অল্পবিস্তর ভোগও দরকার আর তাহলেই তো ত্যাগের মাহাত্ম্য থাকে। 

 

স্বামী বিবেকানন্দের মতে কোনও ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে ধার্মিক হওয়া নয় বরং ভালো মানুষ হওয়া ও ভালো‌ কাজ করাই হল সমগ্র ধর্ম। এইসব কথা সমাজতন্ত্রীর মূল পরিচয় বহন করে। তিনি প্রথাগত দেব-দেবী মূর্তি পূজা-আর্চা নয় বরং মানুষ তথা জীবের সেবাকেই ঈশ্বরের সেবা বলে আখ্যায়িত বলেছেন যার প্রতিফলন পাই তাঁর সেই বিখ্যাত বাণীতে — “বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুজিছ ঈশ্বর ? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। এই সামাজিক জীব মানুষকে দেবতাজ্ঞানে সেবা করা এও এক অসাধারণ সমাজতান্ত্রিক পরিচয়। স্বামীজী অন্নের কথা বলেছিলেন। অন্ন দরকার, বাঁচার জন্য খাদ্য দরকার। অন্ন সম্পর্কে তাঁর সেই বিখ্যাত বাণী দিয়েই এই লেখাটি শেষ করছি। স্বামীজীর কথায়, "অন্ন! অন্ন! যে ভগবান এখানে আমাকে অন্ন দিতে পারেন না, তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখিবেন ইহা আমি বিশ্বাস করি না।" অর্থাৎ, জীবন ধারণের জন্য ধর্মের পাশাপাশি বা তার থেকেও বেশি প্রয়োজন অন্নের তথা খাদ্যের। স্বামীজী তাই পরোক্ষে বলে গেছেন। স্বামীজীর কথায় খালি পেটে ধর্ম হয় না। তাই, অন্ন তথা খাদ্যের উপকারিতা ধর্মীয় আচারের চেয়েও বেশি। একজন সমাজতন্ত্রীও তাই বিশ্বাস করেন। 

 

তথ্যসূত্রঃ– 

লেখাটির তথ্যসূত্র মূলত রামকৃষ্ণ মিশন লোকশিক্ষা পযিষদ, নরেন্দ্রপুর থেকে প্রকাশিত 'বিবেকরশ্মি' নামক গ্রন্থের 'সমাজ' 'এ যুগের মূলমন্ত্র ' অধ্যায়। এছাড়া আরও অন্যান্য গ্রন্থ, উইকিপিডিয়া, উইকিসংকলন, ফেসবুকের পোস্ট ইত্যাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। 

 

—---------------------------------x--------------------------------------------------------


 

লেখক পরিচিতিঃ- বর্তমানে একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে গণিতের সহকারি অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। বিজ্ঞান শিক্ষক ও বিজ্ঞান বিষয়ক সহ নানা প্রবন্ধের লেখক।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait