অনামিকার ডাইরি (দ্বিতীয় পর্ব) – বৃষ্টির দাগ

অনামিকার ডাইরি (দ্বিতীয় পর্ব) – বৃষ্টির দাগ

আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ বেশ ভার। ওই ঠিক যেমন আমাদের পাড়ার খোকন ময়রার ছেলে, আবদার পূরণ না হলে, মুখ গোমরা করে বসে থাকে সারাদিন, তার পরেও পাত্তা না পেলে, মনের রাগ উপচে বারিয়ে আসে চোখের ভাজ দিয়ে, সিক্ত করে দেয় সারা মুখটা, অনেকটা সেরকম। খোকন ময়রার ছেলের ভীষণ রাগ, এখন আকাশের চোখে মুখে। এই কাঁদে কি ওই কাঁদে। সে আকাশ থাক তার নিজের মতন, আমার অন্তরে কিন্তু আজ হুল্লোর লেগেছে। মৌসুমী ওই এলো বলে। বর্ষার প্রথম বৃষ্টি যেন বহু দিন পরে প্রেমিকের সাথে সাক্ষাতের মতন। সেই কোমল বারিসিঞ্চন যখন মাটির সোঁদা গন্ধের সাথে মিশে, পৃথিবীর তৃষ্ণা নিবারণ করে, তখন সেই শীতল জলের ঝাপটা, কেমন করে জানি রক্ত মাংসের আবরণ ভেদ করে হৃদয়ের কোণায় গিয়ে লাগে। সেই স্পর্শ কত শত নাম না জানা শিরা উপশিরায় অনুরণন তুলে দিয়ে যায়। কিন্তু আমি যখন পেখম মেলা পাখী, নিজের মেলে রাখা ভিজে ডানায়, বৃষ্টির জলেদের জমা করি, তাদের সাথে খুনসুটি খেলা করি, সই পাতাই, কত পাখীর তখন বাসা ভাঙ্গে, ওই ক্ষুদ্র শরীরের অভ্যন্তরের অতি ক্ষুদ্র হৃৎপিণ্ডটি তখন না জানি কত ভয়ের সিঁড়ি অতিক্রম করে, সেকথা ভেবে দেখা হয়নি কখনো। সেই বৃষ্টির দাগ কি পাখীগুলো ভুলতে পারে কখনো?

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

মায়ের মুখে শুনেছি এমনই এক বৃষ্টির দাগের গল্প। বৃষ্টির দিন নয়, রাতের গল্প। তখন মধ্যরাত, আমি তখন পৃথিবীতে মাত্র ষষ্ঠ মাসের অতিথি। আমাকে নিয়ে মা বাবার একার সংসার, কলকাতার পুরনো পাড়ার এক অপ্রসিদ্ধ গলির অভ্যন্তরে। বাবা সেদিন বাড়ী ছিল না। অফিসের কাজে বাইরে। মধ্যরাতের কাঁটা যত এগোচ্ছিল, থার্মোমিটারের পারদ তত চড়ছিল। মায়ের চোখের জল মুখের পরিসীমা অতিক্রম করে বৃষ্টির মত ঝড়ে পরছিল আমার উত্তপ্ত কপালের ওপর, আর সেই চোখের জলের শীতলতা ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করছিল ছোট্ট শরীরের উষ্ণতা। প্রচণ্ড বৃষ্টি আর আকাশের দাপটে চাপা পরে যাচ্ছিল মায়ের উদ্বিগ্ন অন্তর। বিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল মায়ের কান্নার আওয়াজ।মা আমাকে অনেকগুলি আস্তরণের ছায়ায় আবদ্ধ করে, মধ্যরাতের এক হাঁটু জল উপেক্ষা করে, বেরিয়ে গিয়েছিলো রাস্তায়। স্তব্ধ, জনহীন,বুদ্যুতহীন, ঘণ,কালো,ভিজে রাতের, দুর্গমতাকে তাচ্ছিল্য করে, বৃষ্টির জলের সাথে নিজের চোখের জল একাত্ম করে, মা যে সেদিন কোথায় যাচ্ছিল, আজও বলতে পারে না।

কিন্তু সেদিন অদ্ভুত ভাবে দেখা মিলেছিল, প্রকৃতির নিযুক্ত করা দেবদূতের। এক রিকশাওয়ালার বেশে। কাল, শীর্ণ চেহারা, নীল, সাদা চেক লুঙ্গি পরণে, আপাদমস্তক সিক্ত, এসে থেমেছিল মায়ের কাছে। তার রিকশার রেগসিনের সিটে স্থান পেয়েছিল এক অসহায় মা আর তার কোলে গুটিয়ে থাকা সন্তান। সে কিভাবে যেন খুঁজে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের বাড়ীতে। সামনে রিকশাটা দাঁড় করিয়ে, ডেকে এনেছিল ডাক্তারকে। বৃষ্টির সমস্ত জলগুলিকে স্বার্থপরের মতন নিজের ভাগে কেড়ে নিয়ে, ছাতা ধরেছিল ডাক্তারের মাথায়। ডাক্তার এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে, ইঞ্জেকশন দিয়েছিল একটা। ভীষণ জোরে নাকি কেঁদে উঠেছিলাম আমি। জীবনদায়ী নিমেশের মধ্যে মিশে গিয়েছিল রক্তের সাথে। আর মিনিট পনেরোর রুদ্ধশ্বাস লড়াই, তারপর সব শান্ত। মা এখন তার ভেজা শাড়ীর শুকনো কোণটা দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে আমার ঘর্মসিক্ত শরীর। রিকশাওয়ালাটা তখনোও ভিজছে, চালিয়ে যাচ্ছে লড়াই, আমাদের নির্বিঘ্নে বাড়ী ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই——-।

পরে মা তাকে অনেক খুঁজেছে। আর কোনদিন দেখতে পায় নি। সে হারিয়ে গিয়েছে। শুধু রেখে গেছে মায়ের অন্তরে এক চিরন্তন বৃষ্টির দাগ। যে দাগ অঝড় বৃষ্টির কোটি কোটি বিন্দু ধুয়ে দিয়ে যেতে পারে না। জমা হয়ে যায় জীবনের স্থায়ী আমানতের খাতায়।

আজ এটুকুই থাক। আবার দেখা হবে অন্য দিন, অন্য গল্প নিয়ে।

 

ক্রমশঃ

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait