কৃষক আন্দোলন ও রবীন্দ্র-ভাবনায় কৃষি-পরিকল্পনা

কৃষক আন্দোলন ও রবীন্দ্র-ভাবনায় কৃষি-পরিকল্পনা

এই প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে প্রথমেই যেটা মনে আসে সেটা লো, রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজের টাকায় তৈরি হয়েছিল কৃষি ব্যাঙ্কআজ বাংলার কৃষক প্রসঙ্গে আলোচনা করার আগে তাই আর একবার স্মরণ করে নেওয়া যাক রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির দিনটা

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

সে দিনটা ছিল খুব হাওয়ার রাত খোয়াইজুড়ে রাস পূর্ণিমার গোল হলুদ চাঁদ উঠেছে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে পারুল বন জোব্বার পকেট থেকে টেলিগ্রামের কাগজটা বের করলেন কবি ভাঁজ খুলে বার দুয়েক পড়লেন চেয়ে রইলেন দূর বনপথে চোখে উদাস করা চাহনি তারপর উদাসীন ভাবে নোবেল প্রাপ্তির টেলিগ্রামটা সচিবের দিকে এগিয়ে বললেন, -

‘‘নিন, নেপালবাবু এই আপনার ড্রেন তৈরির টাকা!’’

রবিঠাকুরের কথা শুনে নির্বাক আশ্রম-সচিব নেপালচন্দ্র রায়! দুচোখের কোণ ভিজে এল তাঁর!

১৯০৫ সালেই তিনি পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেননএই ব্যাংকের মূলধন বন্ধুদের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার করে জোগাড় করেন ছাড়া বিশ্বভারতী হাসপাতাল ফান্ড টিউবওয়েল ফান্ডের টাকা জোগান রেখে আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধি করে চাষিদের কাছে অধিক পরিমাণে টাকা জোগান দেওয়ার মতো প্রচেষ্টা করা হয়পরে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ৮২ হাজার টাকা পতিসরের ব্যাংকে রেখে মূলধনের সমস্যার সমাধান করা হয়

কারণ একদিন হয়ত অনেক কষ্ট পেয়ে তিনি লিখেছিলেনদুই বিঘা জমিকবিতারবীন্দ্রনাথের এই কবিতা শিরোনাম পরবর্তীকালে সলিল চৌধুরী বিমল রায় রিকশাওয়ালার গল্পের উপর অনুপ্রাণিত হয়ে একটি হিন্দি ভাষা চলচ্চিত্রদো বিঘা জমিন (১৯৫৩) নির্মাণ করেন

শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে

বাবু বলিলেন, "বুঝেছ উপেন, জমি লইব কিনে“…

রবীন্দ্রনাথ তাঁর দুই বিঘা জমি বলেছেন, গরিব কৃষক উপেন একজন প্রান্তিক কৃষক তার যে জমিজমা ছিল তার মধ্যে দুই বিঘা জমি ছাড়া সবই ঋণের দায়ে তাকে হারাতে হয়েছে তার সম্বল এখন শুধু ভিটেমাটির এই দুই বিঘা জমি কিন্তু উপেনের কপাল খারাপ তার এলাকার জমিদার বাবুর ভূমির শেষ নেই তবুও জমিদার বাবুর নজর পড়ে উপেনের দুই বিঘা জমির উপর বাবু উপেনের জমি কিনতে চান শুনে উপেন বলে, রাজা এই দেশের মালিক আপনি, জায়গার অভাব নেই কিন্তু আমার এই জায়গাটি ছাড়া মরার মতো ঠাঁই নেই; উপেন দুই হাত জোড় করে বাবুর কাছে ভিটেটা কেড়ে না নেওয়ার অনুরোধ করে এতে বাবু রেগে চোখ গরম করে চুপ করে থাকেন নাছোড়বান্দা বাবু দেড় মাস পরেই মিথ্যে ঋণের দায়ে উপেনের প্রতি ডিক্রি জারি করেন উপেন নিজের ভিটে ছেড়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়

এভাবে ১৫/১৬ বছর কেটে যায় অনেক তীর্থস্থান, শহর, গ্রাম সে বিচরণ করে, তবুও উপেন তার দুই বিঘা জমির কথা ভুলতে পারে না নিজের বাড়িতে এসে উপেন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে স্মৃতিময় আমগাছটি দেখে তার মনের ব্যথা দূর হয়ে যায় আমগাছটির নিচে বসে সে ভাবতে থাকে ছেলেবেলার কথাগুলো তখন হঠাৎ তার কোলের কাছে দুটি আম ঝরে পড়ে ক্ষুধার্ত উপেন ভাবে আমগাছটি তাকে চিনতে পেরে দুটি আম উপহার দিয়েছে কিন্তু আম দুটি হাতে নিতেই বাগানের মালি লাঠি হাতে এসে উপেনকে গালিগালাজ করে, উপনকে ধরে রাজার কাছে নিয়ে যায় বাবু তখন মাছ ধরছিলেন মালির কাছে সব শুনে বাবু রেগে উপেনকে বকা দেন, মারতে চান উপেন কাতর হূদয়ে বাবুর কাছে আম দুটো ভিক্ষা চায় কিন্তু বাবু উপেনকে সাধুবেশী চোর বলে উল্লেখ করেন এতে উপেন হতভম্ব হয়ে যায় চোর উপাধি শুনে উপেনের চোখ দিয়ে ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা পরিহাসের কথা মনে পড়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে

তাই প্রান্তিক কৃষকের জমিজমা ঋণের দায়ে যখন মালিকের হাতে চলে যায় তখন একজন প্রান্তিক কৃষকের কি হাল হয় তা উপরের গল্পেই দেখানো আছেএখন কৃষক আর মালিকের মধ্যে চুক্তি ভঙ্গ হলে সাধারণ কৃষকের পাশে সরকার কী ভাবে থাকবে বা থাকবে কি না তা কারও জানা নেই, বা থাকবে কি না তার কোনও গ্যারান্টি নেইরাজ্যের হাত থেকে কৃষি এখন চলে যাচ্ছে কেন্দ্রের অধিকারেযেটুকু আইনি ব্যবস্থা ছিল কৃষক স্বার্থ রক্ষায় তাও তুলে নেওয়া হল নতুন ব্যবস্থায়কৃষি পণ্য লেনদেনে কৃষক স্বার্থ দেখার খাতাকলমের ব্যবস্থাটুকুও তুলে নেওয়া হলতৈরি হল তিন ধরনের বাজারমান্ডি, চুক্তি চাষ, মান্ডির বাইরের বাজারমান্ডি তৈরি হয়েছিল ফড়েরা যাতে কৃষকদের জমি থেকে পণ্য তুলে তাদের অত্যাচার না করতে পারেনতুন ব্যবস্থায় সমালোচকরা মনে করছেন ফড়েদের রাস্তা আরও প্রশস্ত হলঅত্যাবশ্যক হয়েও চাল, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ আর আলু অত্যাবশ্যক থাকল নারাজ্যের হাতেও বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণের কোনও অধিকার থাকল না

আর চুক্তি-চাষ শুরুতে একটা মজা আছেঅনেকটা অজানা-অচেনা বিবাহিত দুই নারী-পুরুষেরশুধু একটি বছরবিয়ের গল্পের মতোকয়েক বছর আগে কিছু কৃষক পেপসিকো সঙ্গে ফুড প্রসেসিং কোয়ালিটি আলুচাষে চু্ক্তিবদ্ধ হয়েছিলকোম্পানি বীজ, সার কীটনাশক সরবরাহ করেছিলশর্ত ছিল ফসলের দাম থেকে এসবের দাম পরিশোধ হবেআরও শর্ত ছিল, উৎপাদিত আলু কোম্পানি কিনে নেবেদাম শুরুতেই ঠিক হয়েছিলকুইন্টাল প্রতি আটশ টাকাখোলা-বজারের দামের তুলনায় তিনশ থেকে চারশ টাকা বেশিআলুচাষীরা বেজায় খুশিকিন্তু তৃতীয় বছরে কোম্পানীর কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্ট যখন আলুর গ্রেডিং করে আলুর কোয়ালিটির প্রশ্ন তুলল, তখন চাষীরা কমবেশী অর্ধেক পরিমাণ আলুর দাম পেল খোলা বাজারের দামের তুলনায় অর্ধেকফলে, মোটের উপর লাভ পেল সামান্যএরপর থেকে তারা আর পেপসিকোর ছায়া মাড়ায়নিআর আইনের বলে কোম্পানির পোয়াবারোকৃষকরা এখন চোখে সর্ষেফুল দেখছেমনে পড়ে যায় অংশুমান রায়ের গাওয়া সেই গানটা, -

মাথার টোপর পরার আগে ওজন রে দেখো
ওগো শোলার টুপি লোহার হবে সেটা মনে রেখো

যাই হোক, আর আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বাংলার কৃষক কৃষির উন্নতির জন্য ভাবনা কি ছিল বা শুধু ভাবনাই নয়, তিনি কি পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তার রূপায়ণেও কতটা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেটা একটু আলোচনা যাকযদি কোনও সহৃদয় ব্যক্তি এটা পড়ে তার চিন্তাধারাকে আজকের কৃষক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সমাধানের রাস্তা বাতলে দিতে পারেন তাহলে এর চাইতে মহৎ কাজ আর কিছুই হয় নাকবিগুরু কালান্তরে লিখেছিলেন, আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারিআমি জানি, জমিদার জমির জোঁক ; সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিত জীব

জমিদারি দেখভালের সুবাদে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করতেন, দেশের অর্থনীতি মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীলকৃষির উন্নতি হলেই দেশের উন্নতি ঘটবেকৃষিবিদ্যায় স্নাতক হয়ে দেশে ফিরে এলে রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কৃষি পল্লিপুনর্গঠনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেনআমি যে সব কাজ করতে চেয়েছিলুম কিন্তু এখনো হাত দিতে পারিনি, তোকে সেগুলি করতে হবেবিশেষত কৃষির উন্নতির চেষ্টা করতে হবে

তিনি আরও বলতেন, “… আমার জীবনের যে দুটি সাধনা, এখানে হয়তো তার একটি সফল হবে কবে হবে, কেমন করে হবে, তখন তা জানতুম না অনুর্বর ক্ষেত্রেও বীজ পড়লে দেখা যায় হঠাৎ একটি অঙ্কুর বেরিয়েছে, কোনো শুভলগ্নে কিন্তু তখন তার কোনো লক্ষণ দেখা যায় নি সব জিনিসেরই তখন অভাব তার পর, আস্তে আস্তে বীজ অঙ্কুরিত হতে চলল এই কাজে আমার বন্ধু এলমহারস্ট, আমাকে খুব সাহায্য করেছেন আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি ছোটো গ্রাম এদের মনকে পেতে হবে, এদের সঙ্গে একত্র কাজ করবার শক্তি সঞ্চয় করতে হবে সেটা সহজ নয়, খুব কঠিন কুছুসাধন আমি যদি কেবল দুটি-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোটো আদর্শ তৈরি হবেএই কথা তখন মনে জেগেছিল, এখনও সেই কথা মনে হচ্ছে

রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকের একেবারে শেষ লগ্নে শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর অঞ্চলের জমিদারির দায়িত্ব নেনতখন এই সব অঞ্চলে সামন্ততান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থার প্রচলন ছিলএই ব্যবস্থায় গ্রামবাসীর জীবন জীবিকা দুই বিপন্ন হয়ে পড়েছিলচাষ করে লাভ তো দূরের কথা, করের ভারে প্রজাদের জীবন ছিল জর্জরিততার উপরে ছিল ঋণের চাপপ্রজা বা রায়তের সঙ্গে জমিদারের প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক ছিল নাদরিদ্র প্রজার কাছে জমিদার ছিলেন ভয় শক্তির উৎস

সে কালের পল্লিজীবনে রাজা প্রজার এই সম্পর্কের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ওয়াকিবহাল ছিলেন প্রসঙ্গে তাঁর একটি লেখায় পাওয়া যায়,

ইতিপূর্বে আমরা লক্ষ করিয়া দেখিয়াছি, প্রজারা যখন কোনো-একটা বিষয়ে একটু বেশি জিদ করিয়া বসে তখন গবর্মেন্ট তাঁহাদের অনুরোধ পালন করিতে বিশেষ কুষ্ঠিত হইয়া থাকেন-পাছে প্ৰজা প্রশ্রয় পায় সেইজন্য আমাদের শিক্ষিত লোকের যে-সমস্ত কোলাহলকে পোলিটিকাল অ্যাজিটেশন নাম দিয়া থাকেন তাহাকে উদ্দেশ্যসিদ্ধির পক্ষে আমরা সদুপায় বলিয়া মনে করি না … 

এই কথাটিই সে কালের প্রায় সব জমিদারি সম্পর্কেই বলা যেতএই সমস্যা মেটাতে রবীন্দ্রনাথ নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেছিলেনতাঁর উদ্যোগে জমিদারি অঞ্চলে গড়ে উঠেছিলগ্রামহিতৈষী সভাএর কাঠামোটি ছিল অনেকটাই এখনকার ক্রেতা সুরক্ষা সমিতির মতোবাংলার গ্রামগুলি তাঁদের অন্তর্নিহিত শক্তির জোরে যাতে স্বয়ম্ভর সমাজে রূপান্তরিত হয়, সেটাই ছিল এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষে তিনি তাঁর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত কালীগ্রাম পরগনাকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেনপ্রতি গ্রাম থেকে এক জন করে প্রজাকে নির্বাচিত করে এবং জমিদারির এক জনেক মনোনীত করে, গ্রামবাসীদের নিয়ে গড়ে তোলা হত এই হিতৈষী সভাকেন্দ্রীয় হিতৈষী সভা নিয়ম করে, বিভিন্ন সভা বার্ষিক সাধারণ সভার আয়োজন করতএই সব সভার মাধ্যমে বিবিধ জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হতপাশাপাশি, কোনও প্রজার উপরে জমিদার বা তাঁর প্রতিনিধিরা অবিচার, অত্যাচার করলে সেই সব বিষয় সম্পর্কে জমিদারকে অবহিত সতর্ক করা হত

তাঁর পরিকল্পনার স্বরূপ বিচার করলে দেখা যায়, পতিসরই হোক বা শ্রীনিকেতন, রবীন্দ্রনাথ মূলত পিছিয়ে থাকে ভারতীয় কৃষির উন্নয়নে চেষ্টা করেছিলেনপল্লিসংগঠনের কাজকে সম্প্রসারিত করাও এই কৃষির উন্নতির একটি সোপান বলে মনে করতেন রবীন্দ্রনাথপল্লিসংগঠনের কাজকে সম্প্রসারিত করতে তিনি ক্ষুদ্রস্তরে কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক প্রকল্প স্থাপন করতে চেয়েছিলেনযেগুলির সফল রূপায়ণ সারা দেশে কৃষি গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করবে, এই ছিল তাঁর ভাবনাএই কাজের জন্য তিনি সমকালীন আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেনতাঁর এই মতের প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁররাশিয়ার চিঠিতেতিনি সেখানে লিখেছেন,

আমাদের দেশের মতোই এখানকার মানুষ কৃষিজীবী কিন্তু আমাদের দেশের কৃষক এক দিকে মূঢ়, আর-এক দিকে অক্ষম ; শিক্ষা এবং শক্তি দুই থেকেই বঞ্চিত তার একমাত্র ক্ষীণ আশ্রয় হচ্ছে প্ৰথাপিতামহের আমলের চাকরের মতো সে কাজ করে কম, অথচ কর্তৃত্ব করে বেশি তাকে মেনে চলতে হলে তাকে এগিয়ে চলবার উপায় থাকে না অথচ শত শত বৎসর থেকে সে খুঁড়িয়ে চলছে আমাদের দেশে কোনো-এক সময়ে গোবর্ধনধারী কৃষ্ণ বোধ হয় ছিলেন কৃষির দেবতা, গোয়ালার ঘরে তার বিহার ; তার দাদা বলরাম, হলধর লাঙল-অস্ত্রটা হল মানুষের যন্ত্রবলের প্রতীক কৃষিকে বল দান করেছে যন্ত্র আজকের দিনে আমাদের কৃষিক্ষেত্রের কোনো কিনারায় বলরামের দেখা নেইতিনি লজিজতযে দেশে তার অস্ত্ৰে তেজ আছে সেই সাগরপারে তিনি চলে গেছেন রাশিয়ার কৃষি বলরামকে ডাক দিয়েছে ; দেখতে দেখতে সেখানকার কেদারখণ্ডগুলো অখণ্ড হয়ে উঠল, তার নূতন হলের স্পর্শে অহল্যাভূমিতে প্রাণসঞ্চার হয়েছে একটা কথা আমাদের মনে রাখা উচিত, রামেরই হলযন্ত্রীধারী রূপ হচ্ছে বলরাম

রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধির মধ্যে আমরা কৃষিতে মাটির গুরুত্ব, বিজ্ঞান সহায়ে চাষের ভাবনা, কৃষিতে সমবায় ভাবনা, জমিতে চাষির স্বত্ব, কৃষক-জীবনে মানোন্নয়নে লোকশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে শান্তিনিকেতন শ্রীনিকেতনে দুটি পৃথক মেলার আয়োজন, কৃষিতেহলকর্ষণ’, ‘বৃক্ষরোপণ’, ‘নবান্নএর মত উৎসবের সূচনা প্রভৃতি পল্লিপুনর্গঠনে তাঁর কৃষি-চিন্তাভাবনা অভিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে

১৯১২ সালে রায়পুরের জমিদার কর্নেল নগেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের কাছ থেকে কেনা সুরুল কুঠিবাড়িতে ফেব্রুয়ারি ১৯২২ কৃষি গোপালনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ পল্লিসংগঠনের কাজের সূচনা করেনপ্রথমে এর নাম ছিল — ‘সুরুল ফার্ম’, কাগজপত্রে পরিচয় ছিলডিপার্টমেণ্ট অফ্ এগ্রিকালচারশান্তিনিকেতনডিসেম্বর ২২, ১৯২১বিশ্বভারতী সোসাইটিপ্রতিষ্ঠিত হলে সোসাইটির বিধি অনুসারেশান্তিনিকেতন কর্মসমিতিসুরুল সমিতি’ (সুরুল এগ্রিকালচার বোর্ড) নামে দুটি পৃথক সমিতি গঠিত হয়২৬ ডিসেম্বর ১৯২৩ বিশ্বভারতী সোসাইটির বার্ষিক পরিষদের সভায় সংবিধান সংশোধনকালেসুরুল সমিতি পরিবর্তে নামকরণ হয়শ্রীনিকেতন সমিতিশ্রীনিকেতনেরইনস্টিটিউট অফ্রুরাল রিকনস্ট্রাকশননামটিও এই সময় থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছেশ্রীনিকেতনের মর্মকথা

ফিরে চল্‌, ফিরে চল্‌, ফিরে চল্মাটির টানে--

যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে

গানটি রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার এক মাস পরেই রচনা করেন (ফাল্গুন ২৩, ১৩২৮)আমেরিকার কৃষি অর্থনীতিবিদ লেনার্ড নাইট এল.কে. এলম্হার্স্ট, যিনি নিজেকেচাষাবলে অভিহিত করতেন, শ্রীনিকেতনের প্রথম সচিব ডিরেক্টর নিযুক্ত হন এবং ১৯২১১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি শ্রীনিকেতনে ছিলেনলেনার্ড নাইট এল.কে. এলম্হার্স্ট এবং ডরোথি স্ট্রেটের আর্থিক আনুকুল্যে শ্রীনিকেতনে পল্লিপুনর্গঠন কাজের অগ্রগতি ঘটে

পল্লিসংগঠন এবং কৃষি কৃষিসংক্রান্ত গবেষণার যে কর্মযজ্ঞ শ্রীনিকেতনের সূচনাপর্ব থেকে শুরু হয় তার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিতেশ্রীনিকেতন সংলগ্ন গ্রামগুলির মূল জীবিকা কৃষিকে বাঁচাতে তিনি উপলব্ধি করেছিলেনগ্রামগুলি না বাঁচিলে বাংলা উৎসন্নে যাইবে (প্রবাসী পত্রিকা, ফাল্গুন ১৩৩৩)

পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতে কৃষক-কল্যাণের যে সরকারি প্রয়াস তাতে অনস্বীকার্য, রবীন্দ্রনাথেরশ্রীনিকেতনবর্তমানে ভারতে পল্লিউন্নয়ন কর্মসূচিগুলির আঁতুরঘরতাঁর পল্লিপুনর্গঠন পরিকল্পনার মূল তিনটি মতাদর্শআত্মশক্তি, সমবায় উন্নয়নের উদ্বোধন, আজ সমগ্র ভারতে গ্রামোন্নয়নের ভিত্তিরবীন্দ্রনাথের পল্লিউন্নয়নেরমডেলসমগ্র ভারতে প্রশংসনীয় উদ্যম আদর্শ হিসেবে গণ্য হলেও দুঃখের বিষয় অনুসরণীয় হলনা, তথাপি বলা যায় রবীন্দ্রনাথ পল্লিসংগঠকরূপে ভারতে অন্যতম পথিকৃৎ

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন জমিদার হয়েও তাঁর প্রজার জন্য ভেবেছেন, এবং তাঁর সে ভাবনা ছিলো প্রকৃতই যুক্তিবাদী বিজ্ঞানসম্মতসে কারণেই হয়ত তিনি লিখতে পেরেছেন,-

কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি….

 

ঋণ: রবীন্দ্র রচনাবলীইন্টারনেট


0 comments

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait