পুরানো সেই দিনের কথা

পুরানো সেই দিনের কথা

সারারাত ধরে চোখের জলে বিছানার চাদর ভিজিয়ে আমি শুধু এটাই প্ল্যান করেছিলাম আর আমি ওর সাথে কথা বলবো না, আর কোনোদিনও আমি ওর সাথে আমার টিফিন ভাগ করে খাবো না। কি করে পারলো ও এটা!

সেই প্রাইমারি থেকে অনামিকা আমার বেস্টফ্রেন্ড। স্কুলের প্রথমদিন দুটো ঝুঁটি বাঁধা মেয়েটা আমাকে ডেকে নিজের পাশে বসিয়েছিলো, আমি কাঁদছিলাম দেখে আমাকে চকলেটও দিয়েছিলো একটা।

সেই থেকে গত তিন বছরে আমরা স্কুলে কোনোদিন আলাদা বসিনি, ছুটির পর হাত ধরে বেরোতাম দুজন। গ্রীষ্মের ছুটি, পুজোর ছুটিতেও আমরা চিঠির আদানপ্রদান করতাম, এতটাই গভীর ছিল বন্ধুত্ব।

ADVERTISEMENT

আর সে কিনা আজ দুবার ভাবলো না হিংসুটে রীনার ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ের সম্মতি দিতে!

গতমাসেই রীনার কোন এক কাকা আমেরিকা থেকে ওর জন্য এই সাহেব পুতুল এনে দিয়েছিলো, কি সুন্দর নীল চোখ পিটপিট করে, কোটপ্যান্ট পরা, মাথায় এক ঝাঁক সোনালী চুল। আর আমার সোনাই সে জায়গায় নিতান্তই সাদামাটা, ছাঁচে ফেলা প্লাস্টিকের তৈরি, এমনকি জামাটাও প্লাস্টিকের, গায়ের সাথে লাগানো, খোলা যায় না। অনামিকার পুতুল মেয়ে রুপুও একই রকম ছাঁচে ফেলা প্লাস্টিকের, কিন্তু ওর মাথায় ছিল দুই কাঁধ ছাপিয়ে নামা কালো চুলের বেণী । গোলাপি শাড়ি পরা রুপুর টানাটানা আঁকা চোখ ছিল। ঠিক হয়েছিল আমার সোনাই আর অনামিকার রুপুর বিয়ে দেব আমরা, সেই বছর পুজোর ছুটির পর স্কুল খুললেই।

কিন্তু এর মধ্যে রীনার সাহেব আলেক্সকে দেখে অনামিকা মত বদলাতে সব ভেস্তে গেলো। রাগের চেয়েও আমার দুঃখ বেশি হয়েছিল, মনে হয়েছিলো যেন ও আমাকে চিট করেছিল ! অগত্যা ব্রেক আপ, সোনাই আর রুপুরও সেই সাথে বিচ্ছেদ।

আমি আর কোনোদিন ওর সাথে কথা বলি নি, আর ওর দিক থেকেও চেষ্টা ছিল না তার। ওর পুতুল মেয়ের বিয়ে হচ্ছিলো তখনকার দিনের সবচে স্মার্ট পুতুল ছেলের সাথে, সেই অহংকারেই বোধহয়।

ঠিক এর কয়েকদিন পরেই পুজোর ছুটির পর ওর বাবার বদলির কারণে ওরা শহর ছেড়ে চলে যায়।

———

জানি না আজ এতো বছর পর, হ্যাঁ, প্রায় পঞ্চাশ বছর পর হটাৎ সেই দিনটা মনে পড়লো কেন ! মনে আছে সেদিন স্কুল থেকে ফিরে আমি ব্যাগ টা ছুঁড়ে ফেলে কেঁদেছিলাম মা কে জড়িয়ে, কিন্তু মাকে বলিনি কারণটা। মা প্রথমে একটু উদ্বিগ্ন হলেও পরে বাচ্চাদের ব্যাপার বলে আর মাথা ঘামায়নি।

এতো বছরে কখনো মনে পড়েনি, আমি নিজের জিদে অটল ছিলাম, হয়তো অভিমানটা এতকাল আমার মধ্যে ছিল বা! কিন্তু কে জানে আজ হটাৎ কেন অনামিকার কথা মনে পড়ে চোখ ভিজে এলো। মনে হলো একবার ওকে সামনে পেলে জড়িয়ে ধরে বলতাম, “লোভী কোথাকার, তাও আমরা বেস্ট ফ্রেন্ডই থাকবো।”

ডিং ডং…..

আমার স্মৃতিচারণায় বাধা পড়লো দরজার ঘন্টিতে। 
এই দুপুরবেলাটা একান্তই আমার নিজস্ব্য; মিষ্টি আর ওর বাবা অফিস বেরিয়ে গেলে ঘরের কাজ গুছিয়ে আমি একটু আমার ব্যালকনির বাগানে বসি, একটু গল্পের বই পড়ি বা কখনো।

আজ আবার এই অবেলায় কে এলো এই ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দেখি আমার একমাত্র কন্যারত্নটি। জিগ্যেস করতে বললো, ওরা বন্ধুরা মিলে মুভি দেখতে যাচ্ছে, তাই হাফডে নিয়েছে।

ও চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেলে আমি আবার স্মৃতির সমুদ্রে ভেসে গেলাম। মনে পড়ে গেলো মা বলেছিলো অনামিকা নাকি একদিন আমার বাড়ি এসেছিলো শহর ছাড়ার আগে, কিন্তু আমি বাড়ি ছিলাম না, আমি এটুকু জানারও প্রয়োজন মনে করিনি ও কি বলতে এসেছিলো।

ছোট্টবেলার অপরিণত মনের প্রচন্ড অভিমান আমাকে ওর থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো। তখনকার দিনে এখনের মতো ফোন, ইন্টারনেট ছিল না। এতো বছরে কোথায় আছে, কেমন দেখতে হয়েছে তার কোনো হদিস পাওয়া সম্ভব ছিল না। তবু কেন জানি না আজ মনে হচ্ছিলো যদি পাওয়া যায় হারানো রতন।

আবার ঘন্টি বাজলো দরজার। ওমা, আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে কখন পাঁচটা বেজেছে। মিষ্টির বাবা এলো বোধয়।

ও আসার পর সাধারণত আমরা বিকেলের চা খেতে খেতে টুকটাক গল্প করি। স্মৃতির দরজাটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেছিলো তাই। ছোটবেলার পুতুলখেলা আবার মনের অতলে তলিয়ে গেলো।

——

রাতের খাবার একটু আগে মিষ্টি, মানে আমার মেয়ে ফিরলো। ওর সাথে অংশুও এলো। অংশু মিষ্টির কলেজ এর বন্ধু, কিন্তু ওদের মধ্যে ব্যাপারটা যে বন্ধুত্বের কিছু বেশি সেটা আন্দাজ করা শক্ত নয়। অংশুও মিষ্টির মতোই এঞ্জিনিয়ারিং পাস করে মাল্টিন্যাশনালে কর্মরত।
ওদের পরিবারের সাথে খুব বেশি পরিচয় না থাকলেও জানি যে মোটামুটি ভালো সম্ভ্রান্ত পরিবার। তাই আমাদের দিক থেকে ওদের এই সম্পর্কে আপত্তির কিছু ছিল না কোনোদিন।

যাই হোক, অংশুকে বললাম রাতে খেয়ে যেতে। ও একটু মুচকি হেসে বললো, “আন্টি, আমারও তোমাদের কিছু বলার আছে।” 
মিষ্টি দেখলাম লজ্জা পেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। বোঝা কঠিন হলো না কি বিষয়ে কথা।

রাতে খাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে বসে মিষ্টির বাবা আর আমার সামনে অংশু সরাসরি প্রস্তাব রাখলো, প্রায় পাঁচ বছর ওরা একসাথে, দুজনেরই চাকুরীজীবন মোটামুটি সেটলড, আর দেরি না করে ওরা গাঁটছড়া বেঁধে ফেলতে চায়। এও বললো অংশুর বাড়িতেও মিষ্টিকে আগেই ওরা পছন্দ করে ফেলেছে, আমরা সম্মতি দিলেই ওর বাবা মা পাকা কথা বলতে আসবে।

আপত্তির কোনো কারণ ছিল না, তাই পরেরদিনই অংশুর মা বাবা এলো কথা বলতে।

সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেলো, বোঝা যাচ্ছিলো মিষ্টিও ওদের মন জয় করেছে অনেক আগেই। বিয়ের দিন ঠিক হলো মাস দুই পর।

পরের কয়েকটা দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে ভেন্যু ঠিক করা, জিনিসপত্র এবং অভ্যাগতদের নামের তালিকা ঠিক করা ইত্যাদিতে।

—-

আজ রবিবার, মিষ্টি গেছে ওর বাবার সাথে কার্ডের দোকানে, আজ ওরা কার্ডের ফাইনাল ডিজাইন দেখাবে। কয়েকদিন আগেই অংশু আর মিষ্টি গিয়ে সব পছন্দ করে লেখা দিয়ে এসেছে। কার্ড প্রিন্টিংয়ের ওখানে অংশু আর ওর পরিবারেরও আসার কথা। তারপর সবাই মিলে আমাদের বাড়িতে লাঞ্চের প্রোগ্রাম। এদিকে রান্নাবান্নার আয়োজন দেখতে হবে বলে আমি আর যাই নি।

রান্নার ব্যাবস্থাই দেখছিলাম,হঠাৎ ঘন্টি শুনে আমি গিয়ে দরজা খুলে দেখি অংশুর মা দাঁড়িয়ে, উনার চোখে জল, এবং হাতে একটা কার্ড।
কিছু বুঝতে না পেরে আমি একটু ভয়ের সাথেই জিগ্যেস করলাম কি হলো। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন, ভদ্রমহিলাকে অংশুর মা হিসাবেই চিনি, সেরকম আলাপ নেই।

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছি কি হলো, ততক্ষনে মিষ্টি, অংশু এবং ওদের দুই বাবা এসে দাঁড়িয়েছে। আমি জিজ্ঞ্যাসু দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাতে সকলের মুখে একটা আশ্চর্য্যানীত ভাব দেখতে পেলাম। 
অংশুর মা আমাকে ছেড়ে হাতের কার্ডটা আমাকে দিলেন।

অবাক হয়ে পড়তে শুরু করলাম,

“সুধী,
অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আমাদের একমাত্র কন্যা রিধিমা বসুর সাথে শ্রী অক্ষয় রায় এবং শ্রীমতি অনামিকা গুপ্ত রায়ের একমাত্র পুত্র অংশুমান রায়ের শুভবিবাহের আয়োজন……..”
অবাক দৃষ্টিতে অংশুর মায়ের দিকে মুখ তুলে তাকাতে গিয়ে দেখি সব ঝাপসা হয়ে গেছে; অনামিকা গুপ্ত, আমার ছোটবেলার সবচে প্রিয় সাথী আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

অংশুর বাবা ওকে অনু বলে সম্বোধন করছিলেন, আর আমরা মিসেস রয় বলে। অংশুর মা-এর পুরো নাম জানার প্রয়োজন বোধ করিনি, আর অনামিকাও বোধয় মনে করে নি এতদিন।
অন্যান্য কাজের মাঝে এতদিন কার্ডের ব্যাপারেও আমি একদমই মাথা ঘামাইনি, পুরোটাই মিষ্টি আর ওর বাবা দেখেছে। 
আজ কার্ড হাতে পেয়ে আমার পুরো নাম দেখে ওর খটকা লাগে, মিষ্টির বাবার কাছে জানতে পারে আমার বাপেরবাড়ীর শহর ইত্যাদি ।

তারপর ? তারপর আর কি !

দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বিচ্ছেদের পর চোখে জল, মুখে হাসি নিয়ে আর দেরি করি নি অনামিকাকে জড়িয়ে ধরে বলতে, “লোভী কোথাকার, নিলি তো আমার পুতুলটাও শেষ পর্যন্ত…………”

 
 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait