২৬ জানুয়ারি – ইরাবতী’র তীরে নেতাজী চেয়েছিলেন পূর্ণ স্বরাজ – আজ যা প্রজাতন্ত্র দিবস - সংবিধানের জন্মদিন
১৯৩০-এর ২৬ জানুয়ারি সারা দেশ জুড়ে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আনন্দ উৎসব উদ্যাপিত হবে, কিন্তু সুভাষচন্দ্রের এমনই ভাগ্য, তার ক’টা দিন আগেই লাহোর থেকে কলকাতা ফেরার পর তাঁর জন্মদিনের দিন অর্থাৎ ২৩শে জানুয়ারি তিনি গ্রেপ্তার হলেন। দেশের সেই প্রথম স্বাধীনতা দিবসে আনন্দ উৎসবে যোগ দেওয়া থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন। আর আজ যে আমরা ২৬শে জানুয়ারি দিনটি প্রজাতন্ত্র বা সাধারণতন্ত্র দিবস হিসাবে পালন করে থাকি একসময় আমরা এই দিনটাকে স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করতাম। চলুন, কয়েক বছর পিছিয়ে গিয়ে একবার ইতিহাসটা জেনে নেওয়া যাক।
ADVERTISEMENT
সময়টা ১৯২৮ সাল। কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশন চলছে, তরুণ নেতা সুভাষচন্দ্র মিলিটারি ইউনিফর্ম পরে ঘোড়ায় চড়ে ভলান্টিয়ার বাহিনী পরিচালনা করছেন আর সেই অধিবেশনে সভাপতি হচ্ছেন মোতিলাল নেহরু। মহাত্মা গাঁধী প্রস্তাব এনেছেন, ব্রিটিশ সরকারের কাছে কংগ্রেসের দাবি ডোমিনিয়ন স্টেটাস। তরুণ সুভাষচন্দ্র— প্রস্তাবের পরিবর্তন করে বললেন, ডোমিনিয়ন স্টেটাস নয়, চাই পূর্ণ স্বরাজ। গাঁধীজি বুঝিয়ে বললেন, তিনি ব্রিটিশ সরকারকে এক বছর সময় দেবেন। এক বছরের মধ্যে ডোমিনিয়ন স্টেটাস না দিলে তিনি নিজেই পূর্ণ স্বরাজ দাবি করবেন। গাঁধীজি কিন্তু কথা রেখেছিলেন, তবে সুভাষচন্দ্র ততক্ষণে এক ধাপ অগ্রসর হয়ে গিয়েছেন।
ঠিক একবছর পর। সময়টা ১৯২৯-এর ডিসেম্বর। লাহোরে ইরাবতী নদীর তীরে কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতি জওহরলাল নেহরু। মহাত্মা গাঁধী পূর্ণ স্বরাজ দাবি করে প্রস্তাব আনলেন। সুভাষচন্দ্র প্রস্তাব করলেন, শুধু পূর্ণ স্বরাজ নয়, আমরা নিজেদের প্যারালাল গভর্নমেন্ট, সমান্তরাল সরকার ঘোষণা করব। তারপর, লাহোর কংগ্রেসে ঘোষণা হল, ১৯৩০-এর ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস প্রতিপালিত হবে, দেশ জুড়ে আনন্দ উৎসব উদ্যাপিত হবে।
তারপর এসে গেল ১৫ অগস্ট, ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ক্ষমতা হস্তান্তর। দেশের নেতৃত্ব মেনে নিলেন, সে দিন থেকে আমাদের স্বাধীনতা দিবস হল ১৫ অগস্ট। তবে ২৬ জানুয়ারিকে আমরা মনে রাখলাম অন্য ভাবে। স্বাধীন ভারতের সংবিধান যে দিন চালু হল আমরা নিজেদের স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করলাম। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি আমাদের ‘রিপাবলিক ডে’ হিসেবে ঘোষণা হল। মহাত্মা গাঁধী নাম দিয়াছিলেন, স্বতন্ত্রতা সঙ্কল্প দিবস। শেষ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনের শিকল ভেঙে ভারত সত্যিই স্বাধীনতার মুখ দেখল আর ভাগ্যের সাথে গাঁটছড়া বাঁধল ১৫ অগস্ট। ফলত ২৬ জানুয়ারির অভিধাও ক্রমে পাল্টে গেল। আড়াই বছর পর দেশের প্রথম সংবিধান প্রস্তুত করার জন্য একটি শুভদিন দেখে তা কার্যকর করবার দরকার পড়ল। এবং সেই সূত্রে বেছে নেওয়া হল ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যে পূর্ণ ২৬ জানুয়ারি দিনটিকেই। সেই থেকে বিংশ শতকের ভারতে যা ছিল স্বাধীনতা দিবসের প্রথম দাবিদার, সেই ২৬ জানুয়ারির পরিচয় ভারতীয় জনসাধারণের কাছে এসে হল: প্রজাতন্ত্র দিবস।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় গণপরিষদ সংবিধান কার্যকরী হলে ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কার্যকরী হওয়ার ঠিক দুই মাস আগে, ১৯৪৯ খ্রিঃ ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক ভারতের সংবিধান অনুমোদিত হয়। আগেই বলেছি, ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে সংবিধান কার্যকর করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ ১৯৩০ খ্রিঃ ঐ একই দিনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক পূর্ণ স্বরাজের সংকল্প ঘোষিত ও গৃহীত হয়েছিল।
১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ এ দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলে ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পায়। স্বাধীনতা লাভের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয় যুক্তরাজ্যের সংসদে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশ হওয়ার মাধ্যমে। এর ফলে ব্রিটিশ ভারত ভেঙে গিয়ে কমনওয়েলথ অফ নেশনস-এর অন্তর্গত অধিরাজ্য হিসেবে দু'টি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়। ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ এ ভারত স্বাধীন হলেও দেশের প্রধান হিসেবে তখনও বহাল ছিলেন ষষ্ঠ জর্জ এবং লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন ছিলেন এর গভর্ণর জেনারেল। তখনও দেশে কোনো স্থায়ী সংবিধান ছিল না; ঔপনিবেশিক ভারত শাসন আইনে কিছু রদবদল ঘটিয়েই দেশ শাসনের কাজ চলছিল। ১৯৪৭ খ্রিঃ ২৮শে আগস্ট একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার জন্য ড্রাফটিং কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ভীমরাও রামজি আম্বেডকর । ৪ঠা নভেম্বর ১৯৪৭ তারিখে কমিটি একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে গণপরিষদে জমা দেয়। চূড়ান্তভাবে সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে ২ বছর, ১১ মাস, ১৮ দিন ব্যাপী সময়ে গণপরিষদ এই খসড়া সংবিধান আলোচনার জন্য ১৬৬ বার অধিবেশন ডাকে। এই সমস্ত অধিবেশনে জনসাধারণের প্রবেশের অধিকার ছিল। ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর স্বাধীন ভারতের সংবিধান গৃহীত হবার পর ঠিক করা হয় ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারি প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালনের সেই দিনটিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি থেকে ভারতের সংবিধান কার্যকর হবে এবং সেদিন থেকে প্রজাতান্ত্রিক ভারতবর্ষ বা Republic of India হিসেবে পরিচিত হবে। বহু বিতর্ক ও কিছু সংশোধনের পর ২৪ শে জানুয়ারি ১৯৫০ এ গণপরিষদের ৩০৮ জন সদস্য চূড়ান্ত সংবিধানের হাতে-লেখা দু'টি নথিতে (একটি ইংরেজি ও অপরটি হিন্দি) স্বাক্ষর করেন। এর দু'দিন পর সারা দেশব্যাপী এই সংবিধান কার্যকর হয়।
সাধারণতন্ত্র দিবসে কুচকাওয়াজ
সাধারণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে জাতীয় রাজধানী নতুন দিল্লীতে কুচকাওয়াজ হয় রাষ্ট্রপতির আবাসস্থল রাষ্ট্রপতি ভবনের নিকটবর্তী রাইসিনা হিল থেকে রাজপথ বরাবর ইন্ডিয়া গেট ছাড়িয়ে। কুচকাওয়াজ আরম্ভ হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি রাজপথের একপ্রান্তে অবস্থিত ইন্ডিয়া গেটে শহিদ সৈন্যদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মারক অমর জওয়ান জ্যোতি-তে একটি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এর পর ঐ সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ২ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলন ও তার পরবর্তী যুদ্ধগুলিতে ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শহিদ সৈন্যদের প্রতি এইভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। এর পর রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে মিলিত হন এবং প্রধান অতিথির সাথে রাজপথে অবস্থিত অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চে আসেন। রাষ্ট্রপতির দেহরক্ষকরা ঘোড়ার পিঠে করে তাদের পথপ্রদর্শন করেন।
বীটিং রিট্রীট
বীটিং রিট্রীট এর মাধ্যমে সাধারণতন্ত্র দিবস উদ্যাপনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি সূচিত হয়। সাধারণতন্ত্র দিবসের ৩ দিন পর, ২৯শে জানুয়ারি সন্ধ্যেবেলা বীটিং রিট্রীট অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের সামরিক বাহিনীর তিন প্রধান শাখা ভারতীয় স্থলসেনা, ভারতীয় নৌবাহিনী এবং ভারতীয় বায়ুসেনা এই রিট্রীটে অংশ নেয়। রাজপথের প্রান্তে ভারতের কেন্দ্রীয় সচিবালয় ও রাষ্ট্রপতি ভবনের নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লক ভবন দু'টির মধ্যবর্তী রাইসিনা হিল ও বিজয় চকে এই অনুষ্ঠানটি হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি, যিনি অশ্বারোহী 'পিবিজি' (প্রেসিডেন্টস বডিগার্ডস/ রাষ্ট্রপতির দেহরক্ষক) কর্তৃক পথপ্রদর্শিত হয়ে আসেন। তিনি উপস্থিত হলে পিবিজির অধিনায়ক তার বাহিনীকে জাতীয় অভিবাদনের (স্যালুট) নির্দেশ দেন। এর পর সামরিক বাহিনী কর্তৃক ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। এই সঙ্গীতের পাশাপাশি সম্মিলিত স্থল, জল ও বায়ুসেনার বিভিন্ন ব্যান্ড, পাইপ, ভেরী প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের কুশলীরা অনুষ্ঠানের শেষ লগ্নে সারে জাঁহা সেআচ্ছা প্রভৃতি দেশাত্মবোধক গানের আয়োজনও করেন।
যাই হোক, সংবিধান চালু হবার পরের বছরই এই বিশাল জনবহুল বিভেদময় দেশের প্রতিটি কোণে গণতান্ত্রিক নির্বাচনক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবার মধ্যে সেই অসামান্য শপথের ছাপ লুকিয়ে থাকল। সব ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের সমমনস্ক হবার প্রতিজ্ঞার মধ্যে, কিংবা যুগ-যুগ ধরে পিছিয়ে থাকা সমাজকে আলাদা ভাবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ দেবার মধ্যে সেই অসামান্য শপথ ধ্বনিত হ’ল। সময় চির কাল সমান যায় না, রাষ্ট্রের ধ্বজাধারীদের চরিত্রও সব সময় এক হয় না, কিন্তু আশা করা হল, যে কোনও পরিস্থিতিতে দেশের এই বৃহৎ স্বাধীনতাটি রাষ্ট্র সতর্ক ভাবে রক্ষা করে চলবে। তাই, এই বৃহৎ স্বাধীনতার কথা স্মরণ করা— কোথা থেকে শুরু করে কোথায় এসে পৌঁছানো গেল তা বিবেচনা করা—বিশেষ জরুরি। প্রজাতন্ত্র দিবস এই জরুরি কাজটি করবার দিন।
ঋণ: উইকিপিডিয়া। কৃষ্ণা বসু – আনন্দবাজার।
0 comments