মৃণাল সেন : একটি কর্মময় জীবন

মৃণাল সেন : একটি কর্মময় জীবন

আজ ১৪ই মে। এমন এক ব্যক্তির জন্মদিন, যার হাত ধরে সেলুলয়েডের ইতিহাসে উন্মোচিত  হয়েছিল এক নতুন দিগন্ত।বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান, বিশেষত নতুন ধারার সমাজতান্ত্রিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ধরণ এক স্তম্ভ স্থাপন করেছিল।

 

 

 

 

১৯২৩ সালের ১৪ ই মে, তৎকালীন ফরিদপুরের, যা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত, শ্রী দীনেশ সেন এবং শ্রীমতী সারাজুবালা সেনের কোল আলো করে এসেছিলেন মৃণাল সেন। ছোটবেলা থেকেই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশা ভাবাত বালক মৃণাল কে। একটা অজানা টান অনুভব করতেন। সেই তাড়নাতেই, মাত্র আট বছর বয়সে একটি প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করে গ্রেফতার হন। রাজনৈতিক ধারার বীজ, তারমধ্যে ছেলেবেলা থেকেই গ্রন্তিত হয়েছিল‌। ওই বছরেই তিনি জীবনের প্রথম ছায়াছবি, চার্লি চ্যাপলিনের, “কিড”  দেখেন  এবং সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট হন।

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

পরবর্তীকালে কলকাতার, ‘স্কটিশ চার্চ’ কলেজে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তখনই কমিউনিস্ট পার্টির, সাংস্কৃতিক শাখা ‘গণনাট্য সংঘ’র সাথে জড়িয়ে পড়েন। মৃণাল সেন তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘গণনাট্য সংঘ’ তাকে ছবি তৈরি করতে বারবার অনুপ্রাণিত করেছে। জীবনকে দেখিয়েছে অনেক কাছে থেকে। মানুষের লড়াইকে চিনতে সাহায্য করেছে। এই অভিজ্ঞতাই তাঁর ছবি তৈরির অন্যতম উপাদান।

মৃণাল সেন বেশ কিছুদিন ‘ইন্ডিয়ান পিপ্লস’ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হন কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে, এক জার্মান লেখক রুডল্ফ আর্নহেইম লেখা, ‘ফিল্ম এস আর্ট’ বইটি পড়ে। ঐ বইটির ছবি নিচে দেওয়া হল।        

চলচ্চিত্র জগতে তাঁর প্রথম হাতেখড়ি ঘটে, কলকাতার টলিপাড়ার একটি স্টুডিওতে অডিও টেকনিশিয়ান হিসেবে। যদিও সে কাজটি তাঁর একেবারেই পছন্দ ছিল না।

মৃণাল সেন আত্মজীবনীতে লিখেছেন তিনি প্রথমে, একটি কুড়ি-পঁচিশ মিনিট এর ডকুমেন্ট্রীর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। নাম ছিল, ‘দ্যা স্ট্রাগেল অফ ল্যাণ্ড’, কিন্তু সেই ছবিটি শুটিং করতে গিয়ে তিনি বাধার সম্মুখীন হন, যা প্রতিরোধের জন্য যথোপযুক্ত সাহায্য তখন তিনি পাননি। ফলস্বরূপ তাঁর চিত্রনাট্যটি তাকে নষ্ট করে দিতে হয়। এরপর ১৯৯০ সালে তিনি বাংলায় ‘চার্লি চ্যাপলিন’ এর ওপর একটি বই লেখেন। ১৯৫৬ সালে, তিনি একটি ইংরেজী বই অনুবাদ করেছিলেন। ওই বছরই  তিনি প্রথম ছবি, ‘রাতভোর’ তৈরি করেন, যা একেবারেই অসফল একটি প্রচেষ্টা। এতে কিছুটা ভেঙ্গেও পরেন তিনি। আরো কয়েক বছর পর ১৯৫৯ সালে ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিটি তাঁকে প্রথম পরিচিতি দেয়। কিন্তু মৃণাল সেনের নিজের মনে এই ছবিটি খুব একটা দাগ কাটতে পারেনি। ১৯৬০ সালে তিনি তৈরি করেন, ‘বাইশে শ্রাবণ’। এই ছবির হাত ধরেই তাঁর ছবি পাড়ি দেয় বিদেশে।  সেই পথ চলা শুরু। ১৯৬১ সালের ‘পুনশ্চ’,  তাঁকে এনে দেয় সেরা বাংলা ছবির জাতীয় পুরস্কার। ১৯৮০ সালে ‘অকালের সন্ধানে’ সেনকে দেয়, সর্বাধিক জাতীয় পুরস্কার। আবার বার্লিনে অনুষ্ঠিত ৩১তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ পুরস্কারও এনে দেয় এই ছবিটি। ‘ভুবন সোম’ ছবিটি তাঁকে সেরা চিত্র চিত্রপরিচালকের সম্মান এনে দেয়। ১৯৮০ সালের ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবিটি জায়গা করে নেয়, ‘কান চলচ্চিত্র উৎসবে’। ১৯৮৩ সালে ‘খারিজ’ ছবিটির জন্য।

মৃণাল সেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে মানুষের কথা, তাদের দুঃখ-বেদনা, হেরে যাওয়ার কথা, আর সেই হেরে যাওয়া থেকে লড়াই করে উঠে আবার বেঁচে ওঠার কথা  বলেছেন।

 আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বেড়াজালে, যে মানুষগুলোর ভাষা হারিয়ে গেছিল, সেন হয়ে উঠেছিলেন তাদের কণ্ঠস্বর, তাদের প্রতিবাদের ভাষা। লাইট, সাউন্ড এবং ক্যামেরার মোড়কে কিছু পদপৃষ্ট হয়ে শেষ হয়ে যাওয়া বাস্তব তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে। অবশ্য  একথাও  ঠিক, তার প্রচন্ড বাস্তবমুখী ছবি অনেকের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে।

মৃণাল সেনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে তার একনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন তার স্ত্রী এবং অভিনেত্রী গীতা সেন | সাধারণত সেনের ছবিগুলিতে তিনি অভিনয় করতেন। আরো পরে আমরা তাঁর সুপুত্র, কুনাল সেনকেও বাবা-মার সাথে কাজ করতে দেখি।

তৎকালীন অন্যান্য বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মত সেনের ছবিতেও ধরা পড়েছিল শহর কলকাতা। তিনটি ছবি  ‘সাক্ষাৎকার’ , ‘কলকাতা 71’ ,  এবং ‘পদাতিক’, বিভিন্ন কলকাতাকেন্দ্রিক ছবিগুলির মধ্যে সেরা ছবি হিসেবে পরিগণিত হয়। প্রথাগত ধারণার ঊর্ধ্বে এই ছবিগুলি, দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, বেকারত্বের মতন বাস্তব বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিল।

মৃণাল সেন শুধু বাংলা নয় ওড়িয়া এবং তেলেগু ছবিও তৈরি করেছিলেন, যেগুলি একই রকম প্রশংসার অধিকারী।সত্যজিৎ রায়, তার তেলেগু ছবি, ‘ওকা ওরি কথা’, দেখার পর বলেছিলেন, মৃণাল সেনের ছবি এবং তার তৈরীর ধরন দেখে তিনি ঈর্ষান্বিত।

মৃনাল সেন বেশকিছু ডকুমেন্টারি ও শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছিলেন, যেগুলি বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক উৎসবে জায়গা করে নিয়েছিল। ভারত সরকার দ্বারা তিনি, ‘পদ্মভূষণ’ এবং ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার এ ভূষিত হন।

কর্মজীবনে তিনি প্রায় ত্রিশটির কাছাকাছি ছবি, ডকুমেন্টারি এবং শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছেন। তার শেষ নির্দেশিত ছবি ছিল, ‘আমার ভুবন’, যেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন, ঘৃণা দিয়ে ঘেরা আবর্তের মধ্যে শান্তির ঠিকানা। তিনি নিজেই বলেছিলেন, তাঁর প্রতিটি ছবিতে তিনি নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তিনি সব সময় এগিয়ে যেতে ভালোবাসতেন।

তৎকালীন যে তিন স্তম্ভ, বাংলা চলচ্চিত্র কে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মৃণাল সেন। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন এই ত্রিশঙ্কু, বাংলা চলচ্চিত্রের ঝুড়িতে এনে দিয়েছিল কালজয়ী শিরোপা।

ভাগ্যবশত আমি এমন একজনের মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, যিনি মৃণাল সেনের সঙ্গে  সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। শ্রী দিলীপ মজুমদার, কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন সেন এর সাথে। তার কথা অনুসারে, মানুষ হিসেবে মৃণাল সেন ছিলেন সাবলীল, হাসি খুশি এবং গল্প রসিক।একবার গল্প করার সুযোগ পেলে তা কিছুতেই ছাড়তেন না। এই স্বনামধন্য ব্যক্তির জীবনাবসান ঘটে ২০১৮ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর। শুধু রয়ে যায়, পিছনে ফেলে আসা অমর, অসীম ইমারত।

 

 

 

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait