অনামিকার ডাইরি (তৃতীয় পর্ব) - স্নেহের স্পর্শ

অনামিকার ডাইরি (তৃতীয় পর্ব) - স্নেহের স্পর্শ

“প্রায় দশ মিনিট হলো পেন নিয়ে বসে আছি, কি লিখবো কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছি না। আসলে যে কোন লেখারই কয়েকটা ব্যাকরণ থাকা বাঞ্ছনীয়, যেমন তার ভাষা, প্রেক্ষাপট, গ্রন্থনা, যা পাঠককে আপ্লুত করে তুলবে, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অন্য এক ভাবের জগতে। পেনের কালি মনের সাদা খাতায় আঁচড়  কেটে যাবে একের পর এক , সেই আঁচড়গুলো ক্রমশ সম্মিলিত হয়ে গড়ে উঠবে ছবি, তৈরি হবে মনের চিত্রনাট্য।  কিন্তু আজ  লেখকের  মন যেন হিজিবিজি কোলাজ। অনেকটা এবস্ট্রাক্ট  ছবির মতন,  বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট ঘটনা চোখের সামনে দিয়ে ভীষণ দ্রুত রেলগাড়ি চেপে চলে যাচ্ছে,  নিমেষের মধ্যে দৃশ্যগুলো আবছা আবেগের মতন দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে বারবার। কোনটাই যেন ধরতে পারছিনা। তাই ভাবছি আজ বলবো কিছু আবছা স্মৃতির কথা।

ADVERTISEMENT

 ছেলেবেলার একটা দশ বাই দশ এর ঘর ছিল আমার আকাশ। লক্ষ লক্ষ তারা সেখানে স্বপ্ন হয়ে আমার চোখে ঝিলিক লাগাতো। দিনের বেলা সূর্য হয়ে বিচরণ করে বেড়াতাম আকাশময়। রাতের বেলা ক্লান্ত সূর্য ঢেকে  যেত আকাশের আঁচলে। ঘুমিয়ে পড়তাম নিশ্চিন্তে,  লক্ষ তাদের মাঝে।  ঝলমলে স্বপ্নের বৃষ্টিতে পাড়ি দিয়ে, একটুখানি বড় হয়ে যেতাম পরেরদিন।

 মনে আছে ছোটবেলায় রাতে যখন আলগা ঘুমে আমি স্বপ্নময়, তখন একটা হাত পরম স্নেহে মাঝেমাঝে একটা আবছা আস্তরণ হয়ে বয়ে যেত আমার মাথার ওপর দিয়ে,  আমার ললাট স্পর্শ করে।  ভীষণ শ্লথগতির একটি ক্লান্ত নদীর শেষ জলধারার  মতন, যেন তার সমস্ত পলি  প্রাণপণে জমা করে উর্বর  করে চলছে নতুন একটি ভূমি,  প্রতিনিয়ত।  গভীর ঘুমের মধ্যেও তা অনুভব করেছি অনেকদিন, ভীষণভাবে। সে তো কেবল ঘুমন্ত বালিকার ললাট স্পর্শ নয়,  তার গ্রন্থনা ছিল দুইটি হৃদপিন্ডের একতারে বাধা সুতোয়। 

এরপর যখশুরুথ সবেমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় যেতে শুরু করলাম, মানে প্রথম শ্রেণী, তখন টান পড়লো সেই সুতোয়। বাবার কাছে বার্তা এলো,   সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার। ভালো কর্মযোগ তো শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, তার সাথে মিশে থাকে অনেক স্বপ্ন, ইচ্ছাপূরণ, আর এক কামরার সংসার ডিঙিয়ে দুই কামরার আকাশ।

 অগত্যা আমাকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রেখে, বাবা পাড়ি দিল বিলাতে। আমার চোখে তা ছিল সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারের দেশ। ওই যেখানে নানা অভিযানে যায়  সিন্দাবাদ, আর ক্রিস্টোফার কলম্বাস।

 ফোন তখনও পৃথিবীর সংযোগ ব্যবস্থা কে কিনে নেয় নি, তাই চিঠিই  ছিল আমার ভরসা। প্রতিমাসে বাবার একটি করে চিঠি আসতো,  উপরে লেখা থাকতো, "সোনা মা" আর তারপরে কতইনা গল্পে ভরা চিঠি কেমন সুন্দর করে লিখত বাবা, ঠিক যেনো মনে হতো শিশুসাহিত্য।  আর আমিও তার উত্তর দিতাম গোটা গোটা হাতের লেখায়, সব তারাদের স্বপ্ন লিখতাম  সেই চিঠির পাতায়। সন্ধ্যেবেলায় বাবার গলা আসত ইথার  তরঙ্গে ভেসে,  রেডিও চালিয়ে শুনতাম। গর্বের প্রজাপতিরা  ডানা মেলে উড়ে বেড়াতো মনের আনাচে কানাচে। বাবা মনে কত মন পাথরের বোঝার বোঝা চাপিয়ে তখন সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল, এখন বুঝতে পারি নিজের কন্যার চোখ দুটির দিকে  তাকিয়ে।

সুতরাং যা হবার তাই হল, পড়ল, সেই সুতোর টানের  বেদনা এবার অন্তর ছাপিয়ে তার রাজ্য বিস্তার করেছিল শরীরে, বাবাকে ফিরতে হলো মাঝপথেই শুধু আমার জন্য। এত বড় মহাবিশ্বের, আর কেউ কোনদিন আমার মতন অতি সামান্য ব্যক্তি বিশেষের জন্য এত ভীষণ টান অনুভব করবে, সে সারা পৃথিবীর এত সৌন্দর্য উপেক্ষা করে, শুধু আমাকে দেখার জন্য ছুটে আসবে সাত সমুদ্র পেরিয়ে, এতো  তো শুধু গল্পের নায়িকার জন্যই ধার্য।

এরপর সেই নিশ্চিন্ত কোলে মাথা রেখে সিন্দাবাদ,  হাতিম তাই, আরব্যরজনী, রাজা-রানী আর ইতিহাসের গল্প শুনতে শুনতে শেষ হলো আমার মেয়েবেলা। যেদিন আমি রাজকন্যা, সেদিন বাবা পরেছিল, কড়কড়ে  তসরের পাঞ্জাবি। নতুন বরের  মতন। আমার দেওয়া পাঞ্জাবিতে বাবাকে সেদিন সবার থেকে সেরা লাগছিল।

স্বপ্নের হাতছানিতে সাড়া দিতে সেদিনও  আবার টান পড়েছিল আমাদের অন্তরে সেই সুতোতে। তার  বেদনা ঝরে পড়েছিল, বৃষ্টির ধারার মতন। জানিনা ঠিক কতদিন। ক্লান্ত শরীরে সেদিন গিয়েছিলাম আমার এক কামরার আকাশে।  রাগুলো সেদিনও  ছিল আকাশ ভরে।   অনেকগুলি তো ছিল আমার মুষ্ঠিগত। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ পেলাম আবার সেই স্পর্শ। আমার মাথায় পরম স্নেহে একটি হাত খেলা করছে, চোখ খুলতে যখন সম্বিত ফিরে পেলাম, আবছা আলোয় পাশে দেখেছিলাম আমার জীবনের নতুন মানুষটিকে। কিন্তু তক্ষুনি মনে হয়েছিল ছুটে চলে যাই বাবার কোলে,  কুঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়ি আলিঙ্গনের মধ্যে, আবার ফিরে যাই ছেলেবেলায়। নতুন করে শুরু করি শৈশব। চোখ ভরা  স্বপ্নে আবার হারিয়ে যাই তারাদের দেশে।

মনে হয়েছিল, তুমি বেশ রবি হয়েও, আমি বেশ হই কাদম্বরী,  তোমার “ভগ্নহৃদয়”, তুমি লিখবে শুধু আমারই জন্য। আমি “রতন” হয়ে ঘুরে বেড়াবো তোমার বাড়ির আনাচে কানাচে, “পোস্টমাস্টার” হয়ে আমায় নতুন করে পড়িয়ে দিও বাংলা। আমি এখনো দাঁড়িয়ে জানলার ধারে “অমল” হয়ে, অপেক্ষায় আছি সেই দইওয়ালার। তুমি দইওয়ালা হয়ে স্বপ্ন বিক্রি করতে এসো আমার কাছে - বারবার এস,  চিরকাল এস”।

 আমার জীবনের কিছু অমূল্য স্মৃতির মালা গাঁথলাম। আজ তবে এখানেই থামি,  ভালো থেকো স্মৃতিরা আবার আসবো।”

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait