সরলা বনাম কদম

সরলা বনাম কদম

সরলা সেদিন শ্বশুরবাড়ি এল, সেদিন ও এই দুই কামরার ফ্ল্যাটে এই জানলার ধারে একা এসে কয়েক মিনিটের জন্য দাড়িয়ে ছিল। জানলার গ্রিল ধরে ও কি যেন সব ভাবছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা এইছিল, তার আবার নতুন জীবন শুরু হল। আর ঠিক সেই সময় ফ্ল্যাটে পাশে পরে থাকা ফাঁকা জায়গাতে একটি লোক এসে একটি কদম চারা লাগাচ্ছিল। সরলা মন দিয়ে দেখছিল আর ভাবছিল আমার মত ওকেও কোন বড় আশ্রয় থেকে এনে এখানে পতিত করল।

আর যেন তার মালিক তাকে বলে গেল – “তুমি এবার নিজে সবকিছু প্রতিহত করে বাঁচো।”

সরলা এবার ভাবছে ও এখানে এসেছ,- “এইভাবে নতুন এক জীবনে বাঁচার জন্য আমার মা-বাবা দিয়ে গেল।”

তারপর থেকে ও যখনই সময় পায় ওই গাছটিকে দেখে। আর ওকে দেখে নিজের কথা ভাবে। সরলার শ্বশুরবাড়িটা মোটামুটি ধনী ছিল। কিন্তু দুরারোগ্য ওর স্বামীর তেমন আয় ছিল না। কি আর করা যায় বাবা-মা দেখা পাত্র যেমনই হোক মেনে নিতে হবে। তাই ও চেষ্টা করল, নিজে কিছু করবে। আর ওই গাছটিকে দেখে ও সাহস পেত। গাছটি প্রথম দিকে একদম মরেই গিয়েছিল প্রায়। ঠিক সরলার মতো, কিন্তু আস্তে আস্তে পাতা গজাতে লাগল। ও নিজেকে নরম শক্ত মাটি আঁটকে বাঁচার লড়াই লড়তে লাগলো। ঠিক এই রকম সরলাও জীবনযুদ্ধে পা বাড়াল। ওর সংসারে অর্থের স্বছল অবস্থা আনতে একটা ব্যবসা শুরু করল। আর একটু একটু করে সব বাধা অতিক্রম করে ব্যবসাটা দাড় করাতে লাগল। ঠিক অপর দিকে কদম গাছটিও সব প্রতিকুল অবস্থা জয় করে সুন্দরি হয়ে উঠল। ওর কত শাখাপ্রশাখা হল। এই জমিটায় মাথা তুলে দাড়িয়ে যেন জানান দিত ওর মালিককে, যে দেখ আমি নিজেকে ঠিক রক্ষা করতে পেরেছি। আস্তে আস্তে ওর শাখাপ্রশাখা কুড়ির জন্ম হল। তারপর সুন্দর সুন্দর কদম ফুল সরলার প্রতিদিনের একটা বাঁধাধরা কাজ ছিল, জানলার গ্রিল ধরে ওকে একবার দেখা।

ADVERTISEMENT


ওকে দেখে সরলার মনে আসত, সাহ্‌স, আর প্রেমের জোয়ার। কদম গাছটি যখন পরিপূর্ণ হল তখন ওর গাছে কত পাখি, আস্ত টিয়া, শালিক, কাক, কোকিল, আর কতকি। ওরা ডাকত ভোর বেলা। আবার বিকালবেলা মাঝে মাঝে কলরব করত। কিন্তু বসন্ত এলে দুটি কোকিল ডাকত, কি সুন্দর শুনতে লাগত। সবার শুনতে শুনতে হয়ত ফ্ল্যাটের কিন্তু সরলা মন দিয়ে শুনত।

প্রতিটা কাল কদমগাছ জানান দিত। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত, ও বসন্ত। গরমকালে ওর হাওয়া জানালা দিয়ে ঘরে এসে পৌঁছাত। গরমকালে ওর ডালে ডালে ফুল ভরে উঠত।

আর সুন্দর গন্ধে ভরে উঠত বাতাস। সরলার বেশি সুন্দর গন্ধ লাগত কারন ও তো কদম গাছটিকে ভালোবাসতো। ওটা ভালোবাসার গন্ধ বলে সরলার মনে হত। আর ঠিক বর্ষাকালে ফুলগুলো মাটিতে ঝরে পরত। আর বর্ষার জলে পচে কাজে গন্ধ বেরত। বাড়ির সবাই বিরক্ত হয়ে বলত কদমফুল পচার বাজে গন্ধ,।কিন্তু সরলার বাজে লাগত না, কারন ও হয়তো গাছটিকে ভালোবাসতো বলে। সবাই ভাল ওর গুনগায় আবার সেই ভালকেই কেমন একনিমেষে বাজে করে দেয়। সরলা ভাবত ঠিক ওর মত ওরা ওকে ট্রিট করে।


নিজেই মনেই বলত, কারন যখন ব্যবসা করে এনে টাকা দেয় সংসারে তখন তাকে ভালো বলে উৎসাহ দেয়। আবার যখন বাড়ির কাজগুলো পড়ে থাকে ও সময়ের অভাবে করতে পারে না, ওরা সবাই রাগ ঝগড়া করে। ওকে নানা কথার খোঁটা দেয়। যাক সেইসব কথা। সরলারও একটি সন্তান আছে। ওর জন্য সরলাকে সব সহ্য করতে হয়, কি বা করবে। আবার শীতকালে কদমগাছটির সব পাতা ঝড়ে যায়।

এইভাবে বসন্তকালে পাতার সাথে কোকিলের কুহু ডাকও কদমগাছটি শোনায় আর জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে। কদমগাছটি যদি ওখানে না থাকত তাহলে এমন ভাবে কোকিলের সুর শোনা হত না। সরলার এইভাবে দুজনে যেন দুজনের পৃথিবী তৈরি করেছিল। ভালোমন্দে বেশ কাটছিল ওদের জীবন।

হটাৎ করে কোথা থেকে করোনা এসে সরলার জীবন ওলটপালট করে দেবার উপক্রম। কতদিন কোন কাজ নেই। টাকা উপার্জন নেই। জমানো টাকায়ই সংসার চলছিল। আজ খুলবে ব্যবসা কাল খুলবে এই আশাতেই দিন কাটছিল। যেমন-তেমন করে। ওর কিছু ওই কদমগাছটি দেখা থেকে বিরত হয়নি কোনদিন। পয়সা কমে আসছিল আর কত দুশ্চিন্তা জমা হচ্ছিল মনে কি হবে আগামী দিনে। সব ঠিক হবে ত?

ঠিক সেইসময়ে এই ঝড়ের নাম বলল খবরে। “আম্ফান” নাকি সব কিছু উড়িয়ে ভেঙ্গে দুমড়ে, মুছরে, ক্ষতি করবে আমাদের। ভয়ত হচ্ছিল সরলার একটু কিন্তু স্বপ্নেও ভাবে নি, কদমগাছটির এত ক্ষতি হবে।কিন্তু লড়াই করেছিল ঝড়টির সাথে। সরলা ঝড় আসার আগে পর্যন্ত কদমগাছটিকে দেখে জানলা বন্ধ করেছিল। তখন খুব হাওয়ার দাপট ছিল সরলা দেখেছিল বাঁচার লড়াই করছে। কিন্তু সরলার মনে একবারও আসেনি ওর এমন অবস্থা হতে পারে। রাতে যখন ঝড় প্রায় কমে এসেছিল তখন সরলা জানলাটা খুলে দিয়েছিল। আর খুলেই দেখল গাছটির যেটা বেড়ে ওঠার মাথা ছিল সেতা ভেঙ্গে গেছে। ঠিক সরলার সংসারের অর্থের সমাগমের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।


বাঁচার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে আর মন থেকে একটু একটু করে মরে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় কদমগাছটির উপর করোনা বনাম আম্ফান এসে ওর মৃতপ্রায় করে দিয়ে গেল। যেন সেই নতুন শ্বশুর বাড়ি আসার দিন মনে পড়ে গেল সরলার। আবার নতুন করে বাঁচার লড়াই শুরু হল। ওরা দুজনে বেঁচে থাকবে নাকি মরে যাবে, এবার সময় বলবে। সেই দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে বাঁচার লড়াই শুরু হল। সরলা বনাম কদম।   
 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait