তখন রাত পৌনে দুটো হবে। খোলা জানলাটা ঠকাস ঠকাস করে একটা করে পাল্লা এদিক ওদিক করছে আর আওয়াজ হচ্ছে। তিনকড়ি মুখুজ্জে চোখ রগড়ে বিছানায় বসল। বাইরে কি ঝড় উঠল? এই অসময়ে? পড়ন্ত বিকেল এখন তাড়াতাড়ি হয়ে বিকেল বলে কিছু আলাদা হয় না। দুপুর গড়াতেই সন্ধ্যে। কেমন একটা মিষ্টি গন্ধও ভেসে আসছে।
মন্দিরের জানলা খোলা কিনা দেখতে যেতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য ঐ মন্দিরই সম্বল।
গাঁয়ের সবাই জানে, তিনকড়ি এক ভীতু ব্রাহ্মণ। সারাদিন পুজো আচ্চা নিয়েই কেটে যায় তার। বাপ ঠাকুরদার ভিটেতে আজ একা আর ওই মা কালীর মন্দির সম্বল। সারাদিন ওই ঠাকুরের সাথেই তার কথা বলা।
দরজা খুলে দেখল হাওয়া দিচ্ছে বাইরে। মন্দিরের দিকে এগোতে এগোতে হঠাৎই তার পা অবশ হয়ে এল। সারা গা হাত পা ভারি হয়ে এল, সে আর চলতে পারল না। স্বচক্ষে দেখল মন্দির থেকে মা কালী খড়্গ হাতে নেমে আসছে। নিজের গোঙানির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু সে শুনতে পেল না। এভাবে কতক্ষণ সে পড়েছিল, জানে না। ভোর হতেই বিশু আর বিশুর বউ চোখে মুখে জল ছিটিয়ে ঘরে নিয়ে এল। তারপর জ্ঞান আসতেই হাহাকার করে উঠল। তার মন্দির থেকে মা কালীর গয়না চুরি। সারা পাড়ার লোকের জমায়েত, থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়াল। তিনকড়ির মাথায় হাত। পাশের বাড়ি বিশু খুব সাহায্য করল বটে। কিন্তু এর সুরাহা কি? মাকে যে সে নিজের চোখে দেখল। তারপরই এই বিপদ! তিনকড়ি কেঁদে উঠল, মা গো। কি আছে তোর মনে? কেন এই বয়সে এমন পরীক্ষা?
আরও পড়ুন : অরূপ তোমার বাণী
গুটি কয়েক বাড়ি ধরা আছে তার, সেসব যজমানদের ঘরে পুজো সারতে হয়। দু চারদিন ধরে খাওয়া ঘুম চলে গেছে। এমনিই তো ভাতে ভাত ফুটিয়ে খাওয়া, কদিন জল ছাড়া কিছু ইচ্ছেও করছে না। সেদিনের পর বিশুর বউ এসে তাও একটু ফল টল কেটে দিয়েছিল। একার জন্য আর ইচ্ছে করে না। বিশু বলেছিল, কাকা, আমাদের সাথে খাবা ক'দিন। তিনকড়ি রাজী হয়নি। ওদের এমনিই দুজনের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আবার তিনি জুটবেন, বিশুর চাপ হবে। তিনকড়িই মাঝে মাঝে ওদের ডেকে কলাটা মূলোটা দেয়। কিন্তু তার বংশের এই মান্ধাতার আমলের সামান্য কটা গয়না, এ কার কাজ? ধম্মে সইবে?
হঠাৎ রাস্তায় শ্যামাকে দেখে কিছু ছেলে ওকে খুব বিরক্ত করছে। অন্যমনস্ক তিনকড়িকে দেখে শ্যামা বলল, তিনু মামা আমাকে একটু স্টেশন পৌঁছে দেবে। তিনকড়ি বুঝতে পারল, তার বাড়ির উল্টো পথ সে জানে। তাও ছেলেগুলোর অসভ্যতা দেখে শ্যামাকে স্টেশন পৌঁছে দেওয়াই ঠিক মনে করল। ছেলেগুলো পেছন থেকে ব্যঙ্গ শুরু করল। তিনু ভীতু, ভীতু তিনু এরম মন্তব্য ছুঁড়ল। হঠাৎ তিনকড়ির মাথাটা গরম হয়ে উঠল। গয়না চুরি এই বখাটে ছোঁড়াদের কাজ নয়ত? তিনকড়ি ধাঁ করে পেছন ঘুরে তার হাতের মান্ধাতার আমলে ছাতাখানা পাকিয়ে চারটের মধ্যে যাকে সামনে পেল পিটিয়ে দিল। দু চার ঘা খেয়ে ওদের সাহস হল না আর। পালিয়ে গেল সব কটাই।
শ্যামাকে স্টেশনে পৌঁছে, ঘরে ফিরে সন্ধ্যে দিয়ে সবে বসেছে একটু মুড়ি খাবে বলে।
হঠাৎ শ্যামা গেট খুলে মাটির পথ ধরে তিনকড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। তিনু বলল, কিরে তোর এর মধ্যেই কাজ হয়ে গেল? বললি যে পাশের গ্রামে যাত্রা পালা আছে। এত তাড়াতাড়ি শেষ? মুখের দিকে তাকিয়ে তিনকড়ি দেখল, শ্যামার চোখে জল।
কি রে, কি হয়েছে? শ্যামা কিছু না বলে ব্যাগ থেকে একটা কালো ড্রেস আর খড়্গ বের করল। বলল, মামা আমি পাপ করেছি, তুমি যা শাস্তি দেবে দাও। তিনকড়ি কিছু বুঝল না। শ্যামা বলল, পাশের গ্রামে নিবারণের সাথে ওর প্রেম। আজ ওরা পালিয়ে যাচ্ছিল। হাতে টাকা পয়সা নেই তাই সেদিন যাত্রা করার এই ড্রেসটা পরে মাঝরাতে মন্দিরের গয়না চুরি করে শ্যামা। তবে সে এটা করতে চায়নি, ওকে নিবারণ বাধ্য করেছিল। বলল, তোমাকে শিক্ষা দেবে।
পাশের গ্রামে নিবারণের চরিত্র সবাই জানে, আর কানাঘুষো থেকে তিনকড়িও শুনেছিল বটে। সরস্বতী পুজোর দিন মন্ডপে হিন্দী গান চালিয়ে মেয়েদের নিয়ে উল্লাস করার জন্য এই তিনকড়িই অভিযোগ করেছিল ওই গ্রামের মোড়লের কাছে। তার জন্য সবার সামনে ওকে নাক খৎ দিতে হয়েছিল এবং তিনকড়িকে সবাই সমর্থন করেছিল। ব্যাস! এই রাগ। তবে এতকিছু শ্যামার জানার কথা নয়। শুধু তিনকড়ির চোখের সামনে ভেসে উঠল সে দৃশ্য। ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে মায়ের সব গয়না বের করে দিল শ্যামা। তিনকড়ি বলল, তা গেলি না কেন? তোরা তো সংসার করবি বলেই এগুলো নিয়েছিলি।
ADVERTISEMENT
আরও পড়ুন : রিয়া মিত্র'র কলমে ছোটগল্প - মেঘ মল্লার
শ্যামা বলল, চলন্ত ট্রেনে এ ব্যাগটা আমার কাঁধ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে উঠে পড়ল আর আমাকে এক ধাক্কা মারল। তারপর কোত্থেকে যে এত জোর পেলাম আমি নিজেও জানি না। ঝড়ের গতিতে চলন্ত ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়া লাগালাম। হাত কেটে রক্ত ঝড়ছে, তাকাইনি। দেখি জানোয়ারটা তখনও গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মজা দেখছে আর দাঁত বের করে হাসছে। আমার ঝোলা ব্যাগটা উঁকি দিচ্ছে ওর কাঁধে। ব্যাগটা ধরে এক টান মারলাম। ছিঁড়ে আমার হাতে চলে এল মামা।
তারপর হাউহাউ করে কেঁদে উঠল শ্যামা। কি বলবে তিনকড়ি ওকে বুঝতে পারল না। সদ্য সংসারের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া এক মেয়ের কাছে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে তিনকড়ি বুঝল না। শুধু বলল, ওঠ। মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নে। কারোর প্রবঞ্চনায় পা দিয়ে কেউ অজান্তে পাপ করলে মা ঠিক ক্ষমা করে দেবে। যা।
একথা বলে নিজেও দু হাত কপালে ঠেকাল। শ্যামা বলল, মামা। আমাকে তুমি থাকতে দেবে? আমি তোমার মন্দিরের সব কাজ করে দেব। আমার তো ঘর বাড়িতে আর নেবে না। কোত্থাও জায়গা নেই আমার। একটু আশ্রয় দেবে? তোমার ঐ মন্দিরের এক কোণে পরে থাকব, আর গয়না পাহারা দেব। কেউ আরেকবার নিতে এলে কুপিয়ে রেখে দেব।
তিনকড়ি তাকিয়ে দেখল, শ্যামার লাল বর্ণের চোখ টগবগ করে ফুটছে। সেদিন যতই যাত্রার পোষাক পরে মন্দিরে অপকর্ম করে আসুক শ্যামা। আজ যেন সে সত্যিকারের শ্যামা হয়ে উঠেছে।
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট
0 comments