রবীন্দ্রনাথের জীবনের কিছু পয়লা ঘটনা

রবীন্দ্রনাথের জীবনের কিছু পয়লা ঘটনা

পয়লা বৈশাখজন্মদিন পালন:

কবির বয়স বাড়ছেশান্তিনিকেতনে তখন প্রচণ্ড দাবদাহগ্রীষ্মাবকাশের ছুটির কারণে পঁচিশে বৈশাখ নাগাদ আশ্রম চত্বর খাঁ খাঁ করেকবির সম্মতি নিয়েই আশ্রমিকরা ঠিক করেন ১৯৩৬ সালের নববর্ষের দিন বর্ষবরণের পর কবির জন্মদিন পালন করা হবেকবি ৭৫ বছরে পা দেনউদারমনা কবি এই প্রস্তাবকে সাদরে গ্রহণ করলেনএরপর থেকে নববর্ষের দিনই শান্তিনিকেতনে কবির জন্মদিন পালিত হত

ADVERTISEMENT

১৯৪০ সালের নববর্ষে, জন্মোৎসবে শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে সেদিন গানের সঙ্গে পাঠ চলছে, কবির বিভিন্ন লেখা থেকেশান্তিনিকেতনসংকলন থেকে পড়া হয়েছিলনববর্ষপ্রবন্ধআজ নববর্ষের প্রাতঃসূর্য এখনো দিক্প্রান্তে মাথা ঠেকিয়ে বিশ্বেশ্বরকে প্রণাম করে নিইএই ব্রাহ্মমুহূর্তে আমরা আশ্রমবাসীরা আমাদের নূতন বৎসরের প্রথম প্রণামটিকে আমাদের অনন্তকালের প্রভুকে নিবেদন করবার জন্যে এখানে এসেছি এই প্রণামটি সত্য প্রণাম হোক এই-যে নববর্ষ জগতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, কি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছে? আমাদের জীবনে কী আজ নববর্ষ আরম্ভ হল?

এমনকী ১৯৪১ সালের পয়লা বৈশাখেও পঁচিশের শঙ্খধ্বনি বেজেছিলপরদিন ১৫ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর ছাপা হল, ‘সূর্য্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে মন্দিরে উপাসনা আরম্ভ হয়অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন আচার্য্যের আসন গ্রহণ করেন...অনুষ্ঠানে কয়েকটি সঙ্গীত গান করা হয়ইহার মধ্যে দুইটি কবিগুরু কর্ত্তৃক এই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে রচিত — ‘হে পুরুষোত্তমএবংএস হে মহামানব ( মহামানব আসে)সেদিন রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসবের ভাষণ ছিলসভ্যতার সংকট

পয়লা জন্মদিন:

পঁচিশে বৈশাখ আনুষ্ঠানিক ভাবে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁর ভাগ্নি সরলা দেবীঅর্থাৎ ১৮৮৭ সালের (১২৯৪) মে প্রথম পঁচিশে বৈশাখের উৎসব শুরু হয়েছিলরবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ছাব্বিশ বছরতবে তার আগের বছর অর্থাৎ ১৮৮৬ সালের ২৫শে বৈশাখ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখছেন, আজ আমার জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ-পঁচিশ বৎসর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম জীবনে এখন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন

বলাই বাহুল্য, বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়ে, ভাইপো ভাইঝি, ভাগ্নে-ভাগ্নীদের কাছে রবীন্দ্রনাথের সমাদরের অন্ত ছিল নারবি মামার প্রতি সরলা দেবীরও ছিল গভীর ভক্তিসেই ভক্তিবশতই তিনি তাঁর রবি মামারজন্মদিনউৎসব সূচনা করলেনসরলা দেবী তাঁর আত্মজীবনীজীবনের ঝরাপাতা’-য় সেই প্রথম জন্মদিন-উৎসব, সেই প্রথম পঁচিশে বৈশাখ পালনের বর্ণনা দিয়েছেনতিনি লিখেছেন, রবিমামার প্রথম জন্মদিন-উৎসব আমি করাই তখন মেজমামা (সত্যেন্দ্রনাথ) নতুনমামার (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) সঙ্গে তিনি ৪৯ নং পার্ক স্ট্রীটে থাকেন অতি ভোরে উল্টাডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রীটে নিঃশব্দে তাঁর ঘরে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা বাজার থেকে আনান বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল একজোড়া ধুতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম তখন আর সবাই জেগে উঠলেন পাশেই নতুনমামার ঘররবির জন্মদিনবলে একটা সাড়া পড়ে গেল সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হলসরলা দেবীর দাদা জ্যোৎস্নানাথ একটি বই উপহার দেন— ‘‌THE POEMS HEINE‌‌’‌‌‌এর পর থেকে পারিবারিক সীমারেখার মধ্যেই কবির জন্মদিন নিয়মিত ভাবে পালিত হয়ে এসেছেপরিজনের বাইরে, কবি প্রিয়ম্বদা দেবী তাঁকে একটি বাঁধানো নোটবই উপহার দেনপরবর্তিকালে এই সুন্দর নোটবুকে রবীন্দ্রনাথ ‘‌সোনার তরী’‌, ‘‌চিত্রা’‌ কাব্যের অনেকগুলি কবিতা লিখেছিলেনপ্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র–‌ভ্রাতুষ্পুত্রী সুরেন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবী জন্মদিনের উপহার হিসেবে সুরি বাবি, ২৫ বৈশাখ ১২৯৮ লিখে HERBERT SPENCER–‌এর অনেকগুলি বইয়ের মূল্যবান সংস্করণ উপহার দিয়েছিলেন

পয়লা চিঠি:

চার বছর বয়স থেকে আশি বছর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ প্রচুর চিঠি লিখেছেনপ্রথম চিঠি তিনি লিখেছিলেন বাবাকেজমিদারী সেরেস্তার কর্মচারী মহানন্দ বাবু কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ চেয়ে নিয়ে ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ বাবা দেবেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেনপ্রথম দুএকটি চিঠি বাবার হস্তগত হলেও পরের বহু চিঠি পৌঁছোয়নিকারণ সেরেস্তার কর্মচারীরা শিশু রবীন্দ্রনাথের এই লেখা পত্রের প্রতি শেষ পর্যন্ত তেমন আগ্রহ দেখাননিরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁরজীবনস্মৃতিতে বাবাকে প্রথম চিঠি লেখার অভিজ্ঞতার কথা এভাবে বর্ণনা করেছেন : বেশ মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় কোনো এক সময় গবরমেন্টের চিরন্তন জুজু রাশিয়া কর্তৃক ভারত আক্রমণের আশঙ্কা লোকের মুখে আলোচিত হইতেছিলএইজন্য মার মনে অত্যন্ত উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াছিল বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই কেহ তাঁহার এই উৎকণ্ঠা সমর্থন করেন নাই মা সেই কারণে পরিণত বয়স্ক দলের সহায়তা লাভের চেষ্টায় হতাশ হইয়া শেষকালে এই বালকের আশ্রয় করিলেন আমাকে বলিলেন, ‘রাশিয়ানদের খবর দিয়া কর্তাকে একখানা চিঠি লেখো তো মাতার উদ্বেগ বহন করিয়া পিতার কাছে সেই আমার প্রথম চিঠি কেমন করিয়া পাঠ লিখিতে হয়, কী করিতে হয় কিছুই জানি না দফতর খানায় মহানন্দ মুনশির শরণাপন্ন হইলামএই চিঠির উত্তর পাইয়াছিলাম তাহাতে পিতা লিখিয়াছেন, ভয় করিবার কোনো কারণ নাই, রাশিয়ানকে তিনি স্বয়ং তাড়াইয়া দিবেন

পয়লা প্রেম অনুভূতি:

সবার মতো করে রবীন্দ্রনাথও কিশোর বয়স পার করেছেনআর দশজন যেমন করে প্রথম প্রেমের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মাতাল হয়ে পড়ে, রবীন্দ্রনাথকেও সেই হাওয়া দোলা দিয়ে গিয়েছিলযার প্রভাব তার জীবনে পড়েছিল এবং সেটা খুব ভালো করেইকিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথম প্রেমের জোয়ার এনে দিয়েছিল বোম্বের এক মেয়ে, নাম আন্না তড়খড়; রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দিয়েছিলেন নলিনীঘটনা ১৮৭৮ সালেররবীন্দ্রনাথের সাথে তার দেখাই বা হলো কী করে? পরবর্তীকালে যে নারীকে তিনি অমর করে রেখেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে? এমন এক প্রেমের গল্প রবীন্দ্রনাথের মুখেই শোনা যাক,

- মেজদাদা মনে করলেন, বিদেশকে যারা দেশের রস দিতে পারে সেইরকম মেয়েদের সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দিতে পারলে হয়তো ঘরছাড়া মন আরাম পাবে ইংরেজি ভাষা শেখবারও সেই হবে সহজ উপায় তাই কিছুদিনের জন্যে বোম্বাইয়ের কোনো গৃহস্থঘরে আমি বাসা নিয়েছিলুম সেই বাড়ির কোনো-একটি এখনকার কালের পড়াশুনোওয়ালা মেয়েঝকঝকে করে মেজে এনেছিলেন তার শিক্ষা বিলেত থেকে আমার বিদ্যে সামান্যই, আমাকে হেলা করলে দোষ দেওয়া যেতে পারত না তা করেন নি পুঁথিগত বিদ্যা ফলাবার মতো পুঁজি ছিল না, তাই সুবিধে পেলেই জানিয়ে দিতুম যে কবিতা লেখবার হাত আমার আছে আদর আদায় করবার ছিল আমার সবচেয়ে বড়ো মূলধন র্যার কাছে নিজের এই কবিআনার জানান দিয়েছিলেম তিনি সেটাকে মেপেজুখে নেন নি, মেনে নিয়েছিলেন কবির কাছ থেকে একটা ডাকনাম চাইলেন, দিলেম জুগিয়ে- সেটা ভালো লাগল তার কানে ইচ্ছে করেছিলেম সেই নামটি আমার কবিতার ছন্দে জড়িয়ে দিতে বেঁধে দিলুম সেটাকে কাব্যের গাথুনিতে ; শুনলেন সেটা ভোরবেলাকার ভৈরবী সুরে ; বললেন, “কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধ হয় আমার মরণদিনের থেকেও প্ৰাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারিএর থেকে বোঝা যাবে, মেয়েরা যাকে আদর জানাতে চায় তার কথা একটু মধু মিশিয়ে বাড়িয়েই বলে, সেটা খুশি ছড়িয়ে দেবার জন্যেই মনে পড়ছে তার মুখেই প্ৰথম শুনেছিলুম আমার চেহারার তারিফ সেই বাহবায় অনেক সময় গুণাপনা থাকত যেমন, একবার আমাকে বিশেষ করে বলেছিলেন, ‘একটা কথা আমার রাখতেই হবে, তুমি কোনোদিন দাড়ি রেখো না, তোমার মুখের সীমানা যেন কিছুতেই ঢাকা না পড়ে' তার এই কথা আজ পর্যন্ত রাখা হয় নি, সে কথা সকলেরই জানা আছে আমার মুখে অবাধ্যতা প্রকাশ পাবার পূর্বেই তার মৃত্যু হয়েছিল l

১৯২৭ সালের জানুয়ারি অতুলপ্রসাদ সেন দিলীপকুমার রায়ের সাথে আলাপে রবীন্দ্রনাথ এই তরুণীর কথা স্মরণ করেছেন, তখন আমার বয়স বছর ষোলো আমাকে ইংরেজি কথা বলা শেখানোর জন্যে পাঠানো হলো বম্বেতে একটি মারাঠি পরিবারে...সে পরিবারের নায়িকা একটি মারাঠি ষোড়শী যেমন শিক্ষিতা, তেমনি চালাক-চতুর, তেমনি মিশুক...তার স্তাবক-সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না- বিশেষ আরও এই জন্যে যে, বয়সেই সে একবার বিলেত চক্র দিয়ে এসেছিল সে সময়ে মেয়েদের বিলেত-যাওয়া আজকের মতন পাড়া-বেড়ানো গোছের ছিল না, মনে রেখো
আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত কত ছুতো করেই সে ঘুরত আমার আনাচে কানাচে আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিতো সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে
একথা আমি মানব যে আমি বেশ টের পেতাম যে ঘটবার মতন একটা কিছু ঘটছে, কিন্তু হায় রে, সে-হওয়াটাকে উস্কে দেওয়ার দিকে আমার না ছিল কোনোরকম তৎপরতা, না কোনো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব

একদিন সন্ধ্যাবেলা...সে আচম্কা এসে হাজির আমার ঘরে চাঁদনি রাত চারদিকে সে যে কী অপরূপ আলো হাওয়া!...কিন্তু আমি তখন কেবলই ভাবছি বাড়ির কথা ভালো লাগছে না কিছুই মন কেমন করছে বাংলাদেশের জন্যে, আমাদের বাড়ির জন্যে, কলকাতার গঙ্গার জন্যে হোমসিকেনস যাকে বলে

সে বলে বসল, “আহা, কী এত ভাবো আকাশপাতাল!” তার ধরন-ধারণ জানা সত্ত্বেও আমার একটু যেন কেমন কেমন লাগল কারণ সে প্রশ্নটি করতে না করতে একেবারে আমার নেয়ারের খাটির উপরেই এসে বসল কিন্তু কী করি- যা হোক হুঁ হাঁ করে কাজ সেরে দিই সে কথাবার্তায় বোধহয় জুৎ পাচ্ছিল না, ‘আচ্ছা, আমার হাত ধরে টানো তোটাগ্-অফ-ওয়ারে দেখি কে জেতে?’

আমি সত্যিই ধরতে পারি নি, কেন হঠাৎ তাঁর এতরকম খেলা থাকতে টাগ্-অফ-ওয়ারের কথাই মনে পড়ে গেল এমনকি আমি শক্তি পরীক্ষায় সম্মত হতে না হতে সে হঠাৎ শ্লথভাবে হার মানা সত্বেও আমার না হল পুলক-রোমাঞ্চ, না খুলল রসজ্ঞ দৃষ্টিশক্তি এতে সে নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিশেষ রকম সন্দিহান হয়ে পড়েছিল
শেষে একদিন বলল, তেমনি আচমকা: “জানো কোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার?” বলে খানিক বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল নিদ্রাবেশে ঘুম ভাঙতেই সেই চাইল পাশে তার দস্তানার দিকে একটিও কেউ চুরি করে নি

রসশাস্ত্রের বিচারে আন্নাকে অনেকটা প্রগল্ভা নায়িকার পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাছে না হলেও পরিণত রবীন্দ্রনাথের কাছে সে প্রেম যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করেছে

উপরোক্ত কথোপকথনের সূত্রেই তিনি বলেছিলেন, কিন্তু সে মেয়েটিকে আমি ভুলিনি বা তার সে আকর্ষণকে কোনো লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনো দিন আমার জীবনে তারপরে নানা অভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে- বিধাতা ঘটিয়েছেন কত যে অঘটন- কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি গৌরব করে যে, কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনো ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি- তা সে ভালোবাসা যেরকমই হোক না কেন প্রতি মেয়ের স্নেহ বলো, প্রীতি বলো, প্রেম বলো, আমার মনে হয়েছে একটা প্রসাদ – favour; কারণ এটা আমি বরাবরই উপলব্ধি করেছি যে প্রতি মেয়ের ভালবাসা তা সে যে-রকমের ভালবাসাই হোক না কেনআমার মনের বনে কিছু না কিছু আফোটা ফুল ফুটিয়ে রেখে যায়সে ফুল হয়ত পরে ঝরে যায়, কিন্তু তার গন্ধ যায় না মিলিয়ে

আনা- প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ সর্বশ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি দিয়েছেন শেষ বয়সে: জীবনযাত্রার মাঝে মাঝে জগতের অচেনা মহল থেকে আসে আপন মানুষের দূতী, হৃদয়ের দখলের সীমানা বড়ো করে দিয়ে যায়না ডাকতেই আসে, শেষকালে একদিন ডেকে আর পাওয়া যায়নাচলে যেতে যেতে বেঁচে-থাকার চাদরটার উপরে ফুলকাটা কাজের পাড় বসিয়ে দেয়, বরাবরের মতো দিনরাত্রির দাম দিয়ে যায় বাড়িয়ে

আন্নার প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি দিয়েছেন শেষ বয়সেপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অনুমান করেছেন, শৈশবসংগীত কাব্যগ্রন্থেরফুলের ধ্যানঅপ্সরা-প্রেমকবিতা দুটিতে এই তরুণীর মর্মবেদনা কবির ভাষায় রূপ পেয়েছে এবংআমি স্বপনে রয়েছি ভোর, সখী, আমারে জাগায়ো নাগানটির মধ্যে দস্তানা চুরির কৌতুককর কাহিনীর স্মৃতি জড়িয়ে আছেমালতীপুঁথি'তে পাওয়া না গেলেও রবিজীবনীকারের ধারণাভগ্নহৃদয়কাব্যের চতুর্থ সর্গে কবির অষ্টম গানটি—‘শুনেছিশুনেছি কি নাম তাহার—/শুনেছিশুনেছি তাহা!/নলিনীনলিনীনলিনী—/ কেমন মধুর আহা!’ ইত্যাদি আন্না-কে লক্ষ্য করেই রচিত

রবীন্দ্রনাথের গ্যেটে তাঁহার প্রণয়িনীগণ প্রবন্ধে এক জায়গায় আছে, ‘এক প্রকার তাস খেলা আছে, হারিলে চুম্বন দিতে হয়- গ্যেটে এই চুম্বনের পরিবর্তে কবিতা উপহার দিতেনকিন্তু যে মহিলার তাঁহার নিকট হইতে চুম্বন প্রাপ্য থাকিত তাঁহার যে মর্ম্মে আঘাত লাগিত তাহা বলা বাহুল্যএই বর্ণনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কোনো যোগ আছে কি না সেটা রসজ্ঞ পাঠকদের অনুমেয়- বলেছেন রবিজীবনীকার

১৮৭৯ সালের ১১ নভেম্বর বরোদা কলেজের উপাধ্যক্ষ হ্যারন্ড লিট্লেডলের সঙ্গে আন্নার বিয়ে হয়আন্নার মৃত্যু হয় ১৮৯১ সালের জুলাই এডিনবরা শহরে
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিবাহিত জীবনেও আন্না রবীন্দ্রনাথকে ভোলেননিসেই কিশোর-কবির প্রদত্ত আদরের ডাক নামনলিনীস্বাক্ষরেই তিনি প্রবন্ধাদি প্রকাশ করতেনতার অপেক্ষাকৃত পরিণত মনেও সেইআপন-মানুষের দূতগভীর স্বাক্ষর এঁকে দিয়েছিলেন, তারই প্রমাণ প্রসঙ্গে এই তথ্যটিও উল্লেখযোগ্য যে, তার এক ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম রাখা হয়েছিলরবীন্দ্রনাথ

পয়লা বিদেশ ভ্রমণ- সমুদ্র যাত্রা

ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের স্কুল-কলেজ বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি অনীহা ছিলোজমিদার পরিবারের ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে তাই বাড়িতেই গৃহ শিক্ষক রেখে প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি দেয়া হয়

কৈশোর জীবনের শেষ দিকে তাঁর ভালো পড়াশোনার জন্য দাদা সত্যেন্দ্রনাথ প্রস্তাব করেন রবীন্দ্রনাথকে বিলেত পাঠিয়ে দেয়া হোকসেখানকার লেখাপড়া হয়তো তাঁর ভালো লাগবেযেই ভাবা সেই কাজমাত্র ১৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ যাত্রা করেন বিলেত পানেশুরু হলো তাঁর বিশ্বযাত্রা
যাত্রার আদ্যোপান্ত অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁরয়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরী’ ‘জীবনস্মৃতিপ্রভৃতি গ্রন্থে

বিলেতের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে রবীন্দ্রনাথ জাহাজে চড়ার কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েনজাহাজের যাত্রা, পরিবেশ, আবহাওয়ার সাথে তখনও খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি তিনিকেতাবি ভাষায়, এই অসুস্থতাকে অবশ্য ‘Sea Sickness’ নামে অভিহিত করা হয়এইসমুদ্র ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কিশোর কবি একেবারে টি দিন বিছানায়মাথাটিও তুলবার জো ছিলো নাসে সময় জাহাজের জনৈকস্টুঅর্ডতাঁকে পরম মমতায় খাইয়ে দিতেনসেকথা ভুলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ,

আমাদের যে স্টুঅর্ড ছিল ... আমার উপর তার বিশেষ কৃপাদৃষ্টি ছিল দিনের মধ্যে যখনতখন সে আমার জন্য খাবার নিয়ে উপস্থিত করত; ... বলত না খেলে আমি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়ব (weak as a rat)

'দিন পর যখন কবি শয্যা ছেড়ে উঠলেন, তখন দেখলেন, আসলেই তিনি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছেনআমার কথা ছেড়ে কিশোর রবির ভাষাতেই শুনুন,

উঠে দেখি যে সত্যিই ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছি মাথা যেন ধার করা, কাঁধের সাথে তার ভালোরকম বনে না; চুরি করা কাপড়ের মতো শরীরটা আমার যেন ঠিক গায়ে লাগছে না ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতের উপর গিয়ে একটা কেদারায় হেলান দিয়ে পড়লেম অনেকদিন পর বাতাস পেয়ে বাঁচলেম

জাহাজে যাত্রাকালে তিনি নানা রুপের নানা চরিত্রের বিদেশিদের দেখলেন, সেখানে নিতান্ত ভদ্র-সভ্য-বিনয়ী ইংরেজ যেমন দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন কর্কশ-ভাষী অসৌম্য ব্যক্তিদেরওমার্জিত রুচির ইংরেজদের ব্যবহারে কবি যেমন পুলকিত হয়েছেন, তেমনি রূঢ় স্বভাবের ইংরেজদের অমার্জিত আচরণে তিনি ব্যথিত হয়েছেনএমন কত ঘটনা দেখেছেন তিনি, আশ্চর্য হয়েছেনআর আমরা আশ্চর্য হই তাঁর সৃষ্টিশীল হাতের ছোঁয়ায় লেখা এসব ভ্রমণ কাহিনী পাঠ করে!

এডেন থেকে জাহাজে করে সুয়েজ যেতে তাঁদের পাঁচ দিন লেগেছিলসুয়েজে নেমে নৌকোয় করে খানিকটা পথ এগিয়ে ট্রেনে করে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে পৌঁছে সেখান থেকে স্টিমারে চেপে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইতালি পৌঁছান কবিকবি জানতেন যে, আফ্রিকা এক অনুর্বর মরুভূমির নাম; অন্তত বই-পুস্তকে তো তেমনটিই পড়েছেনকিন্তু বাস্তবে দেখলেন উল্টোরাস্তার দু'পাশে তিনি বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত দেখেছেন, দেখেছেন থোকায় থোকায় খেজুরশুদ্ধ গাছ, আরো কত কী!

হাঁটতে হাঁটতে একেবারে ধূলোবালি মেখে মলিন বদনে পৌঁছলেন আলেকজান্দ্রিয়াবন্দরে তাদের জন্য অপেক্ষমাণমঙ্গোলিয়াজাহাজে চেপে তাঁরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেনআলেকজান্দ্রিয়া শহরটি সমৃদ্ধিশালী, তাতে বড় বড় বাড়ি, বড় বড় দোকান, বিভিন্ন দেশের মানুষ, হরেক রকমের দোকানপসার আছেবেশিরভাগ দোকানের সাইনবোর্ড ফরাসি ভাষায় লেখাএখানের বিশাল বন্দরে ইউরোপীয়, মুসলমান সব ধরনের জাতির জাহাজ আছে, শুধুমাত্র হিন্দুদের কোনো জাহাজ নেইএই ঘটনা তাকে বিষণ্ণ করেছিল

কিশোর কবি রসবোধের কিন্তু ঘাটতি ছিলো নাদেখুন না, সেখানে একজন বুড়ি ফল বিক্রেতা রবীন্দ্রনাথদেরকে অনুনয় করলেও তাঁর ফল কেনার ইচ্ছে হয়নিকিন্তু একজন সুন্দরী মেয়েকে দেখে আর ওকে উপেক্ষা করলেন নাভ্রমণকাহিনীর পর্যায়ে ইতালির মেয়েদের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে ভুল হলো না কিশোর কবিরতাঁর দৃষ্টিতে, ইতালির মেয়েরা সুন্দরী, তাদের চোখ, চুল, ভ্রু কালো অনেকটা আমাদের দেশের মতোব্রিন্দিসি শহর থেকে ট্রেনে করে প্যারিস শহরের দিকে যাত্রা করেন কবিপথে মাঝরাতে নানান বিপত্তিতে পড়তে হয়, সেসব বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে অবশেষে তিনি প্যারিস পৌঁছান

অবশেষে রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে ইংল্যান্ডে পৌঁছানব্রাইটন শহরে ঠাকুর বাড়িতে থাকেন কিছু দিনসেখানে তিনি একটি স্কুলে (অনেকের মতে, ব্রাইটন কলেজে) ভর্তি হনকিছু দিন পর, আরো ভালো লেখাপড়ার উদ্দেশে তিনি বড় ভাইয়ের এক বন্ধুর সাথে লন্ডন চলে যানভর্তি হন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে, আইনবিভাগেকিন্তু থাকা-খাওয়া নিয়ে বাঁধলো বিপত্তিঅনেক খোঁজ-খবরের পর একজন ডক্টরের বাসায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন বলে ঠিক হয়কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ ছিলেন না; তাই যে পরিবারে তিনি থাকবেন, সে পরিবারের প্রত্যেকের ছিলো ঘোর আপত্তিতাদের ভারি ভয় হয়েছিলযেদিন রবীন্দ্রনাথের আসবার কথা সেইদিন মেজ ছোট মেয়ে, তাদের এক আত্নীয়দের বাড়ীতে পালিয়ে গিয়েছিলেনপ্রায় এক হপ্তা বাড়িতে আসেনিতারপর হয়তো যখন তারা শুনলেন যে, মুখে সর্বাঙ্গে উল্কি নেই, ঠোঁট বিঁধিয়ে অলংকার পরে নি, তখন তারা বাড়িতে ফিরে এলেন

পয়লা শোক:

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে

তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবুও অনন্ত জাগে।।

প্রিয়জনের বিয়োগজনিত ব্যথার চেয়ে বড় শোক বুঝি আর নেইগানের কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের জীবন দিয়ে অনুধাবন করে লিখেছিলেনতাঁর মতো চোখের সামনে এতগুলো আপনজনের মৃত্যু বিশ্বের দ্বিতীয় কোনো কবি-সাহিত্যিক দেখেছেন কিনা সন্দেহ

প্রায় প্রতিটা মৃত্যুই তাঁকে গোড়াশুদ্ধ নাড়িয়ে গেছে, তারপরও তিনি কেমন করে যেন সব ব্যাথা-কষ্ট ছাড়িয়ে সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছেনসৃষ্টি সুখের উল্লাসে ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর ব্যক্তিজীবনের সমস্ত হাহাকারনা পাওয়ার যন্ত্রণা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রায় আশি বছরের জীবনে পরম স্নেহময়ী মা-বাবা, প্রিয় ভাই-বোন, প্রাণপ্রিয় বৌদি, প্রেমময়ী স্ত্রী, প্রিয়তম ছেলে, মেয়ে, নাতি, ভাইপোসহ আরও অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুস্থানীয় মানুষের মৃত্যু দেখেছেনরবীন্দ্রনাথের মা সারদাসুন্দরী দেবী যখন মারা যান তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ১৩ বছর ১০ মাস

মার মৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনইতিমধ্যে বাড়িতে পরে পরে কয়েকটি মৃত্যুঘটনা ঘটিল ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনোদিন প্রত্যক্ষ করি নাই মা যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অম্ভ্রপ অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রেতখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেনপাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না প্রভাতে উঠিয়া যখন মা মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে- দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল নাসেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত মনোহর জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না বেলা হইল, শশ্মান হইতে ফিরিয়া আসিলাম; গলির মোড়ে আসিয়া তেতালায় পিতার ঘরের দিকে চাহিয়া দেখিলামতিনি তখনো তাঁহার ঘরের সম্মুখের বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া উপাসনায় বসিয়া আছেন

তবে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে আরও গভীর করে চিনলেন চব্বিশ বছর বয়সে এসে তাঁর বউঠাকরুন, বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর মধ্য দিয়েউল্লেখ্য, তিনি আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেনরবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেনকিন্তু আমার চব্বিশবছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয় তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে শিশুবয়েসের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই তাই সেদিনকার সমস্ত দুঃসহ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিল

পয়লা কবিতা-নাটক-প্রবন্ধ-সঙ্গীত-গল্প-উপন্যাস-নৃত্যনাট্য:

রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম নাটকপৃথ্বীরাজ পরাজয়রচনা করেনএই নাটকটির পাণ্ডুলিপি তাঁর জীব্বদশাতেই হারিয়ে যায়পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত প্রথম নাটক 'রুদ্রচণ্ড' (প্রকাশকাল: ১৮৮১)আবার পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত নাটক হচ্ছে 'বাল্মীকি প্রতিভা' (প্রকাশকাল: ১৮৮১)

তিনি আট বছর বয়সে কবিতা রচনা করতে আরম্ভ করেনপ্রথম নিঃস্বাক্ষরযুক্ত কবিতাঅভিলাষ১৮৭৪ সালেভারতীপত্রিকায় প্রকাশিত হয়এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা

জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ!

তোমার বন্ধুর পথ অনন্ত অপার

অতিক্রম করা যায় যত পান্থশালা,

তত যেন অগ্রসর হতে ইচ্ছা হয়

তবে তাঁর প্রথম স্বাক্ষরযুক্ত কবিতা প্রকাশিত হয় ২৫০২১৮৭৫ সালে 'অমৃতবাজার' পত্রিকায়তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র চোদ্দ বৎসরকবিতাটির নাম ছিল 'হিন্দুমেলার উপহার'

হিমাদ্রি শিখরে শিলাসন'পরি,

গান ব্যাসঋষি বীণা হাতে করি --

কাঁপায়ে পর্বত শিখর কানন,

কাঁপায়ে নীহারশীতল বায়

১৮৭৭ সালেভারতীপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়এগুলি হলমেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা’, ভানুসিং-ভণিতাযুক্ত রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কবিতাগুচ্ছ (যা পরবর্তীকালেভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়) এবংভিখারিণীকরুণানামে দুটি গল্পউল্লেখ্য, ‘ভিখারিণীবাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটোগল্প১৮৭৭ সালেই দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরেরঅলীকবাবুনাটকে নামভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে রঙ্গালয়ে আবির্ভাব ঘটে নট রবীন্দ্রনাথের১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থকবিকাহিনী

রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ 'বিবিধপ্রসঙ্গ' (১৮৮৩) আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ 'ভুবনমোহিনী প্রতিভা'সেটি 'জ্ঞানাঙ্কুর' 'প্রতিবিম্ব' পত্রিকার কাৰ্তিক ১২৮৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা চলিত ভাষায় লেখা প্রথম বইদেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটানোর পর ১৮৮০ সালে কোনো ডিগ্রি ছাড়াই দেশে ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথসঙ্গে আনলেন পাশ্চাত্য সংগীতের সুর অপেরা নাট্যশৈলী সম্পর্কে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাএই অভিজ্ঞতার ফসল ১৮৮১ সালেরবাল্মীকি-প্রতিভা১৮৮২ সালে রমেশচন্দ্র দত্তের কন্যার বিবাহসভায় সদ্যপ্রকাশিতসন্ধ্যাসংগীতকাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথসেই কবিতা শুনে নিজের গলার মালা খুলে রবীন্দ্রনাথের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

ইতিমধ্যেই বাংলায় তো বটেই, বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল তাঁর কবিখ্যাতিনৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘খেয়া’ (১৯০৬) গীতাঞ্জলি’ (১৯১০) কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত কিছু কবিতার অনুবাদ পাশ্চাত্য সমাজে রবীন্দ্রনাথকে পরিচিত করে তুললএই অনুবাদগুলির সংকলনসংস অফারিংসবা ইংরেজিগীতাঞ্জলি’ (১৯১৩) প্রকাশিত হওয়ার পর সুইডিশ আকাদেমি তাঁকে ভূষিত করল সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিয়েরবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম এশীয় নোবেলজয়ী সাহিত্যিক

১৮৮৩ সালে লেখারবীন্দ্রনাথের প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত উপন্যাসযশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য বাকলার জমিদার রামচন্দ্রের বিবাদকে উপজীব্য করে রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাসযদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে করুণা নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলেনতবে সেটি অসম্পূর্ণ ছিলতাই প্রথম উপন্যাস হিসেবে বৌ ঠাকুরানীর হাট প্রচলিত

রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম গানটি হল গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলেএই গানটি গুরু নানক রচিতগগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনেভজনটির প্রথমাংশের প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ

গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,

তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে।।

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার ফাল্গুন ১২৮১ (জানুয়ারি, ১৯৭৫) সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়আদি ব্রাহ্মসমাজপ্রকাশিত ব্রহ্মসংগীত স্বরলিপি গ্রন্থে এটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা বলে উল্লেখ করা হয়েছেতবে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, এটি তারই রচনা

নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদাহল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্য১৯৩৬ সালে কলকাতায় অভিনয়ের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত এই নৃত্যনাট্যটির সঙ্গে ১৮৯২ সালে রচিত চিত্রাঙ্গদা কাব্যনাট্যের বিষয়বস্তু তত্ত্ব এক অভিন্ন

জীবনের শেষ পয়লা বৈশাখ:

পয়লা বৈশাখ, ১৯৪১, রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ নববর্ষে তিনি লিখেছিলেন এই গানএই নিয়ে শান্তিদেব ঘোষের লেখায় পাই এই গান রচনার অনুরোধের গল্প... “প্রথমে আপত্তি করলেন ,কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে...বললেনসৌম্য [ঠাকুর] আমাকে বলেছে মানবের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখতেসে বলে আমি যন্ত্রের জয়গান গেয়েছি মানবের জয়গান করিনিতাই একটা কবিতা রচনা করেছি, সেটাই হবে নববর্ষের গানকাছেই ছিলেন শ্রীযুক্তা মৈত্রেয়ী দেবী, তিনি গুরুদেবের খাতা খুলে কবিতাটি কপি করে আমাকে দিলেনকবিতাটি ছিল একটু বড়ো, দেখে ভাবলাম এতো বড়ো কবিতায় সুরযোজনা করতে বলা মানে তাঁকে কষ্ট দেওয়াসুর দেবার একটু চেষ্টা করে সেদিন আর পারলেন না, বললেনকালকে হবেপরের দিন সেই কবিতাটি সংক্ষেপ করতে করতে শেষ পর্যন্ত, বর্তমানে মহামানব আসেগানটি যে আকারে আছে,সেই আকারে তাকে পেলাম

ওই মহামানব আসে

দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে

মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে ।।

সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,

নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক

এল মহাজন্মের লগ্ন

আজ ঘরে ঘরে এলিয়ে পড়েছে রবিঠাকুরে ছবিকরোনার আবহে পাড়ায় পাড়ায় গানবাজনা নেই, কবি-সঙ্গীতকারদের কবিতায় গানে সে মাদকতা নেই, জুঁই ফুলেও তেমন গন্ধ নেই আরআছে বলতে ভোটের গরম হাওয়া, গুলির আওয়াজ, ৪১ ডিগ্রির একটা ফুটন্ত দুপুর, যার নাম পয়লা বৈশাখআর আছি হালখাতার মার্জিনে অকালবয়স্ক আমরা কয়েকজনআমাদের হাত ফসকে পয়লা কখন একলা হয়ে গিয়েছে, বুঝতেই পারিনি

ঋণ: রবীন্দ্ররচনাবলীরবিজীবনীপ্রশান্ত কুমার পালগানের পিছনে রবীন্দ্রনাথসমীর সেনগুপ্তইন্টারনেট


0 comments

Mousumi Mukhopadhyay

Mousumi Mukhopadhyay

Shared publicly - 24th Apr, 21 07:55 pm

আহা, কী ভালো লেখা! যেমন টান টান, তেমনই তথ্য সমৃদ্ধ।

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 24th Apr, 21 01:49 pm

অপূর্ব তথ্য সমৃদ্ধ নিবন্ধ। খুব ভালো লাগলো।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait