মেনকা ও উমা – বাঙালি মা ও মেয়ের স্নেহ-ভালবাসার জীবন্ত কাহিনী

মেনকা ও উমা – বাঙালি মা ও মেয়ের স্নেহ-ভালবাসার জীবন্ত কাহিনী

একসময় মা দূর্গা, উমারূপে মেনকার কোল আলো করে সমগ্র গিরিপুর আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছিলেন – এই পৌরাণিক কাহিনীর মানবিক পাঠ উচ্ছ্বলিত হয়েছে বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়ার গানে। উমা সামান্য মেয়ে নয় তা মেনকা অনুভব করেছেন স্বপ্ন দর্শনে। চতুর্ভূজ নারায়ণ, পঞ্চমুখ শিব সকল দেবতারাই তাকে মাথায় করে রাখেন। তিনি স্বপ্নে দেখেছেন গড়ুর বাহন-নারায়ণ জোড় হাত করে তার কাছে বিনয় প্রার্থনা করছেন। ‘মুনিগন ধ্যানে যারে না পায়’ এই পরমারাধ্যাকেই তিনি গর্ভে ধারণ করেছেন, -আর এই উমাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জনমানসের তথা বাঙালি মাতৃ হৃদয়ের কন্যা সন্তানের জন্য সুগভীর স্নেহ মমতা-বাৎসল্য উৎকন্ঠা মিলন বিচ্ছেদের সুখ ও আর্তি সুচিহ্নিত হয়ে আছে।

আমার উমা সামান্যা মেয়ে নয়!

গিরি তোমারি কুমারী তা নয়, তা নয়!

ADVERTISEMENT

স্বপ্নে যা দেখেছি গিরি কহিতে মনে বাসি ভয়

ওহে কারো চতুর্মুখ, কারো পঞ্চমুখ, উমা তাঁদের মস্তকে রয়!...

প্রসাদ ভনে মুনিগণে যোগ-ধ্যানে যাঁরে না পায়,

তুমি গিরি ধন্য, হেন কন্যা-পেয়েছ কি পুণ্য উদয়!

এহেন কন্যাকে নিয়ে মেনকার ব্যস্ততার অন্ত নেই। মেয়ে কথায় কথায় অভিমান করে। অসম্ভব সব বায়না ধরে। কিছুতেই স্তন্যপান করতে চায়না, এমনই দুরন্ত, এমনই চঞ্চলা গিরিবালা, -

উমা কেঁদে করে অভিমান, নাহি করে স্তন্যপান,
নাহি খায় ক্ষীর ননি সরে

শেষে তার সামনে আয়না ধরলে তবে সে শান্ত হয়, -

সানন্দে কহিছে হাসি, ধর মা এই লও শশী,
মুকুর লইয়া দিল করে

মায়ের আদরে, বাপের সোহাগে, পাড়া প্রতিবেশীদের ভালবাসা গায়ে মেখে বালিকা উমা দিনে দিনে বড় হতে থাকে। কন্যা বড় হলে ভাবী জীবনে স্বামী গৃহে সুখ সমৃদ্ধি যেন পায়, তাই মায়েরা বাল্যকাল থেকেই মেয়েদের নানাব্রত পালন করতে শেখান। উমা রাজকন্যা হলেও তাকে পরের ঘরে দিতে হবে। তাই রানী মেনকা, বালিকা উমাকে ছোট বয়স থেকেই নানাব্রত করতে শেখান। -

নানা ফুল তুলি, চিত্তে কুতুহলী,

গমন কুঞ্জর গমনে।

তারপর ভক্তি সহকারে শঙ্করের পূজা করে এবং শিব যে বিল্ব পত্রে তুষ্ট হয় তাই উমা - …. ‘পূজেন শঙ্কর করবী বিল্বদলে’। তারপর শঙ্করকে প্রণাম করে তাঁর করুণা প্রার্থনা করেন এবং পরে দেখা যায় বালিকা উমা যত বড় হতে থাকে ততই ভাবী জীবনের জন্য সাধারণ বালিকার মত সচেতন হয়ে ওঠে এবং শিবকে স্বামীরূপে পাবার জন্যে কঠোর সাধনা শুরু করে। রাজকন্যা উমার এই অনশন ব্রত দেখে মা মেনকার প্রাণ স্নেহে কাতর হয়ে পড়ে কারণ উমা রাজকন্যা কত আদর যত্নে লালিত পালিত সেই বালিকা, -

ব্রত অনশন, স্বস্তিক আসন,

মান সে শঙ্কর ধ্যান।

শিবকে স্বামীরূপে পাবার জন্যে রাজকুমারী উমার এমন কঠোর অনশন ব্রত দেখে জননী মেনকার মন তো চিন্তায় ব্যাকুল। কারণ উমা যার জন্যে এ সাধনা করছে সে তো তার মতো রাজ রাজেস্বর নয়, তবু উমা যদি তাঁকেই পতি রূপে বরণ করতে চায় তার জন্য তাকে এমন কঠোর তপস্যা করতে হবেনা কারণ তার পিতা গিরিরাজ হিমালয় – সেই হিমালয় – সে ইহিমালয়েই সকলের আবাসস্থল, সুতরাং বিনা তপস্যায়-উমার মনের বাঞ্ছা পূর্ণ হতে পারে। এখানে রানী মেনকা সব মায়েদের মত আপন ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে কন্যা উমাকে সাধারন শিবের জন্য দেহ পাত করে সাধনা করতে নিষেধ করেন। তবু জননী মেনকার কথায় উমা সাধনা ত্যাগ করেনি। তারপর ব্রত শেষ হলে জননী মেনকা অতি আদরে কন্যাকে কোলে তুলে নেন। তার সোনার পুতলি উমার মলিন মুখ দেখে মায়ের প্রাণ দুঃখে দুনয়নে জল ভরে ওঠে। তিনি আবার তার স্নেহের দুলালীকে রাজকন্যার মত নানা অলঙ্কারে ভূষিত করে তার দিকে চেয়ে আনন্দে বলেন, -

আপন অঙ্গে যখন পড়ে গো আঁখি

উমার অঙ্গ আপন অঙ্গে গো দেখি॥

এই উমা যে শক্তিরূপিনী, জগজ্জননী, মেনকার বাৎসল্য প্রেমে তা আবৃত হয়ে পড়ে। তাই সব মায়ের মত তিনিও কন্যাকে সাজিয়ে নিজেরই প্রতিরূপ তার মধ্যে দেখে আনন্দে বিভোর। কারণ উমা তাঁরই তো কন্যা। তারপর একদিন জননী মেনকা কন্যা উমার সম্পর্কে কুস্বপ্ন দেখে অত্যন্ত বিচলিত। তিনি স্বপ্নে দেখেন, -

রাহু গ্রাস করে যে শশীরে,

সেই শশী রাহুর [শিরে]

কোথা গেলে গিরিবর, শিব স্বস্ত্যয়ন কর,

গঙ্গা জল বিল্বদল আনি।

এখানে যশোদা পুত্র কৃষ্ণের প্রতি কোনও অশুভ সংকেত দেখে যেমন বিচলিত হয়ে নানা দেবতার পূজা পাঠের আয়োজন করে পুত্রের কল্যাণ কামনা করেছেন, এখানে মেনকাও উমাকে সাধারণ কন্যা ভেবে তার কল্যান কামনার জন্যে গিরিরাজের কাছে প্রার্থনা জানান। তারপর প্রতিদিনের মত তিনি কন্যাকে প্রভাতে শয্যা থেকে তুলে, -

হিমগিরি সুন্দরী, স্নান করাইয়া গৌরী,

পুনঃ বসাইল সিংহাসনে। :

কবি রামপ্রসাদ বলে এইভাবে জননী মেনকা কন্যাকে নানা সাজে সাজিয়ে নিজেই কন্যার রূপ দেখে অবাক। বকুলের মালা দিয়ে তার কবরী বেঁধে দিলেন, চন্দনের ছোট বিন্দু কপালে দিয়ে তার মধ্যে ছোট একটি সিন্দুরের বিন্দু দেন। গলায় মুক্তার হার। এ রূপ যেন চাঁদকেও হার মানায়। যশোদা যেমন বালক কৃষ্ণকে নানা সাজে সাজিয়ে তার মুখের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে আবার তাকে নাচতে বলেন – তখন বালক মায়ের কথায় নুপূরের রুনুঝুনু শব্দ করে আনন্দে নাচতে আরম্ভ করে। এখানে মেনকাও সেইরকম ভাবে, -

রাণী বলে, আমি সাধে সাজাইলাম, বেশ বানাইলাম,

উমা একবার নাচো গো ।

এরপর সমাজ নীতি মেনে তার বিবাহের তোড়জোড় চলতে লাগল। শেষে নারদের পরামর্শে দেবাদিদেবের সঙ্গেই উমার বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করলেন গিরিরাজ। কিন্তু এই অসমবর্ষীয় বিবাহে বাদ সাধলেন মা মেনকা।
শিব হিমালয়ের প্রাসাদে এসে পৌঁছাতেই মেনকা বেরিয়ে এলেন। বললেন, 'কই, শিব কই? দেখি আমার জামাই কেমন; যাকে পেতে মেয়েটা আমার এমন কঠোর তপস্যা করলে। সে নিশ্চয় পরম সুন্দর।'
তারপর একে একে মেনকা দেখলেন বরুণ, যম, ইন্দ্র, সূর্য, চন্দ্র, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও বৃহস্পতিকে। প্রত্যেকেই পরম সুদর্শন পুরুষ। কিন্তু নারদ মেনকাকে বললেন, এঁরা কেউই শিব নন, শিবের অনুচর মাত্র। শুনে মেনকার আনন্দ আর ধরেনা। এমন সুদর্শন দেবতারা যদি শিবের অনুচর মাত্র হন, তবে শিব নিজে কতনা সুদর্শন। কিন্তু কোথায় শিব? শেষে এলেন শিব। নারদ মেনকাকে বললেন, 'ইনিই শিব।' জামাইয়ের অমন ভীষণ মূর্তি দেখে মেনকা তো মূর্ছা গেলেন।
মূর্ছা যাবেনই বা কেন? ষাঁড়ের পিঠে চড়ে এসেছিলেন শিব। তিনটে চোখ, পাঁচটা মাথা, দশটা হাত, গায়ে মাখা ছাই, কপালে চন্দ্র, পরনে বাঘ ছাল, গলায় খুলির মালা। সঙ্গী ভূত প্রেতেদের যেমন চেহারা, তেমনই ভয়ানক তাদের চিৎকার।
জ্ঞান ফিরতে মেনকা বিলাপ করতে লাগলেন। এমন লোক কে পাত্র নির্বাচনের জন্য তিনি হিমালয়, নারদ ও উমাকে তিরস্কার করতে লাগলেন। ব্রহ্মা, অন্যান্য দেবগণ ও ঋষিরা মেনকাকে শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন।
মেনকা বললেন, 'আমি এমন শিবের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেব না। বরং মেয়েকে বিষ দিয়ে মারব, কুয়োয় ফেলে হত্যা করব, টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবো, সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেবো। আমি আত্মহত্যা করব। কিন্তু উমার বিয়ে আমি অন্য কারোর সঙ্গে দেবো।' উমাও বেঁকে বসলেন। বললেন, 'শিব ছাড়া আমি আর কাউকেই বিয়ে করব না’। বিষ্ণু মেনকাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মেনকা কোনো কথাই শুনলেন না। শেষে নারদ শিবকে মনোহর রূপ ধারণ করার অনুরোধ করলেন। শাশুড়িকে শান্ত করতে শিবকে তাই করতে হল। শিবের শরীর সহস্র সূর্যের প্রভাময় হল, মস্তকে শোভা পেল দিব্য মুকুট, অঙ্গ আবৃত হল বহুমূল্য বস্ত্রে, কণ্ঠের অলংকাররাজি নক্ষত্রদেরও লজ্জা দিতে লাগল। শিবের সেই মনোহর রূপ দেখে সবাই মোহিত হলেন। এমনকি মেনকাও। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য ক্ষমা চাইলেন মেনকা। শিব ও পার্বতীর বিবাহে তাঁর আর কোনো আপত্তি রইলনা। ব্রহ্মার পৌরোহিত্যে শিব ও উমার বিবাহ সম্পন্ন হল।

উমা বছরে মাত্র তিন দিনের জন্য বাপের বাড়িতে আসেন। মেনকার কাছে এই দিনগুলি পরম আনন্দের দিন হয়ে দেখা দেয়। উমার আগমনে বাংলার ঘরে ঘরে, বাংলার আকাশ বাতাস প্রকৃতিতে আনন্দময়ীকে বরণের বার্তা রটে যায়। দৈবী ভাবকে আশ্রয় করে এ এক অনির্বচনীয় মানব রসের উদ্ভাসন। এ এক মহা কব্যিক রস ব্যঞ্জণার আস্বাদ।

যাই হোক, এদিকে মেনকা শুনেছেন, বিয়ের পরে হরের ঘরে উমা দুঃখে আছেন। মেয়ের দুঃখের কথা শুনে অবধি মেনকার রাত্রে ঘুম নেই। দুঃস্বপ্ন দেখেন, -

কুস্বপন দেখেছি গিরি উমা আমার শ্মশান বাসী...

এলোকেশী বিবসনা, উমা আমার শবাসনা,

ঘোরাননা ত্রিনয়না, ভালে শোভে বাল শশী;

ঘুম ভেঙে যায় মেনকার। কন্যাকে দর্শনের জন্য অধীর হয়ে ওঠেন। দুঃস্বপ্নের কথা গিরিরাজকে জানান

আমি কি হেরিলাম নিশি-স্বপনে!
গিরিরাজ, অচেতন কত না ঘুমাও হে!
এই এখনি শিয়রে ছিল,

গৌরী আমার কোথা গেল হে,

আদরের কন্যা স্বপ্নে দেখা দিয়ে আবার হারিয়ে গেলে মায়ের উদ্বেগ কাতরতা আরও বাড়ে। মা জানেন তার আদরের দুলালী কুলীন পাত্র শিবের ঘরে গেছে,– তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এই দুর্ভাবনা থেকেই মেনকা স্বপ্নে দেখেন, -

বাছার নাই সে বরণ, নাই আভরণ,

হেমাঙ্গী হইয়াছে কালীর বরণ,

স্বামীর ঔদাসীন্য দেখে মেনকার অভিমান আরও বৃদ্ধি পায়। সেই আশঙ্কায় তিনি স্বামীকে বলেন, -

কবে যাবে বল গিরিরাজ, গৌরীরে আনিতে ।

ব্যাকুল হৈয়েছে প্রাণ উমারে দেখিতে হে ।।

কৈলাশে উমার অবস্থান করার সময় মেনকা যখন উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন তখনই আকাশে বাতাসে শরৎ ঋতুর আগমনী বার্তা ঘোষিত হয়। তাই শরতের আভাস পাওয়া মাত্রই মেনকা চঞ্চল হয়ে ওঠেন, -

যাও যাও গিরি আন গে উমায়
উমা ছেড়ে আমি কেমন করে রই।'

স্বামী-স্ত্রীর সহযোগিতায় যেমন বাস্তব সংসার জীবন সুখের হয়ে ওঠে, তেমনি উমা ও শিবের সংসার কল্পনার মধ্যেও কবি দেখিয়েছেন তাঁদের পরস্পর নির্ভরশীলতার চিত্র। দেবতাদের উপকার করতে গিয়ে শিব বিষপান করে বিষের স্পর্শে তিনি সে যন্ত্রণা ভুলে যান। তাই শিব গৌরীকে কখনো ছেড়ে থাকতে চান না। এ কথাটি গিরিরাজ ভালোই জানেন, তিনি বললেন-
'বারে বারে কহ রাণী গৌরী আনিবারে
জানতো জামাতা রীত অশেষ প্রকারে।

মেনকার মন মেয়ের জন্য ছটফট করছে। তিনি হিমালয়কে বারেবারে অনুরোধ করছেন, মেয়ে উমাকে কৈলাশ থেকে নিয়ে আসার জন্যে। হিমালয় আজ নয় কাল করে করে মেনকাকে ভুলিয়ে রেখেছেন। স্ত্রীর এই অনুরোধেও গিরিরাজ হিমালয় যখন কন্যা আনার জন্যে তৎপরতা দেখান না, তখন মেনকা গিরিরাজকে অভিযোগ করে বলেন, -

আজি কালি করে দিবস যাবে, প্রাণের উমারে আনিবে কবে?

প্রতিদিন কি হে আমায় ভুলাবে এ কি তব অবিচার?

এদিকে মল মাসের জন্য পঁয়ত্রিশদিন দেরি হয়ে গেছে। মা মেয়েকে বারবার স্বপ্নে দেখেছেন উমা ‘মা মা’ বলে কেঁদেছে মায়ের কাছে আসবেব লে।

যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা কেমন রয়েছে।
আমি শুনেছি শ্রবণে, নারদ-বচনে, মা মা বলে উমা কেন্দেছে॥

এরপর উমা আনার সময় হলে স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে গিরিরাজ হিমালয় উমাকে আনার জন্য কৈলাশে যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করেন। এই সময় মেনকা গিরিরাজকে তার মনের একান্ত আকাঙ্খা জানিয়ে বলেন, -

গিরি ! এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না।

বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনব না৷

শেষ পর্যন্ত মেনকার অনুরোধে গিরিরাজ কন্যাকে আনবার উদ্দেশ্যে কৈলাশে রওনা দিলে মেনকার হৃদয় নানা ভাবনায় ব্যকুল হয়েছে, -

গিরিরাজ গমন করিল হরপুরে ।

হরিষে বিষাদে, প্রমোদ প্রমাদে

ক্ষণে দ্রুত, ক্ষণে চলে ধীরে।

মেনকা গিরিরাজকে বারবার কন্যা আনবার তত্ত্বকথা মনে করিয়ে দেন যাতে করে জামাইয়ের কোনও অসম্মান না হয়, -

শিবকে পূজিবে বিল্বদলে, সচন্দন আর গঙ্গাজলে, ভুলবে ভোলার মন

অমনি সদয় হবেন সদানন্দ, আসিতে দিবেন হারাতারা ধন।

উমা সাধারণত বাঙালি মেয়েদের মত পিতার গৃহে যাবার জন্য স্বামীর অনুমতি প্রার্থনা করেন। তিনদিন পর সে ফিরে আসবেন, পতির কাছে সে কথা জানাতেও ভোলেননা। শিবও সাধারণ স্বামীর মতই উমাকে পিতৃগৃহে যাবার অনুমতি দেন। কবি ঈশ্বর গুপ্ত পদ সৃষ্টি করেছেন শিবের জবানিতে, -

জনক-ভবনে যাবে, ভাবনা কি তার?
আমি তব সঙ্গে যাব, কেন ভাব আর!

উমা এবার গিরিপুরে এলেন। সারা গিরিপুর জুড়ে আনন্দের সাড়া পড়ে গেছে। উমা বরণের আয়োজন চলতে থাকে সাড়ম্বরে, -

মৃদঙ্গ মোহিনী, দুন্দুভি দরপিণী, বাজিছে বিবিধ প্রকার গো গিরি-পুরে।

নগর রমণী, উলু উলু ধ্বনি, আনন্দে দিছে বারেবার॥
নগরবাসী ছুটে চলে নগরদ্বারের দিকে। মেনকাও ছুটে চলেন তাদের সঙ্গে কন্যা বরণের জন্য, -

আমার উমা এলো বলে, রাণী এলোকেশে ধায়।
যত নগর নাগরী, সারি সারি, দৌড়ি, গৌরী পানে চায়।

দু-হাত বাড়িয়ে দেন কন্যার দিকে। তৃষিত মাতৃ হৃদয় শান্ত হতে চায় কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, -

উমা গো যদি দয়া কোরে হিমপুরে এলি, আয় মা করি কোলে।
বর্ষাবধি হারায়ে তোরে, শোকের পাষাণ বক্ষে ধরে, আছি শূন্য ঘরে।

মেয়েকে কোলে বসিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেন মেনকা। মুখ চুম্বনে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। হাজারো প্রশ্নে চকিত করে তোলেন উমাকে,

কেমনে মা ভুলে ছিলি এ দুঃখিনি মায়?

পাষাণ নন্দিনী তুইও কি পাষাণীর প্রায়?

কন্যা পিতৃগৃহে এসেছে। সাধারণ বাঙালি মায়ের মতই মেনকারও জানার ইচ্ছা উমা পতিগৃহে কেমন আছে বা জামাই আছে কেমন?

কেমন করে হরের ঘরে, ছিলি উমা বল মা তাই।
কত লোকে কত বলে, শুনে প্রাণে মরে যাই ৷৷

এবার মেনকার পরিবর্তে উমার মনোবেদনা। মায়ের প্রতি তার অভিমান ফুটে ওঠে, -

তুমি তো মা ছিলে ভুলে, আমি পাগল নিয়ে সারা হই।
হাসে কাঁদে সদাই ভোলা, জানে না মা আমা বই।
ভাং খেয়ে মা সদাই আছে, থাকতে হয় মা কাছে কাছে,
ভাল-মন্দ হয় গো পাছে, সদাই মনে ভাবি ওই॥

সাধারণ বাঙালি ঘরে দেখা যায় বিয়ের পর বাপের বাড়ির প্রতি মেয়ের আকর্ষণ দিন দিন কমে আসে। মেয়ে স্বামীর ঘরে সন্তান ও সংসারের বিভিন্ন কাজকর্মে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে বাপের বাড়িতে সময় অতিবাহিত করার অবকাশ পায় না। তাছাড়া নববধূরসুলভ ভীতিও বাপের বাড়িতে আসার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কয়েক বছর পর দেখা যায় নিজের সংসার ফেলে রেখে বাপের বাড়িতে বেশিদিন থাকতেও চায়না। শ্বশুর বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের জন্য নানা ছলনারও হয়ত আশ্রয় গ্রহণ করে। উমাও তার ব্যতিক্রম নয়, -
এসেছিস্ মা – থাক্ না উমা দিন-কত।
হয়েছিস্ ডাগর-ডোগর, কিসের এখন ভয় এত?

মা-মেয়ের এই মিলন বাস্তবিক স্বর্গীয় সুষমা মন্ডিত। আমাদের প্রতিদিনের ধূলি-ধূসরিত পৃথিবীর দিকে চোখ পাতলে যে চির অমলিন দৃশ্যটি আমাদের মুগ্ধ করে তা এই মিলন বাৎসল্য। তবু বিয়ের পরবর্তীকালে মেয়ের উপর মায়ের আর কোনও জোর থাকে না। বাঙালি মায়ের পক্ষে এই নির্মম করুণ সত্যটি কাব্যে উপস্থিত করার ফলে পদটি জীবন্ত ও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে। গার্হস্থ্য ভাব প্রধান হওয়ার জন্যে মহাদেব, উমা, হিমালয়, মেনকা সব চরিত্রই মানবিক গুণে সমৃদ্ধ। সাধারণ গৃহস্থ ঘরের পত্নী ও কন্যা রূপে মহামায়ার চরিত্রটি অলৌকিকত্ব ও দৈবী মহিমা বিবর্জিত হয়ে একান্ত পরিচিত বস্তু জগতের মানবী হয়ে উঠেছে।

সপ্তমীর প্রভাতে মা-মেয়ের প্রভাত রাগিনী বেজে ওঠে। তারপর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিন দিন হাসি, আনন্দে উচ্ছাসে মা মেয়ের কেটে যায়। “দেখিতে দেখিতে নবমী-নিশীথ আসিয়া পড়িল, এই রজনী প্রভাতেই বিদায় লগ্ন, হিমালয় অন্ধকার করিয়া উমা অন্তর্ধান করিবে। তাই এই রজনীকে বিলম্বিত করিবার জন্য মায়ের সে কি আকুল মিনতি, সকরুণ প্রার্থনা। এখনও গৃহে স্বর্ণদীপের আলো কিন্তু রাত্রি প্রভাতেই সে সব অন্ধকার হইয়া যাইবে…। মাতৃ হৃদয়ের কন্যা বিশ্লেষ জনিত আর্তি পৃথিবীর করুণতম বেদনার স্মারক। শরৎ সপ্তমীর দিনে সমস্ত বঙ্গভূমির ভিখারী-বধূ কন্যা মাতৃগৃহে আগমন করে এবং বিজয়ার দিনে সেই ভিখারী ঘরের অন্নপূর্ণা যখন স্বামী গৃহে যায় তখন সমস্ত বাংলার চোখ যেন অশ্রুপূর্ণ হয়ে ওঠে। শাক্ত কবিরা লিখছেন, -

রজনী, জননী, তুমি পোহায়ো না ধরি পায়,
তুমি না সদয় হ'লে উমা মোরে ছেড়ে যায়।
সপ্তমী অষ্টমী গেল, নিষ্ঠুর নবমী এল,
শঙ্করী যাইবে কাল, ছাড়িয়ে দুখিনী মায়।

ওদিকে মা মেনকার করুণ আর্তি

শুনগো রজনি, করি মিনতি তোমারে।

অচলা হও আজকের তরে, অচলারে দয়া করে।

দেখতে দেখতে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী দিনগুলি পেরিয়ে যায়। নেমে আসে নবমী নিশি। বিচ্ছেদের কাল রাত্রি। রাত পোহালেই উমা বিদায় নেবেন। নবমীর রাত থেকেই বাদ্যির সুরটা বেসুরো বাজছিল। ঢাকের আওয়াজ যেন বিলাপ করছিল, “ওগো নবমীর নিশি আর পোহাইয়ো না”।

ওরে নবমী নিশি! না হৈও রে অবসান।
শুনিছে দারুণ তুমি, না রাখ সতের মান॥

সকাল হলেই যে গিরিরাজ প্রাসাদ শূন্য করে দিয়ে আবার কৈলাশে ফিরে যাবে উমা। আবার আসবে এক বছর পর। চারদিন গিরি রাজপ্রাসাদ আলো করে এসেছিল শিবের ঘরনী উমা, পার্বতী। এই চারটে দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকে মা মেনকা। নবমীর বিকেল থেকেই বুকের ভিতরটা থেকে থেকে কেমন যেন ডুকরে উঠছিল মেনকার। মেয়েকে বিদায় দেওয়ার লগ্ন যেন আর একটু পিছিয়ে যায়, কর জোড়ে দেবী উষার কাছে প্রার্থনা করছিল মা মেনকা।

কিন্তু সব আশার, সব কামনার সমাপ্তি ঘটিয়ে দশমী প্রভাতের আবির্ভাব হয়- মেনকাকেও বাস্তব সত্য মেনে নিতে হয়। দশমী প্রভাতে মা মেনকার মনোবেদনা ব্যক্ত হয়েছে নিম্নলিখিত পদে যেখানে মেনকার মাতৃরূপ বিকশিত, দৈব ভাবনার বিন্দুমাত্র প্রকাশ নেই,-

কি হল নবমী নিশি হইল অবসান গো।
বিশাল ডমরু ঘনঘন বাজে ধ্বনি বিদরে প্রাণ গো।

তা সত্বেও সখী বিজয়া কে মেনকা বলে দেন যে, সে যেন হর কে বলে দেয় যে উমাকে পাঠানো যাবে না,-

জয়া বল গো! পাঠান হবে না,
হর মায়ের বেদন কেমন জানে না॥
তুমি যত বল আর, করি অঙ্গীকার, ও কথা আমারে বোলো না॥

মেনকার এই প্রার্থনা বিফলে যায়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে নবমীর নিশি অবসান ঘটে এবং বিজয়া এসে হাজির হয়। বিজয়ার সাথে কৈলাশ থেকে শিব ডমরু বাজিয়ে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে শ্বশুর বাড়ি হিমালয়ে এসে উপস্থিত হন। এতে মেনকার বুক আরও ফেটে যায়। শেষ পর্যন্ত মেনকা তাঁর কন্যাকে আটকে রাখতে পারেন না, শিব উমাকে নিয়ে কৈলাশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এই সময় মেনকা গিরিরাজকে তাঁর দুঃখ জানিয়ে বলেন,-

আমার গৌরিরে লয়ে যায় হর আসিয়ে
কী করি হে গিরিবর রঙ্গ দেখ বসিয়ে?

তবুও উমাকে বিদায় দিতে হয়। পথ ছেড়ে দাঁড়াতে হয় কন্যার। শেষবারের মত কন্যা মুখ দর্শন করতে চান, উমাকে পথের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেন মেনকা, -

ফিরে চাও, গো উমা! তোমার বিধু মুখ হেরি।
অভাগিনী মায়েরে বধিয়ে, কোথা যাও, গো!॥

কন্যার কাছে আবার আসবার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন, -

এসো মা এসো মা উমা বলো না আর যাই যাই

মায়ের কাছে হৈমন্তী ও কথা মা বলতে নাই

এ যেন বাঙালি মাতার কন্যা বিচ্ছেদ বেদনাকেই ধ্বনিত করে। মা মেনকা চোখের জলে বিদায় দান কালে অনুরোধ করেন, -

বৎসরান্তে আসিস্ আবার, ভুলিস না মায়, ও মা আমার

চন্দ্রাননে যেন আবার মধুর মা বোল শুনতে পাই

উমা চলে যান। মেনকা ঘরে ফিরে আসেন। ঘরের অন্ধকার আজ তার কাছে বেশি জমাট জমাট লাগে, -

রতন ভবন মোর আজি হৈল অন্ধকার,
ইথে কি রহিবে দেহে এ ছার জীবন।

এই দেবী দুর্গাই যে শিবের স্ত্রী উমা একথা নিশ্চিত ভাবে বলা না গেলেও, লৌকিক ও পৌরাণিক আখ্যান মিশে গিয়ে সত্যি সত্যি দুর্গা বা শিব-পার্বতী, এঁরা সকলেই প্রতি বছর শরতের শিউলি তলায় – আম-কাঁঠালের ঘেরা পানা পুকুরের ঘাটে নেমে আসেন আর অখিল বিমানে ধ্বনিত হয় মর্তের আনন্দ বাণী। যেখানে ভক্তির সাথে মিশে যায় লৌকিক আবেগ আর বাৎসল্য-প্রতি বাৎসল্যের অনুভূতিতে দেবী হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে।

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait