সদর্থক

সদর্থক

যে ভাইরাসের আতঙ্কে আমরা ঘরবন্দী , সেই ভাইরাসের সঙ্গে লড়তে যা যা সতর্কতা নেওয়ার, তারপরও যা পড়ে থাকে তা হল ইমিউনিটি বাড়ানো আর সদর্থক থাকা। ফল, সবজি, দই বা ভিটামিনের পর যে ওষুধ আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে তা হলো সদর্থক মনবৃত্তি। পজিটিভ থাকা।
মন ভালো রাখা। মনের জোর আমাদের বাড়াতেই হবে। মৃত্যু একমাত্র গন্তব্য এটা তো জেনেও ভুলেই রোজ থাকি আমরা সারা জীবন। আর এই ভাইরাস আমাদের কবে কখন মৃত্যু দেবে বা দেবে না সেটা ভুলে, অর্থনীতি শেষ হলো না ভেঙে পড়লো সেটা উপেক্ষা করে ভরসা রাখি। মনের জোরে মানুষ এক পা নিয়েও হিমালয় জয় করতে পারে আর আমরা বাড়িতে সবার সঙ্গে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে থাকতে পারবো না! শুধু কিছুদিন একটু নিজেদের ইন্দ্রিয়গুলোকে দমন করে থাকা। রসনা তৃপ্তির সুযোগ আমরা আগেও পেয়েছি বেঁচে থাকলে আবারো পাব। দেশ বিদেশ, পাহাড় সমুদ্র আগেও যাওয়া হয়েছে সেই সুযোগ আবারো পাওয়া যাবে। কিন্তু বেঁচে থাকার একটাই সুযোগ। সেই সুযোগ নিজের ভয়ে, বা নিজের অযথা দুঃসাহসে কেন নষ্ট করি!

ADVERTISEMENT

আমার শ্বশুর মশাইয়ের এক জেঠিমা ছিলেন, বাড়িতে সবাই ওনাকে রাঙাদি বলে ডাকতো। একান্নবর্তী পরিবার ততদিনে ভেঙে গেছে। কমন দেওয়াল রয়েছে কিন্তু হাঁড়ি আলাদা, পার্টিশান পড়ে গেছে পৃথক পৃথক সংসারে। যাই হোক , রাঙাদি তাঁর বিশাল বাড়িতে একা থাকতেন। স্বামী মারা গেছেন বহুদিন। একমাত্র ছেলে কর্মসূত্রে সৌদিতে। বছরে একবার আসতেন । ওই বিশাল বাড়িতে একজন অশিতিপর বৃদ্ধা থাকতেন একদম একা, কাজের একটি রাত দিনের মেয়েকে নিয়ে। বিয়ের পর সকালে বারান্দায় দাঁড়ালে দেখেছি উনি একটা সাদা ধবধবে শাড়ি পড়ে ওনার বাগানে ফুল তুলতেন। দেখা হলেই এক মুখ হাসি, কী গো নাতবউ কেমন আছো ভাই! একবার হলো কী, ওনার গাছ থেকে মাঝ রাত্রিতে ফুল চুরি হতে লাগলো, উনি পরদিন সকালে বললেন, দেখলে ভাই সব ফুল গুলো নিয়ে গেছে হতচ্ছাড়া গুলো। বললাম, রাঙা দি , এবার তুমি পুজো করবে কী করে! অল্প হেসে বললেন, ফুল চুরি আর মন চুরিতে কোনো হাত নেই তো রে কারুর। যাক গে নিয়েছে নিক, আজ ঠাকুর ফুল ছাড়া পুজো পাবে। বাড়ি থেকে প্রায় বেরুতেন না, কিন্তু সব সময় হাসি মুখ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। বই পড়তেন, টিভিতে সিরিয়াল সিনেমা দেখতেন। তিনতলা বাড়ির আনাচে কানাচে কেউ কখনো ধূলো দেখেনি। অনেক সময় লোকজন আসতো ওনার বাড়ি, বিশেষত বিজয়ার সময়, বাকি বছর একাই। মেনে নিয়েছিলেন এই যাপন। জানতেন এভাবেই বাকি জীবন কাটাতে হবে। তাই নিজেকে তৈরি করেছিলেন সেই ভাবেই। উনি মারা গেছেন সে প্রায় ১৫বছর হলো।

কিন্তু আজ এই ঘর বন্দী জীবনে ওনার কথা মনে পড়লো। উনি পেরে ছিলেন মেনে নিতে সেই একাকীত্ব। আমরাও হঠাৎ করে এক অদ্ভুত বিপর্যয়ের ধাক্কায় কাবু হয়ে গেছি। হঠাৎ করে আমাদের বয়ে চলা জীবন থেমে গেছে। আমাদের কোথাও যাওয়ার নেই। কারুর আমাদের বাড়ি আসার নেই। কোনো বিয়ে বাড়ি নেই, কোনো সিনেমা থিয়েটার নাটক দেখা নেই, গান নাচের অনুষ্ঠান নেই, স্কুল কলেজ অফিস নেই। অযথা গাড়ির হর্ন নেই, জ্যাম নেই, সিগন্যালে ট্রাফিক নেই। স্টেশনে ট্রেন নেই,আকাশে প্লেন নেই। আমাদের মুখে হাসি নেই, মনে আনন্দ নেই, কোনো ভালোলাগা নেই, কোনো কিছুতে ভালোবাসা নেই। আমরা ভীত, সন্ত্রস্ত্র। আমরা অস্থির, বিরক্ত। নিজেদের রান্না ঘরে আটকে ফেলেছি, বাড়ির কাজ সবাই মিলে করেও শেষ করতে পারছি না। অফিস উঠে এসেছে ঘরের ভেতর। ক্লাসরুমের আওয়াজ ল্যাপটপের সামনে শুধু। ঢং ঢং ঘন্টা বাজে না আর কোথাও। আমরা জানি না এরপর কী। অহেতুক জল্পনা, আকাশ কুসুম কল্পনা করে কেটে যাচ্ছে দিনগুলো।

 

 

 

 

 

 

 

 

বাঁচব কী বাঁচব না শুধু এই কথাটা বলছি না, কিন্তু ভাবনাটা আছে। তাই আমরা দুঃখী ভেতরে ভেতরে। কিন্তু পৃথিবীর এই দারুন অসুখে লড়তে গেলে মনের জোর, পজিটিভ থাকা, ডাক্তারদের সাবধানবাণী মেনে চলা আর নিজেদের পৃথিবীর উঠোন থেকে গুটিয়ে নেওয়া একান্তই দরকার। বাঁচার জন্য মানুষ কত কী করে। ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষ অসহনীয় কেমোথেরাপি নিয়েও বাঁচার লড়াই করে। বাঁচার জন্য মানুষ নিজের শ্রম, নিজের শরীর বেচে। সংসার ফেলে দূর দেশে পড়ে থাকে রোজগারের আশায়। ট্রাপিজের ভয়ানক খেলাও দেখায় ৭বছরের ছোট মেয়ে, ট্রেনে জুতো পালিশ করে বাঁচে নাবালক শ্রমিক। শুধু বাঁচার জন্যই এত কিছু, আরো কত কিছু। শুধু এই বাঁচার জন্য নাহয় কিছুদিন ঘরে নিজেদের লোকের সঙ্গে রইলাম,এত কাজ করা অসহ্য হলেও রইলাম। আবার বাঁচব বলে রইলাম। ছেলে মেয়েকে বড়ো হতে দেখবো বলে রইলাম । বৃদ্ধ বাবা মা কে সঙ্গ দেবো বলে রইলাম আর রইলাম যারা নিজের সংসার, পরিবার, সন্তান ভুলে, ভাইরাসের মধ্যে পড়ে আছেন তাদের জন্য ।

 

 

 

 

 

 

 

 


তারপর দেখা যাক! তাও তো জানবো মরার আগে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম আমরা। এক পৃথিবী মানুষের এই লড়াই বিফল হবে না নিশ্চিত।
ভালো থাকুন, দূরত্বে থাকুন।


0 comments

Illora Chattopadhyay

Illora Chattopadhyay

জন্মসূত্রে বড় হওয়া উত্তরপাড়ায়। সংস্কৃত সাহিত্যে এম.এ পাশ করার পর ১৫ বছর হুগলী জেলার একটি গ্রামীন আধাসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা । সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করলেও প্রিয় বিষয় বাংলা। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা চিরকালীন। মাঝে কিছুদিন পত্র পত্রিকায় বইয়ের রিভিউ লেখা। তারপর দীর্ঘদিনের বিরতি। প্রাণের টানে আবারও ফিরে আসা সাহিত্যের প্রাঙ্গণে। তবে এবারে শুধু আর পুস্তক আলোচনা নয়, তার সঙ্গে মৌলিক লেখালেখির শুরু। মূলত সোশাল মিডিয়ায়। তারপর থেকে বিভিন্ন ওয়েবম্যাগ, কাগজের পত্রপত্রিকাতে নিয়মিত লিখে চলা।যদিও নিজেকে লেখক নয়, পাঠক মনে করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি।

FOLLOW

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait