রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র - ‘বন্দেমাতরম্’ থেকে ‘জনগণমন’

রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র - ‘বন্দেমাতরম্’ থেকে ‘জনগণমন’

সময়টা ১৯৩৭বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এতটাই তীব্র হল যে, বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িতাকে টেনে আনা হলএই বিরোধ আরও তীব্র হলবন্দেমাতরম্সঙ্গীত এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক চিহ্ন শ্রী পদ্ম নিয়েস্মরণে রাখা দরকার ১৮৯৬ সালে কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম বন্দেমাতরম্ গানটি সুর সংযোগ করে গিয়েছিলেনতারপর বাংলাদেশে স্বদেশী আন্দোলনের পর থেকে এই গানটি অত্যাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তারপর থেকে এতকাল এটি কংগ্রেসের সভাসমিতিতে গাওয়া হচ্ছিলকিন্তু ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ এই সঙ্গীতটিকে উপলক্ষ করে খুবই বিতর্ক উঠলএটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া যাবে কিনামুসলমানদের মূল বক্তব্য এই যে, এই গানে সুস্পষ্টভাবে হিন্দু পৌত্তলিক দেবী দুর্গার স্তব আছে (যথা – “ত্বং হি দূর্গা দশপ্রহরণধারিণীইত্যাদি); দ্বিতীয়ত এই গান বঙ্কিমচন্দ্রেরআনন্দমঠ’- বর্ণিত মুসলিম বিদ্বেষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং এই কারণেই এটি জাতীয় সঙ্গীত হতে পারেনাঅপরপক্ষে বাঙালি হিন্দুদের মূল বক্তব্য হল এই যে, ‘বন্দে মাতরম্ধ্বনি গানটি অর্ধশতাব্দীকাল ধরে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত করেছে এবং এরই জন্য সহস্র সহস্র মানুষ এতকাল কারা-বরণ দুঃখ নির্যাতন ভোগ করেছে গান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই এই গানটিই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে মর্যাদা পাবার অধিকারী

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবনকালেবন্দেমাতরম্সংগীতের [প্রথম অংশটি] সুর সংযোজন করে কলকাতা কংগ্রেসে [১৮৯৬] গেয়েছিলেন সত্যি কথাকিন্তু সমগ্র এই গানটির অন্তর্নিহিত ভাবটি কোনদিনই তঁকে বিশেষ আকর্ষণ করতে পারেনি, একথা কবি স্বয়ং নিজের মুখেই বলেছেনবিশেষতঃবন্দেমাতরম্সঙ্গীত রাজনৈতিক শ্লোগানকে তিনি যে কিছুতেই অন্তরের সাথে মেনে নিতে পারছিলেন নাএকথা তিনি প্রকাশ্য বিবৃতিতে না-হলেও চিঠিপত্রে বহুবার উল্লেখ করেছেনআমেরিকা থেকে একটি পত্রে তিনি রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, - আমার বাণীর পথরোধ করবে এমন সাধ্য কারও নেই সমস্ত পৃথিবীকে আমি আপন দেশ বলে বরণ করে নিয়েচি ... পৃথিবী থেকে যাবার আগে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে আমার আপন সম্বন্ধ অনুভবও স্বীকার করে যেতে পারলুম এইটেতেই আমি আমার জীবন সার্থক বলে জানচি আমাদের বাংলাদেশের কোণে একটা বিশ্বপৃথিবীর হাওয়া উঠেচে এইটে আমাদের সকলের অনুভব করা উচিত[চিঠিপত্র দ্বিতীয় খণ্ড]

পরবর্তীকালে কবি প্রমথ চৌধুরিকে এক পত্রে লিখলেন, [১৮ই কর্ত্তিক, ১৩২৮] - “... দেশের কৰ্ত্তব্যক্তিদের কাছ থেকে হুকুম আসচে যে, “সময় খারাপ অতএব বাঁশি রাখ, লাঠি ধর যদি তা করি তাহলে কৰ্ত্তারা খুসি হবেন, কিন্তু আমার এক বাঁশিওয়ালা মিতা আছেন কৰ্ত্তাদের অনেক উপরে, তিনি আমাকে একেবারে বরখাস্ত করে দেবেন কৰ্ত্তারা বলেন, “তিনি আবার কে? এক আছে বন্দেমাতরং তাদের গড় করে আমাকে আজ বলতে হচ্চে— “আমার বন্দেমাতরং ভুলিয়েচেন তিনি আমি দেশছাড়া ঘরছাড়ার দলে আমি ভূগোলের প্রতিমার পাণ্ডাদের যদি আজ মানতে বসি তাহলে আমার জাত যাবেকিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভূগোলের প্রতিমার পাণ্ডার শুধু পাণ্ডা নয় তারা গুণ্ডাঅতএব মার খেতে হবে তাই সই মার সুরু হয়েচে

“... মরার ভয়ে চাদ সদাগর শিবকে ছেড়ে সাপের দেবতার কাছে হার মেনেছিল, সেইখানে তার গাল রয়ে গেল আমি কিন্তু শিবকে ছাড়ব না আমার শিব সকল জগতেরকিন্তু সাপের দেবতার জায়গা হচ্চে গৰ্ত্তর ভিতরে সেই গর্তের ভিতরে দুধকলা জোগাবার বায়না যাঁরা নিয়েচেন তাঁরা যে-ফলের লোভ করেন আমি সেই ফলকে বড় মনে করি নে আমার মন ম্যাপের গর্তের মধ্যে আর কোনোদিন দেবতা খুঁজবে না বুঝতে পেরেচি এই নিয়ে ঘরে পরে আমাকে ত্যাগ করবে আমি ঠিক করেচি, যার যা মনের সাধ মিটিয়ে নিক্, আমি আর কথা কইব না...[চিঠিপত্র পঞ্চম খণ্ড]

এমনকিবন্দেমাতরম্শ্লোগান বা ধ্বনিকেও তিনি আন্তরিক সমর্থন করতে পারেন নিকবি তাঁর সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে যে বাণী দেন তাতে তিনিবন্দে মাতরম্’-এর পরিবর্তেবন্দে ভ্রাতরম্শ্লোগান গ্রহণ করার আবেদন জানান [দ্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা২৬শে বৈশাখ ১৩৩৮] এমন আরও উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে

কলকাতা ওয়ার্কিং কমিটিরও . আই. সি. সি- অধিবেশনে এই জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথাএই উপলক্ষে বাংলাদেশের অধিকংশ জাতীয়দাবাদী পত্র-পত্রিকাতেইবন্দেমাতরম্সঙ্গীতকে জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষে প্রবল আন্দোলন চালালেনরবীন্দ্রনাথ কলকাতায় গিয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বরাহনগরের বাড়িতে উঠেছিলেনতিনি কলকাতার উত্তেজনার কথা সবই শুনলেন কিন্তু তখনই তিনি সে সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে চাইলেন না

সুভাষচন্দ্র তখন কার্সিয়াঙেকিছুদিন আগে তিনি ডালহাউসি থেকে কলকাতায় ফিরে [৭ই অক্টোবর] সবই শুনলেনকিন্তু তখনই সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে চাইলেন না৯ই অক্টোবর তিনি কর্সিয়াঙে যানএই সময় তিনি কবিকে সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব অভিমত লিখে জানাবার অনুরোধ জানানকবি তাঁর জবাবে সুভাষচন্দ্রকে লেখেন, -

সুহৃদ্বর, বন্দেমাতরম গানের কেন্দ্রস্থলে আছে দূর্গার স্তব একথা এতই সুস্পষ্ট যে নিয়ে তর্ক চলে না অবশ্য বঙ্কিম এই গানে বাংলা দেশের সঙ্গে দূর্গাকে একাত্ম করে দেখিয়েছেন, কিন্তু স্বদেশের এই দশভূজামূর্তিরূপের যে পূজা সে কোনো মুসলমান স্বীকার করে নিতে পারে না এবারের পূজা সংখ্যার বহু সাময়িক পত্রেই দূর্গাপূজার প্রসঙ্গে বন্দে মাতরম্ গানের শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করে দিয়েছেসহজেই দূর্গার স্তব রূপে একে গ্রহণ করেছে আনন্দমঠ উপন্যাসটি সাহিত্যের বই, তার মধ্যে এই গানের সুসংগতি আছে কিন্তু যে রাষ্ট্রসভা ভারতবর্ষে সকল ধর্মসম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র সেখানে গান সর্বজনীনভাবে সংগত হতেই পারে না বাংলাদেশের একদল মুসলমানের মধ্যে যখন অযথা গোঁড়ামির জেদ দেখতে পাই তখন সেটা আমাদের পক্ষে অসহ্য হয় তাদের অনুকরণ করে আমরাও যখন অন্যায় আবদার নিয়ে জেদ ধরি তখন সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয় হয়ে ওঠে বস্তুতঃ এতে আমাদের পরাভব

বন্দে মাতরম্ প্রবন্ধটি কৃষ্ণকৃপালানীর লেখা বিশ্বভারতীর কাগজে তিনি এটা প্রকাশ করবেন আমি জানতুম না বিশ্বভারতীর সঙ্গে এই আলোচনার কোনো যোগ নেই এই নিয়ে জওহরলালকে তিনি পত্র লিখবেন এই কথা ছিল

এখনও ডাক্তারদের চিকিৎসাধীনে আছি - নিস্কৃতি পাই নি, শরীরও যথোচিত কর্মক্ষম হয় নি

ইতি - ১৯১০৩৭

তোমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুনঃ বাঙালি হিন্দুরা এই আলোচনা নিয়ে চঞ্চল হয়েছেন, কিন্তু ব্যাপারটি একলা হিন্দুর মধ্যে বদ্ধ নয় উভয় পক্ষেই ক্ষোভ যেখানে প্রবল সেখানে অপক্ষপাত বিচারের প্রয়োজন আছে রাষ্ট্রীয় সাধনায় আমাদের শান্তি চাই, ঐক্য চাই, শুভবুদ্ধি চাই - কোনো এক পক্ষের জিদকে দুর্দম করে হারজিতের অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাই নে [পাণ্ডুলিপিশান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রসদন- রক্ষিত আছে]

যাই হোক, পরবর্তী ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে দীর্ঘ তিনদিন আলোচনার পর এটাই সিদ্ধান্ত হয় যে, অতঃপর এই সঙ্গীতের প্রথম অংশটিই কংগ্রসের সভা সমিতিতে গাওয়া হবে (২৮শে অক্টোবর, ১৯৩৭)

বলা বাহুল্য, সুভাষচন্দ্রকে এটা কবির ব্যক্তিগত পত্রসন্দেহ নেই কবির এই যুক্তি বক্তব্য সুভাষচন্দ্র আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছিলেনকার্সিয়াঙে থাকার পর ২৪শে অক্টোবর সুভাষচন্দ্র দার্জিলিং মেলে কলকাতায় ফিরলেনপরদিন ২৫শে অক্টোবর সোমবার সকালে জওহরলাল কংগ্রেস সেক্রেটারি আচার্য্য কৃপালানী কলকাতায় এলেনঐদিনই অপরাহ্নে জওহরলাল বেলঘরিয়ায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেনহিন্দু-মুসলমান সমস্যাবন্দেমাতরম্সংগীত সম্পর্কে তিনি বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করেন

উল্লেখযোগ্য, ওইদিনই ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক শুরু হয়রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পূর্বেই তাঁর সেক্রেটারির মারফৎ জওহরলালের কাছেবন্দেমাতরম্সংগীত সম্পর্কে তাঁর অভিমত বা বিবৃতিটি পাঠানতাঁর যুক্তিতে এই সিদ্ধান্তের এক জায়গায় বলা হয় (২৮শে অক্টোবর, ১৯৩৭), -

ওয়ার্কিং কমিটির অভিমত এই যে, অতীতের স্মৃতি সুদীর্ঘকালব্যাপী আত্মত্যাগ দুঃখবরণের ইতিহাস এবং সর্বসাধারণ কর্তৃক ব্যাপক ব্যবহার এই সংগীতের প্রথম দুইটি কলিকে প্রাণবান আমাদের জাতীয় আন্দোলনের সহিত অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কে আবদ্ধ করিয়াছে; সুতরাং এই দুইটি কলি আমাদের সম্ভ্রম সমাদরের বস্তু এই দুইটি কলিতে কাহারও আপত্তি করিবার কিছু নাই সংগীতের অবশিষ্টাংশ অনেকেই জানেন না এবং প্রায় কখনও গান করা হয় না উহাতে এমন বিষয়ের উল্লেখ আছে এবং ধর্মবিষয়ক এমন ভাব বর্ণিত হইয়াছে, যাহা ভারতবর্ষের অন্য সম্প্রদায়ের আদর্শের সহিত সামঞ্জস্যহীন

“’বন্দেমাতরম্সংগীতের কোনও কোনও অংশ সম্পর্কে মুসলমান বন্ধুগন যে আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন, ওয়ার্কিং কমিটি তাঁদের যৌক্তিকতা স্বীকার করিতেছেন মুসলমান বন্ধুদের আপত্তি যতদূর যুক্তিসংগত, তাহা মানিয়া লইয়াও ওয়ার্কিং কমিটি এই অভিযোগ প্রকাশ করিতেছে যে, আমাদের জাতীয় আন্দোলন সুস্পষ্টরূপে গ্রহণের পূর্বে এই সংগীত যে একখানা ঐতিহাসিক উপন্যাসে স্থানলাভ করিয়াছিল, সেই কথাটা জাতীয় আন্দোলনে এই সংগীতের ব্যবহারের তুলনায় নিতান্ত তুচ্ছ সমস্ত বিষয় বিবেচনা করিয়া ওয়ার্কিং কমিটি এই নির্দেশ দিতেছেন যে, জাতীয় সভা-সমিতিতে যখনই এই সংগীত গান করা হইবে তখনই যেন শুধু প্রথম দুটি কলি গান করা হয় তবে এই সংগীতের উপরেও বা এই সংগীতের পরিবর্তে অন্য কোনও নির্দোষ সংগীত গান করিবার পূর্ণ স্বাধীনতাও উদ্যোক্তাগণের থাকিবে... [আনন্দবাজার পত্রিকা২৯শে অক্টোবর৩৭]

তাছাড়া এই সিদ্ধান্তে জাতীয় সঙ্গীত সংকলনের জন্য নিম্নলিখিত চারজনকে নিয়ে একটি সাব্-কমিটি নিয়োগের কথাও ঘোষণা করা হয়, - মৌলানা আজাদ, জওহরলাল, সুভাষচন্দ্র আচার্য নরেন্দ্র দেবআরও স্থির হয় এই সাব্-কমিটি এই বিষয়ে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ উপদেশ গ্রহণ করবেন

পরদিন ওয়ার্কিং কমিটি থেকেবন্দেমাতরম্সঙ্গীত সম্পর্কে কবির বিবৃতিটি প্রেসে দেওয়া হয়কবির বিবৃতিটি ছিল, -

“’বন্দেমাতরম্সঙ্গীতকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করা যায় কিনা দুঃখের বিষয় সেই সম্পর্কে এক প্রশ্ন উঠিয়াছে আমাকে বিষয়ে মতামত প্রকাশের সময় মনে করাইয়া দেওয়া হইয়াছে যে, উহার প্রথম প্যারাতে সুর সংযজোনা করার সুযোগ আমারই প্রথম হইয়াছিল তখনও এই সঙ্গীতের রচয়িতা জীবিত ছিলেন কলিকাতায় আহূত একটি কংগ্রেসে আমিই প্রথম উহা গান করি সঙ্গীতের প্রথম প্যারাতে যে ভক্তি কোমলতার ভাব আছে, উহাতে ভারতমাতার যে সুন্দর রূপ বর্ণনা করা হইয়াছে তাহা আমার চিত্ত বিশেষভাবে আকর্ষণ করে কিন্তু তাহার ফলে আমার পক্ষে সঙ্গীতের প্রথম প্যারাকে সমগ্র সঙ্গীত হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবার কিংবা যে পুস্তকে উহা প্রকাশিত হয় তাহা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবার কোনও অসুবিধা হয় নাইআমি অনায়াসে স্বীকার করি যে, বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম সঙ্গীতটি যদি উহার অন্যান্য ইতিহাসের সহিত পড়া যায় তাহা হইলে উহার এমন অর্থ করা যায়, যার ফলে মুসলমানদের মনে আঘাত লাগিতে পারে, কিন্তু এই জাতীয় সঙ্গীত যদিও সমগ্র সঙ্গীত হইতে গৃহীত দুইটি প্যারা মাত্র, তথাপি উহা যে সর্বদা কেন সমগ্র সঙ্গীতের কথা স্মরণ করাইয়া দিবে কিংবা যে ইতিহাসের সহিত দৈবক্রমে ইহা জড়িত তাহার কথা স্মরণ করাইয়া দিবে, তাহার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নাই উহার সম্পুর্ণ স্বাতন্ত্র্য আছে এবং উহার নিজস্ব এমন একটা উদ্দীপনাময় বৈশিষ্ঠ্য আছে যাহা আমার মনে হয়, কোনও ধর্ম সম্প্রদায়ের মনে আঘাত করে না...

উল্লেখযোগ্য, কলকাতায় বন্দেমাতরম্ সঙ্গীত নিয়ে যখন রকম দারুন উত্তেজনা চলছে সেই সময় মাদ্রাজ থেকে ডাঃ কাজিনস্ (Dr. J. H. Cousins) এক বিবৃতিতে রবীন্দ্রনাথেরজনগণমনসংগীতকে জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেনএই বিবৃতিতে এক জায়গায় বলা হয় (৩রা নভেম্বর৩৭),

My Suggestion is that Dr. Rabindranath’s own intensely patriotic, Ideally stimulating and at the same time world embracing “Morning Song of India” ( ‘Janagana-mana’…) should be confirmed officially as what it has for almost twenty years been unofficially namely the true national Anthem of India. This real expression of Aspiration for the highest welfare of a whole people – not a metrical paragraph from geography, though Janagana also has its relationship with nature is universally known in the country. It has a tune and rhythm that make it singable with definiteness, unity and vigour, whereas the Vande Mataram tune can never be given a satisfactory mass rendering as its twists and turns are only possible in individual singing [Madras Mail, 3rd Nov, 1937].

এই জনগণমন ১৯১৭ সালে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে গীত হবার পর এর উল্লেখ আবার দেখা গিয়েছিল ১৯১৯ সালেদক্ষিণ ভারত ভ্রমণকালে অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তর জেলার মদনাপল্লী শহরের থিওসফিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথের বন্ধু জেমস এইচ কাজিনস কবির সম্মানে এক সভার আয়োজন করেনসেই সভায় কবি স্বয়ংজনগণমনগানটি পরিবেশন করেনগানটির নামকরণ করেনদ্য মর্নিং সং অফ ইণ্ডিয়াগানটির কথা সুর শুনে শিক্ষক, ছাত্র অন্যান্য দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে কবিকে অনুরোধ করেন ইংরেজিতে মানে বলে দেওয়ার জন্যরবীন্দ্রনাথ গানটির অনুবাদ স্বহস্তে লিখে অধ্যক্ষকে উপহার দেন

“Thou art the ruler of the minds of all people,

Thou Dispenser of India’s destiny.

The name rouses the hearts

of the Punjab, Sind, Gujrat and Maratha,

of Dravid, Orissa and Bengal”....

১৯২৭ সালে জাভা থেকে কন্যা মীরাকে লেখা এক দীর্ঘ চিঠির একটি অংশে কবি বলেছিলেন: আমি কয়েকবছর আগে ভারতবিধাতার যে জয়গান রচনা করেছি, তাতে ভারতের প্রদেশগুলির নাম গেয়েছিবিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গার নামও আছে কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে, ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের সমুদ্র পর্বতের নামগুলি ছন্দবদ্ধ করে কেবলমাত্র একটি দেশ পরিচয়ের গান আমাদের লোকের মনে গেঁথে দেওয়া ভাল দেশাত্মবোধ বলে একটা শব্দ আমরা কথায় কথায় ব্যবহার করে থাকি, কিন্তু যার দেশজ্ঞান নেই তার দেশাত্মবোধ হবে কেমন করে

বাংলাদেশের জাতীয়তবাদীদের মন সেই মুহুর্তেবন্দেমাতরম্সঙ্গীতে আচ্ছন্ন ছিলস্বভাবতই . কাজিনস্-এর এই প্রস্তাবকে অনেকেই ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি Statesman দু-একটি ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনও পত্র-পত্রিকা কাজিনস্-এর এই প্রস্তাবের উল্লেখ পর্যন্ত করলেন নাএমনকি কবি-সুহৃদ রামানন্দও এই প্রস্তাবের উপর আদৌ গুরুত্ব দিলেন নাকেননা তিনিই সমগ্রবন্দেমাতরম্সঙ্গীতটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেনকেউ কেউ এমনও ইঙ্গিত করলেন যে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে বলতে না পেরে কাজিনস্-কে এই প্রস্তাব করিয়েছেন

এর কিছুদিন পরেই৮ই জানুয়ারি, ১৯৩৮ সুভাষচন্দ্র বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হরিপুরা কংগ্রেসের জন্য সভাপতি নির্বাচিত হলেনএই সংবাদে দেশের সমস্ত বামপন্থী মহলে বিশেষ করে সারা বাংলা দেশেই যেন উল্লাসের সাড়া পড়ে গেলতাঁরা ভাবলেনএতদিনে একজন শক্ত মনের মত কংগ্রেস সভাপতি পাওয়া গেল যিনি শক্ত হাতে দেশের হাল ধরবেন’!

বলা বাহুল্য, সুভাষচন্দ্র বিষয়ে তাঁদের সম্পুর্ণ নিরাশ করেছিলেনহরিপুরা কংগ্রেসেও সুভাষচন্দ্র বন্দেমাতরম্ সম্পর্কে ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনরকম বিতর্ক উঠতে দেননিমোট কথা সরকারি চাকরিতে হিন্দু মুসলমানের ভাগবাঁটোয়ারা, হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ এবংবন্দে মাতরমসঙ্গীত বিতর্কএর কোনটিই সুভাষচন্দ্র সংকীর্ণ বাঙালি হিন্দুর দৃষ্টিতে বিচার করেননিএই সব বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি চিন্তাধারার প্রত্যক্ষ পরোক্ষ প্রভাব ছিল তাঁর উপর তাতে কোনও সন্দেহ নেই

১৯৩৯ সালে ১১ই আগষ্ট কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর বাড়িতে কবি সাহিত্যিক বন্ধুদের মজলিসে গেলে পরে কথা প্রসঙ্গে বন্দেমাতরম্ সঙ্গীত সম্পর্কে ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তের কথা ওঠেএই প্রসঙ্গে সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হিসেবেসুভাষচন্দ্র নেতাজী সুভাষচন্দ্রবইয়ে লিখেছেন,

“... অন্যান্য কথার পরে সুভাষচন্দ্রকে কালিদাস রায় জিজ্ঞাসা করলেন. – ‘বন্দেমাতরম্ গানটি আপনার সভাপতিত্বেই আংশিকভাবে বাদ দেওয়া হয়েছেএতে অবশ্যই আপনার সম্মতি ছিল’? সুভাষবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার সম্মতি না থাকলে আমি নিশ্চয়ই এর প্রতিবাদ করতাম শুধু বাংলার দিক থেকে বা বিশেষ কোনও ধর্ম বা জাতির দিক থেকে কোনও বিষয়ের বিচার কংগ্রেস করতে পারেনা আজ সমস্ত সমস্যাকে সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতে হবে সেই জন্যে সর্ববাদী-সম্মতভাবে যে অংশটুকু গৃহীত হয়েছে তাতে বন্দেমাতরম্ সঙ্গীতের মর্যাদা কোনও মতে ক্ষুন্ন হয়নি বলেই আমি মনে করি [সুভাষচন্দ্র নেতাজী সুভাষচন্দ্র]

তাই হয়তজনগণমন-অধিনায়কগানটিকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা প্রথম দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগেসুভাষচন্দ্র জার্মানিতে পৌঁছেছিলেন ১৯৪১ সালে এবং সেই বছরে নভেম্বর মাসে জার্মানির বন শহরেদ্য ইণ্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ’-এর কার্যালয় স্থাপন করেছিলেনদ্য ইণ্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ’-এর প্রথম অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪১ সালের নভেম্বরসেই অধিবেশনেই গৃহীত হয়েছিল ব্রিটিশ-বিরোধী যুদ্ধের শপথজয় হিন্দ’, সেই যুদ্ধের জাতীয় নেতা সুভাষচন্দ্র বসুনেতাজিএবং জাতীয় সঙ্গীতজনগণমন’ -অধিনায়কজাতীয় সঙ্গীত সংক্রান্ত বিষয়টি ছিল অধিবেশনের অন্যতম মূল আলোচ্য বিষয়এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি জানা যায় নেতাজির ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং এন জি গণপুলের সমসাময়িক বর্ণনায়উপরোক্ত অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল বার্লিন শহরেওই অনুষ্ঠানেজনগণমন অধিনায়কসঙ্গীতটির গুরুত্ব অনুধাবন করে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, ওই সঙ্গীতে প্রতিফলিত হয়েছিল ভারতের সমস্ত ধর্ম প্রদেশের মিলন-কেন্দ্রের আদর্শসেই আদর্শের জন্যই গানটিকে ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়ার প্রসঙ্গটি নির্দিষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছিলজাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় গানটি যন্ত্রসঙ্গীত সহযোগে প্রথম পরিবেশিত হয়েছিল ১৯৪২ সালেইন্দো জার্মান কালচারাল সোসাইটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, হামবুর্গেএই ঐতিহাসিক দিনেই ভারতের জাতীয় পতাকা বিদেশে প্রথম উত্তোলিত হয়েছিল

সুভাষচন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ-হিন্দ বাহিনীর সেনাপতির পদ গ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ২৫ আগস্ট এবংআজাদ হিন্দঅর্থাৎ স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন ২১ অক্টোবরতারও আগে জুলাই (১৯৪৩) সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন এবং সেই দিনই গানটি গাওয়া হয়জনগণমন’ -অধিনায়ক, জয় হেজাতীয় সঙ্গীতরূপে স্বীকৃতি পেলআরজি হুকুমত--আজাদ হিন্দের নির্দেশ নামাতে উল্লেখ করা হয়: টেগোরস সঙ জয়-হে হ্যাজ বিকাম আওয়ার ন্যাশন্যাল অ্যান্থেম

এইভাবে জার্মানি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, নানা জায়গায় এই গান গেয়ে এর আন্তর্জাতিক পরিচিতি তৈরি করেন নেতাজিইনেতাজি নিজেই এই সঙ্গীতটি গাইতেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হিসেবেপরবর্তীকালে জওহরলাল নেহরু নিজেও বলেছিলেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রামের সময়জনগণমন-অধিনায়কসঙ্গীতটি জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় সেনানীরা বার বার গেয়েছিলেন রণক্ষেত্রের বিভিন্ন ঘটনায়গান্ধিজি যিনিবন্দেমাতরমকে জাতীয় সঙ্গীতরূপে ব্যবহারের পক্ষে একসময় দৃঢ়মত পোষণ করেছিলেন, তিনিওজনগণমন-অধিনায়কসঙ্গীতটির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার্ঘ জানিয়েহরিজনপত্রিকায় লিখেছিলেন : ‘ তো শুধু গান নয়সমগ্র জাতির প্রার্থনামন্ত্র

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সন্ধিক্ষণে, মধ্যরাতেজনগণমন অধিনায়কসঙ্গীতের প্রথম অংশটি নিজে গেয়েছিলেন শ্রীমতী সুচেতা কৃপালনী

ঋণ: রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রনেপাল মজুমদাররবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় তিন মনস্বী. শ্যামাপ্রসাদ বসুউইকিপিডিয়া

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait