বেদ এবং উপনিষদ ভারতবর্ষের প্রাণস্বরূপ। মহতী শিক্ষা, সুমহান জ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের সমাহার ঘনীভূত আকার ধারণ করেছে এই প্রাচীন গ্রন্থগুলির মধ্যে। সেই মহাউপনিষদের একটি সুক্ত বলছেন, “বসুধৈব কুটুম্বকম”। যার মানে হল এই গোটা বিশ্বই আমাদের ঘর।
কিন্তু মানবসভ্যতার ইতিহাস বলছে যে এই বাণীর যাথার্থ্য আমরা মনে রাখিনি বা রাখতে চাইনি। মানবসভ্যতা বহুবার কলঙ্কিত হয়েছে বহিরাগত শত্রুর আক্রমণে। ভূলুণ্ঠিত হয়েছে নারীদের সম্মান, ভেঙ্গে পড়েছে উপসনালয়, কপর্দকশূন্য হয়েছেন, পরাজিত হয়েছেন বহু সম্রাট। আবার নৃশংস জঙ্গি মনোবৃত্তি ছেড়ে কেউ কেউ হয়ে উঠেছেন ধর্মের রক্ষক। এই ভারতবর্ষে দস্যু রত্নাকর হয়েছেন ঋষি বাল্মীকি, চণ্ড অশোক হয়েছেন ধর্মাশোক, সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেছেন দীন-ই-ইলাহী, সমুদ্রগুপ্ত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত আরও অনেকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন শিক্ষার, গড়ে তুলেছেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়! যার খ্যাতি আজও জগতের মহাবিস্ময়। সমস্ত প্রজাদের এক ছাতার তলায় এনে বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ছত্রপতি শিবাজী গড়েছেন হিন্দু-পাদশাহী! শুধু এদেশেই বা কেনো? ফ্রান্স এ সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট প্রজাকল্যাণের জন্য তৈরী করেছেন নতুন আইন যা ‘কোড নেপোলিয়ন’ নামে বিখ্যাত। আব্রাহাম লিংকন আমেরিকায় ‘স্বাধীনতার সনদ’ তৈরি করে নিখিল মানবপ্রেমের সোপান রচনা করতে চেয়েছেন। ভাল উদাহরণের শেষ নেই৷
কিন্তু জন্মাবধি আমরা দেখে আসছি হিংসা হানাহানি মারামরির করাল গ্রাসে জীর্ণ এক পৃথিবী। খাদ্যে ভেজাল, নৈতিক অবনতি, শিশুমৃত্যু, খুন, নারীনির্যাতন, রাজনৈতিক তরজা। হিন্দু মুসলিম শিখ জৈন খৃষ্টান। মানুষ খুব কম। মনুষ্যত্ব তো একেবারেই বিলীন। কারো ঘরে কিছু হল তো হল। আমার তো কিছু হয় নি। সুতরাং আমি বাবা ঘর বন্ধ করে বসে থাকি। দীন মনোভাব, দীনতর অন্তঃকরণ। ভারতবর্ষের প্রাচীন নৈতিকতার শিক্ষা ভুলে প্রতিদিনই আমরা তর্ক নিয়ে বসি। একসাথে কোনকিছু করার জোর তো নেইই, ইচ্ছেও নেই৷ মনুষ্যত্বের এই অপমান দেখে মাঝে মাঝে চোখ জ্বলে ওঠে। ওই পর্যন্তই। কিছু করার ক্ষমতাও তো নেই৷ তাই চোখ টা মুছে নিই আবার।
অভ্যেস হয়ে গেছিল। কিন্তু পোড়া কপালে পোড়া চোখে এক মহত্ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম। বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ এক মহামারীর আগমন হল। করোনাভাইরাস তার নাম। প্রথম প্রথম ভাবছিলাম আমার সংসারটা যেন এই করাল গ্রাস থেকে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু এই স্বার্থপর ভাবনার গালে কষিয়ে এক চড় খেলাম ঈশ্বরের হাত থেকে। বুঝলাম, আমি সুরক্ষিত থাকলে তবেই বিশ্বও সুরক্ষিত, যেমন আমার পাশের পাড়ার লোকটা সুরক্ষিত থাকলে আমি সুরক্ষিত। ভাবতে বাধ্য হলাম, এই যে আমি একা একা ভাবি নিজেকে, আমি একা নইতো! গোটা পৃথিবীর মানুষ আমারই মত শঙ্কিত। অনুভব করলাম এখন সবার আগে দরকার সামাজিক সচেতনতার প্রসার। এই আকালের দিনে, এই মহামারীর দিনে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথা আর একবার বলি। তিনি বলেছিলেন, “তুই কিটানুকীট, তুই জীবের উপকার কি করবি! তার থেকে শিবজ্ঞানে জীবসেবা কর”। ভুলে গেলাম দাঙ্গা, ভুলে গেলাম স্বার্থপরতা। কি সুন্দর লাগছে এখন পৃথিবীটাকে। ঐক্যবদ্ধ। কোনো ধর্মের ভেদাভেদ নেই, কোনো শ্রেণীবিভাগ নেই৷ সবাই সবাইকে বার্তা দিচ্ছে সাথে থাকার, পাশে থাকার। কি অদ্ভূত শান্তি। এই মহামারী হয়ত মিটে যাবে, কিন্তু মানবসভ্যতার ইতিহাসে সগৌরবে লেখা থাকবে এক জোটবদ্ধ সংগ্রামের কথা, গোটা পৃথিবীর মানুষের এক হয়ে লড়াইএর কথা। আচ্ছা, ঈশ্বর কি আমাদের কোনো বার্তা দিতে চাইছেন? নাহলে এই হানাহানির পৃথিবীতে মাত্র সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে আমরা এক হয়ে গেলাম কিভাবে?
রাজপুত্র গৌতম মার আর মারি কে নিজের মনের ওপর রাজত্ব করতে দেন নি। তাদের হারিয়ে বোধি লাভ করে হয়েছিলেন ভগবান বুদ্ধ। আমরাও আজ এক লড়াইতে শামিল। ইতিহাস সাক্ষী থাকবে, আমরাও বোধিলাভ করতে পারব কিনা। প্রকৃত অর্থেই আজ আমরা “বসুধৈব কুটুম্বকম”!!
0 comments