সামাজিক গল্প - দৃষ্টি   (দ্বিতীয় পর্ব)

সামাজিক গল্প - দৃষ্টি  (দ্বিতীয় পর্ব)

দৃষ্টি :  প্রথম পর্বের লিঙ্ক


দ্বিতীয় পর্ব


  সামনা সামনি দুটো চেয়ারে বসে অরূপ আর বাড়ির মালিক সুখেন পোদ্দার। চায়ের কাপে বারকয়েক চুমুক দিয়ে খালি কাপটা টেবিলে প্লেটের উপর নামিয়ে অরূপের দিকে তাকান তিনি। পুরু কাঁচ ওয়ালা মোটা ফ্রেমের কালো রঙের চশমাটা ঠিক করে বলেন, 

"আর একবার ভেবে দেখলে হোতো না বিষয়টা।তোমাদের ফ্ল্যাট দিতে মাত্র দেড় মাস বাকি, এইকটা দিন এখানেই থেকে যাও। এখান থেকে মালপত্র নিয়ে আরেক জায়গায় যাবে, সেখান থেকে আবার অন্য জায়গায়। বৌমার কথাটা একবার ভাবো। আর চলে যাবো বললেই তো আর হয় না। সময় লাগবে।মালপত্র গোছাতে হবে। তাছাড়া তুমি কী এই ব্যাপারে নিশ্চিত যে, তোমার বন্ধু যেখানে ঘরের কথা বলেছে সেখানে এরকম কোনো মানিক নেই। এমনও তো হতে পারে এখানে একটা মানিক আর ওখানে গিয়ে দেখলে দুটো কিংবা তিনটে মানিক আছে। তখন তুমি কী করবে। সৃজনী মামনির সঙ্গে বৌমার সেফটির কথাটাও একবার ভাবো। এখানে তোমরা বছর খানেক আছো, সবার সাথে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ডাকতে হাঁকতে আমরা আছি।দ্যাখো অরূপ, সৃজনী আমার নাতনি তিতলির বয়সী। ওকে আমি নিজের নাতনির মতো স্নেহ করি , সেজন্য বলছি। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভেবে চিন্তে নাও। রাগের বশে মাথা গরম করে কিছু কোরো না। জানি যেটা হয়েছে সেটা একদমই ঠিক না। তোমরা একটু সাবধানে থাকো।মানিক ছেলেটা মোটেই ভালো না।সব ভালোর সঙ্গে কিছু খারাপ জিনিস তো থাকেই। সেগুলো আমাদেরকে এড়িয়ে চলতে হয়। তার উপর এদের মাথায় কিছু নামি দামি মানুষের হাত আছে। তিতলি আর সৃজনীর স্কুল কিছুটা দূরে নাহলে আমিই দুজনকে দিয়ে আসা নিয়ে আসা করতাম। তিতলির মতো সৃজনীও যেত আমার সঙ্গে। তবুও (ঊমার দিকে তাকিয়ে) বৌমা তুমি যদি কোনো দিন সৃজনীকে আনতে যেতে না পারো তাহলে আমার বোলো, আমি নাহয় সেদিন একটা ব্যবস্থা করবো।আর এরকম কিছু আবার হলে আমরা আছি তোমার সঙ্গে। (চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সুখেন বাবু বললেন) আজ আমি আসি, আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখো।"

ADVERTISEMENT

সুখেন বাবু সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যান। ঊমা দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে চায়ের কাপদুটো তুলে নিয়ে অরূপকে বলে," কাকাবাবুর কথাটাও কিন্তু ফেলে দেওয়ার নয়।"

" হ্যাঁ, ঊমা। বয়স্ক অভিজ্ঞ মানুষ উনি।আমাদের ভালোর কথা ভেবেই বলছেন। কয়েকদিনের তো ব্যপার। একটু সাবধানে থাকতে হবে আমাদের।বিশেষ করে সৃজার উপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।" 

এই ঘটনা যারা জানতে পেরেছিল তারাও একই কথা বলেছিল। ঊমার আবৃত্তির ছাত্র ছাত্রীদের অনেকের বাবা মা বলেছিলেন," এই কজন ছেলের জন্য তাদের মেয়েরাও ঠিক মতো রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারে না।পরিবেশটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। কত বাজে বাজে কথা বলে।ওদের বাড়িতে বলেও কোনো লাভ হয়নি।একবার তো জেলও খেটেছে ছেলেটা। আপনার সৃজনীর সাহস আছে বলতে হবে। "কেউ কেউ তো এটাও বলেছিল," কাওকে না কাওকে তো প্রতিবাদ করতেই হতো। আপনি একদম ভয় করবেন না, দরকার হলে আমরা সবাই আপনার সঙ্গে আছি।"

সবার কথা শুনে মনে বেশ ভরসা পায় অরূপ আর ঊমা। বাকি কটা দিন ওখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয় ওরা।কিন্তু মেয়েকে কোনো সময় একা ছাড়ে না। হয় অরূপ নয় তো ঊমা সব জায়গায় দিয়ে আসা নিয়ে আসা করে। ঐ ঘটনার প্রায় দশদিন হয়ে গিয়েছে। পাড়ার মোড়ে, চায়ের দোকানে বা রাস্তাঘাটে কোথাও আর মানিককে দেখা যায় নি এই কদিন।একথা ঊমা অরূপকেও জানিয়েছিল। অরূপ বলেছে, মানিকের তো আর অভাব নেই । তাই ঊমা যেন মেয়ের উপর সদা সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখে। ঊমাও অরূপের কথা মতো কাজ করে যাচ্ছিল। আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা তারপরই তারা চলে যাবে এখান থেকে। নতুন ফ্ল্যাটটা সৃজনীর খুব পছন্দ হয়েছে। নিজের ঘরটা কীভাবে সাজাবে সেটা নিয়ে প্রতিদিন একবার করে বাবা মাকে বলে। সেদিনের পর আর মানিককে দেখতে না পাওয়ায় সৃজনীর মন থেকে সেদিনের ঘটনা ধীরে ধীরে আবছা হতে শুরু করেছিল। মানিকের উপর থেকে ভয়টাও কমে এসেছিল। 

কিন্তু ওদের অলক্ষ্যে যে কতবড়ো ষড়যন্ত্র চলছিল তা ওরা জানতেও পারলো না। মানিক আড়ালে থেকে ওর সাকরেদদের সাহায্যে সৃজার উপর নজর রাখছিল। ও কখন কোথায় যায়, কখন আসে, কী করে সবকিছুর। সেদিন ওর বন্ধুদের সামনে খাওয়া চড়ের কথা মানিক ভোলেনি। যেখানে বড় মেয়েরা ওকে কিছু বলেনা, চুপচাপ চলে যায় সেখানে ক্লাস এইটে পড়া একটা মেয়ে ওকে সবার সামনে চড় মেরেছে।এর শাস্তি তো ওকে পেতেই হবে। 

 সেদিন ছিল রবিবার,আলোর জন্মদিন। আলোর গোটাকয়েক বান্ধবী ও কাছের কিছু আত্মীয়দের নিয়ে একটা ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল আলোর পরিবার। সৃজনীরও নেমন্ত্রন্ন ছিল সেখানে সন্ধ্যাবেলায়। আলো বার বার বলে দিয়েছিল ও যেন সন্ধ্যে লাগার আগেই আলোর বাড়ি চলে যায়।আলোর বাবা নিজে এসে ঊমাকে বলে গিয়েছিলেন সৃজনীকে পাঠানোর জন্য। মেয়েকে সুন্দর করে সাজিয়ে নীল ও সাদার কম্বিনেশনে একটা লং গ্রাউন পড়িয়ে দেয় ঊমা। শেষে মেয়ের বাঁ হাতের কড়ি আঙুলের নখটা হালকা করে কামড়ে নজর লাগা থেকে বাঁচার জন্য নজরটিকা দিয়ে দেয়। অরূপের সেদিন ছুটি থাকায় সন্ধ্যে লাগার একটু পরেই মেয়েকে নিজে গিয়ে দিয়ে আসে ওদের বাড়িতে। আর বলে আসে খাওয়া হয়ে গেলে ওকে যেন একটা ফোন করে। অরূপ আবার গিয়ে নিয়ে আসবে। কারও সঙ্গে যেন না পাঠায়। 

সৃজনীকে দিয়ে এসে অরূপ ও ঊমা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। অরূপ কথা বলার থেকে বেশি ঊমাকে বিরক্ত করছিল। অন্যদিন তো সৃজা থাকে তখন অরূপ একদম ভদ্র ভাবে থাকে কিন্তু আজকে সৃজনী না থাকায় ভদ্রতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সৃজনীকে দিয়ে আসা প্রায় একঘণ্টা হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। অরূপ মুখে বিরক্তি নিয়ে বলে, "এখন আবার কে এল, শান্তিতে রোমান্সও করতে দেবে না।" ওর কথায় ঊমা হেসে উঠে যায় দরজা খুলতে। 

দরজার সামনে আলোর বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয় ঊমা। ওনার কথা শুনে একটু জোড়েই বলে ওঠে , "এসব কী বলছেন আপনি? সৃজা কখন বাড়িতে এল? ওকে তো ঘণ্টা খানেক আগে আপনাদের বাড়িতে দিয়ে এসেছে ওর বাবা।" ঊমার জোড়ে কথা বলা শুনেই অরূপ বেরিয়ে আসে দরজার কাছে। সামনেই আলোর বাবা দাঁড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। অরূপ এসে বলে, 

"কী হয়েছে ঊমা।এভাবে জোড়ে কথা বলছো কেন উনার সাথে?ভিতরে আসতে দাও ওনাকে। "

অরূপকে দেখেই ওর দিকে তাকিয়ে এলোমেলো ভাবে ঊমা বলতে থাকে, "অরূপ, দ্যাখো না উনি কী বলছেন।"

" কী বলছেন?" 

"উনি বলছেন সৃজা নাকি বাড়িতে এসেছে, তাও আবার তুমি দিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরেই। এখনও ওনাদের বাড়িতে যায়নি দেখে উনি সৃজাকে নিতে এসেছেন। তুমিই বলো,এটা কী করে সম্ভব!" 

ঊমার কথা শুনে অরূপ আশ্চর্য হয়ে ব্যস্ততার সাথে বলে, "দাদা আমি নিজে সৃজাকে আপনাদের বাড়িতে দিয়ে এসেছি। বৌদি কে বলেও এসেছি ওকে যেন কারও সঙ্গে না পাঠায়, আমাকে ফোন করে। আপনি ঠিক জানেন, আমি ওকে দিয়ে আসার পর সৃজা বাড়িতে এসেছে। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। ও হয়তো আলোর সঙ্গে বা অন্য কোনো বন্ধুর সঙ্গে আছে।"

আলোর বাবা কিন্তু কিন্তু করে বলে," আসলে হয়েছে কী, আলো যে বাড়িতে এসেছে এটা আমরাও কেউ জানতাম না। কিছুক্ষণ আগেই জেনেছি।আলো ওর জন্য মাথার একটা ক্রাউন আনতে বলেছিল। কিন্তু ওর মা আমাকে বলতে ভুলে যায়।আলো এই কথা সৃজনীকে জানাতে ও বলে,ওর নাকি একটা ক্রাউন আছে। আর সেটা নিতেই ও বাড়িতে আসে।সৃজনীর যেতে দেরী হচ্ছে দেখে কিছুক্ষণ আগে আলো আমাকে এই কথাটা বলে। ও মনে করেছে আপনারা হয়তো সৃজনীকে আর যেতে দেবেন না। তাই আমাকে বলল ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি আলোকে বকেছি এজন্য।"

অরূপ উত্তেজিত হয়ে বলে," আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছেন। আপনার বাড়িতে না থাকলে আমার মেয়ে কোথায়? আপনারা এতো ইরেসপন্সেবল জানলে আমি কখনোই আমার মেয়েকে ওখানে দিয়ে আসতাম না।একটা মেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আর আপনারা কেউ জানতেই পারলেন না।"

ওদের কথা শুনে ঊমা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। 
" তুমি এতো কথা বলছো কেন? আগে আমার মেয়েকে খোঁজো। কথা পরেও বলতে পারবে। সৃজা কোথায়, কী করছে কে জানে। "

" তুমি ঠিক বলেছো ঊমা, তুমি থাকো আমি দেখছি সৃজা কোথায়? "

" না না, আমি বাড়িতে থাকবো না। আমি ও যাবো তোমার সঙ্গে সৃজাকে খুঁজতে। এখানে আমার মন টিকবে না। আমাকেও নিয়ে চলো তোমার সঙ্গে।"

" ঠিক আছে চলো। ফোনটা নিয়ে নিই। তোমার ফোনটাও নাও।(আলোর বাবার দিকে তাকিয়ে) আগে আপনাদের বাড়িতে চলুন, ওখানে আগে একবার দেখে নিই, যদি থাকে।"

" চলুন। "


ক্রমশঃ ______

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait