‘ডাকঘর’ – রবীন্দ্রনাথ থেকে পাওয়া আধ্যাত্মিক প্রতিষেধক

‘ডাকঘর’ – রবীন্দ্রনাথ থেকে পাওয়া আধ্যাত্মিক প্রতিষেধক

“A Spiritual Vaccine from Tagore” নামে কবিগুরুর জন্মদিনের প্রাক্কালে চীনে অনলাইনে প্রদর্শিত হল অনুষ্ঠান। পূর্ব ইওরোপে নাৎসি আগ্রাসনের সময় নিধন শিবিরে নিয়ে যাওয়ার আগে যেভাবে ইহুদি বন্দিদের জীবনীশক্তি জুগিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটক, যেভাবে মৃত্যুপথযাত্রীদের আতঙ্ক থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছিল, আজ করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে সেই সঙ্কট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের থেকে পাওয়া ‘আধ্যাত্মিক প্রতিষেধক’ যেন অনেকটা মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দেয়।’ 

ডাকঘরের অমলকে আপনারা নিশ্চয়ই চেনেন। সেই মৃত্যুপথযাত্রী বালক অমল। পিতা-মাতাহীন এই বালক মাধব দত্তের আশ্রিত, তার মাত্রাতিরিক্ত পরিচর্যায় অমলের স্বাস্থ্য ক্রমশ অবনতির পথে। চার দেয়ালে ঘেরা এই যত্নের বন্ধন ছেড়ে বাইরে বেরোতে চায় সে। জানালার ধারে বসে অমল কাছের ও দূরের দৃশ্য দেখে, ফুল দেখে, মানুষ দেখে। তার ইচ্ছা এই ঘর ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে যেতে। ক্রীড়ারত বালকদের দেখে তার ইচ্ছা হয় তাদের সঙ্গে খেলতে, দইওয়ালাকে দেখে ইচ্ছা হয় দই বিক্রি করতে। জানালার পাশ দিয়ে চলে যায় মালিনীকন্যা সুধা, অমলের ইচ্ছা হয় সেও ফুল কুড়াবে। মাধবের ধারণা জানালার ধারে থাকায়, বাইরের বাতাসে অমল আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে, কবিরাজের নির্দেশে সে জানালাও বন্ধ হয়ে যায়। অমল তার ঠাকুরদার কাছ থেকে জানতে পারে, অনতিদূরে নতুন ডাকঘর বসেছে, সেখান থেকে রাজার নামে তার কাছে চিঠি আসবে। সে-চিঠির অপেক্ষায় দিন গোনে অমল। এক রাতে অমলের গৃহে এসে হাজির হয় রাজদূত, সঙ্গে রাজকবিরাজ। বন্ধ দরজা খুলে তারা ঢোকে, নির্দেশ দেয় সব দরজা-জানালা খুলে ফেলতে। মুক্ত বাতাস এসে ঘরে ঢোকে, অমল দেখে আকাশের জ্বলজ্বলে তারা। সে ঘুমিয়ে পড়ে। ফুলের ডালা নিয়ে দেখা করতে আসে সুধা। অমল ঘুমিয়ে পড়েছে জানতে পেরে ফিরে যাওয়ার সময় মাধবকে বলে যায়, অমলকে বোলো যে সুধা তাকে ভোলেনি।

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ডাকঘর নাটকটি খুব দ্রুত লিখে শেষ করেন। শান্তিনিকেতনের ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে তিনি ডাকঘর রচনার পটভূমি বর্ণনা করেছিলেন। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল কালীমোহন ঘোষের অনুলিখনে সে-কথা জানিয়েছেন –

‘ডাকঘর’ যখন লিখি তখন হঠাৎ আমার অন্তরের মধ্যে আবেগের তরঙ্গ জেগে উঠেছিল। চল চল বাইরে, যাবার আগে তোমাকে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে হবে – সেখানকার মানুষের সুখ-দুঃখের উচ্ছ্বাসের পরিচয় পেতে হবে। সে সময় বিদ্যালয়ের কাজে বেশ ছিলুম। কিন্তু হঠাৎ কি হল। রাত দুটো-তিনটের সময় অন্ধকার ছাদে এসে মনটা পাখা বিস্তার করল। যাই যাই এমন একটা বেদনা মনে জেগে উঠল। পূর্বে আমার দু’একটা বেদনা এসেছিল। আমার মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঘটবে, হয়ত মৃত্যু। স্টেশনে যেন তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠতে হবে সেই রকমের একটা আনন্দ আমার মনে জেগেছিল। যেন এখান থেকে যাচ্ছি। বেঁচে গেলুম। কোথাও যাবার ডাক ও মৃত্যুর কথা উভয়ে মিলে, খুব একটা আবেগে সেই চঞ্চলতাকে ভাষাতে ‘ডাকঘরে’ কলম চালিয়ে প্রকাশ করলুম। যাওয়ার মধ্যে একটা বেদনা আছে, কিন্তু আমার মনের মধ্যে বিচ্ছেদের বেদনা ততটা ছিল না। চলে যাওয়ার মধ্যে যে বিচিত্র আনন্দ তা আমাকে ডাক দিয়েছিল।

পরে, ১৯২১ সালে, অ্যানড্রুজের কাছে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ডাকঘরের মূল বাণী এইভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘Amal represents the man whose soul has received the call of the open road – he seeks freedom from the comfortable enclosure of habits sanctioned by the prudent and from walls of rigid opinion built for him by the respectable.’

এই কাহিনীতে তাদের সবারই নাম অমল। একটি বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়েছে তাদের। না, তারা কোনও অপরাধ করেনি। যে-কারণে তাদের আটকে রাখা হয়েছিল, তার জন্য তারা দায়ীও নয়। তবু বন্দি যারা করে, তারা এমনই নিষ্ঠুর আর অযৌক্তিক যে, অমলরা যে নির্দোষ, এ-যুক্তি তাদের কাছে টেকে না। এই অমলদের আটকে রাখা হয়েছিল, কারণ তারা ইহুদি। তাদের দেশ ছিল পোল্যান্ড। যে সময়ের কথা বলছি, তখন পোল্যান্ডকে কবজা করেছে কুখ্যাত হিটলার। ইহুদি হওয়ার কারণে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল এই পরাক্রান্ত রাষ্ট্রনায়ক। এহেন হিটলারের কাছেই আমাদের এই অমলরাও ছিল বন্দি।

অথচ একদিন তাদের কী চমৎকার একটা ‘রাজ্য’ ছিল। সেই রাজ্যটি স্থাপন করেছিলেন ইয়ানুশ কোর্চাক (Janusz Korczak)। এটি অবশ্য তাঁর আসল নাম নয়। আসল নাম ছিল হেনরিক গোল্ডস্মিথ (Henryk Goldszmit)। কিন্তু ইয়ানুশ নামেই তিনি ছোটোদের জন্য লেখালিখি করতেন এবং সেই নামেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এই কোর্চাক একটি অনাথ আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন। সেখানেই ছিল আমাদের অমলরা। তারা ওই আশ্রমে একেবারে নিজেদের রাজত্ব বানিয়ে ফেলেছিল।

কোরচাক ‘ডাকঘর’ নাটকের এই বাণীটি ঠিক ধরতে পেরেছিলেন। যেতে হবে সে-কথা নিশ্চিত, কিন্তু সে-গমন যেন আনন্দ ও সমাহিত চিত্তে হয়, সেই উদ্বেগ তাঁর মনেও কাজ করছিল।

১৪ জুলাই, বিকেল সাড়ে ৪টায় নাটক মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু তার আগের দিন এক অভাবনীয় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন কোরচাক। নাটকের প্রধান চরিত্রসহ অনেকেই পেটের যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়। নাটক শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হতে পারে, এই উদ্বেগে বিপন্ন হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর সৌভাগ্য, পরদিন অভিনয় শুরুর আগেই শিশু অভিনেতারা সুস্থ হয়ে ওঠে, সফলভাবে অভিনীত হয় ডাকঘর।

কোরচাক ও শিশু অভিনেতারা

ডাকঘর মঞ্চায়নের সময় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন হলেন ইরিনা সেন্দেলরোভা। কোরচাককে তিনি চিনতেন; নাৎসি অবরোধের সেই ভয়াবহ সময়ে কয়েকশো ইহুদি বালক-বালিকাকে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

তাদের জানালার বাইরে কী ঘটনা ঘটছে, তা থেকে শিশুদের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে কোরচাক ডাকঘর নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। কোমল হৃদয় এই ডাক্তার জানতেন কী ভয়াবহ দুর্যোগ এইসব শিশুর জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি এমন একটি নাটক বেছে নিয়েছিলেন যার মূল বাণী ছিল আশাবাদে পূর্ণ। নাটকের শেষে আমরা দেখি রাজার কাছ থেকে সেই চিঠি এসেছে যাতে শিশুদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মুক্ত, স্বাধীন এক নতুন জগতে আগমনের জন্য। এই অসাধারণ শিক্ষাবিদ ডাক্তার চেয়েছিলেন শিশুদের ও তাদের জন্য অপেক্ষমাণ নির্মম অভিজ্ঞতার মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব নির্মাণ করতে। গ্যাস চেম্বারে নিশ্চিত মৃত্যুর আগে ক্ষণকালের জন্য হলেও শিল্পী হিসেবে তাদের শেষ আনন্দপূর্ণ অভিজ্ঞতার উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর লক্ষ্য।

সেন্দেলরোভার বিবেচনায়, যে রাজার চিঠির অপেক্ষায় ছিল অমল, ঘেঁটোর শিশুদের জন্য সেই রাজা ছিলেন স্বয়ং কোরচাক। বৃদ্ধ ডাক্তারের পিছু পিছু যে দুশো শিশু শান্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে ত্রেবলিনকার উদ্দেশে ট্রেনে রওনা হয়, সেন্দেলরোভা জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে না ছিল উদ্বেগ, না ছিল ক্রন্দন।

আর লিফটন জানিয়েছেন, ডাকঘর মঞ্চায়ন শেষ হলে পুরো হলঘরে গভীর নীরবতা নেমে আসে। তাদের নিঃশব্দ অভিব্যক্তি থেকে স্পষ্ট হয়, ছেলে-বুড়ো সবাই তাদের বর্তমান দুর্মর জীবন থেকে মুক্তির একটি আলোর খোঁজ পেয়েছে। ‘যে রাজার আগমনের প্রতীক্ষায় অমল, সে কি মৃত্যু, না ঈশ্বর, অথবা মৃত্যুরূপী ঈশ্বর, সে-বিবেচনার ঊর্ধ্বে গিয়ে হলঘরে উপবিষ্ট প্রতিটি মানুষ ক্ষণকালের জন্য হলেও এই ঘেঁটোর বাইরে এক মুক্ত জীবনের আলো-হাওয়ার সন্ধান পেয়েছিল।’

ইয়ানুশ কোরচাক

যে তারার জগতে চলে যেতে চেয়েছিল অমল, কোরচাকও কি চেয়েছিলেন তাঁর শিশুরা তেমন কোনো অজ্ঞাত আনন্দময় জগতে পাড়ি দিক? কোরচাকের ডায়েরি থেকে আমরা জানি, ১ আগস্ট তারিখে ডাকঘর নাটকের পরিচালক এস্তেরকাকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর অতি-প্রিয় এই মেয়েটি, যে একসময় যুদ্ধের পর সুন্দর জীবনের কথা তাঁকে বলেছিল, তার মুক্তির জন্য কোরচাক হন্যে হয়ে ঘুরেছেন, দ্বারে দ্বারে করাঘাত করেছেন, এমনকি উৎকোচের কথাও ভেবেছেন। না, এস্তেরকার কোনো খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।

৬ আগস্ট ওয়ারশ ঘেঁটোয় কোরচাক ও তাঁর আশ্রমের শিশুদের শেষ দিন। সবেমাত্র তারা প্রাতরাশ সেরেছেন, অকস্মাৎ আশ্রমের বন্ধ দরজায় জার্মান সৈন্যের বুটের আঘাত, সঙ্গে মাইকে নির্দেশ, সব ইহুদি অবিলম্বে বের হও। প্রায় এক মাইল হাঁটাপথে গিয়ে তারপর রেলগাড়ি। কোরচাক ও তাঁর সহকর্মীরা আশ্রমের প্রতিটি শিশু জড়ো করলেন, তাদের পরনে যার যার সেরা পোশাক, কারো হাতে প্রিয় খেলনা।

সেন্দেরলোভা কোরচাক ও তাঁর আশ্রমের শিশুদের দলবেঁধে প্রায় নিঃশব্দে যেতে দেখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘সেই শব-মিছিলের শিরোভাগে ছিলেন কোরচাক। সবচেয়ে কনিষ্ঠ শিশুটি তাঁর কোলে, অন্য আরেকজনের হাত তাঁর হাতে। যে যা-ই বলুক, এ-কথায় কোনো সন্দেহ নেই, নিশ্চিত মৃত্যুর কথা তিনি জানতেন, মিছিলে অংশগ্রহণকারী শিশুরাও। অনাথ আশ্রম থেকে উমশ্লাগপ্লাজ – বা বন্দিদের যেখানে জড়ো হওয়ার নির্দেশ ছিল – তার মধ্যে লম্বা দূরত্ব ছিল। আমি নিজ চোখে দেখলাম জেলেঞ্জা সড়ক থেকে লেজনো সড়কে দলটি মোড় নিল।’

কোরচাক অথবা তাঁর আশ্রমের শিশুদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারার রাজ্যে যারা এইভাবে হারিয়ে গেল, তারা আশ্রয় নিল আমাদের স্মৃতি ও চৈতন্যে।

অমলকে সুধা কথা দিয়েছিল, সে তাকে ভুলবে না। এমন একসময়ে এ-কথা বলা যখন অমল ঘুমিয়ে পড়েছে, হয়তো অন্য আরেক জগতে সে পাড়ি দিয়েছে। সে-সময় সুধাকে ঠিক এই কথাটিই কেন বলতে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ তার কোনো ব্যাখ্যা করে যাননি। অনুমান করি, তিনি বলতে চেয়েছিলেন মানুষ মরে গেলেও সে যে মানব হয়ে বেঁচে থাকে, তার কারণ আমরা তাদের ধারণ করি স্মৃতিতে। জন্মজন্মান্তর সে-স্মৃতি জেগে থাকে।

ঋণ: রবিজীবনী, প্রশান্তকুমার পাল; রবীন্দ্ররচনাবলী; ইন্টারনেটউইকিপিডিয়া

 
 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait