ছোটগল্প - ছায়াসঙ্গী

ছোটগল্প - ছায়াসঙ্গী

 

যেমনটি ভেবেছিলাম ঠিক তেমনটি হলো। অনেক কষ্ট করে একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেলো। এবার ঠিক সময়ে হাওড়া স্টেশন এ পৌঁছে যেতে পারলেই হলো। রাতের শেষ ট্রেন টা ধরতেই হবে, নাহলে সারারাত বড় ঘড়ির নিচে শুয়ে থাকা ছাড়া আমার আর গতি নেই। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই উঠে পড়লাম গাড়িতে। " দাদা একটু তাড়াতাড়ি চালাবেন, নাহলে ট্রেন টা মিস করবো"!! গাড়ির চালক অভয় দিলেন, বললেন " কোনো অসুবিধে নেই দাদা, আপনাকে ঠিক সময়ে পৌঁছে দেবো"। একটু স্বস্তি ফিরতেই মা কে একটা ফোন করে জানিয়ে দিলাম এয়ার পোর্ট থেকে বেরিয়ে পড়েছি। মা বললেন সাবধানে আসতে। খুব ঝড় উঠেছে আর বৃষ্টিও হচ্ছে।​

ড্রাইভার দাদা কথামত ঠিক সময়ে পৌঁছে দিলেন হাওড়া স্টেশন এ। আমি রীতিমত উসেন বোল্ট এর গতিতে উড়ে এসে পড়লাম টিকিট কাউন্টার এ। শেষ ট্রেন টা এখনও ছাড়েনি। টিকিট কেটে সমান গতিতে চলে এলাম 1 নম্বর প্ল্যাটফর্ম এ। গাড়ি তখন ছাড়বো ছাড়বো করছে। আমিও যথারীতি আমার পুরোনো পারফরম্যান্স এ দৌড়ে চলে এলাম একদম সামনের বগির কাছে। উঠে পড়লাম ট্রেন এ। এবার আর কোনো চিন্তা নেই। অবশেষে ৭ বছর পরে বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরতে পারবে। গন্তব্য, হুগলী জেলার দেবানন্দ পুর, আমার গ্রামের বাড়ি।​

কর্মসূত্রে আমি ৭ বছর আগেই দেশ ছেড়েছিলাম। তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে করতেই চাকরি পেয়ে চলে আসি​ সিঙ্গাপুর এ। গ্রামের বাড়িতে​ আমার পরিবার বলতে শুধু আমার মা আর বাবা। আমার বাবা এই দেবানন্দ পুর গ্রাম পঞ্চয়েত এর ক্লারিক্যাল পোস্ট এ চাকরি করতেন। মা বরাবরের গৃহিণী। সেভাবে বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি আমাদের ছোটো থেকেই। অভাবের সংসার না হলেও সেরকম সচ্ছল পরিবারের ছেলেও আমি নই। আমি ক্লাস ১০ এ পড়ার সময় মা এর খুব বড়ো একটা অসুখ এর জন্য অনেক টাকা খরচ হয়েছিলো বাবার। ব্যাংক লোন নিয়ে সে বারের মত মা কে সুস্থ করে কে বাড়ি ফেরানো হয়। তারপর থেকে লোন এর টাকা শোধ করতে করতেই বাবার সব মাইনের টাকা শেষ হয়ে যেত। আমার নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি আমার ছায়াসঙ্গী,​ আমার বন্ধু​ রাজার সুপারিশ এ পাড়ায় কয়েকটা টিউশন পেয়েছিলাম। সেখান থেকে কিছু আয় করে বাবার হাত এ তুলে দিতাম আর নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতাম। রাজা বলতো, "নিজেকে একা ভাববি না। তোর মা​ আমার নিজের মায়ের মত। আমি তোর বাড়িতে না যেতে পারলেও সবসময় তোর পাশে থাকবো তোর ছায়াসঙ্গী হয়ে"। আমি বলতাম, "রাজা আমার মা জানে আমি তোর সঙ্গে আর মেলামেশা করিনা এখন। মা যদি জানতে পারে তুই আমায় টিউশন গুলো পাইয়ে দিয়েছিস, আমার সেদিন আর নিস্তার নেই" ।​ ​ রাজা হেসে আমার কথাগুলো উড়িয়ে দিত আর বলতো "তাওতো তোর ওপর রাগ করার কেউ আছে রে বাড়িতে"। চোখ ছলছল করে উঠতো রাজার।​

হঠাৎই​ বুকের ভিতর টা ধড়ফড় করে উঠলো। বাইরে শনশন করে হাওয়া বইছে। বৃষ্টির কারণে ট্রেন এর গতি ও খুব কম। একবার বাইরে উকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কোথায় আছি। অন্ধকার​ আর বৃষ্টির দাপট এ কিছুই যে বোঝা যাচ্ছে না।​ একবার কামরার দিকে নজর টা ঘোরালাম। আমায় নিয়ে গোটা বগিতে মোট ৮ জন মানুষ।​ এই স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে কামরার মেঝে তে একজন একটা শাল মুড়ি দিয়ে বসে আছে। ভিজে যাচ্ছে, অথচ ভিতরে এসে বসছে না। বেশ বুঝতে পারছি ওর অভ্যাস হয়ে গেছে ওভাবে বসে যেতে । ভিতরে এসে বসার সুযোগ হয়তো পায়না সেভাবে অন্যদিন​ অনেক যাত্রী থাকে বলে। আজ এই দুর্যোগের দিনে ভালো ভাবে বসে যাওয়ার লোভে না পড়ে নাইবা ছাড়লো নিজের পুরোনো সঙ্গী, নিজের বসার জায়গাটা।​

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser


​ সাত বছরে একবার ও রাজার কথা আমার মনে পড়েনি!!​ সেই যেদিন রাজার মা মারা গেলেন, আমার মা ওকে ওর বাড়ী থেকে কোলে করে নিয়ে এলো একটু ভাত খাওয়াবে বলে, সেদিন ওর আমাদের বাড়ীতে প্রথম আসা। রাজার বাবা ছাড়া আর কেউ ছিল না এই তল্লাটে ওর নিজের বলতে। উনিও একদিন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ হলেন। রাজা তখন থেকেই অনাথ ।​ আমার থেকে বয়স এ 2 বছরের বড় হলেও কিন্তু আমাদের মধ্যে বয়স্ এর সেই ফারাক টা ছিল না কোনোদিন। রাজার মা মারা যাওয়ার পর থেকেই ও আমাদের বাড়িতেই বড়ো হয়েছে। আমার মা এর কাছে রাজা বড়ো ছেলে আর আমি ছোট ছেলে। এ নিয়ে আমার কোনো আপত্তি ছিল না কোনোদিন। আমি যেদিন কলকাতাতে কলেজ এ ভর্তি হতে এলাম সেদিন রাজা বলেছিল ," কলকাতায় এসেছিস ঠিক আছে, কিন্তু এর বেশি আর যেতে পারবি না আমায় ছেড়ে"। আমি সেদিন কিছু বলিনি, আমার স্বপ্নের কথা, আমার বিদেশ এ চাকরি করার ইচ্ছার কথা। রাজা খুব আবেগপ্রবণ , কষ্ট পাবে বলে বলিনি সেদিন। আর যেদিন আমি চাকরি জয়েন করার লেটার পেলাম, সেদিন ও আমি কিছু বলতে পারিনি। কিছুটা দুঃখে, কিছুটা ভয়ে। ভয় পেয়েছিলাম , খুব ভয় , কারণ রাজা আমার প্রাণের বন্ধু হলেও কিন্তু খুব বদমেজাজি​ ছিল। এমনিতে শান্তশিষ্ট স্বভাবের ছেলেটা হঠাৎ যে কি হয়ে গেল একটা দিনের অভিজ্ঞতায়। এই তো সেইদিন আমাদের স্কুল এর রবীন্দ্র জয়ন্তী র দিন আমাদের পাড়ার শিবুর সঙ্গে আমার খুব ঝামেলা হলো। স্কুল এর চৌহদ্দির মধ্যে শিবু আর ওর সাঙ্গপাঙ্গ রা​ সেদিন সিগারেট খাচ্ছিল। আমি প্রতিবাদ করতে ওরা সবাই মিলে তেরে এলো আমার দিকে। শিবু আমার সাইকেল টা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল স্কুল এর পাশের জঙ্গলে। আমি বাড়ি এসে রাজা কে বলতেই রাজা একটা দা নিয়ে ছুটে গেছিলো শিবুর পাড়ায়। ওদের ওখানের ক্লাব এর মেম্বার ছিল শিবু। সে তো ক্লাব এর ১০ জন কে নিয়ে রাজা কে মারবে বলে হাজির। কিন্তু রাজা কে হারাবে সেই ক্ষমতা ওদের কারোর ছিল না। রাজা আমাদের পাড়ার রবিন হুড। যেমন তার গায়ের জোর তেমন বুদ্ধি।​ সব কটা কে ঘায়েল করে রাজা বাড়ী ফিরে এলো সেদিন।​ কিন্তু কিছুক্ষন পরেই থানা থেকে পুলিশ এসে রাজা কে তুলে নিয়ে গেলো । পরে জানতে পারলাম মারপিট করতে গিয়ে রাজা একজনের হাত এ কোপ বসিয়ে দিয়েছে !!​​

হঠাৎ বৃষ্টির ঝাপটায় ঘুম টা কেটে গেলো। চোখ মুছে ট্রেন এর জানলা টা তুলে দেখলাম কোন নগর পার হচ্ছি।​

সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকেই মা রাজা কে আর বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। রাজা ও কিছু না বলে বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলো।​ মা আমাকে পাঠিয়ে দিতে চেয়ে ছিল লিলুয়ায় মামার বাড়িতে,​ কিন্তু বাবা দেননি। শিবু আসলে আমাদের এলাকার খুব বড়ো একজন প্রোমোটার এর ছেলে কিনা। ওনার পয়সার জোর আর রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল । মা ভয় পেয়েছিল এটা ভেবেই যে শিবুর বাবা যদি আমার কোনো ক্ষতি করতে চায় তাহলে কি হবে!!​ একদিন তো শিবুর বাবা আমার বাবাকে বাড়িতে এসে বলে গেলেন , " আপনার ছেলে​ তো পড়াশোনায় ভালো , এই গ্রাম এ রেখে কেনো ওর ভবিষ্যত নষ্ট করছেন। ওকে কলকাতার ভালো কোনো কলেজ এ ভর্তি করে দিন, এখানে থাকলে রাজার মতো কিছু ছেলের পাল্লায় পড়ে শেষে না আবার , মানে ওই আর কি, যা হয়, বুঝলেন না, মারপিট করবে, গুন্ডা গিরি করবে, লকআপ এ যাবে, দুদিন পরে আরো কত কি করবে !! সেসব আপনাদের মত শিক্ষিত সমাজের মানুষেরা কি আর সহ্য করতে পারবে? আমার ছেলে না হয় দুদিন পর আমার ব্যবসা দেখবে কিন্তু আপনার ছেলে কি করবে বলুন " সেদিন থেকে মা এর জেদ আমায় গ্রাম এ থাকতে দেবে না। কিন্তু আমি কি করে বোঝাব যে রাজা সেদিন যেটা করেছে সেটার জন্য আমিও দায়ী। আমি যদি সেদিন ওকে এসে কিছু না বলতাম তাহলে এত কিছু ঘটতো না। কিন্তু সত্য কথাটা বলা হয়নি সেদিন। আর হয়তো সেই জন্যই, আমার বন্ধু রাজা, আজও মায়ের কাছে অপরাধী হিসেবেই বেঁচে আছে।

বড্ড ঠান্ডা লাগছে হঠাৎই। চুচুড়া স্টেশন পেরিয়ে এলাম। এতক্ষণ এ টের পেলাম যে লোকটি নিচে বসেছিল, সে যেন কখন উঠে এসে আমার পেছনের সিট এ বসেছে। এমনভাবে মুখটা ঢেকে আছে, বোঝা যাচ্ছে না। চোর নয় তো ! অমন ভাবে বসে আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে কেনো ? যাই হোক ব্যান্ডেল প্রায় চলেই এসেছি। অসুবিধে হবেনা। আর ১০ মিনিট এ পৌঁছে যাবো।​ চুচুরা পৌঁছানোর পর মনে পড়লো কাল সকাল এ একবার কোর্ট এ আসতে হবে। আসলে আমার হঠাৎ দেশে ফেরার কারণ যে আমার সেই অতীত এর ওই দিনটা , সেটাই তখন থেকে মাথায়​ ঘুরছে। আমি বিদেশ চলে যাওয়ার পরে শিবুর বাবা আর তার কিছু অসাধু বন্ধুবান্ধব আমার পরিবারের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাঝে মাঝেই বাড়িতে এসে হাজির হতো আর কারণে অকারণে কিছু উটকো ঝামেলা সৃষ্টির চেষ্টা করতো। এসবের মূল পান্ডা আমার ছোটো কাকা। আসলে আমাদের বাড়িটা বড়ো রাস্তার ধারে।​ ফ্ল্যাট বানানোর জন্য বড়ো রাস্তার পাশের জমির চাহিদা থাকায় মাঝে মাঝেই বাবাকে প্রোমোটার দের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।​ আমার ছোটো কাকা আমাদের সঙ্গে থাকলেও আমাদের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক ছিল না। বাবা বরাবর ওনাদের সাহায্য করে এসেছেন কিন্তু কাকুর কোনোদিন ও ভালো কিছু করার ইচ্ছে ছিল না। সারাদিন পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে দিন কাটে তার। স্থানীয় একটি মিলের সুপারভাইজার এর কাজ করতেন কাকু। একদিন ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা চুরির অপবাদ এ চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় তাকে। তারপর থেকে আর কোথাও কেউ ভরসা করে তাকে চাকরি তে​ রাখেনি। বাবা অনেক চেষ্টা করেও কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেনি কাকুর জন্য। সেই জন্যই বোধ করি বাবার ওপর কাকুর খুব রাগ। এখন কাকুর নজর আমাদের জমির ওপর। ১০ কাঠা জায়গা বলে কথা ! ওনার সাথে হাত মিলিয়েছে শিবুর বাবা। কাকুকে টোপ দিয়েছে যদি ঐ জমিটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে তাহলে একটা ফ্ল্যাট আর সাথে ৫ লক্ষ টাকা নগদ পাইয়ে দেবেন উনি। এসব যদিও মায়ের মুখ এ শোনা। তাও একবার নিজে এসে সবকিছু না দেখলে হচ্ছিলো না। ৫ দিন আগেই মায়ের খুব চাপাচাপিতে শেষ মুহূর্তে সবকিছু ব্যবস্থা করে আসতে হলো। রাজা থাকলে হয়ত এসব নিয়ে ভাবতে হতনা।​

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। মায়ের ফোন। " কি রে কতদূর? ১২ টা বেজে গেলো তো? ট্রেন লেট নাকি?" মায়ের সব প্রশ্নের পরিপাটি উত্তর পরিবেশন করার পর যেই ফোন টা রেখেছি, দেখলাম দুজন আমার কামরায় উঠলো হুগলী স্টেশন থেকে। একজনকে একটু চেনা চেনা মনে হলো, কিন্তু অন্যজন কে চিনতে পারলাম না। ওরা বসলো না, দাড়িয়ে থাকলো গেট এর সামনে। যথারীতি কারসেড এর সামনে কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ট্রেন এসে থামলো ব্যান্ডেল জংশন এ।​

প্ল্যাটফর্ম এর বাইরে এসে একটাও জনমানুষ দেখতে পেলাম না । বাইরে তখন ও মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এত খারাপ ওয়েদার আজই হতে হলো, এতদিন পরে যদিও নিজের জায়গায় এসে আমার উত্তেজনার পারদ নামতে চাইছিল না। প্রায় ১৫ মিনিট দাড়িয়ে থাকার পর কাউকে দেখতে না পেয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ী পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। তাড়াতাড়ি পা চালালে এখান থেকে হেঁটে যেতে মোটামুটি ৪৫ মিনিট লাগবে । টর্চ একটা থাকলে ভালো হতো, ছাতা ও নেই, এসব ছাইপাশ ভাবছি, হঠাৎ দেখি পিছনে সেই গায়ে শাল জড়ানো লোকটি, আমার থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে কি যেনো একটা খুঁজছে নিজের পকেট এ। নাহ্, ভালো লাগছে না ব্যাপারটা। হাঁটা শুরু করি।​ ভাবতে না ভাবতেই দেখি হুগলী থেকে ওঠা সেই দুজন লোক বাইরে বেরিয়ে এসেছে। একজন আমায় দেখে বললেন, " এখন তো কিছু পাবেন না, কোন দিকে যাবেন?" আমি বললাম দেবানন্দ পুর লেবুতলা মাঠ যাবো। উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন " আমরাও ওদিকেই যাবো, আমাদের গাড়ি আছে, আপনাকে নামিয়ে দেব চলুন"। আমি একটু স্বস্তি পেলাম, যাক বাবা খুব বড়ো বাচা বেঁচে গেলাম আজ।​


একটা টাটা সুমো এলো ১০ মিনিট এর মধ্যে। আমরা সবাই গিয়ে উঠলাম গাড়িতে। আমি সামনের সিট এ বসলাম। গাড়ি চলতেই আমি ধন্যবাদ জানালাম সাহায্যর জন্য। উনি কোনো কথা বললেন না। চুপ করে শুধু শুনলেন। আরেকজন জিজ্ঞাসা করলেন কোথা থেকে আসছি। আমি বলতে উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন "ওঃ, আপনি বীরেশ্বর বাবুর ছেলে? আমি চিনি ওনাকে। লেবুতলা মাঠের পাশে বড়ো রাস্তার ধারে আপনার বাড়ী তাই না? আমি জবাব দিলাম , " আসলে অনেকবছর পর বাড়ী ফিরছি তো তাই আসলে একটু ধন্ধে আছি রাস্তা টা নিয়ে। এটা কি নতুন কোনো রাস্তা? এটা তো দেবানন্দ পুর এর রাস্তা নয়? " ভদ্রলোক এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার বলে উঠলেন " হ্যাঁ ঠিক ধরেছিস, এটা তোর বাড়ির রাস্তা না, এটা স্বর্গের রাস্তা, আমরা এসেছি তোকে ওখানে পৌঁছে দেব বলে" বলেই হাহাহাহা করে হেসে উঠলেন লোকটি !!!


ওর কথা শুনে আমার মাথা টা হঠাৎ ঘুরে গেলো, গলা শুকিয়ে উঠলো, গোটা শরীর গুলিয়ে উঠলো। হাতপা কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে অবশ হয়ে উঠলো। মাথায় আসছিল না কেউ কেনো আমায় খুন করতে চাইবে। আমি তো এত বছর পর দেশে ফিরছি। কারোর সাথে যোগাযোগ ও নেই আমার। এরাই বা কারা? কথা বলার ক্ষমতায় ছিলাম না অনেকক্ষন। বললাম " এসব আপনারা কি বলছেন? আপনাদের কোনো ভুল হয়েছে। আমি সে লোক নই আপনি যাকে ধরেছেন।"​ " তোকে চিনতে ভুল কীকরে করবো সিধু? " পেছন থেকে একটা গলা ভেসে এলো। খুব চেনা একটা গলা। শিবু ??? হ্যাঁ , ঠিক ধরেছি, শিবুর গলা। খেয়াল করিনি, ও অন্ধকারে পেছনে বসেছিল। বললাম " শিবু তুই ? তুই এটা কি করছিস আমার সাথে? গুন্ডা দিয়ে আমায় কিডন্যাপ করে কি করছিস এগুলো? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?" শিবু উত্তর দিলো, " তুই চলে যাওয়ার পর শুধু ওপরওয়ালা কে ডেকেছি তুই যেনো আমি বেঁচে থাকতে থাকতে ফিরে আসিস!! তোর আর রাজার জন্য আমার জীবন টা শেষ হয়ে গেছে। ওইদিন রাজা যাকে দা দিয়ে মেরেছিল, সে আমার নিজের দাদা ছিল। তোদের জন্য ও পঙ্গু হয়ে গেলো জানিস। সেই দুঃখ সহ্য না করতে পেরে দাদা আত্মহত্যা করেছে । সেদিন থেকে আমার বাবার আর আমার জীবন এ শুধু একটাই লক্ষ্য। তোদের শেষ করে দেওয়া। তাই তোর কাকা কে হাত করে তোর মা কে চাপ দিয়ে তোকে বিদেশ থেকে এখানে আনা করিয়েছি যাতে তোকে খতম করে আমি আমার দাদার মৃত্যুর বদলা নিতে পারি। রাজাকে তো​ আগেই ভুয়ো খুনের মাম লায় ফাঁসিয়ে কুখ্যাত করে দিয়েছি। পুলিশ যেখানেই পাবে, সেখানেই রাজা কে কুকুরের মতো গুলি করে মারবে। বাকি ছিলিস তুই আর তোর​ মা। তোকে শেষ করে তোর লাশ টা নিয়ে ফেলবো তোর বাড়ির সামনে। ব্যাস, ওনাকে আর কষ্ট করে মারতে হবেনা। তোর লাশ টা দেখলে এমনি মারা যাবে ", বলেই একটা পৈশাচিক হাসি হাসলো শিবু।


আমার আর কথা বলার ক্ষমতা ছিল না। কি করবো ভেবে না পেয়ে আমি গাড়ির ব্রেক টা জোর করে পা দিয়ে চেপে ধরলাম। গাড়িটা খুব জোর দিয়ে দাড়িয়ে গেলো ফাঁকা রাস্তার মাঝে। পেছন থেকে একটা হাত এসে পেচিয়ে ধরলো আমার গলা টা। শিবু জোরে জোরে চেঁচাতে লাগলো " এটাকে এত সহজে ছাড়া যাবেনা নন্দ, অনেক কষ্ট করে ধরেছি, আর সুযোগ পাবনা। গাড়ি থেকে নামা ওকে। এখানেই শেষ করবো!!!"​


আমার গলায় একটা গামছা জড়িয়ে গাড়ি থেকে আমায় নামালো নন্দ। গাড়ির লাইট এর সামনে হাঁটু গেড়ে আমায় বসিয়ে দিয়ে সরে গেলো। আমার চোখ তখন জলে ভেসে যাচ্ছে, বুঝতে পারছিনা কি করবো। শুধু আমি আর আমার মা মানে?​ সামনে এসে দাড়ালো শিবু। কি ভয়ঙ্কর লাগছে ওর চোখ দুটো। আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম " শিবু সেদিন যেটা হয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ রূপে একটা কাকতালীয় ঘটনা। তোর ও দোষ ছিল। শুধু একজনের দোষ দেখিস না শিবু, প্লিজ। বোঝার চেষ্টা কর।​ মানছি তোর দাদার সাথে যেটা হোয়েছে সেদিন খুব ই খারাপ হয়েছে। কিন্তু সেটার জন্য তুই এভাবে প্রতিশোধ নিবি?? " শিবু কিছু শুনতেই চাইলো না। ওর শুধু প্রতিশোধ চাই। ও বললো, " তোকে আজ না শেষ করলে আবার আমাকে অন্য কাউকে মারতে হবে। সেদিন রাজা কেও ফাঁসানোর জন্য আমায় একটা খুন করতে হয়েছে। আমি শুনেছি ও নাকি তোর ছায়াসঙ্গী ছিল। এখন কোথায় সে? দেখ কোনো গলির মধ্যে পড়ে আছে গুলি খেয়ে। হাহাহাহা "​


হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে​ একটা​ আলো এসে পড়লো আমার মুখে। চোখের সামনে থেকে হাত টা সরিয়ে দেখতে পেলাম একটা বাইক এসে দাড়িয়েছে আমাদের সামনে। গাড়ির লাইট এর আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম - সেই শাল জড়ানো লোকটাকে। আমার দিকে সেই একভাবে তাকিয়ে আছে। বাইক থেকে নেমে দাড়ালো সে। শিবু চেঁচিয়ে উঠলো " এই কে রে তুই,? চল ভাগ এখান থেকে। দেখছিস না বড়রা কাজ করছে । নন্দ সরা মালটাকে" । লোকটা কোনো জবাব না দিয়ে খুব শান্ত ভাবে কোমর থেকে কি যেনো একটা বার করতে থাকলো। নন্দ ওর সামনে গিয়ে ওকে সরাতে যাওয়ার আগেই খুব জোর চিৎকার করে উঠলো !!!​

আমি দেখলাম, নন্দ র জামা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। দাড়িয়ে থাকতে থাকতে নন্দ পড়ে গেলো। আবছায়া আলোতে দেখলাম মুখটা কে। রাজা ?????


হ্যাঁ, চিনতে ভুল করিনি। এ তো রাজা !! ও কীকরে জানলো আমি বাড়ী ফিরছি? কিভাবে জানলো কোন ট্রেন এ ফিরছি? আমাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখেছিল তাহলে? ও জানত শিবু কি প্ল্যান করে বসে ছিল?​ ও তো পালিয়ে গেছিলো এখান থেকে, কোথায় ছিল, কি করছিল এতদিন, নাহ্, মাথা ঘুরে যাচ্ছে এতকিছু ভাবতে ভাবতে। সম্বিত ফিরলে দেখলাম চারিদিকে শিবু আর তার সাঙ্গপাঙ্গ ধরাশায়ী হয়ে পড়ে আছে। কারোর শরীরে প্রাণ নেই। রাজা একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, " বাড়ী চল, মা চিন্তা করছে" ।

 

প্রায় পৌনে দুটোয় বাড়ী পৌছে দিল আমায় রাজা। যাওয়ার আগেই বলে গেলো, মা যেনো এতকিছু জানতে না পারে। আমি অভয় দিয়ে বললাম তোর সাথে কিছু কথা আছে। রাজা বললো " তোর সব প্রশ্নের উত্তর তোর বাড়িতেই আছে। " বলে বাইক টা ঘুরিয়ে চলে গেলো। আমায় একবার দেখলো পর্যন্ত না।​

মা আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিল। আমি ভেতরে ঢুকেই সবার আগে জিজ্ঞাসা করলাম, " বাবা কোথায়?"​

সবকিছু যেনো স্বপ্নের মতো লাগছিল। শরীরের সব শক্তি যেন কেউ নিংড়ে বার করে নিয়েছে।। বাবা নেই ? ভাবতেই পারছিনা। মা কে ভালোভাবে দেখার পরে অস্বস্তি আর ধরে রাখতে পারলাম না। মা কে চেপে ধরে কেঁদে ফেললাম। মা কে বললাম "আমায় জানাওনি কেনো তোমরা? মুখাগ্নি কে করলো? কিভাবে ঘটলো?" মা যা​ যা বললো সব শুনে আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো।


৫ দিন আগে বাবা বাজার গেছিলেন। আর ফেরেন নি। একদিন পরে ওনার মৃতদেহ পাওয়া যায় বাড়ির থেকে ৪ কিমি দূরে একটি খাল থেকে। পাড়ার কেউ একজন বলেন বাবাকে শেষ নাকি রাজার সাথে কথা বলতে দেখা গেছিলো। এমনিতেই রাজা​ অপরাধী সন্দেহের জেরে গা ঢাকা দিয়ে থাকতো। সেদিন বাবার সাথে বাজার এ দেখা করেছিল রাজা। আমার মা রাজা কে বাড়ী থেকে বার করে দিয়েছিল। সেই দুঃখের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজা আমার বাবাকে খুন করেছে, সেই কথাটি আমাকে আমার মা কে সবাই বলেছে। আর আমার ছোট কাকা মা কে বলে আমি​ যেন এখনই কিছু জানতে​ না পারি। শুধু বলতে জমি নিয়ে ঝামেলা হয়েচে, বাড়ী ফিরতে। আমি সব জেনে গেলে খুব কষ্ট পাবো আর এতটা পথ আসতে আমার অসুবিধে হবে তাই আমায় কোনো খবর দেওয়া হয়নি । আমার খুড়তুতো ভাই মুখাগ্নি করেছে। সব শোনার পর আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। একটা একটা করে সব কটি প্রশ্নের ফাঁস খুলতে লাগলো আমার সামনে।


রাজাকে ফাঁসানোর জন্য শিবু আমার বাবাকে হত্যা করলো। তারপর আমার কাকার সাহায্যে খুব সহজ এ আমার মায়ের মনে রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলো। আমাকে এখানে ডেকে আনলো আমায় মারবে বলে। সেই দোষটা ও রাজার ঘাড় এ চাপতো। আজ আমার বাবার মৃত্যুর বদলা রাজা নিয়েছে, বড়ো ছেলে হিসেবে ও নিজের কর্তব্য পালন করেছে।​ ছোটো ছেলে হিসেবে আমার কর্তব্য মায়ের দেখাশোনা করা, সেটাও রাজা বুঝিয়ে গেছে।​

ঠিক করলাম, আর বিদেশ এ থাকবো না। কলকাতায় একটা চাকরি নিয়ে চলে আসবো। মা কে সাথে রাখবো। কাকার বিরুদ্ধে​ কোর্ট এ মামলা করবো, আর বাবার মৃত্যুর তদন্ত করবো।​
 

আজ ৩ বছর পরেও আমি মা কে সত্যি কথা টা বলতে পারিনি​ কিভাবে এখনও রাজা আমাদের পরিবারের ছায়াসঙ্গী হয়ে চলছে।​ ও দোষী ই থেকে গেলো মায়ের চোখে । শুধু ওর একটা কথা আজ ও মনে পড়ে " আমি সত্যি সত্যি কলকাতা থেকে বেশি দূরে যেতে পারলাম না।"

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait