শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব - এক অদ্ভুত জীবন

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব - এক অদ্ভুত জীবন

জন্ম তাঁর স্বাভাবিক নয়। পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় গেছেন গয়াধামে, পিণ্ডদান করতে। সেখানে গিয়ে এক স্বপ্ন পেলেন। দেখেন, শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী নারায়ণ দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে বলছেন, "ক্ষুদিরাম, বড় ইচ্ছে তোমার ঘরে এসে তোমার সেবা নিই।" আত্মহারা ক্ষুদিরাম সরোদনে বলছেন তাঁর দারিদ্রের কথা। জানাচ্ছেন তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা। কি খেতে দেবেন ভগবানকে? অখিলপতি নারায়ণ ক্ষুদিরামের কথা শুনে হাসছেন! বলছেন, তিনি সেবা চান। অন্তরের নিঃস্বার্থ পবিত্র শুদ্ধ সেবা। আর খাওয়া? কিছু না পেলে নয় বাতাসা দিয়েই পুজো দেবেন ক্ষুদিরাম! তিনি তাতেই খুশি। ঘুম ভাঙতে ক্ষুদিরামের চোখের জল বাঁধ মানছে না। ভগবান যেচে তাঁর ঘরে আসতে চেয়েছেন! এ সৌভাগ্য কজনের হয়?

ওদিকে কামারপুকুর গ্রামে ক্ষুদিরামের স্ত্রী চন্দ্রমনি দেবী তাঁর এক সখী ধনী কামারনির সাথে যুগিদের শিবমন্দির দর্শন করতে গেছেন। পুজো দিয়ে বেরোচ্ছেন, এমন সময় হঠাৎ তাঁর মনে হল ওই শিবমন্দির থেকে একটা জ্যোতি বেড়িয়ে এসে তাঁর শরীরে ঢুকে গেল। জ্ঞান হারালেন চন্দ্রাদেবী। এর কিছুদিনের মধ্যে তাঁর শরীরে গর্ভলক্ষণ দেখা দিল। পরে জানা গেল, ক্ষুদিরাম যে সময়ে স্বপ্ন পেয়েছিলেন, সে সময়েই চন্দ্রাদেবীর সাথে ওই ঘটনা ঘটেছিল।

ADVERTISEMENT

আরও পড়ুন - শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের কল্পতরু হওয়ার কাহিনী

যথাসময়ে শিশুর জন্ম হল। চন্দ্রাদেবী ঘুমিয়ে। দাই ধনী কোনো কাজে আঁতুড়ঘরের বাইরে গেছেন। সদ্যোজাত শিশু কিভাবে যেন সেই অবকাশে ঢেঁকিশালের মধ্যে ঢুকে পরে সারা গায়ে ছাই মেখেছে। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। ধনী এসে বের করলেন ছেলেকে। জন্মমাত্রই সারা গায়ে বিভূতি মেখে ভূতনাথ জানান দিলেন যে তিনি এসে পড়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে নানা অস্ত্র নিয়ে এসেছেন, এবারে এলেন সর্বধর্মসমন্বয় করতে, অস্ত্র হিসাবে নিয়ে এলেন রুগ্ন শরীরের সুবিশাল হৃদয়ে পৃথিবীব্যাপী প্রেম ধারণ করে! এলেন গরল ধারণ করে সুধা বিলোতে! এলেন জাত ধর্মের বিভেদ ঘোচাতে। গয়াধামে নারায়ণের স্বপ্ন পেয়ে ছেলের জন্ম। তাই নাম হল গদাধর। ডাক নাম গদাই।নিজের উপনয়নের সময় ধনী কামারনিকে ভিক্ষা মা করার আবদার ধরলেন বড় দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় এর কাছে। নইলে নাকি তিনি পইতে গায়ে তুলবেন না। ঘরে খিল দিলেন। ধনী কামারের বৌ। তিনি কি করে ব্রাহ্মণের ছেলের ভিক্ষা মা হবেন? প্রশ্ন উঠল। কিন্তু নয় বছরের ছেলের জেদের কাছে হার মানলেন পিতৃসম বড় দাদা। ধনীই ভিক্ষা মা হলেন গদাই এর। এই শুরু।

গ্রামের এক ছুতোরের বৌ এর বড় ইচ্ছে গদাইকে নিজে হাতে বেড়ে খাওয়াবেন। গদাই তৃপ্তি করে খেলেন। এ কথা জেনে তো ছুতোর রেগে আগুন। "তুই ছোট জাত হয়ে বামুনের ছেলেকে ভোগ দিলি? সে চাইলেই তুই দিবি? এত বড় সাহস? আজ তোর একদিন কি আমারই একদিন!" ছুতোরের বৌ কিন্তু মন খাঁটি করে রেখেছেন। ঠাকুরকে ভোগ দিয়েছি, তিনি গ্রহণ করেছেন, আমি ইহজীবনে উদ্ধার হয়ে গেছি। আর কিছুতেই আমার কোনওকিছুই গায়ে লাগবে না।

চিনিবাস বলে এক ময়রা আছেন কামারপুকুরে। গদাইকে পেলেই ধরে মিষ্টি খাওয়ান। তাঁকে কাঁধে তুলে নাচেন। বলেন, “তুমি কৃষ্ণ,আর আমি তোমার বলরাম।” সেই চিনিবাস একদিন নিভৃতে ডেকে নিয়ে গেলেন গদাইকে। মুঠো মুঠো ফুল গদাইএর পায়ে দিয়ে বললেন, তুমি কত লীলা করবে, তা তো এ চোখে আর দেখতে পাব না, তাই আগে ভাগে পুজো সেরে নিলাম। সম্ভবত ঠাকুরের স্বরূপ তিনি মনস্চক্ষে উপলব্ধি করেছিলেন।

আরও পড়ুন - কেমন ছিলো শ্রী রামকৃষ্ণদেবের সাথে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের সম্পর্কের সমীকরণ

এর অনেকদিন পরের কথা। কামারপুকুরের ছোট্ট গদাই তখন দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। তিনি তখন অবতার! তিনি তখন রামকৃষ্ণদেব। এক মেথর আছেন মন্দির প্রাঙ্গণ পরিষ্কার রাখার জন্য,নাম রসিক! ঠাকুর রোজ নাইতে যান গঙ্গায়! রসিক তখন কাজ করেন! পথ ছেড়ে দেন ঠাকুরকে। যেন ছোঁয়া না লাগে। সেই রসিক বিকেলের দিকে তুলসীতলায় বসে হরিনাম করেন আর হরি বলতে ঠাকুরকেই ভাবেন। ঠাকুরের কাছে কি আর তিনি যেতে পারবেন কোনোদিন? মনে ভাবেন। আর দক্ষিণেশ্বরে নিজের ঘরে বসে ঠাকুর রসিকের মনের ভাবটি ঠিক টের পান। ভোর হতেই ছোটেন রসিকের বাড়ি। তাকে গলায় জড়িয়ে ধরেন। রসিকের অশ্রু বাঁধ মানে না। ‘তবে তুমি এলে ঠাকুর!! দীনতারণ পতিতপাবন! তবে এই দয়া করো যেন জীবনের শেষ ক্ষণে তোমায় পাই।’ ঠাকুর স্মিত হাসলেন। এরপর রসিক বেশিদিন বাঁচেন নি। প্রাণবায়ু নির্গত হওয়ার আগে তুলসীতলায় কাকে যেন দেখে তিনি ‘ঠাকুর এসেছেন, ঠাকুর এসেছেন’, বলতে বলতে দেহত্যাগ করেন।

এই ধনী কামারনি, ছুতোরের বৌ, চিনিবাস ময়রা, রসিক মেথর—– এরা কারা ছিলেন জানা নেই৷ ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে জানা সম্ভব ও নয়। শুধু এইটুকু জানা থাক, তিনি অদ্ভূত। তাঁর জন্ম অদ্ভূত, তাঁর কর্ম অদ্ভূত! জীবের ত্রাণের জন্য নীলকণ্ঠ শিব একদা কালকূট বিষ কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। আর সমাজে পতিত বলে যারা চিন্হিত, এ যুগে তাদের নিজক্রোড়ে স্থান দিয়ে ঠাকুর নিজের কণ্ঠে গলরোগ ধারণ করলেন। সেই দেহত্যাগেও তিনি অদ্ভূত! তাঁর লীলার শেষ নেই৷ তিনিই ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণ!

ঠাকুরের ১৮৫ তম জন্মতিথিতে সাশ্রু নয়নে বিনম্র কৃতাঞ্জলী জানাই!! 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait