নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই কি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী?

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই কি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী?

একদিন আগে পরে ভারত পাকিস্তান নিজেদের স্বাধীনতা দিবস পালন করে আসছে। পাকিস্তানে ১৪ আগস্ট, আর ভারতে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। অথচ ভারত স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী একটিই দিন থাকার কথা ছিল। কেন ১৫ আগস্টই হলো সেই বিশেষ দিন? দিনটি নির্বাচনে আছে নানা কাহিনী। আর কাহিনীর অন্যতম নায়ক ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন।

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট  লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিবিদ সি রাজাগোপালাচারি লেখেন, যদি ১৯৪৮ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়, তবে হস্তান্তরের জন্য কোনও ক্ষমতাই থাকবে না। আর মাউন্টব্যাটেন সময়কে এগিয়ে নিয়ে আসেন ১৯৪৭ সালের আগস্টের দিকে।

সময়টা এগিয়ে আনার ক্ষেত্রে মাউন্টব্যাটেনের যুক্তি ছিল তিনি দাঙ্গা বা রক্তপাত হতে দেবেন না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ পাস হয়। ওই আইনে ১৫ আগস্টকেই ধরা হয় ব্রিটিশ ভারতের শেষ দিন। পরে একসময় মাউন্টব্যাটেন বলেন, ‘আমিই পুরো প্রক্রিয়ার অন্যতম এক ব্যক্তিত্ব। এটা দেখাতে চেয়েছিলাম আমি। যখন তাঁরা বললেন, আমরা দিনটি ঠিক করেছি কি না, আমি জানতাম দ্রুত কিছু করতে হবে। নির্দিষ্ট দিন মাথায় ছিল না। তবে ভাবনায় ছিল আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের কোনও একটা দিন। পরে ঠিক করলাম, ১৫ আগস্ট। কেন? এদিন জাপানের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বার্ষিকী পালিত হবে।’ অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জহরলাল নেহরু

কিন্তু তার বেশ কয়েক বছর আগে স্বাধীন সরকার গড়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু৷ ১৯৪৩-এর ২১ অক্টোবরসিঙ্গাপুরে প্রথম ‘স্বাধীন’ ভারতীয় সরকার গড়েছিলেন৷ সেই আজাদ হিন্দ সরকারের মন্ত্রীসভার শীর্ষে ছিলেন স্বয়ং নেতাজি৷

কদম কদম বাড়ায়ে যা,

খুশিকে গীত গায়ে যা!

ইয়ে জিন্দেগী হে কৌম কি,

তু কৌম পে লুটায়ে যা!!

তু শের হিন্দ আগে বাড়,

মত সে কভি না ডর!

উড়া কে দুশমনোকা সর,

জোস বাতান বাড়ায়ে যা!

হ্যাঁ। এই সঙ্গীতটির সাথে জড়িয়ে আছে ভারতের প্রথম স্বাধীন সরকারের স্মৃতি।

১৯৪১-এর ১৬ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের চোখে ধুলো দিয়ে ছদ্মবেশে পালিয়েছিলেন৷ নানা জায়গা ঘুরে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, ইতালীয় দূতাবাসের সহায়তায় তিনি রাশিয়া হয়ে জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছান৷ গঠন করেন যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে এক বাহিনী, যারা ইন্ডিয়ান রিজিয়নের সদস্য হলেন৷ কিন্তু ভৌগোলিকভাবে অত দূর থেকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত থাকা যে বেশ কঠিন! এটা উপলব্ধি করে নেতাজি পূর্ব-এশিয়ায় চলে আসতে চান৷ রাসবিহারী বসু তখন জাপানে৷ সাবমেরিন করে জাপানে পৌঁছালে রাসবিহারী বসু নেতাজির হাতে তুলে দেন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর ভার৷
 


জাপান সরকার সর্বতোভাবেই এই স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতকে সাহায্য করে ব্রিটিশ-শাসনমুক্ত করতে প্রস্তুত ছিল৷ কিন্তু একইসঙ্গে তারা বাহিনীকে রাখতে চেয়েছিল আজ্ঞাধীন৷ সুভাষচন্দ্র জাপান কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, শুধুমাত্র মিলিটারি কার্যক্রম ভারতের স্বাধীনতার জন্য পর্যাপ্ত নয়৷ চাই আলাদা প্রচার কার্যক্রম৷ এজন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, একটি স্বাধীন সরকারের প্রতিষ্ঠা– যাকে ‘অক্ষশক্তি’ প্রয়োজনীয় স্বীকৃতি প্রদান করবে৷ নেতাজি পূর্ণ উদ্যমে নতুন স্বাধীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নিলেন৷

১৯৪৩-এর ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে প্রতিষ্ঠিত হয় তথাকথিত প্রথম ‘স্বাধীন’ ভারতীয় সরকার: ‘Provisional Government of Free India’৷ গঠিত হয় পূর্ণ মন্ত্রিসভা৷ আর রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে প্রথমেই শপথ নেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ নিজের হাতে রাখেন পররাষ্ট্র যুদ্ধবিষয়ক দফতর৷ অর্থমন্ত্রী এ. সি. চট্টোপাধ্যায়, নারীবিষয়ক মন্ত্রী লক্ষ্মী সেহগল, প্রচার প্রোপাগান্ডা দফতরের প্রধান এস. এ. আইয়ার৷ এ. এন. সরকার-সহ আরও ১৫ জন ছিলেন মন্ত্রিসভায়৷ রাসবিহারী বসু মনোনীত হন এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা৷

সে রাতেই প্রধানমন্ত্রী সুভাষচন্দ্রের বাসভবনে মন্ত্রীসভার পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে অবিলম্বে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে৷ রাত বারোটার পর সিঙ্গাপুর রেডিও মারফত প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন৷

একবছর দশ মাস এই স্বাধীন সরকার দেশ শাসন করেছিল৷ আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের মূল ভূখণ্ডের পূর্ব সীমান্ত ছিল এই সরকারের শাসনাধীন৷ কিন্তু ১৯৪৫-এর আগস্ট আমেরিকা অ্যাটম বোম নিক্ষেপ করায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় জাপান এবং প্রধান সাহায্যকারীর অনুপস্থিতিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিকল্পিত পথে পূর্ণতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়৷

কিন্তু ২১ অক্টোবর ১৯৪৩-এ যে অন্তর্বর্তীকালীন ‘স্বাধীন’ ভারত সরকার স্থাপিত হয়েছিল তাকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল ইউরোপ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ৷ ক্রোয়েশিয়া, আয়ারল্যান্ড, ইটালি, জার্মানি, জাপান, ফিলিপাইন্স, মায়ানমার, তাইল্যান্ড, মাঞ্চুকুয়ো (চিন)- সহ ১০টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করে প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষের নেতৃত্বে এই সরকার প্রকাশ করেছিল ডাকটিকিট৷ চালু রেখেছিল নিজস্ব ডাকব্যবস্থা, কারেন্সি নোট৷ স্থাপিত হয়েছিল আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক)৷ এই সরকারে জন্য একটি জাতীয় সংগীত হয়েছিল – ‘শুভ সুখ চৈন কী বরখা বরষে ভারত ভাগ হৈ জাগা……’৷ এই গানটি স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন ডঃ অম্বিক মজুমদার, সংগীতের স্বরগ্রামটি তৈরি করেছিলেন ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুর এবং প্রথমে গানটি পিয়নতে বাজিয়ে নেতাজিকে শোনানো হয়েছিল।

আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শন করে নেতাজি দু’টি জায়গার নাম বদলে রেখেছিলেন ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ দ্বীপ’৷ নিয়োগ করেছিলেন প্রশাসক৷ এই সরকার বিদেশে দূতাবাসও স্থাপন করে৷ ‘প্রধানমন্ত্রী’ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর এই কথা বর্তমান প্রজন্ম কেন সেভাবে জানে না, তা এক বিস্ময়! ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ নামে একখানা আত্মজীবনী লিখছিলেন তিনি। সেটি অসমাপ্ত থেকে যায়। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘তরুণের স্বপ্ন’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে 'দেশনায়ক' আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন- "স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।"

নেতাজির জন্মদিন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা তার নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তার নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়।

তবুও প্রশ্ন উঠছে, অখণ্ড ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতাজিকে স্বীকৃতি দেওয়া কি সম্ভব?

তিনি শহিদ স্বরাজ দ্বীপ বা আন্দামান নিকোবর এবং ইম্ফলে জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন৷ তাঁর সরকার ১৯৪৩ সালে গঠিত হয়েছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি, জাপান-সহ ১১টি দেশ তাকে স্বীকৃতিও দিয়েছিল৷ নেতাজির স্বীকৃতির ক্ষেত্রে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এই ১১টি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সহযোগিতা সম্মতি চাইতে হতে পারে প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারকে৷ এখানে একটি মহলের আবার মত হল, নেতাজি নন, অখণ্ড ভারতের প্রথম সরকার গঠন হয়েছিল ডিসেম্বর, ১৯১৫-য়, কাবুলে। হুকুমত-ই-মোক্তার-ই-হিন্দ নামে সেই সরকার গঠন করেছিলেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ এবং মৌলানা বরকতউল্লাহ।

কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগ নিয়ে নেতাজির নাতি এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্ডিনার অধ্যাপক সুগত বসু বলছেন, 'এই সিদ্ধান্ত যদি নেওয়া হয়, তা হলে তা খুবই সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত হবে। নেতাজিকে যদি সত্যি মর্যাদা দিতে হয়, তা হলে শুধু তাঁর স্মৃতিতে দিবস উদ্যাপন করলেই হবে না, তাঁর মতাদর্শ গ্রহণ করে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ঐক্যসাধন করতে হবে।' নেতাজির আর এক নাতি চন্দ্রকুমার বসুর বক্তব্য, 'গত বছর আজাদ হিন্দ দিবস পালনের উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসে প্রধানমন্ত্রী নিজেই জানিয়েছিলেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর তত্ত্বাবধানে গঠিত অখণ্ড ভারতের প্রথম স্বাধীন সরকারের উদ্যাপন যাতে প্রতি বছরই সারা দেশে পালিত হয়, তার জন্য উদ্যোগী হবেন তিনি৷ সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য উনি কাজ শুরু করেছেন, এটা দারুণ বিষয়৷ ক্ষেত্রে সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রয়োজন৷ আমার আশা, কেন্দ্রীয় সরকার খুব দ্রুত এই বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে৷' নেতাজি গবেষক জয়ন্ত চৌধুরীর কথায়, 'প্রধানমন্ত্রী নিজে পুরো বিষয়টিতে আগ্রহী হয়েছেন, এটা খুব ভালো বিষয়৷ দেশের জনগণ আজাদ হিন্দ বাহিনীর পুরো ইতিহাস জানতে পারলে আখেরে উপকৃত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম৷ একইসঙ্গে দেশের গৌরবোজ্জ্বল এই অধ্যায় সম্পর্কে উৎসাহী হবে পুরো বিশ্ব৷' ‘দেশপ্রেম দিবস’ হিসাবে পালনের যে দাবি ফরওয়ার্ড ব্লক দীর্ঘদিন যাবৎ জানিয়ে আসছে, সেটিকেও এবার সম্মান জানানো যেতে পারে। অতএব এই বিরাট মাপের ঘটনার কথা মনে রেখে এখনই স্বীকৃতি দেওয়া কর্তব্য যে, আর কেউ নন, স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই হলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তবে, এই সাহস কবে কার হবে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। কারণ, সিদ্ধান্তটি এতই বিতর্কিত যে তখন ১৫ আগস্ট কী নামে আখ্যায়িত হবে, উঠবে সেই প্রশ্নও। স্বাধীনতার বয়সটাও ঘোষণা করতে হবে নতুন করে। কারণ, একটি দেশে একইকালে দুটি স্বাধীনতা দিবস থাকবে কী করে? তখন কি বলা হবে—১৯৪৭ নিছকই ক্ষমতা হস্তান্তর বা ভারতভাগের এক মর্মান্তিক বছর? এই চরম সত্যটি মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে কি ভারতের আজকের রাজনীতি? 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait