স্টাইল আইকন

স্টাইল আইকন

” বড়দি, এই লাল ড্রেসটা পরে আমি প্রাইজ নিতে যাবো?” ছোট্ট তিতলি তার দিদিকে জিজ্ঞাসা করে। “তুই আর লাল ড্রেস! তোর গায়ের রংয়ে এই ড্রেস পরলে কেমন লাগবে তোকে জানিস? কোনো “ফ্যাশন সেন্স’ নেই, না! তোর?” বড়দির কথা শেষ হলে মেজদি তরু হেসে বলে, “ফ্যাশন সেন্স হবে কি করে? যে যেমন দেখতে তার রুচি তো তেমনই হয়। তাই না? কিভাবে যে বাবা এই কালো মেয়ের বিয়ে দেবে সেটাই ভাবি রে বড়দি।” দুই দিদির উপহাসে ছোট্ট তিতলির মুখে শ্রাবণ সন্ধ্যার বিষণ্ণতা নামে। তিতলির বাবা বিক্রম চৌধুরী মেয়েদের ঘরের বাইরে যে টানা বারান্দাটা আছে, সেখানে বসে তখন কাগজ পড়ছিলেন। বড় দুই মেয়ের দম্ভমিশ্রিত কন্ঠস্বর ও টুকরো হাসি শুনে কৌতুহলি হয়ে মেয়েদের ঘরে আসেন।সেখানে ছোটমেয়ের বিষাদ মাখানো মুখ দেখে ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলে যান।তবু বাইরে তার প্রকাশ না করে দৃঢ় কন্ঠস্বরে বলেন,”ওই জামাটা তো ওর জন্যই কেনা হয়েছে। তোমাদের কাছে এলো কি করে? ” বাবার কথায় ভয় পেয়ে বড় মেয়ে তুলি বলে, “বাবা ও তো কালো। ওকে এই লাল রং ভালো লাগবে না গো।তাই আমি তরুর জন্য রেখে দিয়েছিলাম।”মেয়ের কথা শুনে বিক্রমবাবু বিরক্ত মুখে বলেন ” যার জিনিষ তাকে এক্ষুনি ফেরৎ দিয়ে দাও। ওকে ভালো লাগবে কিনা,তার বিচার করার তোমরা কে? কথাগুলো গম্ভীর ভাবে বলে ঘরের বাইরে পা বাড়ান। বাবার রাগ দেখে বেজার মুখে তিতলির হাতে জামাটা দিয়ে, তুলি বলে,”কিছুই তো পেলি না বাবা, মায়ের মতো। তবুও বাবা তোকেই বেশী ভালোবাসে দেখ!” বিক্রমবাবু ঘর থেকে বের হতে গিয়েও বড় মেয়ের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পরেন। তারপর বড় মেয়ের উদ্দশ্যে বলেন,” তোমরা আমার রূপ পেয়েছো। কিন্তু ও আমার সর্বশ্রেষ্ট সন্তান।কারণ ও আমার গুনটা পেয়েছে। আমি যা পারি নি, ও তা করে দেখাবে। তাই ও আমার ‘কন্যারত্ন’। কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ঘরের বাইরে চলে গেলেন বিক্রমবাবু।

ADVERTISEMENT

চৌধুরীরা এই গ্রামের সবথেকে ধনী পরিবার।আগে এদের জমিদারী ছিলো। আজ জমিদারি প্রথা উঠে গেলেও ব্যবসা থেকে প্রচুর উপার্জন তাদের। এই বাড়ীর বৌ হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা হলো, ফর্সা ও সুন্দরী। ফলে বাড়ীর বেশীর ভাগ সদস্যই সুন্দর।নিজেদের সৌন্দর্য্য নিয়ে একটা অহংকারও প্রায় সবারই আছে। তিতলির মা বাড়ীর বড় বৌ। আর সে-ই হলো এই বাড়ীর সুন্দরীশ্রেষ্ঠা । তার রূপের ছটায় সারা গ্রামের মানু্ষই মোহিত। রূপ নিয়ে এবাড়ীর সবার মতো তারও দম্ভ আছে। তবে তিতলির বাবা বিক্রমবাবু একে বারেই ব্যাতিক্রম। সেও যথেষ্ট সুপুরুষ। তার দূরদর্শীতায়ই চৌধুরীবাড়ীর ব্যাবসার এতো শ্রীবৃদ্ধি।

কালো’ বলে ছোটবেলা থেকে সবার উপেক্ষা ও উপহাস পেয়ে পেয়ে কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে যায় তিতলি। এমন কি তিতলির সুন্দরী মাও বড় দুই মেয়ের তুলনায় তিতলিকে একটু কমই আদর যত্ন করতো। তবে তার একমাত্র আবদারের জায়গা ছিলো তার বাবা। বড় হওয়ার সাথে সাথে তিতলির বাবা-ই তার সব থেকে কাছের বন্ধু হয়ে ওঠে। একমাত্র বাবার সাথেই তিতলি তার মনের কথা বলতে পারতো।

তিতলির বাবা বিক্রমবাবু এক সময় ভালো ফুটবল খেলতো। খুব ভালোও বাসতেন খেলাটাকে। তবে ওনার বাবা কোনদিনই চান নি, ওনার ছেলে ফুটবল খেলুক। প্রাক্তন জমিদার ও গ্রামের সবথেকে ধনী পরিবারের সন্তান হয়ে তার ছেলে কতোগুলে চাষাভূষা মানুষের সাথে রোদ, বৃষ্টিতে পুড়ে মাঠে,ঘাটে খেলবে এটা মেনে নিতে পারেন নি বিক্রমবাবুর বাবা। এই নিয়ে তাদের মধ্যে একটা মন কষাকষিও ছিলো। তবে তার মধ্যেও বাবাকে লুকিয়ে মাঝেমাঝে ফুটবল খেলতেন। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর ফুটবল খেলার আর সময় পেতেন না উনি। বাড়ীর বড় ছেলে হিসাবে সংসারের পুরো চাপটাই বিক্রমবাবুর মাথার উপরে এসে পরে। উনি খুব সুন্দর ভাবেই পারিবারিক ব্যাবসা পরিচালনা করেন এবং ব্যাবসার আরো শ্রীবৃদ্ধি ঘটান। তারপর বিয়ে করেন। তিন সন্তানের জনক হন। কিন্তু খেলার মাঠের প্রতি ওনার টানটা থেকেই যায়। তার জন্য গ্রামের ছেলেদের খেলাধুলায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য উন্নত খেলার মাঠ, কোচিং সব কিছুর ব্যবাস্থা করেন। সেই সুত্রেই খেলার মাঠে রোজ যেতেন উনি।

একটু বড় হওয়ার পর, তিতলির দিদিরা যখন তাদের মায়ের সাথে রূপচর্চায় ব্যস্ত থাকতো, তখন বাবার সাথে খেলার মাঠে যেতো তিতলি। আপন মনে দৌড়াদৌড়িও করতো। সেই সময়ই তিতলির দৌড়ানো দেখে বিক্রমবাবুর এক বন্ধু, যাকে কিনা উনি ফুটবল খেলা শেখানোর জন্য কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি বিক্রমবাবুকে পরামর্শ দেন, মেয়েকে খেলাধুলাটা মন দিয়ে শেখাতে। ওর মধ্যে জন্মগত ভাবেই খেলাটা আছে। তিতলির এইগুনের কথা শুনে বিক্রমবাবু কলকাতা থেকে শিক্ষক এনে তিতলিকে দৌড়ের প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু করলেন।

তিতলির এই মাঠে গিয়ে দৌড়ানো নিয়ে প্রবল প্রতিবাদের ঝড় উঠলো বাড়ীতে। তাদের মতো অভিজাত বাড়ীর মেয়ে মাঠে গিয়ে দৌড়াবে সেটা, মেনে নিতে পারলো না কেউই। এমন কি তিতিলির মাও প্রবল আপত্তি জুড়ে বললো,”একে তো কালো মেয়ে,তারপর আরো যদি মাঠে গিয়ে দৌড়ায়, তো রোদে পুড়ে গায়ের রংয়ের আর কিছু থাকবে নাকি? ” কিন্তু বিক্রমবাবু সেই সব কথায় কান দেন নি। একটু বড় হলে দেখা গেলো, তিতলি পড়াশুনায়ও বেশ ভালো। স্কুলে পড়াশুনো ও খেলাধুলায় প্রাইজ বাঁধা ছিলো ওর। সেই নিয়ে গর্বে বুক ভরে উঠতো তিতলির বাবা, বিক্রম চৌধুরির।

কিন্তু তিতলির এইসব গুণগুলো ম্লান হয়ে যেতো, ওর দিদিদের রূপের ছটায়। যতো বড় হতে থাকলো তুলি আর তরুর রূপের দম্ভ বাড়তে লাগলো। তিতলিকে হেয় করাতেই যেনো ওদের আনন্দ। এমন সময় জেলাস্তরের একটা দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে কলকাতায় গিয়ে প্রশিক্ষন নেবার সুযোগ পায় তিতলি।বিক্রমবাবুও সেই সুযোগের সদ্ ব্যাবহার করে তিতলিকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন।

কলকাতায় এসে তিতলির জীবনে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। মুখচোরা তিতলি, এক এক করে দেশের নানা প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেতে থাকলো। কালো বলে যে মেয়েটির কপালে একদিন কেবল উপেক্ষা আর উপহাস জুটেছিলো, খেলারমাঠ সেই মেয়েটির কপালেই জয়ের টীকা পরিয়ে দিলো। খেলা আর পড়াশুনার সুবাদেই সে একটি ভালো চাকরীও পেয়ে গেলো। এর মধ্যে তিতলির দুইদিদির বিয়ে হয়েছে গিয়েছে। আর তিতলির বাবাও অসুস্থ্য হয়ে পরেছে।

প্রথম রোজগারের টাকাটা বাবার হাতে তুলে দেবে ভেবে যখন তিতলি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছিলো, তখনই একদিন বাবার মৃত্যু সংবাদ পায় সে। পাগলের মতো দৌড়িয়ে বাড়ী যায় সে। কিন্তু তিতলি নাকি এ বাড়ীর সন্মান নষ্ট করছে। কারণ সে মাঠে, ঘাটে খেলে বেড়াচ্ছে, আবার জমিদার বাড়ীর মেয়ে হয়ে চাকরীও করছে। এইসব বাজে বদনাম এনে তিতলির দুই হিংসুটি দিদি তিতলিকে বাবার সব সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে। এবার তিতলির মা, তিতলির প্রতি হওয়া অন্যায়ের মৃদু প্রতিবাদ করেন। কিন্তু মুখরা দুই মেয়ের সাথে পেরে ওঠেন না। তিতলি বাবার পরলৌকিক কাজ মিটিয়ে, বাবার ছবি বুকে করে ওই বাড়ীর সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসে। বাবার মৃত্যু তিতলির জেদ আরো বাড়িয়ে দেয়। সে বাবার স্বপ্নকে পূরন করার জন্য আরো কঠোর অনুশীলন শুরু করে। তার ফলও পায়। দেশে, বিদেশে নানা প্রতিযোগিতায় সফল হতে থাকে সে।

আজ অ্যাথলেটিক হিসবে দেশে, বিদেশে নাম তার। নিজের রেকর্ড সে নিজেই ভাঙ্গে। দেশের মধ্যে প্রথম মহিলা হিসাবে আন্তর্জাতিক একটি প্রতিযোগিতায় সাফল্য লাভ করে সে। তার এই সফলতার পরই নানা দেশী, বিদেশী কোম্পানীগুলো তাকে নিজেদের পন্যের মডেল করতে চায়। সেই শুনে তাদের জিজ্ঞাসা করে ‘সে কি করে মডেল হবে?সে তো সুন্দরী নয়!’ সেই শুনে তারা বলে, ” ম্যাডাম আপনার গুণই আপনার পরিচয়। আপনি না করবেন না। ” তিতলি রাজি হয়ে যায়। এরপর তিতলি এক এক করে নানা কোম্পানীর মডেল হয়। তিতলির সাজ পোশাক সবই নতুন প্রজন্মের হার্টথ্রব। সে এখন দেশের ‘স্টাইল আইকন’। নানা সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায়ও বিচারকের আসনে বসে সে। সেদিনের মুখচোরা মেয়েটি আজ আত্মপ্রত্যয়ী, ব্যক্তিত্বময়ী। তবে মাঝে মাঝে বাবার জন্য, বাড়ীর জন্য বড্ড মন কেমন করে ওর। তখন বাচ্চা মেয়ের মতো বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে।

এমনই এক দিনে একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় বিচারক হয় তিতলি। সেদিনের প্রতিযোগিদের মধ্যে একটি মেয়েকে বড় চেনা চেনা লাগে। কিন্তু কোথায় দেখেছে বুঝতে পারে না। প্রতিযোগিতায় মেয়েটি বিজয়ী হয়। বিচারকের কাজ সেরে তিতলি যখন বাড়ী যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন ওই মেয়েটি এসে তিতলিকে নমষ্কার করে বলে,”মাসি তুমি, আমাকে চিনবে না। কারণ আমার জন্মের পর তুমি আর ওই বাড়ী যাওইনি। কিন্তু তোমার জন্যই আমি আজ বিজয়ী হলাম।” তিতলি অবাক হয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন মেয়েটি বলে, “আমি তোমার বড়দি, তুলির মেয়ে। ছোটবেলা থেকে টি.ভিতে, কাগজে তোমাকে দেখে দেখে আমি স্টাইল শিখেছি। বুঝেছি সৌন্দর্য ভগবান দেন না। ওটা অর্জন করতে হয়। তাই আমি তোমার মতো দৌড়াতে না পারলেও তোমার মতো আত্মবিশ্বাস, ব্যক্তিত্ব আনার চেষ্টা করেছি। খুব ইচ্ছে করতো তোমার মতো দৌড়াতে। তবে আমার অতো ক্ষমতা নেই গো। তাই তো তোমার ফ্যাশান, তোমার স্টাইল, তোমার আদর্শ অনুসরণ করি। ” তিতলি এবার বুঝতে পারে কেনো মেয়েটিকে চেনা লাগছিলো। মেয়েটির চেহারার সাথে ওর বড়দি তুলির অসম্ভব মিল। অমিল হলো মেয়েটির মুখের সরলতা ও ব্যাক্তিত্ব। এর জন্যই ওকে আরো বেশী সুন্দরী লাগছে। তিতলির হতবাক হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলে, “তুমি বাড়ী ফিরে চলো মাসি। ওদের রূপের দম্ভ, আজ তোমার গুণের কাছে হার মেনেছে। তুমি বুঝিয়ে দিয়েছো, কি করে ‘স্টাইল আইকন’ হতে হয়! সবাই আজ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। বোনঝির কথা শুনে তিতলি ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।

আজ চৌধুরী বাড়ীতে সাজো সাজো বর। বহু বছর পর তিতলি বাড়ী ফিরছে। সারা গ্রাম আজ তাদের বিজয়িনী মেয়েটিকে অভ্যর্থনা করতে ব্যস্ত। তিতলি আজ মাথা উঁচু করে, সন্মান নিয়ে বাড়ীতে ঢু্কেছে। হ্যাঁ, আজ সে এই বাড়ীর অহংকারকে ভাঙ্গতে পেরেছে। বোঝাতে পেরেছে যে, মেয়েরা কেবল বিয়ে করে পরের ঘরে যাওয়ার জন্য জন্মায় না, তারা নিজেদের পরিচয়ও তৈরী করতে পারে। হতে পারে দেশের ‘স্টাইল আইকন’।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait