ছোটগল্প - মুখেভাত

ছোটগল্প - মুখেভাত

আজ নতুন একটি দিন রূপশ্রীর জীবনে। আজ ঘুম ভেঙেছে নতুন এক বাড়িতে। এই বাড়িতেই তার বাকি জীবন টা কাটানোর কথা। তার স্বামীর বাড়ি, এখন তার নিজের বাড়ি।
কে জানে কেন লোকে "শশুরবাড়ি" বলে বাড়ি এবং বাড়ির লোকগুলোকে এত পর করে দেয়ে, রূপশ্রী বোঝেনা, নাকি বুঝবে নাই ঠিক করেছে। অবশ্য এমন কিছু যে বোঝার মতো বয়স হয়েছে, তা তো না। এখনকার দিনে বহু মেয়েই এই ২৩ বছরে উচ্চশিক্ষা, চাকরি, স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে বসেনা।

রূপশ্রীও যে বিয়ে করতে চেয়েছিল, তা না। তবে মা নেই তো, বাবা ব্যানার্জী বাবু একা মেয়ে কে নিয়ে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন, যে দিন বাড়ি ফিরতে দেরি হতো, চিন্তায় শেষ হয়ে যেতেন - মেয়ে টা একা বাড়িতে, না জানি কি হয়ে। রূপ তো ঢেলে দিয়েছেন বিধাতা, গুন ও, বিদ্বেবুদ্ধি ও।

শুধু মা কেই পেলোনা মেয়ে টা, যেদিন পৃথিবী তে এলো, সেদিনই মা কে হারালো। কখনো মাসির মধ্যে, কখনো মামীর মধ্যে, কখনো বা জেঠি কাকী দের মধ্যে মা ক খুঁজেছে। তবে মা কে পায়নি, মা এর মত কে পেয়েছে।

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

তাই যখন এই সম্বন্ধটির প্রস্তাব এলো, ব্যানার্জী বাবু না করেননি। একমাত্র ছেলে, শুনেছেন একটি মেয়েও ছিল নাকি, খুব অল্প বয়সে একসিডেন্ট এ মারা যায়। ভট্টাচার্য দম্পত্তি খুবই অমায়িক। প্রথম পরিচয়ই উভয় পক্ষের পছন্দ হলো।
"রূপশ্রী কে আমরা মেয়ের মতো করে রাখবো, বৌমা নয়" - বিশেষ করে এই কথাটি বাবা মেয়ের দুজনেরই মনে ধরেছিল। অবশ্য অনেকেই বলেছিল, ওরকম এখন সবাই বলে।
যাই হোক, 5 মাস এর মধ্যে বিয়ে টা হয়ে যায়। গতকাল মেয়ে এই বাড়ি থেকে ওই বাড়ি চলে গেছে। ব্যানার্জী বাবুর দুঃখ হচ্ছে ঠিকই, তবে কোথায় যেন একটু নিশ্চিন্ত ভাব টা বেশি।

এদিকে রূপশ্রী ঘড়ি দেখে, ওমা, অনেক বেলা হলো তো..। ৭ঃ৩০টা। অবশ্য বাবার কাছে এই সময়ে উঠে পড়লে হয়তো বাবা বলতো, "কি রে, এত 'ভোরে' উঠেছিস? কোথাও যাবি?"

শশুরবাড়ি তে এসব চলেনা, সে জানে। আর তা ছাড়া নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েই সে এসেছে, যে প্রথম দিন থেকে নিজেকে 'প্রমান' করবে, কাউকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দেবেনা। সবাই যেন প্রথম দিন থেকে বলে "বাহ, এই না হলে বৌমা"! তার খুড়তুতো দিদির বেলায় দেখেছে সে, কেমন বিয়ের ঠিক 2মাসের মাথায় ওর শশুরবাড়ি থেকে দিদি কে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল এই বলে যে মেয়ে রান্না করতে পারেনা। আলু পটল ঢেড়শ কোনোটাই ঠিকঠাক কাটতে ছুলতে পারেনা। আর অফিস করে তো কি হয়েছে? দরকার পড়লে ২-১ দিন রাত হতেই পারে শুতে, তাই বলে পরের দিন বেলা ৮টা করে উঠবে নাকি? হোক না রবিবার। তাই বলে কি আর কেউ জলখাবার খাবেনা?ন

রূপশ্রী তাই নিজেকে সেদিন থেকেই বুঝিয়েছে, যত রাতই হোক না কেন ঘুমোতে, ভোরে ওঠা শ্বশুরবাড়িতে অবশ্যক - যাকে বলে মাস্ট-হ্যাভ।
তাড়াতাড়ি ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুমটায়ে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়ে সে। স্নান করেই বেরোয়, শুনেছে অনেক বাড়িতে স্নান করে তবে রান্নাঘরে ঢোকা নিয়ম। আগেভাগে সেসব নিয়ম মেনে চলাই ভালো।

একটা তুতে রঙের তাঁতের শাড়ী বের করে জড়িয়ে নেয়ে সে। শাড়ী পরায়ে পটু। বাংলা মিডিয়াম এ পড়ার এই একটা বিশেষ সুবিধে। ক্লাস ৯ থেকে ধরে বেঁধে শাড়ী পরা শিখিয়ে দেয়ে স্কুলেই।

দরজা খোলার আগে একবার ঘড়ি দেখে সে - ৮ঃ১০. ওমা, অনেক দেরি হয়ে গেল। যদি কেউ কিছু বলে?
বাড়ি ভর্তি লোক - সায়ক এর মামা মাসি মামী পিসি কাকী মিলিয়ে প্রায় ১০-১১ জন মানুষ আগের রাতে এই বাড়িতেই ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে না জানি কি আলোচনা করবেন রূপশ্রীর দেরি করে ঘর থেকে বেরোনো নিয়ে।

হলো ঠিক তাই , বেরোতেই সায়কের বড় জেঠি বলে উঠলেন - "কি মা, উঠেছ? ভাবছিলাম এইবার বোধহয় তোমায় কাসর ঘন্টা বাজিয়ে ডাকতে হবে। এস এস।" বলেই উনি হেসে উঠলেন আর সাথে সাথে পিসিমা বললেন "দাড়াও বৌদি, তাও তো ভালো, গতরাত কালরাত্রি ছিল। না জানি আগামীকাল কখন উঠবে।"
রূপশ্রী লজ্জায় মিশে গেল, না.. ফুলশয্যার ইঙ্গিতে না। তার প্রথম অভিযোগ এর খোটায়ে।

মুখ নিচু করে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো সে। শাশুড়িমা কড়ায়ে কি যেন নাড়ছেন। গিয়ে বললো, "আমায় দাও মামনি, আমি করছি।"
ভটচাজ গিন্নি বললেন, "না তুমি খাবার টেবিলে যাও, এখানে কেন। আমি তো ডাকিনি।"
এবার হঠাৎ রূপশ্রীর খুব কান্না পেল! গলার কাছটায়ে কেমন যেন ব্যথা করে উঠলো।
সায়ক ই বা কোথায়। এমন অবশ্য না যে তাদের প্রেম করে বিয়ে, বা অনেক দিনের আলাপ। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বড়োজোর দুই কি তিন বার দেখা করেছে তারা। সায়ক কে অফিসের কাজে প্রচুর ট্যুর করতে হয়, সেই জন্যেই এরই সুযোগ পায়নি তারা দেখা করার বা ঘোরার। তবে হ্যাঁ, ফোনে কথা হতো। প্রায় রোজই হতো। তাই হয়তো আজ এই মুহূর্তে সায়ক কেই সে খুঁজছে। কে জানে সে কোথায়।

চুপচাপ খাবার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো রূপশ্রী। ঘর ভর্তি লোক। নিজেদের মধ্যে কথা আলোচনা চলছে। আজ সন্ধেবেলা কে কি সাজবে, কনে কে সাজাতে parlour থেকে কখন লোক আসবে। কনের গয়না গুলো কোনটা সুন্দর আর কোনটা সেকেলে। এইসব..আরো অনেক আলোচনা। সব যেন রূপশ্রীর কানে এলোনা।
এমন সময় শাশুড়িমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পেছন পেছন কাজের মেয়েটি।

"নীলা, তুমি প্লেট গুলো পাতো। আর ওই রুপোর বাসন গুলো রুপা কে দাও..না না এখানে কেন, ওকে ওই চেয়ার টায় বসতে দাও।" বলে একটি চেয়ার এর দিকে আঙুল দেখালেন। এই চেয়ার টা যেন অন্য গুলোর থেকে কম ব্যবহৃত। যেন নতুন। কে জানে হয়তো এটা আগে ছিলনা, বা হয়তো আলাদা করে পালিশ করানো হয়েছে।
রূপশ্রী চেয়ার টার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
 "কি হলো, বস।"
"সবাই না বসলে আমি কিকরে বসবো মামনি..."! কার কথা যে বললো সে নিজেই জানেনা, তবে বাড়ির বউ এর যে সবার আগে বসা উচিত হবেনা, সেটা কে যেন ভেতর থেকে তাকে বারে বারে বলে দিচ্ছিল।

এবার শাশুড়িমা আর কিছুই বললেন না। প্লেট গুলো পাতলেন.. প্লেট, বাটি, গ্লাস সব যেন একটু ছোট ছোট সাইজের। রুপোর তো, হয়তো বেশি বড় কেনা সম্ভব হয়নি। আর কতই বা খাবে সে, যে বড় বড় থালা দরকার!

হঠাৎ চোখে পড়লো প্লেটে লেখা - "শুভশ্রীর অন্নপ্রাশন"! অবাক হয়ে তাকালো সে...শাশুড়িমা যেন অপেক্ষাই করছিল তার শান্ত চোখের প্রশ্নটির।

"আমার মেয়ে, ৫ মাস বয়স এ মারা যায়। সায়ক তখন ৩ বছর। সায়ক কে নিয়ে আমি বাড়িতে, আয়া মেয়ে কে প্র্যাম-এ করে ঘোরাতে নিয়ে গেছিলো। দুজনেই আর বেঁচে ফেরেনি। ১০ দিন পর আমার মেয়ের অন্নপ্রাশন ছিল। এইসব তার এ থালা বাসন।"

এক চোখ জল নিয়ে শাশুড়িমা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, "১০ দিন বাড়তে বাড়তে যে ২৫ বছর হয়ে যাবে বুঝিনি...তবে আজ আমার মেয়ে কে খাওয়াতে পারছি, এটাই এক নিমেষে আমার সব কটা হারানো বছর ভুলিয়ে দিচ্ছে। বসো, খেতে বসো। আজ আমার মনের মতো রেঁধেছি, এরপর তোমার প্রিয় খাবার গুলো জেনে নেব, সেগুলোও রেঁধে খাওয়াবো।"

এক ঘর ভর্তি নিস্তব্ধতা - যাকে বলে পিন ড্রপ সাইলেন্স। সেই নিস্তব্ধতা কেটে গেল রূপশ্রীর কান্নায়। মা কি এরকমই হয়ে তাহলে?

সব ভুলে শাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলেছে সে ...কখন জানি বলে ফেললো - "মা, এতদিন পরে এলে কেন? এতো অপেক্ষা কেন করালে মা?"

মামনি থেকে সদ্য মা হওয়া ভট্‌চাজ গিন্নি অনেক কষ্টে চোখের জল সংবরণ করে বলল, "তোকে খুঁজে পেতে সময়ে লেগে গেল রে মা। নাম পাল্টে ছিলি তো, তাই।"


0 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 03rd May, 21 10:56 pm

খুব ভালো লাগলো...

Piyali Kushari

Piyali Kushari

Shared publicly - 03rd May, 21 10:38 pm

বাহ, বেশ ভিন্ন স্বাদের গল্প,দারুন !!

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait