সালটা ১৯১৯। রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেছেন কয়েক মাস আগে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তিনি কলকাতা থেকে শিলং এলেন। সঙ্গে এলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। শিলং সেই সময় আসামের রাজধানী হলেও আসামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর তখনও সিলেট।
এই সিলেট সফরের সময়ই প্রায় ১২ বছর আগের লেখে ‘হাছন উদাস’ নামক একটি গানের বই কবির হাতে আসে। লেখক হাসন রাজা। জমিদার কবি হাসন রাজা তখনো জীবিত এবং নিতান্তই অপরিচিত।
পরবর্তীকালে ১৯২৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তারিখে ভারতীয় দার্শনিক কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার সিনেট হলে। সভাপতি রবীন্দ্রনাথ। ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি সিলেটের অখ্যাত গ্রামে জন্ম নেওয়া সাধক কবি গীতিকার হাসন রাজার নাম উল্লেখ করেন। আরও পরে তিনি হাসন রাজার কিছু গান ইংরেজিতে অনুবাদও করেন। পরে ১৯৩০ সালে তিনি যখন বিলেত গিয়েছিলেন তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভাষণে হাসন রাজার ইংরেজি অনুবাদকৃত গান দুটির উল্লেখ করেন। তাঁর বক্তৃতায় অত্যন্ত বিনয়ের সাথে, যাদের সাহিত্য ও ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মরমী কবি হাসন রাজা ।
ADVERTISEMENT
রবীন্দ্রনাথের থেকে বছর সাতেকের ছিলেন। হাসন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালে আর রবীন্দ্রনাথের ১৮৬১। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক হাসন রাজা প্রতাপশালী জমিদার হয়েও সমস্ত রকম ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে সাধারণ মানুষেরই মাঝে বাউল ও মরমি গানের মাধ্যমে বিলীন হয়ে গেছেন। খুঁজে পেয়েছেন নিজেকে।
হাসন রাজার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন হিন্দু। হাসন রাজার প্রপিতামহ রাজা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব (কারো কারো মতে বাবু রায়চৌধুরী) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। নাম রাখেন বাবু খাঁন।
ইংরেজ রাজত্বকালে হাসন রাজার পিতা বৃহত্তর সিলেটের বিখ্যাত জমিদার ছিলেন। সিলেটের বিশ্বনাথ থানার অন্তর্গত কৌড়িয়া পরগনার বিশাল রামপাশা এস্টেট, সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী, চামতলা, মহারাম, পাগলা, লাউড় ও বর্তমান ভারতের করিমগঞ্জের অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তাদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৩-৫ লাখ বিঘা ছিল।
সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে আলী রাজা চৌধুরী এবং হুরমত জান বিবির ঘরে জন্ম হয় হাসন রাজার। এই হুরমত জান বিবি ছিলেন আলী রাজার খালাতো ভাই আমির বখ্শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা। পরে আলী রাজা তাকে বিবাহ করেন। হাসন রাজা ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র। সিলেটে তখন আরবী-ফার্সি চর্চার খুব প্রচলন ছিল। সিলেটে ডেপুটি কমিশনার অফিসের নাজির আবদুল্লা ছিলেন একজন বিখ্যাত ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁর পরামর্শে নামকরণ করা হয় হাসন রাজা। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন।
বংশের নিয়ম অনুযায়ী তিনি প্রথমে আরবী এবং পরে বাংলা ভাষায় পাঠ নিতে শুরু করেন। হাসন যে যুগে জন্মেছিলেন সে সময় মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষার সেভাবে প্রচলন না থাকার দরুন বিদ্যালয়ের পড়াশুনা তার বেশী করা হয়ে ওঠেনি।
কিশোর বয়েসে দুটি মৃত্যু তাঁর জীবনকে বড় নাড়া দিয়ে যায়। তাঁর বৈমাত্রেয় বড় ভাই ওবেদুর রাজা এবং পিতা আলী রাজার মৃত্যু। এরপর হুরমত তাঁকে জমিদারি দেখার ভার দেন। হাসনের বয়েস তখন মাত্র পনেরো।
খুব কম বয়সে এত সম্পত্তির মালিক হওয়ায় হাসন বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পরেন। তিনি ভাওয়ালী নৌকা এবং ঘোড়ায় চড়তে খুব ভালাবাসতেন। শোনা যায় অনেক নারীর সাথেও তার মেলামেশা ছিল। তার একটি গানে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘‘সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া’’। একটা সময় এমন ছিল যখন আনন্দ উল্লাসে সময় কাটানোই ছিল তার একমাত্র বাসনা। ফলস্বরূপ তিনি প্রজাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন ক্রমশ। নিজের স্বভাব দোষেই অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর রাজা হিসেবে পিরিচিত হয়ে উঠলেন। প্রত্যেক বছর বিশেষ করে বর্ষার সময়, নৌকাবিহারে যাওয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সাথে থাকতো নৃত্য-গীতের ব্যবস্থা। এই সময়ও তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন। সেই সব গানে পাওয়া যেত মানুষের নশ্বর জীবনের কথা, নিজের অপরাধবোধের কথা। বাইজী দিয়ে নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত।
ভালোবাসতেন পশু-পখি। তাদের যত্ন ও লালন পালনের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন। আরও নানান বিচিত্র শখ ছিল তাঁর। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের এক জায়গায় জড়ো করে রুপোর টাকা ছড়িয়ে দিতেন। বাচ্চাগুলি সেই টাকা কুড়োবার জন্য দৌড়ঝাপ হুটোপুটি করতো, তখন তিনি খুব মজা পেতেন। তিনি ছিলেন ইংরেজবিদ্বেষী। পরাধীনতা বরদাস্ত করতেন না। তিনি তার এস্টেটের জন্য ইংরেজ ম্যানেজার ও দেহরক্ষীও রেখেছিলেন।
কে জানতো সেই ভোগবিলাসী জমিদারই একদিন হয়ে উঠবেন প্রজাদরদি এবং দরবেশ জমিদার! সংসারে এক সন্ন্যাসী।
শোনা যায়, ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন আসাম এবং সিলেট অঞ্চলে এক ভয়াবহ ভুমিকম্প হয়। প্রচুর মানুষ ও পশু-পাখি প্রায় হারায় তাতে। এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে এই সবই দেখতে পান এবং এরপরই তাঁর মনে জীবন সম্পর্কে কঠিন বৈরাগ্যের সূচনা হয়। তিনি ধারণ করেন বৈরাগীর বেশ। শুধু বহির্জগতই নয়, তার অন্তর্জগতেও শুরু হয়ে গেল পরিবর্তন। কামিনী কাঞ্চনের প্রতি তিনি ক্রমশ নিরাসক্ত হয়ে উঠতে লাগলেন। মনে দেখা দিল এক ধরনের উদাসীনতা। নিয়মিত প্রজাদের খোঁজ খবর রাখা থেকে শুরু করে মসজিদ ও আখড়া তৈরী, বিদ্যালয় প্রতিষ্টা ইত্যাদি করতে থাকেন। সুনামগঞ্জের প্রধান শীর্ষ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অকাতরে দান করেন। এর মধ্যে বলতে হয় সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা। আর এর পাশাপাশি চলতে থাকে গান রচনা।
হাসনের চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যেতে লাগলো তাঁর গানে। তিনি কত গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। অনুমান করা হয়, অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে রয়ে গিয়েছে আর বেশ কিছু কালের নিয়মে হারিয়ে গিয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫৫৩টি গানের সন্ধান পাওয়া গেছে। অনেকে মনে করেন হাসন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশী।
হাসন রাজার গানগুলো শুনলে মনের মাঝে আধ্যাত্ম বোধের জন্ম হয়। তাঁর অনেক কবিতা ও গানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধন পাওয়া যায়। নারী ললুপ জমিদার এক সময় নিজেই গেয়ে ওঠেন, ‘ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন’। তাঁর গানে হাসন বার বার অদৃশ্য এক মহাশক্তির কথা বলেছেন। এই মহাশক্তিকে কেবল অনুভব করা যায়। একমাত্র তৃতীয় নয়ন খুললেই তাকে দেখা বা উপলব্ধি করা সম্ভব। বাস্তবে হাসন ছিলেন সংসারের মায়ায় আবদ্ধ। তাই তিনি বলেছেন, ‘স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল। কেমনে করিবে হাসন বন্ধের সনে মিল।’ এই আত্মবিশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই হাসন রাজা মরমি-সাধন-লোকের সন্ধান পেয়েছিলেন।
১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ। সুনামগঞ্জের গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে নিজের মায়ের কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শুয়ে পড়েন মরমী কবি হাসন রাজা। এই কবরখানা তিনি মৃত্যুর আগে নিজেই প্রস্তুত করেছিলেন।
হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর। এই জাদুঘরের নাম ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’। এখানে হাসন রাজা ও তার পরিবার সম্পর্কিত নানান তথ্য প্রদর্শিত হয়েছে। কালোত্তীর্ণ এক সন্ন্যাসী রাজার ব্যবহৃত তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, কুর্তা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতা ও গানের পাণ্ডুলিপি এখন সবাইকে আবেগাপ্লুত করে রাখে।
কোনো প্রকার কৃত্রিমতা ছাড়াই অত্যন্ত সহজ সরলভাবে হাসন রাজা তার গানে হৃদয়ের অনুভূতিকে জায়গা করে দিয়েছেন। আঞ্চলিক সুর ও কথার যে অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন তিনি তার গানে তা বাংলার ইতিহাসে বিরল । হাসন রাজা বুঝেছিলেন জীবনের মুসাফিরখানায় মায়া মমতায় আবদ্ধ হয়ে থাকার কোনো সার্থকতা নেই। তাই তিনি রচনা করেছিলেন -
“লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার”
0 comments