সামাজিক গল্প - দৃষ্টি (প্রথম পর্ব)

সামাজিক গল্প - দৃষ্টি (প্রথম পর্ব)

প্রথম পর্ব

 

"সৃজা.. , সৃজা.. তাড়াতাড়ি এসো দেরী হয়ে যাচ্ছে, এখনও খাওয়া হয়নি তোমার ।"

ব্যাগের ভিতরে টিফিন কৌটো ভরতে ভরতে মেয়েকে আদুরে সুরে ডাক দেয় ঊমা। সৃজা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। পড়াশোনায় মোটামুটি ভালই। অনেক ভেবে ঊমা ও অরূপ তাদের মেয়ের নাম রেখেছে সৃজনী। কিন্তু ওরা সৃজনীকে সৃজা বলেই ডাকে। পারিবারিক ভাবে দেখাশোনা করেই অরূপ ও ঊমার বিয়ে হয়েছে। ওদের দুজনকে দেখে সবাই ভাবে ওদের হয়তো ভালোবেসে বিয়ে। কিন্তু ভালোবাসাটা ওদের মধ্যে হয়েছে বিয়ের পরে। দুজনের মধ্যে বণ্ডিংটা ভীষণ ভালো। কর্মসূত্রে ওরা নিজেদের বাড়ি ছেড়ে সংসার পেতেছে আলাদা।ছুটির সময় বাড়িতে গেলে  সৃজনী দাদু, ঠাম্মি আর কাকাই এর সাথে সারাদিন কাটিয়ে দিলেও ঘণ্টায় একবার করে মাকে দেখে যাওয়া চায়। বড্ড মা নেওটা। ঊমাও নিজের সবটা দিয়ে মেয়েকে মনের মতো করে মানুষ করে তুলছে। ভালোবাসার সাথে অনুশাসনও আছে। পড়াশোনার সাথে ছবি আঁকা ও আবৃত্তি শেখে সৃজনী। আবৃত্তির শিক্ষা চলে তার মায়ের কাছে। আর আঁকা বাবার কাছে। নিজেদের কাজ ছাড়া ঊমা ও অরূপের বেশিরভাগ সময় কাটে সৃজার সাথে। সৃজারও পুরো দুনিয়া জুড়ে রয়েছে তার বাবা - মা। 

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

অরূপ একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে। ভালোই স্যালারি পায়। কিন্তু কাজের চাপ খুব বেশি, মাঝে মধ্যে বাইরেও যেতে হয়।

 অরূপকে অফিসের জন্য সবকিছু রেডি করে দিয়ে মেয়ের তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঊমা। অরূপ অফিসে বেরিয়ে গেলে মমতা মেয়েকে নিয়ে  স্কুলে যায়। ওকে দিয়ে এসে সংসারের বাকি কাজকর্ম গুলো শেষ করে। রাতের রান্নাটাও করে রাখে।মেয়ের পড়াশোনা, আঁকা, আবৃত্তি সবকিছুর দায়িত্ব নিখুঁতভাবে পালন করে ঊমা। সপ্তাহে তিনদিন  সৃজা ওর বান্ধবী আলোর  বাড়িতে যায় অঙ্ক করতে। আলোর মা খুব ভালো অঙ্ক করান। শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখলেও তা আর বাস্তবে রূপ পায়নি। তাই বাড়িতে টিউশনি পড়িয়ে নিজের ইচ্ছেটা আংশিক পূরণ করার চেষ্টা করেন।

মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে ৫ টার সময় আলোর বাড়ি দিয়ে আসে ঊমা আর অরূপ অফিস ফিরতি পথে রাত সাতটার সময়  মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। ঊমা সপ্তাহে দুদিন বিকেলে ঐ পাড়ার ও আশপাশের কিছু ছেলে মেয়েকে আবৃত্তি শেখায়। ওদের সাথে সৃজনী ও আবৃত্তি শেখে। তখন ঊমা সৃজনীর সাথে মায়ের মতো নয় একজন শিক্ষিকার মতো ব্যবহার করে। শিক্ষিকা হিসেবে সম্মান ও পায় যথেষ্ট। রাস্তা ঘাটে চলতি পথে ছাত্রদের সঙ্গে দেখা হলেই তারা বিভিন্ন ভাবে সম্বোধন করে কথা বলে। কেউ বলে ম্যাম, কেউ দিদিমণি আবার কেউ বলে মণি। মণি ডাকটা ঊমার ভীষণ প্রিয়। কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় ডাকটা শুনলে। যারা খুব ছোটো তারা দিদিমণি ডাকটাকে নিজের মনের মতো করে নিয়ে ছোট্ট করে মণি বলে ডাকে। ছাত্রদের বাড়ির লোকজনও যথেষ্ট সম্মান করে তাকে।তাদের দৃষ্টিতে নিজের জন্য ভালোবাসা আর সম্মান দেখতে ভালোই লাগে ঊমার। 

আঁকা ও আবৃত্তির পাশে ঊমা আরও একটা জিনিস মেয়েকে শেখানোর চেষ্টা করে, সেটা হল অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। ঊমার একমাত্র এই স্বভাবটাই ওর শ্বাশুড়ি পছন্দ করে না। উনার বক্তব্য, "মেয়ে মানুষের কথায় কথায় অতো প্রতিবাদ কিসের। যেন দুনিয়া উদ্ধার করতে নেমেছে। সংসার করতে গেলে একটা মেয়েকে কতো কিছু সহ্য করতে হয়, অত মান-অপমান, ন্যায় - অন্যায় বোধ নিয়ে বসে থাকলে দুদিনে সংসার লাটে উঠবে। একটু চুপ করে থাকলে লাভ বৈ ক্ষতি তো কিছু নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা।নিজের সাথে সাথে আমার নাতনিটাকেও একই শিক্ষা দিচ্ছে। আরে বাবা ওকে তো পরের ঘরে যেতে হবে। ওখানে গিয়ে কী সৃজা তোমার মতো জ্ঞান দিয়ে বেড়াবে সবাইকে।"

শ্বাশুড়ির এই কথাগুলো শুনে ঊমা রাগের পরিবর্তে হেসে বলে, "মা, যারা ন্যায় - অন্যায় বোধ ভুলে বসে আছে তাদেরকে একটু মনে করিয়ে দিলে লাভ বৈ ক্ষতি তো কিছু নেই।"

চাকরি সূত্রে অরূপকে পাড়ি দিতে হয়েছে বাড়ি থেকে দূরে। একটা বাড়ি ভাড়া করে ঊমাকে নিয়ে বসিয়েছে নিজের ছোট্ট সংসার। এই জায়গাটায় আসা বছর খানেক আগে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ চাকুরীজীবি আর বেশিরভাগ বাড়িই আগেকার তৈরী। কিছু বাড়ি তৈরী ফ্ল্যাট সিস্টেমে। এরকমই একটা বাড়ির একতলাটা ভাড়া নিয়ে  অরূপ, ঊমা ও সৃজাকে নিয়ে থাকে আর দোতলায় বাড়ির মালিক ৭৮ বছর বয়সী সুখেন পোদ্দার, তার স্ত্রী, ছেলে, বৌমা আর সৃজার বয়সি এক নাতনিকে নিয়ে বসবাস করেন। ঊমাদের সাথে তাদের বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে সুখেন পোদ্দারের সঙ্গে সৃজার। ঊমার সংসারে নেই কোনো আড়ম্বর আর না আছে সামর্থের বাইরে বিলাসিতা। নিজের হাতে একটু একটু করে সংসার সাজিয়েছে ঊমা। আর সেই সংসারকে পূর্ণতা দিয়েছে সৃজনী।

মাথার দুদিকে বাঁধা বিনুনিদুটো হাতে নিয়ে লাফাতে লাফাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সৃজনী। ঊমা মেয়ের একহাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দেয়। খাওয়া শেষে স্কুলে দিয়ে আসে। স্কুল থেকে আলোর সঙ্গে বাড়ি চলে আসে সৃজনী। এখান থেকে স্কুল খুব দূরে নয়।

 টেবিলে বই খুলে অন্যমনস্কভাবে সামনের দেওয়ালে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৃজা। পড়াতে একটুও মনোযোগ নেই। স্কুল থেকে এসেও কিছু খায়নি, খিদে নেই বলেই ঘরে চলে এসেছে। মেয়ের মুখে চিন্তা আর অন্যমনস্কভাব দেখে ঊমা জানতে চায় কী হয়েছে। মায়ের দিকে কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে দেখেই জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সৃজা। ঊমা মেয়ের কান্না দেখে ভয় পেয়ে যায়। মেয়েকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জানতে চায় কী হয়েছে। কান্নার জন্য কথাও বলতে পারছে না সৃজা। ঊমা জানে কান্না না কমলে সৃজা কিছুই বলবে না। তাই কিছুক্ষণ সময় দেয় মেয়েকে শান্ত হওয়ার জন্য।
কান্নার রেশ কমলে মেয়েকে জানতে চায়, "কী হয়েছে সৃজা, এভাবে কাঁদছো কেন?"

সৃজা কোনো উত্তর না দিয়ে মাথাটা নীচু করে আছে।

- "বলো কী হয়েছে? মা কে বলো সোনা"।

সৃজার কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে ঊমা বলে, "আচ্ছা মাকে বলতে হবে না। কিন্তু তোমার বেস্টফ্রেন্ডকে তো বলবে তাই না। আমি না তোমার বেস্টফ্রেন্ড।"

মায়ের কথা শুনে সৃজা ভয়ে ভয়ে বলে, "আগে প্রমিস করো তুমি বকবে না।"

মেয়ের মুখটা তুলে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ঊমা বলে, "তুমি কি কোনো অন্যায় করেছো? আচ্ছা বেশ বকবো না, এবার বলো কী হয়েছে।" 

সৃজা ভয়ে ভয়ে আস্তে করে বলে, "মা আজকে আমি মানিক না কি জানি নাম ওকে চড় মেরেছি।"

 মেয়ের কথা শুনে যার পর নাই আশ্চর্য হয়ে ঊমা বলে, "চড় মেরেছো!! কেন? কখন মেরেছো!!"

সৃজা ভীত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, "বাড়িতে আসার সময়। আমি আর আলো যখন স্কুল থেকে আসছিলাম তখন মানিক নামের ছেলেটা আমাদের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে বাজে কথা বলছিল। আমি অনেকবার সরতে বলেছিলাম কিন্তু সরেনি। উল্টে আমার হাত ধরে টান দেয়। তখনই আমি রাগে ওর গালে চড় মেরে দিই। আমার ভয় করছে মা।" 

মেয়ের কথা শুনে ঊমার নিজেরই রাগ উঠছে। মেয়েকে দুহাত দিয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে মনে মনে ভাবে, "ভদ্রলোকের পাড়ায় কিছু অভদ্র ছেলে জুটেছে। লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিয়ে রাস্তার মোড়ে বসে মেয়েদের বিরক্ত করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই এদের। বাবার পয়সার জোরে যা খুশি তাই করছে। এই ছেলেগুলোর জন্য রাস্তাঘাটে বেরোবার যো নেই।" আর পাড়ার বাকি ভদ্রলোকেরা নিজেদের ভদ্রতা বজায় রাখছে কোনো ঝামেলায় না জড়িয়ে। 

ঊমা কিছুক্ষণ চিন্তা করে, এই নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না সৃজাকে। অরূপ এলে ওকে আগে জানবে। এমনিতেই মেয়েটা ভয় পেয়ে আছে। যা জানার পরে জিজ্ঞেস করবে।
পরিবেশকে হালকা করার জন্য ঊমা বলে, "ওসব ভাবা বন্ধ কর্। এখন চল্ আজকে আমরা দুই বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুকে (অরূপ) একটা সারপ্রাইজ দিই।"

- "কী সারপ্রাইজ মা।"

ঊমা একটু চিন্তা করে বলল, "তুই আর আমি মিলে বিরিয়ানি বানালে কেমন হবে।"

সৃজা লাফিয়ে উঠে বলে, "দারুণ আইডিয়া মা। আজকে বিরিয়ানি কিন্তু আমি বানাবো, তুমি হবে আমার হেল্পার।"

- "ওকে, ডান। আজকে নো পড়া, অনলি আনন্দ।"

- "স্ক্রাউন্ডেলটার সাহস হয় কী করে আমার মেয়ের হাত ধরার। ওর হাত আমি কেটে ফেলবো।"

- "কী করছো কী অরূপ, আস্তে কথা বলো। পাশের ঘরে সৃজা আছে। এখনও ঘুমায়নি।"

নিজেকে সংযত করে অরূপ বলে, "এখানে আর থাকবো না। ফ্ল্যাটটা দিতে এখনও দেড় মাস বাকি ততদিনে না হয় অন্য কোথাও থাকবো। ঊমা তুমি একদম সৃজাকে একা ছাড়বে না। সবসময় চোখে চোখে রাখবে। এবার থেকে তুমি গিয়ে স্কুল থেকে নিয়ে আসবে। দিন সময় একদম ভালো নয়। জায়গাটাকে ভালো মনে করে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম আমি বাইরে থাকলে তোমরা সেফ থাকবে। কিন্তু এখন দেখছি আমার মনে করাটাই ভুল ছিল।"

অরূপের কাঁধে হাত দিয়ে ঊমা বলে, "মেয়েদের জন্য কোনো জায়গাই সেফ নয় গো। কোথায় কে কখন হায়নার দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে বোঝা মুশকিল। শোনো তুমি আজকে এই ঘরে একা থাকো, আমি সৃজার সঙ্গে ওঘরে থাকছি। মেয়েটাকে একা রাখা ঠিক হবে না। খুব ভয় পেয়েছে।" 

"তার দরকার নেই, আমি সৃজাকে এই ঘরে নিয়ে আসছি। তিনজনে একসঙ্গে থাকবো। তাছাড়া সবাই একসাথে থাকলে সৃজারও ভালো লাগবে।"

অরূপকে যেতে দেখে ঊমা বলে ওঠে, "একটু ঠান্ডা মেজাজে কথা বোলো।"
অরূপ ঘুরে ঊমার কাছে এসে বলে," আমি কি কখনও সৃজার সাথে চিৎকার করে কথা বলেছি, ঐ ডিপার্টমেন্টটা তোমার।"

ঊমা সংকোচের সঙ্গে বলল, "না আমি সেটা বলতে চাইনি, কথাটা শুনে তো তুমি খুব রেগে গিয়েছো তাই বললাম আরকি।"

- "আমার রেগে যাওয়াটা কি অস্বাভাবিক? বেশ তাহলে এক কাজ করো, ওঘরে যাওয়ার আগে তুমি আমার রাগটা কমিয়ে দাও।"

ঊমা হা করে অরূপের দিকে তাকিয়ে বলল, "কিছুক্ষণ আগেই না তুমি রেগে ছিলে, আর এখন এসব কথা বলছো।" 

- "যা বাবা ভুল কী বললাম!"

- "তোমাকে বেশি ঠিক বলতে হবে না, যাও মেয়েকে নিয়ে এসো, আর ওর বালিশটাও নিয়ে এসো।"

ঊমা খাটের এককোনে বসে বাবা আর মেয়ের কাণ্ড দেখছে। অরূপের কথায় মাঝে মাঝেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে সৃজা। আজকে ঊমাকে একপাশে করে দিয়ে বাবা মেয়ে জুটি বেঁধেছে। গল্পের মাঝে অরূপ সৃজাকে বুঝিয়ে বলে ও যেন এভাবে কারও গায়ে হাত না তোলে। ভালো মেয়েরা এরকম আচরণ করে না। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাসি গল্পের পর ক্লান্ত হয়ে সৃজা বাবার হাতে মাথা রেখেই ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়। 

 

ক্রমশঃ...


0 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 21st Nov, 21 07:19 am

পরের পর্বের অপেক্ষায়....

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait