প্রেম শুধু একজোড়া ছেলে মেয়ের মধ্যেই হয় না, মানুষের সাথে মানুষের হয়। সেই প্রেম কোনো প্রেমই নয়, যার দ্বারা কারো উপকার না হয়। তাই এই প্রেমের সপ্তাহে নিজের মনের কিছু ভাবনা সাজিয়ে তিনটি অণুগল্প লেখার ক্ষুদ্র প্রয়াস করলাম।
অণুগল্প - ১
রোজ ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাত বারোটা অবধি সংসারের সব কাজ সামলে নাজেহাল অবস্থা হয় মনিমালার। ঝকঝকে রত্নে তাই ইদানিং একটু মরচে পড়েছে বোধহয়। শত প্রসাধনীর আড়ালেও তাই চোখের তলার কালিটা ঢাকা পরে না ঠিকঠাক। বিয়েটা সম্বন্ধ করে হলেও প্রেম কি একেবারেই ছিল না? নাকি আজ তার কতটুকুই বা অবশিষ্ট? তাই মনিমালা যখন ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলোকে ওই প্রেম দিবস না কি যেন উদযাপন করতে দেখে, ভাবে তার বরটাও যদি তাকে একটা উপহার এনে দিতো!! ভেবেই নিজের মনে হেসে ফেলে। তাদের আবার প্রেম দিবস।
ADVERTISEMENT
বিকেলবেলা কাজ থেকে তার সাদাসিধে বর ঘরে ফিরে আসে। রাতের বেলা বাচ্ছা মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়লে মনিমালার হাতে একটা ডার্ক চকোলেট ধরায়। জীবনে এই প্রথমবার। বলে, "ইচ্ছে হলো"। মুখে বোকা বোকা হাসি। একটু চকোলেট ভেঙে ধরে বৌয়ের মুখের কাছে। মনিমালা বলে, "আজ থাক। রাত হয়েছে, কাল মেয়েটা ঘুম থেকে উঠলে তিনজনে একসাথে খাবো এটা"। তাদের দেখে মনে হয়, প্রকৃত প্রেম স্বাচ্ছন্দে নয়, স্বছন্দে প্রকাশ পায়।
অণুগল্প - ২
ছোটো থেকেই দেখতে ভালো নয়, তার ওপর গায়ের রংটা ফর্সা নয় অস্মিতার। আত্মীয় স্বজন তার বাবা মাকে বলতো, এ মেয়ের বিয়ে দিতে পারলে হয়। সুন্দরী বান্ধবীদের প্রেমে পড়ার গল্প শুনতে শুনতে আর তাদের বয়ফ্রেন্ড দের থেকে পাওয়া দামী উপহারগুলোর বর্ণনা শুনতে শুনতে তার মনে হতো, অভাবের সংসারে এই একটা উপহারের টাকায় তাদের কদিনের খাওয়া জুটে যেত হয়ত। কিন্তু ওই রঙিন গল্পগুলোর থেকে এক ঝটকায় নিজেকে টেনে আনতে হতো বাস্তবের মাটিতে, কলেজ সেরে টিউশন পড়িয়ে রাতে বাড়ি ফিরে খুব ইচ্ছে করতো শরীরটাকে এলিয়ে দিতে বিছানায়। কিন্তু উপায় নেই। সেও যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তার প্রেমের কাছে।
ভিন রাজ্যের কোনো এক জেলার সরকারি কোয়ারটারে সাব ডিভিশনাল অফিসার অস্মিতা বসু তাঁর পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। বড় কাজ, বিরাট দায়িত্ব আজ তাঁর মাথায়। দোকানে কাজ করা বাবা, রোগে ভোগা মা আর অভাবের সংসারের কাছে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বড় হবেন, আজ হয়ে দেখিয়েছেন। সেই অদম্য জেদ তাঁকে সাফল্য দিয়েছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে। তবে বিয়েটা আজও তাঁর করা হয়ে ওঠে নি, কি করবেন, যোগ্য পাত্র পেলেন না যে!
অণুগল্প - ৩
রাস্তার ধারে ছোটো ধাবাটায় রোজ চায়ের কাপ ধুতে দেখে ছেলেটাকে আই টি সেক্টর এ কর্মরত অভিক। মাঝে মাঝে ওই ধাবায় চা জলখাবার খেতে যায় বন্ধু বান্ধব সহ। ছেলেটা খাবারের প্লেট এগিয়ে দেয়। একদিন অভিক টাকাভর্তি পার্স টা খুঁজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষন আগেই তো পার্স থেকে টাকা বের করে ধাবায় পে করলো। বন্ধুরা বললো, "ও আর পাবি না, নির্ঘাত ওই ছেলেটা ঝেড়েছে"! অভিক ও ভাবলো আর আশা নেই, হাজার চারেক টাকা ছিল, তবু পরের দিন আশায় আশায় ওই ধাবায় গেলো। ছেলেটা বললো, "দাদা, তোমার টাকার ব্যাগ, কাল ফেলে রেখে গেছিলে চেয়ারের ওপর, ভাগ্যিস আমি দেখতে পেলাম, অন্য কেউ দেখলে ফেরত দিতো না হয়ত"। অভিক গুনে দেখলো টাকা ঠিক আছে। এর আগে কোনোদিন ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করেনি অভিক। আজ জিজ্ঞেস করলো। ছেলেটার নাম দেবা, কাছেই থাকে বিধবা মাকে নিয়ে, মা লোকের বাড়ি বাসন মাজে। পড়াশোনায় মন নেই বলে মা তাকে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ছেলের ফুটবল খেলায় খুব মন।
দেশজোড়া খ্যাতি ফুটবলার দেবব্রত গায়েন এর। এখন তিনি অবশ্য কোচ, তাঁর একাডেমিতে অনেক ছেলে ফুটবল খেলা শেখে। কিন্তু যখনই তাঁকে ইন্টারভিউ করা হয়, তখন তিনি জানাতে ভোলেন না তাঁর অভিক দার কথা, যিনি একদা জোর করে ফুটবল একাডেমি তে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন তাকে, তার সব ব্যয়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। অভিক দা না থাকলে আজও হয়ত তিনি কোনো চায়ের দোকানে...
0 comments