তরুণ এক সন্ন্যাসী ভারতবর্ষের শেষ শিলাখন্ডে বসে ধ্যানে মগ্ন ছিলেন, মহাদেবের মতোই। হঠাৎ উত্তাল সমুদ্রের মাঝে যেন তাঁর গুরুকে দেখতে পেলেন, তিনি হাতছানি দিয়ে শিষ্যকে ডাকছেন। বুঝলেন গুরু তাঁকে সংকেত দিচ্ছেন কিছুর। গুরুমা কে চিঠি লিখলেন, জগজ্জননী আদেশ দিলেন গুরুর কথা মান্য করার, সন্ন্যাসীর বিশ্বাস হলো মা যখন আদেশ দিয়েছেন, তখন জয়ী তিনি হবেনই হবেন। প্রস্তুতি শুরু হলো আমেরিকা যাওয়ার।
9/11, হ্যাঁ আজকের তারিখ। না, আমেরিকা মহাদেশে কোনো সন্ত্রাসবাদী বিস্ফোরণ নিয়ে লিখতে বসিনি। আজকের দিনে ওই আমেরিকাতেই মানবসভ্যতার যে গৌরবোজ্বল ইতিহাস লিখিত হয়েছিল, সেই ইতিহাসের অবতারণা করতে চাইছি।
এক সাধারণ যুবা, গেরুয়া পরিহিত, এসেছেন ভারতবর্ষ থেকে। শিকাগো শহরের বিষম ঠান্ডায় তিনি কাঁপছেন, গরম জামা নেই তেমন ভালো। আগের রাতে কাঠের বাক্সে রাত্রি যাপন করতে হয়েছে তাঁকে, অখ্যাত ব্যক্তিকে কেউ আশ্রয় দেয়নি। শিকাগো শহরে যখন তাঁর সঞ্চয় ফুরিয়ে আসছে, ঠিক করলেন বোস্টন শহরে যাবেন, পথে এক দয়ালু ভদ্রমহিলা, মিসেস স্যানবর্ণের সাথে আলাপ, তাঁর খামারবাড়িতে অতঃপর কয়েকদিন যাপন। স্যানবর্ন স্বামীজিকে শিকাগো ধর্মমহাসভায় যোগদান করতে বললেন, ঠিকানা দিলেন যোগাযোগ করার।
ADVERTISEMENT
কিন্তু এমনই ভাগ্য(নাকি ঠাকুরের উপর্যুপরি পরীক্ষা?), শিকাগো শহরে গিয়ে ঠিকানা ফেললেন হারিয়ে। যখন ধর্মমহাসভায় এলেন তখন নাম দেওয়ার শেষ দিন গেছে পেরিয়ে। এমতাবস্থায় অধ্যাপক রাইট এর সাথে দেখা, তিনি স্বামীজীর সংস্পর্শে এসে বললেন, "আমেরিকা মহাদেশে সমস্ত পন্ডিতদের মিলিত জ্ঞানের থেকেও স্বামীজির জ্ঞান অনেক বেশি, তাঁর কাছ থেকে পরিচয়পত্র চাওয়ার অর্থ সূর্যকে জিজ্ঞাসা করা যে তাঁর আলো দেওয়ার অধিকার আছে কিনা!"
আর কোনো বাধা রইলো না, নির্দিষ্ট দিনে পূর্বাহ্নে স্বামীজিকে ডাকা হলোনা বক্তৃতা দেওয়ার জন্য, অপরাহ্নে হঠাৎ তাঁর নাম ডাকা হলো। তিনি ঠাকুর ও শ্রীমাকে স্মরণ করে মঞ্চে উঠলেন। বজ্রসম কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, "আমেরিকাবাসী আমার ভগ্নি ও ভ্রাতাগণ...." এটুকু শুনেই সমবেত জনতার হাততালি চলল মিনিট সাতেক। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, মিনিট সাতেক। ঐদিনের অতীব যুগান্তকারী ভাষণে স্বামীজী হিন্দুধর্মের জয়ধ্বজা তো উত্তোলন করলেন, হিন্দু ধর্ম যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম, সেই স্বীকৃতিও পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করলেন। ঘোষিত হলো অমর বাণী, "বিবাদ নয়, সহায়তা। বিনাশ নয়, পারস্পরিক ভাবগ্রহণ। মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।" ঠাকুরের সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ গোটা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হলো।
সেইদিন আমেরিকার মাটিতে যে আধ্যাত্মিক বিস্ফোরণ হয়েছিল, তার জোয়ার গোটা পৃথিবীতে এক শুভ আলোক বহন করে নিয়ে এলো। তরুণ সন্ন্যাসীর ত্যাগের আদর্শ মানবসভ্যতার ভীত ধরে নাড়িয়ে দিলো।
জন্ম হলো স্বামী বিবেকানন্দের। বিবেক উন্মোচিত করেন যিনি, তিনিই তো বিবেকানন্দ। আজ, মানবসভ্যতার এই তুরীয় উত্তরণের দিনে, যুগনায়ককে সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই।
জয় ঠাকুর।
0 comments