...নিশি ফুরালে কেহ চায়না আমায়

...নিশি ফুরালে কেহ চায়না আমায়

কাঠের নকশা করা দরজা ঠেলে চৌকাঠ পেরোলেই নাকে লাগবে পাঁচ মিশালি একটা চেনা গন্ধ। বেল ফুলের মিষ্টি সুবাস, সুগন্ধি আতর বা গোলাপ জল, সুগন্ধি ধূপ, দামী সুরা, শৌখিন তামাক-- আর তার সঙ্গে সারেঙ্গি, তবলা, তানপুরার সুরে ঠুমরির তাল ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ি...’। ঘুঙুরের রুনুঝুনু, চুরি-কঙ্কনের শিঞ্জিনী, আর সুরা পাত্রের টুংটাং শব্দটা, ফাও। এরই মাঝে তারিফের বন্যায় মেহফিল মাত... ওয়াহ, কেয়াবাত-কেয়াবাত।

কাল্পনিক এই নস্টালজিয়াটার উপর ভর করে হাল ফ্যাশনের কাঠের দরজায় ধাক্কা দিতেই ‘অন্ধকারে সিঁড়ি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও আরেকটা সিঁড়ি আছে ভেবে পা বাড়ালে মনের অবস্থাটা যেমন হয়’ ঠিক তেমন ঠিক তেমনই হবে। হয়তো চোখ পড়বে বাজারিয়া, চটুল হিন্দি গানের সঙ্গে কোমর দোলাচ্ছে বউবাজারের মাধুরী কিংবা প্রীতি। নতুন বাবু দেখেই সস্তা মেক-আপ মাখা চোখে-মুখে একটা ‘অন্যরকম’ ইশারা। যদিও আদব-কায়দা বা আপ্যায়নে সেই ‘ঐতিহ্যবাহী ভদ্রতা’টা কিছুটা হলেও রয়ে গেছে। ঠিক যেমনটা ছিল সেই মোঘল আমলে, তাদের পূর্বসূরী বেগম সুরাইয়া, জ়িনত জান কিংবা পাকিজ়া বেগমদের মধ্যে। যখন নবাব, বাদশাহ, সুলতানদের মনোরঞ্জনের জন্য সুন্দরী মহিলাদের নাচ ও গানের বিশেষ তালিম দেওয়া হত। উর্দুতে ওই মহিলাদের পোশাকি নাম ছিল তাওয়ায়েফ। আর বাংলায় বাইজি। আজকের মাধুরী, প্রীতি, রেশমারা তাদেরই বংশধর। কলকাতার বউবাজারে আজও এদের মেহফিল বসে ৷ যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো আমলের মেহফিলের মেজাজ এখন প্রায় ঠুনকো হয়ে পড়েছে। মোঘল আমল থেকে শুরু করে উনিশ শতকের গোড়া পর্যন্তও নিজেদের কোঠায় কিংবা নবাব-জমিদারদের বাগানবাড়িতে তাওয়ায়েফদের মেহফিল বসত৷ তা সে অনেক দিনের কথা৷ রেশমা বাই, সুস্মিতা বাইদের কপাল অতটা ভালো নয়। ওদের কারও কারও পূর্বসূরী নাকি লখনউ-এর বিখ্যাত বাইজি ছিল। এক সময়ের বাই নাচের খাসমুলুক লখনউ কিংবা দ্বিতীয় স্থানে থাকা কলকাতায় বাইজিদের রমরমা বাজারের গল্প তারা শুধু মা দিদিমার মুখেই শুনেছে। যখন সন্ধে হতে না হতেই ঘুঙুরের বোল আর মিষ্টি গানের সুরে রঙিন হয়ে উঠত বাইজি পাড়া। আর রাজা দেবী সিং-এর রাজপ্রাসাদে এক রাত মেহফিলের জন্য লখনউ-এর বিখ্যাত হীরা বাইয়ের পাঁচ হাজার স্বর্ণমুদ্রা নজরানা নেওয়ার কথা তো ওদের কাছে ‘পবিত্রগাথা’।

কলকাতাকে বাইজি দ্বিতীয় খাসমুলুক বলে ধরা হলেও এই শহরে বাইজি কালচার কিন্তু তুলনামূলক নতুন। জঙ্গল সাফ করে কলকাতাকে সাজিয়ে গুছিয়ে ইংরেজরা যখন সুসভ্য শহর গড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে সেই সময় শহরে পা রাখে বাইজিরা। আসলে নবাবী আমলে বাংলার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ। কলকাতা তখন জল-জঙ্গলে পরিপূর্ণ, কুমীর-বাঘেদের আড্ডা। দেশের নামজাদা বাইজিদের বায়না করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়া হল নবাব এবং অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিদের জন্য। চার্ণক সাহেব যখন জাহাজ নোঙর করেন তখনও কলকাতা অজ পাড়া গাঁ।

তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। নিজেদের সুবিধার জন্য জঙ্গল সাফ করে শহর গড়তে শুরু করেছে ইংরেজরা। আশপাশের গ্রামের লোকজনকে বিনামূল্যে জমি দান করে বসতি স্থাপনের চেষ্টা চালায় তারা। ধীরে ধীরে কলেবরে বাড়তে থাকে কলকাতা। শহর ভরে উঠতে শুরু করে নানা শ্রেণির নাগরিকে। শুরু হয় বঙ্গবাসীর তথাকথিত আধুনিক জীবন। সাহেবদের পাশাপাশি দেশীয় অভিজাত শ্রেণির মানুষরাও পাকাপাকিভাবে কলকাতা শহরে বসবাস শুরু করে দিলেন। শহরে ভাগ্যান্বেষণের চেষ্টায় পা রাখেন বাইরের মানুষজন। এত মানুষের বসবাস যে শহরে সেখানে তো সবধরনের বন্দোবস্ত চাই। খাদ্য, পানীয় বাসস্থানের পাশাপাশি প্রয়োজন বিনোদনের। গ্রাম্য কবিগান, যাত্রাপালা কলকাতায় জনপ্রিয়তা পায় বটে কিন্তু সুন্দরী রমণীদের সংগীতের মুর্ছনা কলকাতার বাবুদের আকর্ষণ করে অনেক বেশি। সঙ্গে অসামান্য নাচ। সেই সংগীত বা নৃত্য কোনও কুরুচিকর চটুল পরিবেশন নয়, সেগুলি ছিল রীতিমতো ধ্রুপদী ঘরানার পরিবেশন। অভিজাত বাবুরা তো বটেই সাবেক কলকাতার বাইজিদের গুণের কদর করতেন বাংলার বহু মণীষী।

বলা হয়, কলকাতায় বাইজি নাচের প্রবর্তক রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তাঁর সভায় অভিজাত অতিথিদের জন্য বাই নাচের আয়োজন করা হত। শুরুর দিকে বাইজিরা থাকতেন চিৎপুরে। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ প্রথম চিৎপুরে বাইজিদের থাকার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীকালে বউবাজার হয়ে ওঠে তাদের বাসস্থান। সাধারণ লোকের কাছে বাইজি মানেই অচ্ছুৎ, অসামাজিক। বাইজি মানে 'নষ্ট মেয়েমানুষ'। অথচ সুযোগ পেলে সেই বাই নাচ-গানের প্রতি লোভও ছিল মানুষের অবাধ। সাবেকি বাইজিদের গায়ে 'নষ্ট মেয়েমানুষে'র তকমা দেওয়া হলেও সাধারণ খ্যামটাওয়ালি, নাচনিদের থেকে বাইজিদের যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। বারবণীতা সমাজে বাইজিদের সম্মান ছিল সবচেয়ে বেশি।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে বাইজি সংগীত অনেক সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল। সৌজন্যে কলের গান। সালকাজান, গওহরজান, কৃষ্ণভামিনী, হরি বাইদের গান শোনা যেন ঘরে বসেই। শুধু ধ্রপদী সংগীতই নয়, বাইজিদের কণ্ঠে রেকর্ড হয়েছি রবি ঠাকুরের গানও।

বউবাজারে বাইজি ঘরানার সেই ঐতিহ্য প্রায় নেই বললেই চলে। ওস্তাদ কিংবা গুরুদের কাছে তালিম নেওয়ার চলও প্রায় অবলুপ্তির পথে। এরই মধ্যে কেউ কেউ আবার পারিবারিক সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে মরিয়া। সংখ্যাটা হাতে গোনা হলেও হিন্দি গানের পাশাপাশি বউবাজারের কোনও কোনও কোঠায় আজও মুজরা, ঠুমরি, গজ়লের তালে মেতে ওঠে সন্ধেবেলায় মেহফিল। কদরদান বাবুদের মর্জির উপর নির্ভর করে মেহফিলের রং-রস-গন্ধ। তাছাড়া ঘণ্টায় দুই থেকে তিনটি গানের জন্য প্রায় তিন হাজার টাকা নজরানা নেহাত মন্দ নয়। স্বামী নেই। সন্তান তো রয়েছে। ওদের যে বড় করতে হবে। শহরের নামী স্কুলে পড়ানোর খরচাও তো অনেক। তাছাড়া নিজেদের ভবিষ্যৎকেও তো সুরক্ষিত করাটা জরুরি ৷ কারণ মোঘল আমল হোক বা আধুনিক যুগ সমাজে যে এরা বঞ্ছিত বরাবর৷

আসলে নিশি ফুরালেই যে জলসাঘরের বেলোয়াড়ি ঝারের কোনও কদর থাকে না। এই কঠিন সত্যটা ওরা সবাই জানে। কিন্তু পেট বড় বালাই আর সঙ্গে রয়েছে ঐতিহ্য ধরে রাখার তাগিদ। এভাবেই দিন চলছে। কিংবা এভাবেই হয়তো দিন শেষ হয়ে আসছে।

মেহফিলে ঠুমরি, টপ্পার বদলে সিনেমার গান আজ বুকে বড় ব্যথা দেয়। আতরের গন্ধে মাখা মুজরার আসরে সাইয়া কথা না বলায় জোছনার সঙ্গে আড়ি করে দিয়ে অভিমানী প্রেয়সীর কোয়েলিয়ার কুহু তান থামানোর আকুতির কাছে যে চিকনি চামেলির জলওয়া যে একদম ফেল৷ হোক না নকল, কিন্তু আজও তালিম নেওয়া আধুনিকাদের গলায় গওহর জান, বেগম সামরুর গজ়লের দু কলি কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিলে মনটা একটু হলেও আকুল করবে। থেমে থাকবে না মুখের তারিফ বাক্যও...ওয়াহ, কেয়াবাত-কেয়াবাত।

ADVERTISEMENT

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait