কেমন ছিল রবি ঠাকুরের শেষের দিনগুলি

কেমন ছিল রবি ঠাকুরের শেষের দিনগুলি

বাইশে শ্রাবণ

রবীন্দ্রনাথ বেশ জোরের সঙ্গে বলতেন, আর সবার শরীর আর রবীন্দ্রনাথের শরীর এক নয়। কারণ অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তি, উন্নত দর্শন। বজ্রসেনের অলক্ষ্যে যেন নিজের সৌম্যমুর্তির কথাই উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছয়ফুট দুই ইঞ্চি দীর্ঘ দেহ, চওড়া বুক, সবল পেশী, আজানুলম্বিত মহাভূজ, বৃষস্কন্ধ, সিংহগ্রীবা। বিধাতা উজাড় করে দিয়েছেন -- স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য। এমন অলৌকিক মেধা, এমন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, এমন রূপবান জীবন শিল্পী-- কোটিতে গোটিক। সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চার সঙ্গে চলেছে স্বাস্থ্যচর্চা। ছেলেবেলা থেকে তিঁনি লড়েছেন কুস্তি, সাঁতরে এপার ওপার করেছেন পদ্মা। টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়েছেন প্রবল আনন্দে। তাই এমন মজবুত শরীরে কোন অসুখ সহজে এসে আক্রমণ করতে পারেনি। তিঁনি নিজেই বলতেন শরীরটা একগুঁয়ে রকমের ভালো ফলে দৈবাৎ কখনও জ্বর এলে বলা হত গা'গরম। অতুলনীয় স্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর দীর্ঘজীবন লাভের একটিই কারন ছিল পরিমিত আহার এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা। এই প্রসঙ্গে প্রতিমাদেবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ক্লান্তি শব্দটা বাবামশাইয়ের অভিধানে ছিল না। তাঁর ঘুম ছিল খুব কম, কখন যে তিঁনি ঘুমোতেন, কেউ জানতে পারতাম না। কিন্তু আর যেনো কথাটা বলতে পারছেন না। শরীরটা তেমন সায় দিচ্ছে না তা প্রায় বছরখানেক ধরে। কিন্তু কবির ক’দিন ধরেই অল্প অল্প জ্বর হচ্ছে।

প্রতিমাদেবী সেইসময় ছিলেন কালিম্পংয়ে। কবিও চললেন সেখানে। যাবার আগে অমিয় চক্রবর্তীকে লিখে গেলেন, ‘কিছুদিন থেকে আমার শরীর ক্রমশই ভেঙে পড়ছে, দিনগুলো বহন করা যেন অসাধ্য বোধ হয়। তবু কাজ তো করতে হয়- তাতে এত অরুচিবোধ সে আর বলতে পারিনে। ভারতবর্ষে এমন জায়গা নেই যে পালিয়ে থাকা যায়। ভিতরের যন্ত্রগুলো কোথাও কোথাও বিকল হয়ে গেছে। বিধান রায় কালিম্পং-এ যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু মন বিশ্রামের জন্য এত ব্যাকুল হয়েছে যে তাঁর নিষেধ মানা সম্ভব হল না। চল্লুম আজ কালিম্পং।’ নির্মলকুমারী মহলানবিশকে অবশ্য বলেছিলেন, কালিম্পং যাওয়া তার উচিত হবে না। বরং গিরিডি যাওয়ার দিকেই মন ছিলো। কিন্তু শেষমেশ গেলেন সেই কালিম্পংয়েই।

কালিম্পং যাত্রাই যেনো কবির জন্য কাল হলো। ২৭ সেপ্টেম্বর কবি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। প্রতিমাদেবী তড়িঘড়ি কলকাতায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে খবর পাঠালেন। সেদিন আবার মৈত্রেয়ী দেবী কবির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কালিম্পংয়ে সাহেব ডাক্তার খুব করে ধরেছিলেন অপারেশনের জন্য। কিন্তু কবির অপারেশনের আপত্তির কথা ভেবেই, প্রতিমাদেবী রাজি হলেন না। কবিকে ফিরিয়ে আনা হলো জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। 

দোতালার পাথরের ঘরটায় রাখা হয়েছে তাকে। গায়ে জ্বর। কীরকম একটা ঘুম ঘুম আচ্ছন্ন অবস্থা। ভালো করে কথা বলতে পারছেন না, কিন্তু মন সজাগ। ওই অবস্থাতেই একদিন দুপুরে রানী মহলানবিশকে ডেকে বললেন, ‘সামনের ওই আলমারিটা খোলো তো। ওই kali salf এর শিশিটা নিয়ে এসো।’ বায়োকেমিকে কবির খুব বিশ্বাস ছিলো। কবির এই বায়োকেমিক প্রীতির কথা নির্মলকুমারী ভালোই জানেন। ওষুধের বাক্সটা আনতে আনতে তিনি ভাবলেন, এবার নিশ্চয়ই নিজেই নিজের চিকিৎসা করবেন। ওষুধ এনে গোটা ছয় বড়ি কবির মুখে দিতে যাবেন, অমনি কবি মৃদু স্বরে বললেন, ‘আমি না নিজে খাও। হাত যে একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। আমার গায়ে হাত বুলোচ্ছ তাই টের পাচ্ছি যে, তোমারও আমারই অবস্থা, তুমি আবার আমার সেবা করছো।’ 

১৮ নভেম্বর কবি ফিরলেন শান্তিনিকেতনে। কখনই কারও সেবা নিতে চাইতেন না। কিন্তু এবারে তিনি যেনো অসহায়। বাধ্য হয়েই নিজেকে ছেড়ে দিয়েছেন সেবক-সেবিকাদের হাতে। এমনকি ডিকটেশন দিয়ে লেখানোর কাজও তিনি কখনও করেননি। এবার তাই করতে হচ্ছে। কখনও বা চেয়ারে একটু বসেন। কখনও বিছানায় শুয়ে পড়েন। সময় কী তবে ফুরিয়ে আসছে? জানলার ধারে আরামকেদারায় বসে প্রতিমাদেবীর বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দেখেন সৃষ্টির বিচিত্র এই লীলা। জীবন যেমন আছে, তেমনই মৃত্যুও আছে। তা তিনি সহজভাবে স্বীকারও করে নিয়েছেন। তবু ‘জীবন যেমন সত্য, মৃত্যুও ততোটাই সত্য। খুব কষ্ট হয় তা জানি, তবু এ কথা অস্বীকার করলে চলবে না যে মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোনো মূল্যই থাকে না, যেমন বিরহ না থাকলে মিলনের কোনো মানে নেই।’ তবু তরী যে কেন এমন হঠাৎ ডুবে যেতে চায়! কবির শরীর যেনো নিজের মনের সজীবতার সঙ্গে তাল রাখতে পারে না।

কিন্তু কবির শরীর যেনো আর চলে না। ১লা জুলাই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, রথী ঠাকুরের থেকে একটা চিঠি পেলেন। তিনি লিখেছেন, ‘ইন্দুবাবুরা বুধবার এসেছিলেন। ওঁদের তিনজনেরই অর্থ্যাৎ রামবাবু, জ্যোতিবাবু ও ইন্দুবাবুর মতো যে, অপারেশন করা উচিত। ইন্দুবাবু ভার নিয়েছেন যে ললিতবাবু শিলং থেকে ফিরলেই তাঁকে এখানে নিয়ে আসবেন-পরীক্ষা করবার জন্য। তারপর অপারেশনের দিন স্থির হবে। ইতিমধ্যে জ্বরটা কমবার জন্য অটোভ্যাকসিন দেওয়া হবে। ইউরিন এ গতবার কলি পাওয়া গেছে। রামবাবু আবার কাল আসছেন সম্ভবত ভ্যাকসিন নিয়ে আসবেন।  বাবার শরীর খুবই খারাপ হয়ে গেছে। জ্বর রোজই ১০০.৪ ডিগ্রি উঠছে। এখন সবসময় শুয়ে থাকতে হয় এত দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাই বিশেষ রকম চিন্তিত হয়ে আছি।’

কবির অপারেশনে একদমই ইচ্ছে নেই। কেবল বলেন, ‘আর কদিনই বা বাকি আছে? এই কটা দিন দিক না আমাকে যেমন আছি তেমন করে থাকতে। কোনোদিন তো আমাকে যেতেই হবে। কিন্তু আমি কবি। আমার ইচ্ছে কবির মতনই যেতে-সহজে এই পৃথিবী থেকে ঝরে পড়তে চাই, শুকনো পাতার মতো। যাবার আগে আমাকে নিয়ে এই টানাছেঁড়া কেন?’ তাই কবির ইচ্ছেতেই এলেন কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ মশাই। তাকে কবি বললেন, ‘দেখো হে তোমরা আমার কিছু করতে পার কিনা। ছেলেবেলা থেকে আমার শরীরে কোন অস্ত্রাঘাত হয়নি। শেষকালে কি যাবার সময় আমাকে ছেঁড়াখোঁড়া করে দেবে?’ কবিরাজ আশ্বাস দিয়ে বললেন, কবির নাড়ির গতি খুবই ভালো। যদিও এ রোগ পুরোপুরি সারে না, তবু শরীরের গ্লানি অনেকখানি কমে আসে। কবি বললেন, ‘তাহলেই হল। এই বয়সে তো আর আমি লাফালাফি করতে চাচ্ছি না। ... হাতের আঙুল টাঙুলগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেছে, লিখতে পারি না আজকাল। এটুকু পেলেও তো অনেকখানি।’ 

সেইমতো শুরু হলো চিকিৎসা। শরীরের এই হালেও রীতিমতো চালিয়ে যাচ্ছেন রসিকতা। একদিন ইন্দিরা দেবীকে সামনে পেয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, ‘তুই দেখ আমাকে এরা আজকাল কি খেতে দিচ্ছে। এ কি কখনো খাওয়া যায়? না কেউ কাউকে খেতে দেয়? ... কবিরাজমশাই বলেছেন এসব খেলেই নাকি আমি আর ক’দিন পরে লাফালাফি করে বেড়াতে পারবো। কিন্তু তুই সত্যি করে বল এসব কি মানুষে খেতে পারে? কেবলই চালকুমড়ো খাবো, কেবলই চালকুমড়ো খাবো? আর কি ভালো জিনিস কিচ্ছু নেই? তুই তো দেখছিস, এঁরা আমাকে কী খেতে দেন। তারপর আবার বলেন আহা আর একটু খান, আপনি কিছু খাচ্ছেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে, ভালো জিনিস একটু কিছু দাও, তারপরে দেখো খাই কিনা।’ কবির নালিশ করার ধরন দেখে সবাই হেসে উঠলেন। তাকে ঘিরে আনন্দের হাট যেমনি ছিলো তেমনই আছে। জীবনের এই চক্রটিকে বেশ ভালভাবে অনুধাবন করতে পারছিলেন। সেই পদ্মাচরের দিন আজ আর নেই। আজ আশেপাশে ঘোরাঘুরি অনেক নতুন মানুষের। এরকমটাই তো হওয়ার কথা- 
কবিরাজিতেও কাজ হচ্ছে না। ধীরে ধীরে সবাই অপারেশনের দিকেই ঝুঁকলেন। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন কবি নিজে।

অবশেষে এই ২৫ জুলাই, শান্তিনিকেতন থেকে কবিকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিন ধার্য হয়েছে। এতোক্ষণে ভোরও হয়েছে। আশ্রমের ছেলেরা এসে জড়ো হয়েছে কবির জানলার কাছে।

একটু পরে স্ট্রেচারের হাতলের ওপর ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে শান্তিনিকেতন দেখতে দেখতে কবি চলেছেন। আশ্রমের সবাইও বুঝেছে কবিকে আর হয়তো কাছে পাওয়া যাবে না। ছেলেমেয়েরা সবাই গাইছে-আমাদের শান্তিনিকেতন, আমাদের সব হতে আপন। যখন গাড়িতে উঠলেন, চালক ইচ্ছে করেই শান্তিনিকেতনের চারিদিক ঘোরাতে ঘোরাতে কবিকে নিয়ে চললেন। কবি শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন তার শান্তিনিকেতনকে। গ্রামের লোকেরা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো চিৎকার নয়, জয়ধ্বনি নয়, নীরবে তারা কবিকে বিদায় অভিনন্দন জানালো। দেখতে দেখতে শান্তিনিকেতনের সীমা শেষ হয়ে এলো, গাড়ি চলল স্টেশনের দিকে। চোখের ওপর রুমাল চাপা দিলেন কবি।

কাটাছেঁড়া কোনোভাবেই আটকানো গেলো না। ঠিক হয়েছে ৩০ জুলাই কবির অস্ত্রোপচার হবে। কবিকে সে কথা জানানো হলো না। তিনি শুধু শুনেছেন অপারেশন হবে, অজ্ঞান করা হবে না, লোকাল অ্যানাস্থেসিয়া করা হবে। বারবার জানতে চাইছেন, ‘আচ্ছা জ্যোতি, আমাকে বুঝিয়ে বলতো ব্যাপারটা কিরকম, আমার কতদূর লাগবে। আগে থেকেই আমি সব বুঝে রাখতে চাই।’ জ্যোতি অর্থাৎ ডা. নীলরতন সরকারের ভাইপো জ্যোতিপ্রকাশ রায় বললেন, তেমন লাগবে না। ওই ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো। চাইলে কবি অপারেশনের সময় মুখে মুখে কবিতাও তৈরি করে ফেলতে পারেন। কবি আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘তাহলে তুমি বলতে চাইছ যে আমার কিছুই লাগবে না? তাহলে তো আজ তোমাকে এখানে খাইয়ে দিতে হয় ভালো করে।’

অপারেশনের দিন সকাল থেকে কবি ছিলেন খোশমেজাজে। প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে কথাবার্তাও বলেছেন। সকালে একটা কবিতা লেখাও হয়েছে। কলকাতায় আসার পর থেকে ইতিমধ্যেই দু’টো কবিতা তৈরি হয়ে গেছে। আর আজ একটা।

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।…
কিছুতে পারে না তা'রে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভান্ডারে।…

সাড়ে ন’টার সময় রানি চন্দকে আরও তিনটে লাইন বললেন,

অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।

বললেন, ‘সকালবেলার কবিতাটার সঙ্গে জুড়ে দিস।’ তখন কে জানত, এটাই হবে কবির শেষ রচনা! সাড়ে দশটার সময় ললিতবাবু এসে জানালেন, আজ দিনটা ভালো মনে হচ্ছে, আজই তাহলে সেরে ফেলি? এই প্রথম গম্ভীর হলেন কবি। বললেন, ‘আজই?’। আয়োজন সব করাই ছিলো। স্ট্রেচারে করে কবিকে অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। সবাই উৎকণ্ঠিত। অবশেষে খবর এলো, অপারেশন ভালোয় ভালোয় হয়ে গেছে। বারোটার সময় রুগীকে তার বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো। কবির খাটের পাশে এসে দাঁড়ালেন, প্রশান্তচন্দ্র ও নির্মলকুমারী। কবি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘জ্যোতি মিথ্যে কথা বলেছে। কেন বলেছিল যে, কিছু লাগবে না। আমার খুব লেগেছে। এতো কষ্ট হচ্ছিল যে, আমি জোর করে ঠোঁট চিপে চোখ বুজে পড়ে রইলুম-পাছে আমার মুখ দিয়ে কোনরকমে আর্তনাদ বেরিয়ে যায়’।

অপারেশন হলো বটে। তবে কবির শারীরিক অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি হলো না। তবে কী স্যার নীলকান্ত সরকারের ভাবনাই ঠিক ছিলো? সবার শরীর আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরীর এক নয়। সে দেহ যেনো ভালো করে সুরে বাঁধা বাদ্যযন্ত্রের মতো। বাইরে থেকে আঘাত করতে গেলে সমস্ত দেহযন্ত্রটাই বিকল হয়ে যাবার আশংকা। সবাই চিন্তিত।

৩১শে জুলাই আবার কবির জ্বর বাড়ল। কষ্টে বলে উঠলেন, ‘জ্বালা করছে, ব্যথা করছে’।

১লা আগস্ট কবির হিক্কা শুরু হলো। কাতর হয়ে নির্মলকুমারীকে বললেন, ‘কিচ্ছু কমবে না। ওরা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না আমি তা টের পেয়েছি, কেবল আন্দাজে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছে। তুমি আমার কীরকম হেডনার্স? কমাও আমার কষ্ট।’ এলাচ–মিছরি দিতে সেদিন হিক্কা একটু কমলো। কিন্তু পরদিন ভোর থেকে আবার শুরু হলো হিক্কা। 

৩রা আগস্ট অবস্থা আরও সংকটজনক। অসাড় হয়ে আছেন কবি। মাঝে মাঝে পথ্য বা জল খাওয়াতে গেলে বলছেন, ‘আর জ্বালিও না তোমরা। ... যিনিই বলুন না কেন আমি কারও কথাই আর শুনছি নে। তোরা আর জ্বালাস নে আমাকে।’ মুষড়ে পড়লেন সবাই।
৪ঠা আগস্ট শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে এলেন প্রতিমাদেবী। তাকে চিনতে পারলেন। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। বরং সবার আশংকাকে সত্যি করে খবর এলো-কিডনি ফেল করেছে।

৫ই আগস্ট কবির বন্ধু, ডা. নীলরতন সরকার এলেন কবিকে দেখতে। অভ্যাসবশে নাড়ি দেখলেন। তারপর কবির হাতে ধীরে ধীরে হাত বোলাতে লাগলেন। চোখে মুখে ফুটে উঠছে অসহায়তা। ধ্বন্বন্তরি ডাক্তার তিনি। কিন্তু এ যেনো অর্জুনের হাত থেকে গাণ্ডিব খসে গেছে। কিছুই আর করার নেই। উঠে চলে যাবার সময় দরজার কাছ থেকে বারবার ফিরে চাইলেন। তিনি জানেন, এই তার শেষ দেখা। কবিও জানতেন। তার চোখে গড়িয়ে পড়ল জল। নীরবে বললেন কি, হে বন্ধু, বিদায়! ৬ই আগস্ট রাত্রি থেকেই স্যালাইন দেওয়া হলো। একবার কি কবিরাজকে ডাকা হবে? বিধানবাবু কিছুতেই রাজি হলেন না। সুতরাং কিছুই আর করার নেই। শুধুই অপেক্ষা।

৭ই আগষ্ট ১৯৪১ খৃষ্টাব্দ। বাইশে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ। রাখী পূর্ণিমার শেষ লগ্ন। আকাশ থেকে রাকা চাঁদের ওড়না সরিয়ে দিয়ে একটু একটু করে অরুণ আলোর অঞ্জলি ছড়িয়ে পড়েছে পূব দিগন্তে।

ADVERTISEMENT

জোড়াসাঁকোর সরুগলির সারারাত কেটেছে নিদ্রাহীন অথচ ভয়ংকর কিছুর সম্ভাবনায় আতঙ্কিত তটস্থ অবস্থায়। মাঝে মাঝে শোনা গেছে চেনাজানা মানুষদের আবেগ উৎকন্ঠাব্যঞ্জক প্রশ্নোত্তর।

ভোর চারটে বাজতে না বাজতেই গাড়ির আনাগোনা বেড়ে চলে। প্রিয় পরিজন আত্মীয়স্বজন সব আসছেন দলে দলে। চতুর্দিকে কেমন একটা অস্বস্তিকর অস্থিরতা। আজকের এই সিঁদুরভাঙা ভোরে ত্রিভুবনের কোথাও যেন আনন্দধারা বইছে না, সবাই আজ এক মোহন মৃত্যুর মুখোমুখি।

৬নং সদর স্ট্রীটের ঐতিহাসিক অট্টালিকার দোতলায় সেই ‘পাথরের ঘর’। অমৃতপথযাত্রীর শিয়র বরাবর নিত্যদিনের মতো পূবের আকাশ। ঠিক একইভাবে নিমীলিত নেত্রে শান্তম-শিবম্-অদ্বৈতম্-এর উপাসক আজ ধ্যানমগ্ন। ৩০শে জুলাইয়ের ‘অস্ত্রাঘাতের অপঘাতে’ প্রায় ১লা আগষ্ট থেকে প্রায় নির্বাক আচ্ছন্ন কবি হয়ত বা যোগনিদ্রায় মগ্ন। মাঝে মাঝে স্নেহধন্য পরিজনদের আকুল আহ্বানে হয়তো বা মুহুর্তের জন্য তপোভঙ্গ ঘটে, পরমুহুর্তেই আবার মগ্নচৈতন্যে ফিরে যান। এ যেন ‘মেঘের কোলে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা’।

গত সন্ধ্যা থেকে এ বাড়িতে বেড়ে গেছে আনাগোনা। লোকারণ্য। তবে রথযাত্রা নয় – বিশ্ববরেণ্য কবির বিদায়যাত্রা।

মাত্র সাত দিন আগে ৩০শে জুলাই ১৯৪১ কাঁপা কাঁপা হস্তাক্ষরে বাবামশায়ের শেষ স্বাক্ষরিত চিঠিখানি পেয়েছিলেন স্নেহের মামণি প্রতিমাদেবী শান্তিনিকেতনের রোগশয্যায় শুয়ে। ৩রা আগষ্ট টেলিগ্রাম পেয়ে অসুস্থ অবস্থাতেই ছুটে এসেছেন বাবামশায়কে শেষ দেখা দেখার জন্যে। কানের কাছে মুখ এনে আকুলকন্ঠে ডাকলেন তিনি – বাবামশায় - বাবামশায় – বাবামশায় – বাবামশায়।

ধ্যানমগ্ন ঋষি সাড়া দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখলেন। নির্মোহ নির্লিপ্ত দৃষ্টি। হয়ত বা সীমা নয়, অসীমের উদ্দেশ্যে মেলে ধরা। রূপ নয়, অরূপকে দেখার জন্যে আকুতি। ছোটদি বর্ণকুমারী অস্থিরতায় চঞ্চল হয়ে ভাইটির শয্যা শিয়রে ঘন শ্রাবণ মেঘের মত মুখভার করে একবার দাঁড়িয়ে আবার পালিয়ে যান কাঁপতে কাঁপতে। এমনি করে সারারাত কেটে গেছে তাঁর বিনিদ্রভাবে। ঘরের ভিতর কে আসে কে যায়, কারোর যেন কিছু নজরের মধ্যে আসে না। সবারই দৃষ্টি একজনের দিকে – মনে ভাবনা, আর কতক্ষণই বা এই অনিন্দ্যনিন্দিতকান্তি নশ্বরলোকে দৃষ্টির মধ্যে ধরা থাকবে।


0 comments

Sushanta Das

Sushanta Das

Shared publicly - 31st Aug, 20 11:50 am

A great piece of writing indeed.

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 31st Aug, 20 11:36 am

Excellent post

Aniruddha banik

Aniruddha banik

Shared publicly - 31st Aug, 20 10:01 am

Nice Post !

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait