সে এক অবাক করা গল্প, দেশ একটা সুসন্তান পেয়েছিল। ডাক নামে আদর করে মা ডাকতেন সুবি। যেমন মেধাবী, তেমন সুদর্শন, আর তেজ যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে দুই চোখ দিয়ে। পিতা যথেষ্ঠ স্বচ্ছল, চেয়েছিলেন ছেলে ইংরেজ আদবকায়দায় মানুষ হোক। কিন্তু সে ছেলে কটক এর স্কুল এ ভর্তি হয়ে জেদ ধরলো ধুতি পরে স্কুলে যাবে। বাবা তো রেগে আগুন। কিন্তু ঐটুকু ছেলের জেদের কাছে হার মানলেন। এরপর আরো কতবার যে তার কাছে হারতে হবে!
সে ছেলের বই পড়ার খুব নেশা। একবার সে এক শিক্ষক মশাই এর থেকে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর জীবনী চাইতে গেলো, কিন্তু শিক্ষক তাকে বললেন রামকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দ সাহিত্য পড়তে। আর একজনের লেখাও পড়তে বললেন, রবীন্দ্রনাথ! কেনোনা আগে দেশ কে তো জানতে হবে! ব্যাস! এসব পড়তে পড়তে তার মনে আগুন একটু একটু করে জ্বলে উঠতে শুরু করলো। ঐটুকু ছেলে বীর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির প্রতিবাদে স্কুলে অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে অরন্ধন পালন করলো। ব্রিটিশ পুলিশের চোখরাঙানি অগ্রাহ্য করে। প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাস বাধা তো দিলেনই না, বরং খুশি হলেন। সুবির বয়স তখন এগারো।
ADVERTISEMENT
এরপর তো কলকাতায় চলে আসবে সে ছেলে, প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হবে, ভারতবিরোধী ইংরেজ শিক্ষক কে জুতোপেটা করবে, কলেজ থেকে বহিস্কৃত হবে, বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ তাকে স্কটিস চার্চ কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবেন। সে তারপর বিলেত গিয়ে আই সি এস পরীক্ষায় চতুর্থ হয়ে ইংরেজ সরকারের দেওয়া চাকরি প্রত্যাখ্যান করবে। দেশ সেবায় নিয়োজিত করবে নিজেকে। আর তার সব সিদ্ধান্ত এবং জেদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হবেন বাবা, দেশ, তামাম বিশ্ব।
সে ছেলেকে ব্রিটিশ পুলিশ গৃহবন্দী করবে, সে ছেলে পাঁচিল টপকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালাবে অন্য দেশে। মাসখানেক সবাই জানবে বাড়ির বন্ধ দরজার আড়ালে সে ছেলে মৌনব্রত পালন করছে। এরপর কাবুল, কান্দাহার, রাশিয়া, গোটা পৃথিবী তোলপাড় করে সর্বত্র পুলিশের চোখে ধুলো দিতে দিতে সে ছেলে একদিন জার্মানি থেকে ঘোষণা করবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের। সে ছেলেকে ফিউরার হিটলার ও সমঝে চলবেন। কেনোনা তামাম বিশ্বে ওই একটি ছেলেই হিটলারের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছিলো। এরপর সে ছেলে আজাদী সৈনিকদের নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে শহীদ আর স্বরাজ দ্বীপে স্বাধীনতার পতাকা ওড়াবে। ততদিনে বৃটিশের ঘুম উড়ে গেছে।
এরপর? এরপর থাক! ওই প্লেন ক্র্যাশ, ওই রাশিয়ার জেলে বন্দী, ওই গুমনামি বাবা সব থাক পিছনে পরে। অতটা স্থবির করে দেওয়া তত্ত্ব সুভাষচন্দ্রের সম্পর্কে মানায় না। এই ছেলের সম্পর্কেই বলা যায় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে উদ্ধৃত করে, "তুমি তো দেশের জন্য সমস্ত দিয়েছো, তাই তো দেশের খেয়া-তরী তোমাকে বহন করিতে পারে না, দুর্গম পাহাড় পর্বত তোমাকে ডিঙ্গাইয়া চলিতে হয়.....কারাগার তো শুধু তোমাকে স্মরণ করিয়াই নির্মিত হইয়াছিল সেই তো তোমার গৌরব! মুক্তিপথের অগ্রদূত! পরাধীন দেশের হে রাজবিদ্রোহী! তোমাকে শতকোটি নমস্কার!"
বেঁচে থাকুন সুভাষ আমাদের রক্তে। অমরত্বের আর এক নাম সুভাষ!
0 comments