দশমী মানেই মা দুর্গা কৈলাসে পতিগৃহে যাত্রা করলেন এই ধারণায় বিশ্বাসী নন আলিপুরদুয়ার শহর লাগোয়া পূর্ব ভোলার ডাবরি গ্রামের বাসিন্দারা। তারা বিশ্বাস করেন বাপের বাড়িতে আরও একদিন অন্যররূপে থাকার অনুমতি পেয়েছিলেন মা দুর্গা। তাই এই গ্রামে দুর্গার আরেক রূপ ভান্ডানি রূপে পুজিত হন মা দুর্গা। বাপের বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার পথে গ্রামের মানুষেরা ক্রন্দনরত দুর্গার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এই গ্রামের মানুষেরা।
ADVERTISEMENT
আর এক গল্পে আছে, মা দুর্গা কৈলাসে ফিরে যাওয়ার পরে মর্ত্যে কেমন পুজো পেলেন, তা জানতে চাইলেন শিব। উত্তর মা দুর্গা বলেন, ‘মানুষ ভক্তি ভরে আমার পুজো করেছে।’ সেই কারণে কৈলাসে ফিরেও মা দুর্গার মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে ছিল। তাই মা দুর্গা আবার মর্ত্যে ফিরে আসেন। মা দুর্গা হিমালয়ের পাদদেশে একদল বালককে বাঘের ভয় দেখান। বালকেরা ভয় পেয়ে মা দুর্গার পুজোর আয়োজন করে। এরপর মা দুর্গা আবার ফিরে যান কৈলাসে। লোককথা অনুযায়ী মা ‘ভন্ডামি’ করে পুজো নেন বলে এই পুজোকে ভান্ডানি পুজো বলা হয়। মা ভান্ডানি বাঘের পিঠে বসে আছেন। সঙ্গে আছেন কার্তিক, গনেশ, লক্ষ্মী, ও সরস্বতী। মা ভান্ডানি বাঘের পিঠে চড়ে অসুর বধ করছেন। মা ভান্ডানির প্রতিমা বিসর্জন করা হয় না।
গল্পে যা-ই থাক না কেন, উত্তরবঙ্গে রাজবংশী সম্প্রদায়ের আরাধ্যদেবী মা ভান্ডানি হলেন বনদুর্গা। মা ভান্ডানির পুজা করা হয় দুর্গাপুজার পরে একাদশীর দিন। উত্তরবঙ্গের ময়নাগুড়ির বার্নিশ, মেখলিগঞ্জ, মাথাভাঙা, রানিরহাট, খয়েরকাটা, নাগরাকাটা-সহ অন্যান্য জায়গাতেও মা ভান্ডানির পুজো করা হয়। একাদশীতে যখন পুজো শেষ হওয়া গোটা বাংলায় বিষণ্ণতার সুর, তখন অন্য এক দুর্গা পুজো শুরুর আনন্দ জলপাইগুড়ি জেলার একাংশে।
তাই আধুনিকতা কেড়ে নিতে পারেনি এই প্রাচীন গোষ্ঠী জীবনের পরম্পরা। সেই কারণে স্বমহিমায় তিস্তা পাড়ের মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত রাজবংশী সমাজের শস্য রক্ষার দেবী ভান্ডানি। একাদশী তিথি মঙ্গলবার থেকে ওই দেবী আরাধনাকে ঘিরে উত্তরবঙ্গে শুরু হয় অন্য এক শারদ উত্সব।
শিলিগুড়ি, কোচবিহার এবং উত্তর দিনাজপুর থেকেও প্রচুর মানুষ এখানে ভিড় করেন। কোথাও একাদশী থেকে তিন দিন, আবার কোথাও লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন। এ ভাবে দেবী ভান্ডানির কাছে শস্যরক্ষা ও সমাজের মঙ্গল কামনা করেন রাজবংশী চাষি পরিবারের লোকজন। দেবী ভান্ডানি দ্বিভূজা ব্যাঘ্রবাহিনী। রক্তিম বর্ণ। তিনি পশ্চিম মুখে বসেন। সময়ের সঙ্গে নানা এলাকায় দেবীর গড়নে পরিবর্তন এসেছে। এই ভাবেই কোথাও বাহন কখনও বাঘ হয়েছে। কখনও সিংহ। কোথাও দেবী দ্বিভূজা, কোথাও চতুর্ভুজা ভাবনাও পাল্টেছে। শস্য রক্ষার দেবীকে দুর্গা অথবা বনদুর্গা রূপে কল্পনার চল হয়েছে। রাজবংশী পরিবারের ভাষায় “ভান্ডানিকে দেবী দুর্গা কল্পনা করা হলেও, তিনি আদতে শস্যের দেবী। শব্দটির উত্স ভাণ্ডার শব্দ থেকে। যেমন, শস্য ভাণ্ডার। তাই ওই দেবী যে শস্য ভাণ্ডার রক্ষার দেবী সেই বিষয়ে বিতর্ক থাকার কথা নয়।”
এমনকি মা ভান্ডানি ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী। একাদশীতে দিনভর মা ভান্ডানির পুজা করা হয়। ভোরবেলা থেকে পুণ্যার্থীরা বাতাসা, দুধ, কলা দিয়ে পুজো দেন। মোমবাতি ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দেবীর আরাধনা করা হয়। দেবীর নামে পায়রা উড়িয়ে দেওয়ার রীতি আছে। মা ভান্ডানির পুজোতে প্রচুর পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। পুজো উপলক্ষে মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিজয়ায় মা দুর্গার বিসর্জনের পরে মন খারাপ কাটাতে প্রচুর মানুষ ভিড় জমান মা ভান্ডানিকে দর্শন করতে। ভান্ডানী পুজাকে নিয়ে সমাজতত্ববিদেরা বলে থাকেন যে, উত্তরবঙ্গের এই সমস্ত অঞ্চল ৬০ বছর আগেও জঙ্গলে ভরা ছিল। অরণ্যে বন্যজন্তু বিশেষ করে বাঘের ভয় ছিল। যে কারণে বন্যজন্তুর হাত থেকে রেহাই পেতেই জঙ্গলে ঘেরা এই অঞ্চলের মানুষজন লোকদেবী হিসেবে ভান্ডানী দেবীর পুজো আরম্ভ করেছিলেন। এখানে দেবী অরণ্যচারী লোকদেবীরুপেই বছরের পর বছর ভান্ডানী হিসেবে পুজিত হয়ে আসছেন। আবার আর একটি প্রচলতি মত হল, এই অঞ্চলের মানুষ নিজেদের শস্য ভান্ডার সবুজ ফসলে পরিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যেই ভান্ডানী দেবীর পুজার প্রচলন শুরু করেছিলেন। যে রীতি আজও চলে আসছে।
সূত্র: ইন্টারনেট
ছবি সৌজন্য- FirstPost
0 comments