পয়লা বৈশাখ – জন্মদিন পালন:
কবির বয়স বাড়ছে। শান্তিনিকেতনে তখন প্রচণ্ড দাবদাহ। গ্রীষ্মাবকাশের ছুটির কারণে পঁচিশে বৈশাখ নাগাদ আশ্রম চত্বর খাঁ খাঁ করে। কবির সম্মতি নিয়েই আশ্রমিকরা ঠিক করেন ১৯৩৬ সালের নববর্ষের দিন বর্ষবরণের পর কবির জন্মদিন পালন করা হবে। কবি ৭৫ বছরে পা দেন। উদারমনা কবি এই প্রস্তাবকে সাদরে গ্রহণ করলেন। এরপর থেকে নববর্ষের দিনই শান্তিনিকেতনে কবির জন্মদিন পালিত হত।
১৯৪০ সালের নববর্ষে, জন্মোৎসবে শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে সেদিন গানের সঙ্গে পাঠ চলছে, কবির বিভিন্ন লেখা থেকে। “শান্তিনিকেতন” সংকলন থেকে পড়া হয়েছিল ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধ – আজ নববর্ষের প্রাতঃসূর্য এখনো দিক্প্রান্তে মাথা ঠেকিয়ে বিশ্বেশ্বরকে প্রণাম করে নিই –এই ব্রাহ্মমুহূর্তে আমরা আশ্রমবাসীরা আমাদের নূতন বৎসরের প্রথম প্রণামটিকে আমাদের অনন্তকালের প্রভুকে নিবেদন করবার জন্যে এখানে এসেছি। এই প্রণামটি সত্য প্রণাম হোক। এই-যে নববর্ষ জগতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, এ কি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছে? আমাদের জীবনে কী আজ নববর্ষ আরম্ভ হল?
এমনকী ১৯৪১ সালের পয়লা বৈশাখেও পঁচিশের শঙ্খধ্বনি বেজেছিল। পরদিন ১৫ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর ছাপা হল, ‘সূর্য্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে মন্দিরে উপাসনা আরম্ভ হয়। অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন আচার্য্যের আসন গ্রহণ করেন।...অনুষ্ঠানে কয়েকটি সঙ্গীত গান করা হয়। ইহার মধ্যে দুইটি কবিগুরু কর্ত্তৃক এই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে রচিত — ‘হে পুরুষোত্তম’ এবং ‘এস হে মহামানব’। (ঐ মহামানব আসে)। সেদিন রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসবের ভাষণ ছিল ‘সভ্যতার সংকট’।
পয়লা জন্মদিন:
পঁচিশে বৈশাখ আনুষ্ঠানিক ভাবে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁর ভাগ্নি সরলা দেবী। অর্থাৎ ১৮৮৭ সালের (১২৯৪) ৭ মে প্রথম পঁচিশে বৈশাখের উৎসব শুরু হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ছাব্বিশ বছর। তবে তার আগের বছর অর্থাৎ ১৮৮৬ সালের ২৫শে বৈশাখ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখছেন, “আজ আমার জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখ-পঁচিশ বৎসর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এখন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন”।
বলাই বাহুল্য, বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়ে, ভাইপো ভাইঝি, ভাগ্নে-ভাগ্নীদের কাছে রবীন্দ্রনাথের সমাদরের অন্ত ছিল না। রবি মামার প্রতি সরলা দেবীরও ছিল গভীর ভক্তি। সেই ভক্তিবশতই তিনি তাঁর রবি মামার ‘জন্মদিন’ উৎসব সূচনা করলেন। সরলা দেবী তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’-য় সেই প্রথম জন্মদিন-উৎসব, সেই প্রথম পঁচিশে বৈশাখ পালনের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “রবিমামার প্রথম জন্মদিন-উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা (সত্যেন্দ্রনাথ) ও নতুনমামার (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) সঙ্গে তিনি ৪৯ নং পার্ক স্ট্রীটে থাকেন। অতি ভোরে উল্টাডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রীটে নিঃশব্দে তাঁর ঘরে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনান বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন পাশেই নতুনমামার ঘর। ‘রবির জন্মদিন’ বলে একটা সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হল।” সরলা দেবীর দাদা জ্যোৎস্নানাথ একটি বই উপহার দেন— ‘THE POEMS HEINE’। এর পর থেকে পারিবারিক সীমারেখার মধ্যেই কবির জন্মদিন নিয়মিত ভাবে পালিত হয়ে এসেছে। পরিজনের বাইরে, কবি প্রিয়ম্বদা দেবী তাঁকে একটি বাঁধানো নোটবই উপহার দেন। পরবর্তিকালে এই সুন্দর নোটবুকে রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’ কাব্যের অনেকগুলি কবিতা লিখেছিলেন। প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র–ভ্রাতুষ্পুত্রী সুরেন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবী জন্মদিনের উপহার হিসেবে সুরি ও বাবি, ২৫ বৈশাখ ১২৯৮ লিখে HERBERT SPENCER–এর অনেকগুলি বইয়ের মূল্যবান সংস্করণ উপহার দিয়েছিলেন।
পয়লা চিঠি:
চার বছর বয়স থেকে আশি বছর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ প্রচুর চিঠি লিখেছেন। প্রথম চিঠি তিনি লিখেছিলেন বাবাকে। জমিদারী সেরেস্তার কর্মচারী মহানন্দ বাবু’র কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ চেয়ে নিয়ে ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ বাবা দেবেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন। প্রথম দু’একটি চিঠি বাবার হস্তগত হলেও পরের বহু চিঠি পৌঁছোয়নি। কারণ সেরেস্তার কর্মচারীরা শিশু রবীন্দ্রনাথের এই লেখা পত্রের প্রতি শেষ পর্যন্ত তেমন আগ্রহ দেখাননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে বাবাকে প্রথম চিঠি লেখার অভিজ্ঞতার কথা এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘বেশ মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় কোনো এক সময় গবরমেন্টের চিরন্তন জুজু রাশিয়া কর্তৃক ভারত আক্রমণের আশঙ্কা লোকের মুখে আলোচিত হইতেছিল। … এইজন্য মার মনে অত্যন্ত উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াছিল। বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই কেহ তাঁহার এই উৎকণ্ঠা সমর্থন করেন নাই। মা সেই কারণে পরিণত বয়স্ক দলের সহায়তা লাভের চেষ্টায় হতাশ হইয়া শেষকালে এই বালকের আশ্রয় করিলেন। আমাকে বলিলেন, ‘রাশিয়ানদের খবর দিয়া কর্তাকে একখানা চিঠি লেখো তো’। মাতার উদ্বেগ বহন করিয়া পিতার কাছে সেই আমার প্রথম চিঠি। কেমন করিয়া পাঠ লিখিতে হয়, কী করিতে হয় কিছুই জানি না। দফতর খানায় মহানন্দ মুনশির শরণাপন্ন হইলাম।… এই চিঠির উত্তর পাইয়াছিলাম। তাহাতে পিতা লিখিয়াছেন, ভয় করিবার কোনো কারণ নাই, রাশিয়ানকে তিনি স্বয়ং তাড়াইয়া দিবেন।’
পয়লা প্রেম অনুভূতি:
সবার মতো করে রবীন্দ্রনাথও কিশোর বয়স পার করেছেন। আর দশজন যেমন করে প্রথম প্রেমের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মাতাল হয়ে পড়ে, রবীন্দ্রনাথকেও সেই হাওয়া দোলা দিয়ে গিয়েছিল। যার প্রভাব তার জীবনে পড়েছিল এবং সেটা খুব ভালো করেই। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথম প্রেমের জোয়ার এনে দিয়েছিল বোম্বের এক মেয়ে, নাম আন্না তড়খড়; রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দিয়েছিলেন নলিনী। ঘটনা ১৮৭৮ সালের। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার দেখাই বা হলো কী করে? পরবর্তীকালে যে নারীকে তিনি অমর করে রেখেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে? এমন এক প্রেমের গল্প রবীন্দ্রনাথের মুখেই শোনা যাক,
- মেজদাদা মনে করলেন, বিদেশকে যারা দেশের রস দিতে পারে সেইরকম মেয়েদের সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দিতে পারলে হয়তো ঘরছাড়া মন আরাম পাবে। ইংরেজি ভাষা শেখবারও সেই হবে সহজ উপায় । তাই কিছুদিনের জন্যে বোম্বাইয়ের কোনো গৃহস্থঘরে আমি বাসা নিয়েছিলুম। সেই বাড়ির কোনো-একটি এখনকার কালের পড়াশুনোওয়ালা মেয়ে’ ঝকঝকে করে মেজে এনেছিলেন তার শিক্ষা বিলেত থেকে । আমার বিদ্যে সামান্যই, আমাকে হেলা করলে দোষ দেওয়া যেতে পারত না । তা করেন নি। পুঁথিগত বিদ্যা ফলাবার মতো পুঁজি ছিল না, তাই সুবিধে পেলেই জানিয়ে দিতুম যে কবিতা লেখবার হাত আমার আছে। আদর আদায় করবার ঐ ছিল আমার সবচেয়ে বড়ো মূলধন। র্যার কাছে নিজের এই কবিআনার জানান দিয়েছিলেম। তিনি সেটাকে মেপেজুখে নেন নি, মেনে নিয়েছিলেন। কবির কাছ থেকে একটা ডাকনাম চাইলেন, দিলেম জুগিয়ে- সেটা ভালো লাগল তার কানে। ইচ্ছে করেছিলেম সেই নামটি আমার কবিতার ছন্দে জড়িয়ে দিতে। বেঁধে দিলুম সেটাকে কাব্যের গাথুনিতে ; শুনলেন সেটা ভোরবেলাকার ভৈরবী সুরে ; বললেন, “কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধ হয় আমার মরণদিনের থেকেও প্ৰাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।” এর থেকে বোঝা যাবে, মেয়েরা যাকে আদর জানাতে চায় তার কথা একটু মধু মিশিয়ে বাড়িয়েই বলে, সেটা খুশি ছড়িয়ে দেবার জন্যেই। মনে পড়ছে তার মুখেই প্ৰথম শুনেছিলুম আমার চেহারার তারিফ। সেই বাহবায় অনেক সময় গুণাপনা থাকত। যেমন, একবার আমাকে বিশেষ করে বলেছিলেন, ‘একটা কথা আমার রাখতেই হবে, তুমি কোনোদিন দাড়ি রেখো না, তোমার মুখের সীমানা যেন কিছুতেই ঢাকা না পড়ে।' তার এই কথা আজ পর্যন্ত রাখা হয় নি, সে কথা সকলেরই জানা আছে। আমার মুখে অবাধ্যতা প্রকাশ পাবার পূর্বেই তার মৃত্যু হয়েছিল। l
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি অতুলপ্রসাদ সেন ও দিলীপকুমার রায়ের সাথে আলাপে রবীন্দ্রনাথ এই তরুণীর কথা স্মরণ করেছেন, ‘তখন আমার বয়স বছর ষোলো। আমাকে ইংরেজি কথা বলা শেখানোর জন্যে পাঠানো হলো বম্বেতে একটি মারাঠি পরিবারে।...সে পরিবারের নায়িকা একটি মারাঠি ষোড়শী। যেমন শিক্ষিতা, তেমনি চালাক-চতুর, তেমনি মিশুক।...তার স্তাবক-সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না- বিশেষ আরও এই জন্যে যে, ঐ বয়সেই সে একবার বিলেত চক্র দিয়ে এসেছিল। সে সময়ে মেয়েদের বিলেত-যাওয়া আজকের মতন পাড়া-বেড়ানো গোছের ছিল না, মনে রেখো।
‘আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই সে ঘুরত আমার আনাচে কানাচে। আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিতো সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে।’
একথা আমি মানব যে ‘আমি বেশ টের পেতাম যে ঘটবার মতন একটা কিছু ঘটছে, কিন্তু হায় রে, সে-হওয়াটাকে উস্কে দেওয়ার দিকে আমার না ছিল কোনোরকম তৎপরতা, না কোনো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।
‘একদিন সন্ধ্যাবেলা...সে আচম্কা এসে হাজির আমার ঘরে। চাঁদনি রাত। চারদিকে সে যে কী অপরূপ আলো হাওয়া!...কিন্তু আমি তখন কেবলই ভাবছি বাড়ির কথা। ভালো লাগছে না কিছুই। মন কেমন করছে বাংলাদেশের জন্যে, আমাদের বাড়ির জন্যে, কলকাতার গঙ্গার জন্যে। হোমসিকেনস যাকে বলে।
সে বলে বসল, “আহা, কী এত ভাবো আকাশপাতাল!” তার ধরন-ধারণ জানা সত্ত্বেও আমার একটু যেন কেমন কেমন লাগল। কারণ সে প্রশ্নটি করতে না করতে একেবারে আমার নেয়ারের খাটির উপরেই এসে বসল। কিন্তু কী করি- যা হোক হুঁ হাঁ করে কাজ সেরে দিই। সে কথাবার্তায় বোধহয় জুৎ পাচ্ছিল না, ‘আচ্ছা, আমার হাত ধরে টানো তো— টাগ্-অফ-ওয়ারে দেখি কে জেতে?’
আমি সত্যিই ধরতে পারি নি, কেন হঠাৎ তাঁর এতরকম খেলা থাকতে টাগ্-অফ-ওয়ারের কথাই মনে পড়ে গেল। এমনকি আমি এ শক্তি পরীক্ষায় সম্মত হতে না হতে সে হঠাৎ শ্লথভাবে হার মানা সত্বেও আমার না হল পুলক-রোমাঞ্চ, না খুলল রসজ্ঞ দৃষ্টিশক্তি। এতে সে নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিশেষ রকম সন্দিহান হয়ে পড়েছিল।
‘শেষে একদিন বলল, তেমনি আচমকা: “জানো কোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার?” বলে খানিক বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল নিদ্রাবেশে। ঘুম ভাঙতেই সেই চাইল পাশে তার দস্তানার দিকে। একটিও কেউ চুরি করে নি।’
রসশাস্ত্রের বিচারে আন্নাকে অনেকটা প্রগল্ভা নায়িকার পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাছে না হলেও পরিণত রবীন্দ্রনাথের কাছে সে প্রেম যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করেছে।
উপরোক্ত কথোপকথনের সূত্রেই তিনি বলেছিলেন, ‘কিন্তু সে মেয়েটিকে আমি ভুলিনি বা তার সে আকর্ষণকে কোনো লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনো দিন। আমার জীবনে তারপরে নানা অভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে- বিধাতা ঘটিয়েছেন কত যে অঘটন- কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি গৌরব করে যে, কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনো ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি- তা সে ভালোবাসা যেরকমই হোক না কেন। প্রতি মেয়ের স্নেহ বলো, প্রীতি বলো, প্রেম বলো, আমার মনে হয়েছে একটা প্রসাদ – favour; কারণ এটা আমি বরাবরই উপলব্ধি করেছি যে প্রতি মেয়ের ভালবাসা তা সে যে-রকমের ভালবাসাই হোক না কেন – আমার মনের বনে কিছু না কিছু আফোটা ফুল ফুটিয়ে রেখে যায় – সে ফুল হয়ত পরে ঝরে যায়, কিন্তু তার গন্ধ যায় না মিলিয়ে।
আনা-র প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ সর্বশ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি দিয়েছেন শেষ বয়সে: জীবনযাত্রার মাঝে মাঝে জগতের অচেনা মহল থেকে আসে আপন মানুষের দূতী, হৃদয়ের দখলের সীমানা বড়ো করে দিয়ে যায়। না ডাকতেই আসে, শেষকালে একদিন ডেকে আর পাওয়া যায়না। চলে যেতে যেতে বেঁচে-থাকার চাদরটার উপরে ফুলকাটা কাজের পাড় বসিয়ে দেয়, বরাবরের মতো দিনরাত্রির দাম দিয়ে যায় বাড়িয়ে।
আন্নার প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি দিয়েছেন শেষ বয়সে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অনুমান করেছেন, শৈশবসংগীত কাব্যগ্রন্থের ‘ফুলের ধ্যান’ ও ‘অপ্সরা-প্রেম’ কবিতা দুটিতে এই তরুণীর মর্মবেদনা কবির ভাষায় রূপ পেয়েছে এবং ‘আমি স্বপনে রয়েছি ভোর, সখী, আমারে জাগায়ো না’ গানটির মধ্যে দস্তানা চুরির কৌতুককর কাহিনীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মালতীপুঁথি'তে পাওয়া না গেলেও রবিজীবনীকারের ধারণা ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যের চতুর্থ সর্গে কবির অষ্টম গানটি—‘শুনেছি—শুনেছি কি নাম তাহার—/শুনেছি— শুনেছি তাহা!/নলিনী—নলিনী—নলিনী—/ কেমন মধুর আহা!’ ইত্যাদি আন্না-কে লক্ষ্য করেই রচিত।
রবীন্দ্রনাথের গ্যেটে ও তাঁহার প্রণয়িনীগণ প্রবন্ধে এক জায়গায় আছে, ‘এক প্রকার তাস খেলা আছে, হারিলে চুম্বন দিতে হয়- গ্যেটে এই চুম্বনের পরিবর্তে কবিতা উপহার দিতেন—কিন্তু যে মহিলার তাঁহার নিকট হইতে চুম্বন প্রাপ্য থাকিত তাঁহার যে মর্ম্মে আঘাত লাগিত তাহা বলা বাহুল্য।’ এই বর্ণনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কোনো যোগ আছে কি না সেটা রসজ্ঞ পাঠকদের অনুমেয়- বলেছেন রবিজীবনীকার।
১৮৭৯ সালের ১১ নভেম্বর বরোদা কলেজের উপাধ্যক্ষ হ্যারন্ড লিট্লেডলের সঙ্গে আন্নার বিয়ে হয়। আন্নার মৃত্যু হয় ১৮৯১ সালের ৫ জুলাই এডিনবরা শহরে।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিবাহিত জীবনেও আন্না রবীন্দ্রনাথকে ভোলেননি। সেই কিশোর-কবির প্রদত্ত আদরের ডাক নাম ‘নলিনী’ স্বাক্ষরেই তিনি প্রবন্ধাদি প্রকাশ করতেন— তার অপেক্ষাকৃত পরিণত মনেও সেই ‘আপন-মানুষের দূত’ গভীর স্বাক্ষর এঁকে দিয়েছিলেন, এ তারই প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে এই তথ্যটিও উল্লেখযোগ্য যে, তার এক ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল ‘রবীন্দ্রনাথ’।
পয়লা বিদেশ ভ্রমণ- সমুদ্র যাত্রা
ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের স্কুল-কলেজ বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি অনীহা ছিলো। জমিদার পরিবারের ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে তাই বাড়িতেই গৃহ শিক্ষক রেখে প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি দেয়া হয়।
কৈশোর জীবনের শেষ দিকে তাঁর ভালো পড়াশোনার জন্য দাদা সত্যেন্দ্রনাথ প্রস্তাব করেন রবীন্দ্রনাথকে বিলেত পাঠিয়ে দেয়া হোক। সেখানকার লেখাপড়া হয়তো তাঁর ভালো লাগবে। যেই ভাবা সেই কাজ। মাত্র ১৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ যাত্রা করেন বিলেত পানে। শুরু হলো তাঁর বিশ্বযাত্রা।
এ যাত্রার আদ্যোপান্ত অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরী’ ‘জীবনস্মৃতি’ প্রভৃতি গ্রন্থে।
বিলেতের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে রবীন্দ্রনাথ জাহাজে চড়ার কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। জাহাজের যাত্রা, পরিবেশ, আবহাওয়ার সাথে তখনও খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি তিনি। কেতাবি ভাষায়, এই অসুস্থতাকে অবশ্য ‘Sea Sickness’ নামে অভিহিত করা হয়। এই ‘সমুদ্র ব্যাধি’তে আক্রান্ত হয়ে কিশোর কবি একেবারে ছ’ ছ’টি দিন বিছানায়। মাথাটিও তুলবার জো ছিলো না। সে সময় জাহাজের জনৈক ‘স্টুঅর্ড’ তাঁকে পরম মমতায় খাইয়ে দিতেন। সেকথা ভুলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ,
আমাদের যে স্টুঅর্ড ছিল ... আমার উপর তার বিশেষ কৃপাদৃষ্টি ছিল। দিনের মধ্যে যখন–তখন সে আমার জন্য খাবার নিয়ে উপস্থিত করত; ... বলত না খেলে আমি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়ব (weak as a rat) ।
ছ'দিন পর যখন কবি শয্যা ছেড়ে উঠলেন, তখন দেখলেন, আসলেই তিনি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আমার কথা ছেড়ে কিশোর রবির ভাষাতেই শুনুন,
উঠে দেখি যে সত্যিই ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছি। মাথা যেন ধার করা, কাঁধের সাথে তার ভালোরকম বনে না; চুরি করা কাপড়ের মতো শরীরটা আমার যেন ঠিক গায়ে লাগছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতের উপর গিয়ে একটা কেদারায় হেলান দিয়ে পড়লেম। অনেকদিন পর বাতাস পেয়ে বাঁচলেম।
জাহাজে যাত্রাকালে তিনি নানা রুপের নানা চরিত্রের বিদেশিদের দেখলেন, সেখানে নিতান্ত ভদ্র-সভ্য-বিনয়ী ইংরেজ যেমন দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন কর্কশ-ভাষী অসৌম্য ব্যক্তিদেরও। মার্জিত রুচির ইংরেজদের ব্যবহারে কবি যেমন পুলকিত হয়েছেন, তেমনি রূঢ় স্বভাবের ইংরেজদের অমার্জিত আচরণে তিনি ব্যথিত হয়েছেন। এমন কত ঘটনা দেখেছেন তিনি, আশ্চর্য হয়েছেন। আর আমরা আশ্চর্য হই তাঁর সৃষ্টিশীল হাতের ছোঁয়ায় লেখা এসব ভ্রমণ কাহিনী পাঠ করে!
এডেন থেকে জাহাজে করে সুয়েজ যেতে তাঁদের পাঁচ দিন লেগেছিল। সুয়েজে নেমে নৌকোয় করে খানিকটা পথ এগিয়ে ট্রেনে করে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে পৌঁছে সেখান থেকে স্টিমারে চেপে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইতালি পৌঁছান কবি। কবি জানতেন যে, আফ্রিকা এক অনুর্বর মরুভূমির নাম; অন্তত বই-পুস্তকে তো তেমনটিই পড়েছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখলেন উল্টো। রাস্তার দু'পাশে তিনি বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত দেখেছেন, দেখেছেন থোকায় থোকায় খেজুরশুদ্ধ গাছ, আরো কত কী!
হাঁটতে হাঁটতে একেবারে ধূলোবালি মেখে মলিন বদনে পৌঁছলেন আলেকজান্দ্রিয়া। বন্দরে তাদের জন্য অপেক্ষমাণ ‘মঙ্গোলিয়া’ জাহাজে চেপে তাঁরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন। আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি সমৃদ্ধিশালী, তাতে বড় বড় বাড়ি, বড় বড় দোকান, বিভিন্ন দেশের মানুষ, হরেক রকমের দোকানপসার আছে। বেশিরভাগ দোকানের সাইনবোর্ড ফরাসি ভাষায় লেখা। এখানের বিশাল বন্দরে ইউরোপীয়, মুসলমান সব ধরনের জাতির জাহাজ আছে, শুধুমাত্র হিন্দুদের কোনো জাহাজ নেই। এই ঘটনা তাকে বিষণ্ণ করেছিল।
কিশোর কবি রসবোধের কিন্তু ঘাটতি ছিলো না। দেখুন না, সেখানে একজন বুড়ি ফল বিক্রেতা রবীন্দ্রনাথদেরকে অনুনয় করলেও তাঁর ফল কেনার ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু একজন সুন্দরী মেয়েকে দেখে আর ওকে উপেক্ষা করলেন না। ভ্রমণকাহিনীর এ পর্যায়ে ইতালির মেয়েদের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে ভুল হলো না কিশোর কবির। তাঁর দৃষ্টিতে, ইতালির মেয়েরা সুন্দরী, তাদের চোখ, চুল, ভ্রু কালো অনেকটা আমাদের দেশের মতো। ব্রিন্দিসি শহর থেকে ট্রেনে করে প্যারিস শহরের দিকে যাত্রা করেন কবি। পথে মাঝরাতে নানান বিপত্তিতে পড়তে হয়, সেসব বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে অবশেষে তিনি প্যারিস পৌঁছান।
অবশেষে রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে ইংল্যান্ডে পৌঁছান। ব্রাইটন শহরে ঠাকুর বাড়িতে থাকেন কিছু দিন। সেখানে তিনি একটি স্কুলে (অনেকের মতে, ব্রাইটন কলেজে) ভর্তি হন। কিছু দিন পর, আরো ভালো লেখাপড়ার উদ্দেশে তিনি বড় ভাইয়ের এক বন্ধুর সাথে লন্ডন চলে যান। ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে, আইনবিভাগে। কিন্তু থাকা-খাওয়া নিয়ে বাঁধলো বিপত্তি। অনেক খোঁজ-খবরের পর একজন ডক্টরের বাসায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন বলে ঠিক হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ ছিলেন না; তাই যে পরিবারে তিনি থাকবেন, সে পরিবারের প্রত্যেকের ছিলো ঘোর আপত্তি। তাদের ভারি ভয় হয়েছিল। যেদিন রবীন্দ্রনাথের আসবার কথা সেইদিন মেজ ও ছোট মেয়ে, তাদের এক আত্নীয়দের বাড়ীতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় এক হপ্তা বাড়িতে আসেনি। তারপর হয়তো যখন তারা শুনলেন যে, মুখে ও সর্বাঙ্গে উল্কি নেই, ঠোঁট বিঁধিয়ে অলংকার পরে নি, তখন তারা বাড়িতে ফিরে এলেন।
পয়লা শোক:
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবুও অনন্ত জাগে।।
প্রিয়জনের বিয়োগজনিত ব্যথার চেয়ে বড় শোক বুঝি আর নেই। গানের কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের জীবন দিয়ে অনুধাবন করে লিখেছিলেন। তাঁর মতো চোখের সামনে এতগুলো আপনজনের মৃত্যু বিশ্বের দ্বিতীয় কোনো কবি-সাহিত্যিক দেখেছেন কিনা সন্দেহ।
প্রায় প্রতিটা মৃত্যুই তাঁকে গোড়াশুদ্ধ নাড়িয়ে গেছে, তারপরও তিনি কেমন করে যেন সব ব্যাথা-কষ্ট ছাড়িয়ে সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছেন। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর ব্যক্তিজীবনের সমস্ত হাহাকার। না পাওয়ার যন্ত্রণা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রায় আশি বছরের জীবনে পরম স্নেহময়ী মা-বাবা, প্রিয় ভাই-বোন, প্রাণপ্রিয় বৌদি, প্রেমময়ী স্ত্রী, প্রিয়তম ছেলে, মেয়ে, নাতি, ভাইপোসহ আরও অনেক ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুস্থানীয় মানুষের মৃত্যু দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের মা সারদাসুন্দরী দেবী যখন মারা যান তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ১৩ বছর ১০ মাস।
মার মৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন– ইতিমধ্যে বাড়িতে পরে পরে কয়েকটি মৃত্যুঘটনা ঘটিল। ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনোদিন প্রত্যক্ষ করি নাই। মা’ র যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অম্ভ্রপ। অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়– তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে।” তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন– পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল। স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে- দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না– সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না। কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না। বেলা হইল, শশ্মান হইতে ফিরিয়া আসিলাম; গলির মোড়ে আসিয়া তেতালায় পিতার ঘরের দিকে চাহিয়া দেখিলাম– তিনি তখনো তাঁহার ঘরের সম্মুখের বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া উপাসনায় বসিয়া আছেন।
তবে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে আরও গভীর করে চিনলেন চব্বিশ বছর বয়সে এসে তাঁর বউঠাকরুন, বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, তিনি আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন– কিন্তু আমার চব্বিশবছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে। শিশুবয়েসের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়– কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই। তাই সেদিনকার সমস্ত দুঃসহ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিল।
পয়লা কবিতা-নাটক-প্রবন্ধ-সঙ্গীত-গল্প-উপন্যাস-নৃত্যনাট্য:
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম নাটক ‘পৃথ্বীরাজ পরাজয়’ রচনা করেন। এই নাটকটির পাণ্ডুলিপি তাঁর জীব্বদশাতেই হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত প্রথম নাটক 'রুদ্রচণ্ড' (প্রকাশকাল: ১৮৮১)। আবার পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত নাটক হচ্ছে 'বাল্মীকি প্রতিভা' (প্রকাশকাল: ১৮৮১)।
তিনি আট বছর বয়সে কবিতা রচনা করতে আরম্ভ করেন। প্রথম নিঃস্বাক্ষরযুক্ত কবিতা ‘অভিলাষ’ ১৮৭৪ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা।
জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ!
তোমার বন্ধুর পথ অনন্ত অপার ।
অতিক্রম করা যায় যত পান্থশালা,
তত যেন অগ্রসর হতে ইচ্ছা হয়।
তবে তাঁর প্রথম স্বাক্ষরযুক্ত কবিতা প্রকাশিত হয় ২৫•০২•১৮৭৫ সালে 'অমৃতবাজার' পত্রিকায়। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র চোদ্দ বৎসর। কবিতাটির নাম ছিল 'হিন্দুমেলার উপহার'।
হিমাদ্রি শিখরে শিলাসন'পরি,
গান ব্যাসঋষি বীণা হাতে করি --
কাঁপায়ে পর্বত শিখর কানন,
কাঁপায়ে নীহারশীতল বায়।
১৮৭৭ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এগুলি হল ‘মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা’, ভানুসিং-ভণিতাযুক্ত রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কবিতাগুচ্ছ (যা পরবর্তীকালে ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়) এবং ‘ভিখারিণী’ ও ‘করুণা’ নামে দুটি গল্প। উল্লেখ্য, ‘ভিখারিণী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটোগল্প। ১৮৭৭ সালেই দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অলীকবাবু’ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে রঙ্গালয়ে আবির্ভাব ঘটে নট রবীন্দ্রনাথের। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ 'বিবিধপ্রসঙ্গ' (১৮৮৩) আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ 'ভুবনমোহিনী প্রতিভা'। সেটি 'জ্ঞানাঙ্কুর' ও 'প্রতিবিম্ব' পত্রিকার কাৰ্তিক ১২৮৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’ই রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা চলিত ভাষায় লেখা প্রথম বই। দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটানোর পর ১৮৮০ সালে কোনো ডিগ্রি ছাড়াই দেশে ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে আনলেন পাশ্চাত্য সংগীতের সুর ও অপেরা নাট্যশৈলী সম্পর্কে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার ফসল ১৮৮১ সালের ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’। ১৮৮২ সালে রমেশচন্দ্র দত্তের কন্যার বিবাহসভায় সদ্যপ্রকাশিত ‘সন্ধ্যাসংগীত’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই কবিতা শুনে নিজের গলার মালা খুলে রবীন্দ্রনাথের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
ইতিমধ্যেই বাংলায় তো বটেই, বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল তাঁর কবিখ্যাতি। ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘খেয়া’ (১৯০৬) ও ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০) কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত কিছু কবিতার অনুবাদ পাশ্চাত্য সমাজে রবীন্দ্রনাথকে পরিচিত করে তুলল। এই অনুবাদগুলির সংকলন ‘সংস অফারিংস’ বা ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১৩) প্রকাশিত হওয়ার পর সুইডিশ আকাদেমি তাঁকে ভূষিত করল সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিয়ে। রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম এশীয় নোবেলজয়ী সাহিত্যিক।
১৮৮৩ সালে লেখা। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত উপন্যাস। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ও বাকলার জমিদার রামচন্দ্রের বিবাদকে উপজীব্য করে রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে করুণা নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। তবে সেটি অসম্পূর্ণ ছিল। তাই প্রথম উপন্যাস হিসেবে বৌ ঠাকুরানীর হাট ই প্রচলিত।
রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম গানটি হল ’গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’। এই গানটি গুরু নানক রচিত ‘গগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে’ ভজনটির প্রথমাংশের প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ।
গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,
তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে।।…
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার ফাল্গুন ১২৮১ (জানুয়ারি, ১৯৭৫) সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়। আদি ব্রাহ্মসমাজপ্রকাশিত ব্রহ্মসংগীত স্বরলিপি গ্রন্থে এটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, এটি তারই রচনা।
নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্য। ১৯৩৬ সালে কলকাতায় অভিনয়ের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত এই নৃত্যনাট্যটির সঙ্গে ১৮৯২ সালে রচিত চিত্রাঙ্গদা কাব্যনাট্যের বিষয়বস্তু ও তত্ত্ব এক ও অভিন্ন।
জীবনের শেষ পয়লা বৈশাখ:
পয়লা বৈশাখ, ১৯৪১, রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ নববর্ষে তিনি লিখেছিলেন এই গান ।এই নিয়ে শান্তিদেব ঘোষের লেখায় পাই এই গান রচনার অনুরোধের গল্প... “প্রথমে আপত্তি করলেন ,কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে...বললেন ‘সৌম্য [ঠাকুর] আমাকে বলেছে মানবের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখতে । সে বলে আমি যন্ত্রের জয়গান গেয়েছি মানবের জয়গান করিনি । তাই একটা কবিতা রচনা করেছি, সেটাই হবে নববর্ষের গান ।’ কাছেই ছিলেন শ্রীযুক্তা মৈত্রেয়ী দেবী, তিনি গুরুদেবের খাতা খুলে কবিতাটি কপি করে আমাকে দিলেন। কবিতাটি ছিল একটু বড়ো, দেখে ভাবলাম এতো বড়ো কবিতায় সুরযোজনা করতে বলা মানে তাঁকে কষ্ট দেওয়া। সুর দেবার একটু চেষ্টা করে সেদিন আর পারলেন না, বললেন ‘কালকে হবে’। পরের দিন সেই কবিতাটি সংক্ষেপ করতে করতে শেষ পর্যন্ত, বর্তমানে ‘ঐ মহামানব আসে’ গানটি যে আকারে আছে,সেই আকারে তাকে পেলাম ।”
ওই মহামানব আসে ।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে ।।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক–
এল মহাজন্মের লগ্ন ।
আজ ঘরে ঘরে এলিয়ে পড়েছে রবিঠাকুরে ছবি। করোনার আবহে পাড়ায় পাড়ায় গানবাজনা নেই, কবি-সঙ্গীতকারদের কবিতায় গানে সে মাদকতা নেই, জুঁই ফুলেও তেমন গন্ধ নেই আর। আছে বলতে ভোটের গরম হাওয়া, গুলির আওয়াজ, ৪১ ডিগ্রির একটা ফুটন্ত দুপুর, যার নাম পয়লা বৈশাখ। আর আছি হালখাতার মার্জিনে অকালবয়স্ক আমরা কয়েকজন। আমাদের হাত ফসকে পয়লা কখন একলা হয়ে গিয়েছে, বুঝতেই পারিনি।
ঋণ: রবীন্দ্ররচনাবলী। রবিজীবনী – প্রশান্ত কুমার পাল। গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ – সমীর সেনগুপ্ত। ইন্টারনেট।
Comment 2
Share
আহা, কী ভালো লেখা! যেমন টান টান, তেমনই তথ্য সমৃদ্ধ।
অপূর্ব তথ্য সমৃদ্ধ নিবন্ধ। খুব ভালো লাগলো।
অপূর্ব তথ্য সমৃদ্ধ নিবন্ধ। খুব ভালো লাগলো।
আহা, কী ভালো লেখা! যেমন টান টান, তেমনই তথ্য সমৃদ্ধ।
Enter your email address to reset your password.
The very name 'SWADES' denotes the philosophical essence and ideological standpoint of our vision. We envisage serving our 'Swades' by providing news, special stories and literary works of the new generation writers which would cater to the interest of the Nation.
Swades Times © 2020 , All rights Reserved
0 comments