নীলকমল বোস। স্কুলে অনেকেই নীল বলে। ক্লাস টেনে পড়ে। ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলা চলে। বলা চলে বলার কারণ হল, নীল অনেক সময় নিজের মধ্যে হারিয়ে যায়। তখন অঙ্ক ভুল করে, কেমেস্ট্রি ভুল, বানান ভুল হয়। ওর কয়েকজন বন্ধু আছে। অর্ণব, আর অদিতি তাদের মধ্যে পড়ে। ওরা নীলকে অনেক বোঝায়। নীল মৃদু হাসে। খুব চাপাচাপি করলে বলে, ‘সব সময় ফার্স্ট হয়ে লাভ আছে কী!’
নীলের বাবা এই খামখেয়ালিপনাকে বলেন, ‘এ তো বিলাসিতা। পরীক্ষার নম্বর একটু কমে গেলে ওর কি এসে যায়। শত শত প্রশ্ন শুনতে আসলে নীলকমলবাবু যে বড়ো ভালোবাসে। ওই যে কি বলো না তোমরা Attention seeker. লেখাপড়া খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হয় না তো’!
নীলের মা কিছু বলেন না। নীল বোঝে মা ওর মন বোঝে। আরেকজন অবশ্য বোঝেন তিনি হলেন স্কুলের হেড স্যার।ক্লাস টিচার ভালোবাসেন ঠিকই তবুও নীলকে পুরোপুরি বোঝেন না।
করোনায় লক ডাউন। অন লাইনে পড়া চলছে। প্রথমদিকে নীল রোজই বসত জুমের সামনে কিন্তু এখন বড্ড কম বসছে। ক্লাস টিচারের ফোন এসেছে, সাইন্স টিচার তো বাবাকে সক্কাল সক্কাল ফোন করে অনেক কথা বলেছেন। নীলের প্রেমে পড়ার বয়স এ কথাও বলেছেন। যথারীতিতে নীলের বাবা এইসব কথা সহজ ভাবে নেন নি। নীলকে তো বলছেনই , সঙ্গে নীলের মা বাদ যান নি।
নীলের কোন ভ্রূক্ষেপই নেই । নিজের ঘরে থাকছে। তবে বাবার বকা খেয়ে ঠিক মতো অন লাইন ক্লাসে বসছে। পড়াও বলছে। হোমওয়ার্কও করছে। নীলদের হেডস্যার অঙ্ক ক্লাস নেন। অনলাইনেও তিনিই পড়াচ্ছেন। নীলের ভালোলাগার ক্লাস, ভালোবাসার মানুষ। নীল চেষ্টা করে এই ক্লাসটা করতে। কিন্তু আজ ঠিক তেমন মন নেই নীল বুঝতে পারছে।
দিন কয়েক আগে আমফান এসে সব যেন এলোমেলো করে দিল। টিভিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার ছবি নীল দেখতে পারে না। অদিতিদের বলেছে। ওরাও খুব কষ্ট পাচ্ছে। কিছু ভাবে ওদের সাহায্যের কথাও ভাবছে। টাকা দেওয়ার কথা ভাবছে। নীলের এটাও ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে একবার টাকা দিলেই সব কাজ শেষ? আর কিছুই করার নেই? অদিতিদের বলতেই এরা বলেছে , ‘ নিশ্চয়ই আছে। আমরা করব। তবে আগে তো আমাদের পরীক্ষা, ভালো রেজাল্ট ইত্যাদি। নীল জানে রেজাল্ট ভালো করতে হবে। নীলের কিছু একটা করতে হবে মনে হচ্ছে।কিন্তু সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। দিন কতক হল কেমন যেন লাগছে। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় নীলের মোবাইল বেজে উঠল। অচেনা নম্বর।
‘হ্যালো’ ।
‘কে নীলকমল? আমি স্যার মানে প্রকাশ সেন।’
‘স্যার আপনি! বলুন স্যার। আমি নীলকমল বলছি।’
‘ না এমনি। আছ কেমন? বই পড়ছো তো!
‘হ্যা স্যার অঙ্ক প্র্যাক্টিস চলছে’।
‘বা, খুব ভালো। পরীক্ষা এসে যাচ্ছে যে।আচ্ছা কোন অসুবিধা লাগলে এই নম্বরে ফোন করবে। আজ রাখলাম’।
ফোন কেটে গেলে নীল ভাবতে লাগল , স্যার এই কথার জন্য ফোন করলেন! আর কি কিছু বলতেন?
নীল নিজেকে একটু দোষী ভাবল।হেড স্যারের ফোন, আরেকটু উচ্ছ্বাস হয়েতো আশা করেছিলেন ওর থেকে। আচ্ছা, কেন হঠাৎ বলেন যে দরকার হলে ফোন করো। নিশ্চয়ই অর্ণব কিছু বলেছে। পরের দিনই প্রকাশ স্যারের অনলাইন ক্লাস বসতেই হবে। সকাল সকাল সব হোমওয়র্ক করে দশটার মধ্যে পাঠিয়ে দিল। দুটোতে শুরু হবে ক্লাস।ক্লাস শুরু হল জুমে। নীল আজ বেশ মন দিয়েই ক্লাস করল।
আবার রাতে ফোন বাজল। দেখল প্রকাশ স্যার।
‘হ্যালো’ বলতেই অন্য প্রান্ত থেকে বলা হল, ‘আমি স্যার, প্রকাশ স্যার’।
‘হ্যাঁ স্যার আমি নীল’ বলুন।
‘কেমন আছো? এখন কি করছ? কী কী বই পড়লে ? মানে গল্পের বই কী পড়ছ এখন’।
‘বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছি স্যার’।
‘ বা ! বেশ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়েছ?’
‘না স্যার তেমন ভাবে পড়া হয় নি। বাড়িতে আছে কিন্তু সামনে পরীক্ষা--’
‘পরীক্ষা তো থাকবেই সারা জীবন, কিন্তু এই গল্পগুলি এখনই তো পড়বে।পরে কী আর সময় হবে’।’
‘স্যার’!
‘আমি কিছু শুনব না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিল্পী’ আর ‘কে বাঁচে কে বাঁচায়’ দুটো গল্প পড়বি। পড়ে আমায় জানাবি মতামত।চারদিন সময় দিলাম। কাল ক্লাসে আসছিস কিন্তু।’
‘নিশ্চয়ই বলব, নিশ্চয় পড়ব’ বলে রেখে দিল।
স্যার তুই করে বলেন। কেন?
পরের দিন ক্লাসে পড়া বলতে হবে। কেমিস্ট্রি ক্লাস ও আছে। কাজ না করলই বাবাকে ফোন। বাবাকে ফোন মানেই হরেকরকম কথা হবে।পড়তে বসল। ভালো লাগছে না , ধীরে ধীরে বুক সেলফ থেকে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় দু’টি গল্প বার করে নিল। ‘শিল্পী’ পড়তে পড়তে মন গেল আটকে। তাই আর আরেকটা গল্প পড়া হল না।‘শিল্পী’ মদনতাঁতি ওকে ভাবিয়ে তুলেছে। দিন দুই পরে ‘কে বাঁচে কে বাঁচায় পড়ল’। নিজেই সন্ধ্যাবেলা প্রকাশ সেন কে ফোন করল।
‘স্যার আমি নীলকমল।পড়েছি গল্প দুটো’—কথা শেষ না হতেই স্যার বলে উঠলেন, ‘নিজেকে খুঁজে পেলি তো কে বাঁচে কে বাঁচায়’ তে। নিজেকে দোষী ভাবলে চলে। দু:খ দূর করতে নিজেকে তৈরি করতে হয়।
নীলকমল চুপ।ভাবছে, ‘স্যার কী করে বাড়ি বসে আমার মন বুঝে যাচ্ছেন’?
স্যার বললেন, ‘কীরে ভুল বললাম কিছু? নিজেকে তৈরি কর। অনেক বই পড়। আচ্ছা শোন কাল এই সময় আমায় একটা ফোন করবি। কথা আছে। রাখলাম’।
মনটা বেশ ভালো লাগছে। স্যার বই পড়তে বলেছেন। স্যার নিশ্চয়ই আরও অনেক বইএর নাম বলবেন। বাবা আর কিছু বলতে পারলেন না।
পরের দিনটা কখন যে আসবে এই ভাবতে ভাবতে স্কুলের কাজ সেরে ঘুমিয়ে পড়ল। অদিতি ফোন করল। সব বলল। অদিতি বলল, ‘ বেশ বেশ’। আরো কিছু কথা হল ।
সন্ধ্যা হতেই নীল ঘুরঘুর করল ফোন হাতে নিয়ে । ঠিক আটটা বাজতেই ফোন গেল প্রকাশ স্যারের কাছে।
‘হ্যাঁ বল’।
‘নীল বলছি। ফোন করতে বলেছিলেন’।
‘পড়া ছেড়ে উঠিস নি তো’!
‘না স্যার বলুন,’।
‘কিছু না। বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ তাই ভাবলাম ফোন করলে গল্প করব। তবে আজ গল্প করব না, গল্প বলব। গল্প শুরু হল।ফরাসি বিপ্লব, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ, চলছে তো চলছে। তারপর হঠাৎ ফোন বন্ধ হল। যুদ্ধ নিয়ে একটা সিনেমার লিংক এল নীলের ফোনে।। সঙ্গে ম্যাসেজ কাল রাত আটটায়।
খেয়ে নিয়েই সিনেমা দেখতে বসে গেল। কী ভয়ানক, কী কষ্টের , কী বেদনার। সিনেমা শেষ হলে খুব সাহস করে স্যারকে লিখল নীল , ‘ভালো লাগল’।
উত্তর এল, ‘গুড নাইট’।
এই ভাবে গল্প চলল রোজ। নীলের নেশা ধরেছে। নীল এই কথাটা বলেছে শুধু মাকে। মা গল্পটা শুনেছেন প্রতিদিন একদিন বাবাও শুনলেন গল্প। উঠে যাওয়ার সময় বলেন, ‘বেশ’।
পরেরদিন প্রকাশ স্যার বলেন, আলবেয়ার কামুর ‘দ্যা প্লেগ’। গল্প শুনতে শুনতে নীল স্তব্ধ হয়ে গেল।সব যেন আজকের সঙ্গে মিলছে। ফোন ছেড়ে জানলা দিয়ে আকাশটা দেখতে লাগল। একটা ম্যাসেজ এল, ‘কাল নো গল্প। আবার পরে। মিটিং আছে’।
বেঁচে গেল যেন নীল। নীল পড়ায় মন দিল। অনলাইন ক্লাসে সে সেরা হয়ে উঠল।
এদিকে সাইক্লোনে জন্য নীলদের ড্রাইভারদাদা মানে বাদলকাকুর পরিবার, মিনুমাসির পরিবার এসেছে। উঠেছে ওদের বাড়ির গ্যারাজে, একতলার একটা ঘরে। মা অবশ্য তফাত রেখেই একতলায় রেখেছে ড্রাইভার দাদার পরিবারকে। ছাদের পাশে ঘরটায় মিনুমাসিদের।
সন্ধ্যা আটাটায় ফোন বেজে উঠল প্রকাশ স্যারে ফোনে। বুঝলেন নীলের ফোন। চা এর কাপে চুমুক দিয়ে ফোন ধরলেন।
‘বল নীল’।
‘আমি নীলের মা বলছি। স্যার ধন্যবাদ জানাব না তবে নীল ওর পথ খুঁজে পেয়েছে। লক ডাউন উঠে গেলে আসুন। আপনি তো জানেন ঝড়ের পর থেকে নীলের বাদল কাকু আর মিনুমাসিরা আমাদের বাড়িতেই আছে। দিনকয়েক ধরে আমাদের গ্যারেজ ঘরে ক্লাস শুরু করছে নীল, ঝড়ে চলে আসা কচিকাঁচাদের নিয়ে। আসবেন নিশ্চয়ই’।
ADVERTISEMENT
0 comments