লোকমাতা
1793 সালের 28 সে সেপ্টেম্বর হালিশহরের অখ্যাত গ্রামে যে মেয়ের জন্ম হয়েছিল, মহাকালের নিয়মে তিনিই উত্তরকালে হয়ে উঠবেন লোকমাতা রানী রাসমণি। বাবু রাজচন্দ্র দাসের সাথে তাঁর বিবাহ হয় মাত্র এগারো বছর বয়সে। চার কন্যা এবং তাঁকে রেখে বাবু রাজচন্দ্র দাস যখন পরলোক গমন করলেন, তখন রানীমা জমিদারির দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা পরিচালনা করতে থাকেন। প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী, চরিত্রে কঠোর রানীমা কিন্তু আদতে ছিলেন প্রবল প্রজাহিতৈষী। প্রজাকল্যানের জন্য তিনি ইংরেজ শাসকের সাথেও বহুবার লিপ্ত হয়েছেন সংগ্রামে। ইংরেজ শাসক তাঁকে সমঝে চলত।
রানীমা ছিলেন গরিব মানুষদের কাছে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। তিনি বাবু রাজচন্দ্র দাসের স্মৃতিতে কলকাতায় 'বাবুঘাট', এবং তৎসহ আহিরীটোলা ঘাট এবং নিমতলা ঘাট এর নির্মাণ করেন। হিন্দু কলেজও অধুনা জাতীয় গ্রন্থাগার নির্মাণে প্রভূত দান করেন।
একবার ইংরেজ সরকার গঙ্গায় জেলেদের মাছ ধরার উপর জলকর আরোপ করে। নিরুপায় হয়ে জেলেরা রাণী রাসমণির কাছে গেলে রাণী রাসমণি ইংরেজ সরকারকে ১০ হাজার টাকা কর দিয়ে ঘুসুড়ি থেকে মোটিয়াবুরুজ এলাকার সমস্ত গঙ্গার ঘাট জমা নেন এবং রশি টানিয়ে জাহাজ ও নৌকো চলাচল বন্ধ করে দেন। এতে ইংরেজ সরকার আপত্তি করলে রাসমণি বলেন যে, জাহাজ চলাচল করলে মাছ অন্য জায়গায় চলে যাবে ফলে জেলেদের ক্ষতি হবে। এই অবস্থায় ইংরেজ সরকার রাণী রাসমণির ১০ হাজার টাকা ফেরত দেয় এবং জলকর তুলে নেয়। এরকম অনেক কাজের মাধ্যমে তিনি চিরস্মরণীয়।
তবে ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে দক্ষিনেশ্বর মন্দির নির্মাণের জন্য। এই মন্দির নির্মাণের জন্য তাঁকে কত যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তা বলার নয়। তবুও অনেক বাধা কাটিয়ে তিনি যখন মন্দির নির্মাণ করলেন, গোঁড়া পণ্ডিত সমাজ তাঁর হাতে ভাবতারিনীর পুজোয় বাধা দিতে লাগলো। তখন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ এবং বেদবিদ, কামারপুকুরের রামকুমার চট্টোপাধ্যায় বিধান দিলেন রানীর মন্দিরে পুজো হবে এবং ভোগরাগ দেওয়া যাবে, যদি মন্দির দেবত্র করে দেওয়া যায়। রানী তাই করলেন। এই রামকুমার চট্টোপাধ্যায় এর ভাই হলেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ দেব। রানী ছিলেন ঠাকুরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, সেই কর্তব্য রানীর পরেও রানীর সেজজামাই মথুরামোহন বিশ্বাস নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিলেন।
রানী তাঁর এস্টেটের সিলমোহরে পরিচয় লিখতেন, 'রাসমণি দাসী'। ভবতারিনীর সেবিকা রাণীমাকে লোকমাতা বলা হয়, ঠাকুর স্বয়ং বলেছেন যে তিনি নাকি মায়ের অষ্টসখীর অন্যতমা।
লোকমাতার পুন্য জন্মতিথিতে তাঁকে প্রণাম জানাই। প্রণাম জানায় স্বদেশ ও স্বদেশজন।
ADVERTISEMENT
0 comments