‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে’ বা Fête de la Musique

‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে’ বা Fête de la Musique

করোনার জেরে গত ৬৯ দিন ধরে দেশ জুড়ে লকডাউনের শেষে আনলক হওয়ার পর করোনায় মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দেশে আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৩ লক্ষেরও বেশি। মন ভালো নেই পৃথিবীর। আর সেই মন কেমনের বাস্তব চিত্রটাই ধরা পড়ছে পৃথিবীর সব সঙ্গীত শিল্পীর কন্ঠে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থসংস্থা জানাচ্ছে সম্মিলিতভাবে সঙ্গীত অনুষ্ঠানের মহড়া থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই নিরুপায় হয়ে মানুষ এখন অনলাইনে সুরের আকাশে মুক্তির খোঁজ করছেন। আমাদের বাংলাতেও শিল্পীরা গেয়ে উঠছেন ‘পৃথিবীর মন ভালো নেই’।

হ্যাঁ একদিন ছিল যখন সুরের মায়াজালে প্রকৃতিতে আগুন জ্বলত, আকাশ থেকে বৃষ্টি নামত। কিছুদিন আগেও এই বাংলাতেই কোমা অবস্থা থেকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিল সঙ্গীত। রোজ একটু একটু করে সঙ্গীত ঢুকছিল তাঁর কানে। তিনি ছিলেন গভীর কোমায়। শুয়েছিলেন প্রায় গানের ও-পারে। একদিন, দু’দিন তিন দিন…। শিরা-উপশিরা-ধমনিতে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছিল দরবারি কানাড়া। কী আশ্চর্য! সুরের ছোঁয়ায় এক মাস পরে চোখ মেললেন ডেঙ্গির ছোবল খাওয়া তরুণী।

ADVERTISEMENT

আবার দীপক রাগে যখন বহ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়তো, তখন মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি আনতেও ভুলতেন না তানসেন। বিভিন্ন ‘রাগ’ এর ওপর তার ছিলো অদ্ভুত এক নিয়ন্ত্রণ, সঙ্গীত শিল্প যেন নিজেকে সঁপে দিয়েছিলো সঠিক নিয়ন্ত্রকের হাতেই। হ্যাঁ, এই নিয়ন্ত্রকই তিনি, সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। যিনি রাতের বেলা আকবরকে এক সুমধুর রাগের মাধ্যমে ঘুম পাড়াতেন এবং সকালে আরেক অপূর্ব রাগ গেয়ে শান্ত ভঙ্গিতে আকবরকে ঘুম থেকে জাগাতেন। সম্রাটের যখনই ঘোড়া কিংবা হাতির পিঠে আরোহণ করবার সময় আসতো,  আর যখন ওরা চঞ্চল হয়ে উঠত, সেইসময় তানসেনই তাদের গান গেয়ে শান্ত করতেন আর সম্রাট নিরাপদে তাতে আরোহণ করতেন। সঙ্গীত এমনই এক শিল্প যার কারণে পৃথিবীর মন ভালো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু পড়তে হবে সঠিক নিয়ন্ত্রকের হাতে যা আজ সারা ভারতবর্ষে কেন সারা পৃথিবীতে বড় অভাব। তবু এই দুর্দিনে মানুষ অনলাইনে গাইছেন পৃথিবীর মন ভালো করে দেওয়ার জন্য। পৃথিবীর শরীরকে সুস্থ করে দেওয়ার জন্য।

যাই হোক এই সঙ্গীত শিল্প কয়েক বছর আগে থেকেই ‘ভ্যালেনটাইন ডে’-র মত ‘বিশ্ব সঙ্গীত দিবস’ হিসাবে পালিত হচ্ছে। ফরাসী ভাষায় ‘ফেট ডে লা মিউজিক’- আর বাংলায় ‘বিশ্ব সংগীত দিবস’ । ২১ জুন পালিত হয় বিশ্ব সংগীত দিবস ৷ বহু বছর ধরেই এই দিনে ঐতিহ্যবাহী মিউজিক ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করছে ফ্রান্স। এভাবে, ১৯৮২ সালে এসে এ ফেস্টিভ্যাল ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে’-তে রূপ নেয়। ‘গান হতে হবে মুক্ত; সংশয়হীন’- এই স্লোগানকে সামনে রেখেই বিশ্বের ১১০টি দেশ যোগ দেয় এই আন্দোলনে। ১৯ বছরের পথপরিক্রমায় আন্তর্জাতিক মাত্রা পায় এটি। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, স্থানীয়ভাবে অথবা ফরাসি দূতাবাসের সহায়তায় জুনের ২১ তারিখে পালন করা হয় ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে’। ১৯৮২ সালে ফরাসি মন্ত্রী জ্যাক ল্যাং সর্বপ্রথম বিশ্ব সংগীত দিবস পালনের প্রস্তাব করেন। ১৯৮৫ সালের ২১ জুন প্রথম গোটা ইউরোপ এবং পরে সারা বিশ্ব এই সংগীত দিবস পালন করে। এরপর থেকে দিনটি বিশ্ব সংগীত দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরে প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই মিউজিক্যাল ফেস্টিভ্যাল।

ফ্রান্সে জন্ম হলেও এই চিন্তাধারার জন্ম হয়েছিল মার্কিন মুলুকে! ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে’ চিন্তাধারাকে বয়ে এনেছিলেন এক মার্কিন সঙ্গীতজ্ঞ জোয়েল চোহেন। সত্তরের দশকের সেই সময়ে ফ্রান্সের এক রেডিও স্টেশন (ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল রেডিও)-তে মিউজিক প্রোডিউসার ছিলেন চোহেন। এই সঙ্গীতপ্রেমীর মাথায় উঁকি দেয় এই ধারণা। তিনি ভাবেন গ্রীষ্মকালীন বছরের সবচেয়ে দীর্ঘতম দিন উত্তরায়ণের দিন। তাই ২১ জুন উত্তর গোলার্ধের সব চেয়ে বড় দিন হওয়ায় দিনটিকে সঙ্গীত দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বেছে নেয়া হয়। তিনি ভাবলেন এই দিনটাকে গানে গানে ভরিয়ে উদযাপন করলে কেমন হয়! চোহেন চেয়েছিলেন বছরে গ্রীষ্মের দীর্ঘতম দিন তথা গ্রীষ্মের প্রথম দিনটিকে স্বাগত জানাতে। এদিন সন্ধ্যেটা গানে গানে ভরিয়ে তুলতে। সেই ভাবনা থেকেই তার মাথায় আসে ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে’-র ধারণা। পরে চোহেনের এই ধারণাটিকে মান্যতা দেয় ফ্রান্স সরকার। উৎসবের মর্যাদা দেওয়া হয়। সেই বছর থেকেই ফ্রান্সে শুরু হয় ‘ফেতে দে লা মিউজিক’ (Fête de la Musique) বা ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে’। পেশাদার হোক বা সখের শিল্পী সমস্ত ধরণের সঙ্গীত শিল্পীই এই উৎসবে যোগ দিতে পারেন। ১৯৮৫ সালের পর থেকে ইউরোপের আশেপাশের দেশগুলিও এই উৎসবে যোগ দিতে শুরু করে।

গান ভালবেসে গান। সমালোচকদের ভাষায় গানের জন্য একটা দিন চিহ্নিত করে দেওয়া ঠিক নয়। তাহলে ব্যাপারটা কেমন যেন হুজুগে পরিণত হবে। গানবাজনার ছুতোয় ‘সেলিব্রেট’ করার আর একটা দিন? কেউ বলছেন “সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্য প্রতি দিনই সঙ্গীতের দিন। বিশ্ব সঙ্গীত দিবস বলে চিহ্নিত করলে সেটা পাশ্চাত্য ধারণার বশবর্তী হতে হবে। তাহলে তো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দিবসও পালন করা উচিত।”

আবার কেউ বলছেন “বিশ্ব সঙ্গীতকে কোনও নির্দিষ্ট ‘টিউনে’ বাঁধলে সেখানে একটা সংকীর্ণতা আসতে পারে। অনেকের ধারণা “কলকাতায় বসে বিশ্ব সঙ্গীত দিবস পালন করা যদি হুজুগ হয় হোক না। এই দিনে সুরের দুনিয়ায় কোনও বৈষম্য থাকবে না। যেহেতু সঙ্গীতই সবার আগে দেশ-কালের গণ্ডি পেরোয়। কাঁটা তারের বেড়া ভাঙে। সেই কারণেই আমেরিকান সাহিত্যের আগেই সেখানকার সঙ্গীত আমাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। যে সঙ্গীত মানুষকে স্পর্শ করে, যে সুর কানে গেলে ভুলে যাই ভৌগোলিক সীমানার কথা, সেই সঙ্গীতই বিশ্ব সঙ্গীত।” এ শহরের বাতাসেও তাই একই সঙ্গে ঘুরে ফেরে কীর্তন আর সুফির সুর।

তাই গানবাজনা দিয়েই হোক আর হজুগেই হোক্ বিশ্ব সঙ্গীত দিবস আসলে সঙ্গীতের মাধ্যমে বিশ্বকে এক করে। আজ যেখানে করোনা হানায় সারা বিশ্ব প্রায় কোমায় চলে গেছে সেখানে সঙ্গীত দিয়ে বিশ্বের বুকে প্রাণ সঞ্চার করার মত রূপকথা তৈরি হতে পারে।

 

সূত্র: ইন্টারনেট
ছবি সৌজন্যঃ www.newsd.in

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait