রবীন্দ্রনাথকে যারা ট্রোল করেছিল

রবীন্দ্রনাথকে যারা ট্রোল করেছিল

 

কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ: তিনি রবীন্দ্রবিরোধী গোষ্ঠীর অন্যতম এক ব্যক্তি। শুধুমাত্র ১৮৬১, সংখ্যাটি  ছাড়া বাকি সবটাই অমিল ছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। দুজনেই জন্মেছিলেন ১৮৬১ সালে। কলকাতার ভবানীপুরে থাকতেন কালীপ্রসন্ন। হিতবাদী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ব্যঙ্গ লেখক হিসেবেও সেই আমলে বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন। জীবনের একটি সময় তিনি ‘রাহু’ ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি গ্রাস করার জন্য ব্যয় করেছিলেন। ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কড়ি ও কোমল’। রবীন্দ্রনাথের কবিতা বোঝার মতো মন আর সময় কোনোটাই ছিল না কালীপ্রসন্নের। তাই শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথকে আঘাত করার মানসিকতা থেকেই কালীপ্রসন্ন ‘রাহু’ ছদ্মনামে ‘কড়ি ও কোমল’ এর কয়েকটি কবিতা প্যারোডি করে ‘মিঠে কড়া’ নামে একটি পুস্তিকা ছাপালেন। তখন ১৮৮৮ সাল। আখ্যাপত্রে ঘোষণা করা  হলো— ‘ইহা কড়িও নহে, কোমলও নহে, পুরো সুরে মিঠেকড়া।’ এরপর? পাতার পর পাতা রবীন্দ্রনিন্দা। যাঁরা ‘কড়ি ও কোমল’ পড়েননি, তাঁরাও কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের ‘মিঠে কড়া’র নাম শুনেছিলেন। কারণ, ঠাকুরবাড়ির ‘পায়রা কবি’ যে নগদ একটাকা মূল্যের জোরেই বই ছাপাতে সক্ষম, এমন কথা আর কে কোথায় বলেছে? এইসব সমালোচনার অন্তরালে রোম্যান্টিক ও ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্যের দ্বন্দ্বের কথা না হয় নাই বললাম। কিন্তু খেউর, খিস্তি আর অশালীন ইঙ্গিতে একজন নবীন কবিকে ক্ষতবিক্ষত করেছিলেন কালীপ্রসন্ন:

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

‘উড়িস নে রে পায়রা কবি
খোপের ভিতর থাক ঢাকা।
 
তোর বকবকম আর ফোঁস ফোঁসানি
তাও কবিত্বের ভাব মাখা!
তাও ছাপালি, গ্রন্থ হলো
নগদ মূল্য একটাকা!’

এটা যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে প্রথম ট্রোল সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ তো নেই – এমনকি গ্রন্থাকারে রবীন্দ্রনাথের কবিতার এমন ট্রোল সংকলন পরবর্তীকালে আর দেখা যায়নি। ‘মিঠেকড়া’র চাহিদা সে যুগে হয়েছিল জোর। রবীন্দ্র বিদ্বেষীরা তারিয়ে তারিয়ে এর রস খেয়েছিলেন:

ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ বঙ্গের আদর্শ কবি

শিখেছি তাঁহারি দেখে তোরা কেউ কবি হবি?...

সে যে রবি- আমি রাহু, তুল্য মূল্য সবাকার।

ধনী সে – দরিদ্র আমি, সে আলো- এ অন্ধকার।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: প্রাথমিকভাবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও রবীন্দ্রনাথের সুসম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য কোনওদিনই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও বিদ্বেষভাব পোষণ করেননি। তিনি ‘সাধনা’ পত্রিকায় দ্বিজেন্দ্রলালের লেখার প্রশংসা করতেন। ১৮৯৭ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর লেখা ‘বিরহ’ নামের প্রহসন রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। সেটি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অভিনীত পর্যন্ত হয়। অথচ কিছুদিন বাদে দ্বিজেন্দ্রলাল রবীন্দ্রবিমুখ হয়ে ওঠেন। আর সেই বিমুখতা বিদ্বেষে পরিণত হলে সুরেশচন্দ্র তাঁকে লুফে নেন। ১৩১৩ বঙ্গাব্দের ‘সাহিত্য’ পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় ‘সোনার তরী’র প্যারোডি ও তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। তাঁর মতে কবিতাটি খানিক ধোঁয়া ছাড়া আর কিছু নয়। তাই কবিকে উদ্দেশ্য করে লেখেন, ‘যদি স্পষ্ট করিয়া না লিখিতে পারেন, সে আপনার অক্ষমতা। .. অস্পষ্ট হইলেই গভীর হয় না, কারণ ডোবার পঙ্কিল জলও অস্পষ্ট..।’ এতেই থামলেন না তিনি রবীন্দ্রনাথকে গালাগালি করে লেখা প্রবন্ধ পাঠালেন রবীন্দ্রনাথের সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য নিয়ে প্রকাশিত হল দ্বিজেন্দ্রলালের সেই রচনা ‘কাব্যের উপভোগ’।

দ্বিজেন্দ্রলালের ট্রোলের মধ্যে সবচেয়ে নজরকাড়া তাঁর রবীন্দ্রসংগীতের ট্রোল। একটি ধ্রুপদি উদাহরণ দিই: রবীন্দ্রনাথের ‘এখনও তারে চোখে দেখিনি’ দ্বিজেন্দ্রলালের হাতে ট্রোল হয়

‘এখনও তারে চোখে দেখিনি,

শুধু কাব্য পড়েছি,

অমনি নিজের মাথা খেয়ে বসেছি।’

রবীন্দ্রনাথের আর একটি গানে আছে-
সে আসে ধীরে, যায় লাজে ফিরে,
রিনিকি ঝিনিকি রিনি ঝিনি মঞ্জু মঞ্জীরে।

দ্বিজেন্দ্র লাল রায় আনন্দ বিদায়-এ ট্রোল করে লিখলেন-
সে আসে ধেয়ে, এন ডি ঘোষের মেয়ে,
ধিনিক ধিনিক ধিনিক, চায়ের গন্ধ পেয়ে।

দ্বিজেন্দ্রনাথ লিখছেন: “(রবীন্দ্রনাথের) উত্তম কবিতাগুলি অনুকরণে অসমর্থ হয়ে তাঁর অর্থহীন কবিতাগুলির অন্ধ অনুকরণে ভাবহীন ঝংকার কর্চ্ছেন তার চেলাগণ”। এর আগেই তিনি সেই ‘চেলা’দের উদ্দেশ্যে বলে নিয়েছেন: “রবীন্দ্রবাবুর কাব্য আমি যেরূপ অনুভব করি, সেই চেলাগণ তাহার দশমাংশও করেন কিনা সন্দেহ। তবে রবীন্দ্রবাবু যাই’ লেখেন লেখেন তাতেই, ‘তাধিন তাকি ধিন তাকি, ধিন তাকি, ধিন তাকি, ম্যাও এঁও এঁও বলে’ কোরাস দিতে পারি না – রবীন্দ্রবাবুর বন্ধুত্বের খাতিরেও নও”।...

চিত্রাঙ্গদা প্রকাশের বেশ কিছুদিন পরে ১৯০৭ সালে সরব হলেন তিনি৷ রবীন্দ্রনাথের খণ্ডকবিতা সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রলাল যে অভিযোগ করেন তারই প্রমাণস্বরূপ তিনি চিত্রাঙ্গদা কাব্যগ্রন্থটি গ্রহণ করলেন – কারণ ‘এটি রবীন্দ্রবাবুর ভক্তদের বড় প্রিয় কি না’; রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’র গল্পাংশ সংক্ষেপে বিবৃত করে দ্বিজেন্দ্রলাল লিখলেন;

রবীন্দ্রবাবু অর্জুনকে কিরূপ জঘন্য পশু করিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন, দেখুন। একজন যে কোনও ভদ্রসন্তান এরূপ করিলে তাহাকে আমরা একাসনে বসিতে দিতে চাহিতাম না। ... ‘চিত্রাঙ্গদা! বেচারি মা আমার! বঙ্গের কবিবরের হাতে পড়িয়া তোমার এহেন দুর্গতি হইবে তাহা বোধ হয় তুমি স্বপ্নেও ভাবো নাই৷ এক জন যে-সে হিন্দু কুলবধূ যে অবস্থায় প্রাণ দিত, কিন্তু ধর্ম দিত না, সেই অবস্থায়, সেই অবস্থা তুমি উপযাচিকা হইয়া গ্রহণ করিলে৷ আর বলিব কী, বর্ষকাল দ্বিধা নাই, ধর্ম নাই, কেবল নিত্য ভোগ, ভোগ আর নির্লজ্জভাবে তাহার বর্ণনা, আর কেবল রূপটি নিজের নহে বলিয়া আত্মগ্লানি৷’ কামপীড়িতা চিত্রাঙ্গদার বাসনায় উজ্জ্বল চরিতচিত্র সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রলাল আর একটি কথা জানালেন, ‘রবীন্দ্রবাবু এই পাপকে যেমন উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত করিয়াছেন, তেমন বঙ্গদেশের আর কোনো কবি অদ্যাবধি পারেন নাই৷ সেই জন্য এ নীতি আরো ভয়ানক৷’ 

সুরেশচন্দ্র সমাজপতি: ইনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাতী। ১৯১২ সালে বিদেশে রবীন্দ্রনাথের সংর্বধনার খবর যখন বিভিন্ন বিদেশি সংবাদসংস্থা ও সংবাদপত্র মারফৎ ভারতে এসে পৌঁছাতে শুরু করে তখন ১৩১৯ বঙ্গাব্দ কার্তিকের সাহিত্য সংখ্যায় তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে মন্তব্য করলেন, "ইংল্যাণ্ডে রবীন্দ্রনাথ সম্বর্দ্ধনার খবরে দেখিতেছি- ইংল্যাণ্ডের অনেক সুধী স্বীকার করিতেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও ভাবুক-এ বিষয়ে তাঁহার তুল্য দ্বিতীয় ব্যক্তি জগতে কোন দেশে নাই। আনন্দের কথা নয়? তবে কিনা দেশের লোক এতদিন তাহা বুঝতে পারে নাই। ইদানীং রবীন্দ্র ভক্তবৃন্দের বগলেই বিরাজ করেন দর্শন দুর্ঘট। বিস্ময়ের কথা এই যে, দেখিতে দেখিতে জগতের সাহিত্য এত দরিদ্র -প্রায় দেউলিয়া হইয়া গিয়াছে যে রবীন্দ্রনাথ সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইলেন। কোন কোন সুধী এই জগতব্যাপী কবি জরিপের সার্ভেয়ার ছিলেন,তাহা বলিতে পারিনা। যাঁহারা আমাদের ধন্য করিলেন, তাঁহারাই ধন্য।"

নজরুল ইসলাম: বাংলা সাহিত্যের দুই মহান দিকপাল কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাই ট্রোলের শিকার হয়েছে সব চেয়ে বেশি। কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই রবীন্দ্রনাথের ‘১৪০০’ সাল কবিতার প্যারোডি করেছেন। ঠিক প্যারোডি হলেও সেটি ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধারই নিদর্শন স্বরূপ এবং সেটিকে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। একবার হুগলি জেলে বসে জেলারের উদ্দেশ্যে গাইলেন কাজী নজরুল:

তোমারই জেলে পালিছ ঠেলে

তুমি ধন্য ধন্য হে,

আমার এ গান তোমারই ধ্যান

তুমি ধন্য ধন্য হে......

কিন্তু, নজরুলকে তো ছাড় দেওয়া যায় না। আবদারের পর প্যারডি রচনায় রাজি হলেন নজরুল। কিন্তু, রেডিমেড প্যারডি তো নেই। তাঁকে দেওয়া হল রবীন্দ্রনাথের গান - ‘আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো নমো হে নমো’। নলিনীকান্ত ও বাকিরা একি-দু লাইন করে গানটি গান আর নজরুল মুখে মুখে তার প্যারডি রচনা করে চলেন। মূল রবীন্দ্রসংগীতে ছিল—

‘আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো নমো হে নমো
তোমায় স্মরি হে নিরুপম
নৃত্য রসে চিত্ত মম, উচ্ছল হ’য়ে বাজে’

নজরুলের প্যারডিতে তা হয়ে দাঁড়াল—
‘ওহে, শ্যামো হে শ্যামো নামো হে নামো
কদম্বডাল ছাইড়া নামো
দুপুর রোদে বৃথাই ঘামো--- ব্যস্ত রাধা কাজে’

এই গানের এমন প্যারডি নির্মাণ হয়তো নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। ততক্ষণে গানের ঘোর পেয়ে বসেছে তাঁকে। প্যারডি এগোতেই থাকে--

‘আহা ললিতা দেবী সলিতা পাকায়,
বিশাখা ঝুলে হিজল শাখায়,
বিন্দাদূতি পিন্দা ধুতি...

এইখানটায় এসে খানিক আটকে যান কবি। তালে তাল দিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে গুনগুন করতে থাকেন পরের সম্ভাব্য লাইনগুলো। ইতিমধ্যে নিতাই ঘটক কখন পকেট থেকে বের করে নিয়েছেন কলম। শোওয়ার জন্য পেতে রাখা খবরের কাগজেই সবার অলক্ষে লিখে রেখেছেন এক কিংবদন্তির লেখা গান নিয়ে আরেক কিংবদন্তির এই ঐতিহাসিক প্যারডি। একে কি হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় নাকি!

যাইহোক, ‘বিন্দাদূতি পিন্দা ধুতি’ লাইনটাকে ততক্ষণে বদলে দিয়েছেন নজরুল। তার বদলে জুড়েছে নতুন লাইন— ‘পিন্দা ধুতি গোষ্ঠে গেছেন সাইজা রাখাল সাজে। বাকি রচনাটিও গড়গড়িয়ে এগোতে থাকে রাতের লালগোলা প্যাসেঞ্জারের মতো---

তুমি ইতিউতি চাও বৃথাই,---কমু না—
কোথায় তোমার যমুনা,
কলিকাতা আর ঢাকা, রমনার
লোকে পাইব্যা তার নমুনা।
কলেজে ফিরিছে ছিদাম-সুদাম,
মাইর্যা মালকোঁচা খুইল্যা বোতাম।
লাঙ্গল ছাইড়্যা বলরাম ডাম্বেল-মুদ্‌গর ভাঁজে।’

নিবারণ চক্রবর্তী: কবিগুরুর রচিত বিখ্যাত একটি গান “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে", এটা নিয়ে প্যারোডি করলেন নিবারণ চক্রবর্তী, দিবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে। নিবারণ চক্রবর্তী লিখলেন-

“যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই দ্বারে

আমি বইব না আর বাজার বোঝা এই ঘাড়ে

চুকিয়ে দিয়ে মুদির দেনা,

সাঙ্গ করে কাপড় কেনা

প্রবাস যাত্রা করবো আমি"...

সজনীকান্ত দাস: বাংলা সাহিত্যের ট্রোলকরাদের লিষ্টে যার নাম সবার আগে চলে আসে তিনি হলেন ‘সজনীকান্ত দাস’। ‘শনিবারের চিঠি’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। সমালোচনার বাণে যেমন সমসাময়িক সাহিত্যিকদের জর্জরিত করতেন, সেই সাথে সমান তালে চলতো তার প্যারোডি রচনা। অনুকরণে সজনীকান্ত দাসের প্যারডির নাম ‘মানের তরী’। মূল কবিতার অংশ বিশেষ সহ এঁর প্যারডির কিছু অংশের উদ্ধৃতি দিচ্ছি-সজনীকান্ত দাস লিখেছেন-
ভবনে গরজে প্রিয়া, নাহি ভরসা
কখন ঝরিবে জানি মান বরষা
করে বুঝি করে তাড়া
রাশি রাশি ভারা ভারা
বরষিয়া গালি ধারা খর পরশা,
ভাবিতে ভাবিতে প্রাণে নাহি ভরসা।
রবীন্দ্রনাথের ‘পত্র’ কবিতার লাইনগুলো ছিল

“কাজল বিহীন সজল নয়নে

হৃদয় দুয়ারে ঘা দিয়ো।

আকুল অচিলে পথিক চরণে

মরণের ফাঁদ পাতিয়ো।”

এর প্যারোডি করে সজনীকান্ত লিখলেন-

“দন্ত বিহীন শুষ্ক বদনে

ফোকলা কান্না কাঁদিয়ো।

শাড়ির আঁচলে দোক্তা ও চুন

সযতনে প্রিয়া বাঁধিয়ো।”

পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়: রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ সবুজপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর, সে সময় ‘সবুজপত্র’র ভাষা নিয়ে সনাতনপন্থীরা যে সমালোচনা, কটুক্তি ও বিক্ষোভে সামিল হলেন তা আজকের দিনে ভাবা যায় না। একে ‘বীরবলী ভাষা’, ‘ইয়ারকির ভাষা’ ইত্যাদি বলা হতে থাকল। এও বলা হল যে চলতি বাংলায় নাকি কোনও মহৎ ভাব, গভীর তত্ত্ব সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করা আদৌ সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ নাকি বাংলা ভাষাকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য আবির্ভুত হয়েছেন। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন, ‘… বিদ্যাসাগর বাঙ্গলা গদ্যের যে আকার ঠিক করিয়া গিয়াছেন তাহা আর বদলাইবে না। বঙ্কিমচন্দ্র ছাঁচের ওপরে একটু কারিগরি করিয়াছিলেন মাত্র, ছাঁচ বদলান নাই। রবীন্দ্রনাথ ছাঁচ বদলাইতে চাহিতেছেন, তাহা হইবার নহে। … রবীন্দ্রনাথের ভাষার ব্যাপ্তি নাই, বিস্তার নাই, কোনওদিন হইবেও না। .. বাঙ্গলার সাধারণ শিক্ষিতসমাজে তাঁহার প্রভাব বড়ই কম …।’

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত:  মজার কথা এই যে, রবীন্দ্রগানের দুঃসাহসিকতম ট্রোল দ্বিজেন্দ্রলালের মতো রবীন্দ্র-বিরোধীর হাত থেকে বেরোয়নি, বেরিয়েছিল এক পরম রবীন্দ্রানুরাগী রবীন্দ্রানুসারীর হাত থেকে। শুনুন:

“(বিধি) ছাগল-দাড়ি যারে দেছে

তারে (কেন) ছাগল দড়ি দিয়ে বাঁধিব না?

… (তব) কণ্ঠরবে হ’য়ে ঝালাপালা

(ধোপা) অনেক ধাওয়া ক’রে হ’ল আলা,

(যদি) ও গলা নিরুপম নিকটে ভাঁজ মম

সজোরে ভ্যা ভ্যা সুরে গাধার দাদাসম,

মাথাটা ধরে যদি শুনি তোর সরগম

তবে তো আমি তোরে চা দিব না”। …

রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’ কবিতাটি নিয়েও বহু ট্রোল হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকও রয়েছেন। যেমন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন ‘সর্বশী’, বনফুল লিখেছেন ‘শালা’, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ‘শালী’, সুধাংশুশেখর গুপ্ত লিখেছেন ‘শ্যালিকা’ এবং সজনীকান্ত দাস লিখেছেন ‘শীতলা’ মূল কবিতার কিয়দংশ সহ অন্য দু-একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি-
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী,
হে নন্দন বাসিনী উর্বশী।
গোষ্টে যবে সন্ধ্যা নামে শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি
তুমি কোন গৃহ প্রান্তে নাহি জ্বাল সন্ধ্যা দীপ খানি।

(উর্বশী : রবীন্দ্রনাথঠাকুর)
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত: লিখলেন ‘সর্বশী’
নহ ধেনু, নহ উষ্ট্রী, নহ ভেড়ী, নহ গো মহিষী,
হে দামুন্যা-চারিণী সর্বশী,
ওষ্ঠ যবে আর্দ্র হয় জিহ্বা সহ তোমার বাখানি
তুমি কোন হাঁড়ি প্রান্তে নাহি রাখ খণ্ড মুণ্ডখানি।

বনফুল: লিখলেন ‘শালা’
সামান্য মনুষ্য নও, নও শুধু গৃহিণীর ভ্রাতা
হে শ্যালক, হে স্বভাব শালা।
বহু দেশে বহু বেশে বহুবার দেখেছি তোমারে
রচিয়াছি তব জয়মালা।

শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়: লিখলেন ‘শ্যালিকা’

“নহ পৌঢ়া, নহ বৃদ্ধা, নহ শিশু, নহ নাবালিকা
হে তরুণী রূপসী শ্যালিকা।”

দিনু ঠাকুর: নগেন আইচ বলে এক ভদ্রলোক শান্তিনিকেতনে বাংলা পড়াতেন। কেউ তাকে কখনো গান গাইতে শোনেনি। কিন্তু গভীর রাত হলেই তাকে গানে পেত। জানালার পাশে বসে আপন মনে গান ধরতো মেজাজে। পাশাপাশি বাড়িতেই থাকতেন দিনু ঠাকুর। বিশ্রামের ব্যাঘাত হতো তাঁর। এ বেসুরো গান শুনে চুপ করে বসে থাকাই যেন দায় হয়ে যেত। নগেন আইচ একদিন যেই না গান ধরেছেন, দিনু ঠাকুর রেগে গিয়ে এসরাজ নিয়ে জুড়ে দিলেন একটি প্যারোডি গান:-
গভীর রাতে তোমার অত্যাচার
নগেন আইচ শত্রু হে আমার
তোমার গান কান্না সম
আসেনা ঘুম নয়নে মম
দুয়ার খুলি হে মোর যম
তোমায় তাড়াই বারেবার।

 

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait