রবীন্দ্রনাথের গানে নতুন বৌঠান

রবীন্দ্রনাথের গানে নতুন বৌঠান

রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী আর সুরে রয়েছে মর্ত্যলোকের সীমা ছাড়িয়ে অসীমের আকুতি। রবীন্দ্রগানের ঐশ্বর্যে যে অতুলনীয় সমৃদ্ধি তার উৎসে রয়েছেন এক অনন্য সাধারণ নারী যিনি রবীন্দ্রনাথেরই নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী। কাদম্বরী দেবীর অকাল মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের গানকে করেছে কালজয়ী–মৃত্যুঞ্জয়ী। ব্যক্তি হৃদয়ের মধ্য দিয়ে সেই গান সারা বিশ্ব প্রকৃতিতে ব্যাপ্ত হয়েছে। তাই কখনও গান লিখেছেন তাঁর স্মৃতিতে, কখনও তাঁর উপস্থিতিতে, কখনও ছাদে উঠে একলা গেয়েছেন।

আসলে ঠাকুর পরিবারের প্রায় সবাই ছিলেন সাহিত্য রসিক, সাহিত্য স্রষ্টা, কবি, দার্শনিক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও প্রাচ্য সঙ্গীতের মিলনে এক নতুন সঙ্গীত ধারার সৃষ্টিতে নেমেছিলেন। কাদম্বরী ও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর এই প্রচেষ্টার সঙ্গী। জ্যোতিদাদা ও বৌঠাকরুন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন–

সেকালে বড়ো ছোটোর মধ্যে চলাচলের সাঁকোটা ছিল না। জ্যোতিদাদা এসেছিলেন নির্জলা নতুন মন নিয়ে। আমি ছিলুম তাঁর চেয়ে বারো বছরের ছোটো। ছাদের ঘরে এলপিয়ানো। এইবার ছুটল আমার গানের ফোয়ারা। জ্যোতিদাদা পিয়ানোর উপর হাত চালিয়ে নতুন নতুন ভঙ্গিতে ঝমাঝম সুর তৈরি করে যেতেন, আমাকে রাখতেন পাশে। তখনি তখনি সেই ছুটে-চলা সুরে কথা বসিয়ে বেঁধে রাখবার কাজ ছিল আমার। বৌঠাকরুন গা ধুয়ে চুলবেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন। গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা, বেহালাতে লাগাতেন ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের গান। গলায় যেটুকু সুর দিয়েছিলেন বিধাতা তখনও তা ফিরিয়ে নেন নি। সূর্য-ডোবা আকাশে ছাদে ছাদে ছড়িয়ে যেত আমার গান। হুহু করে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে, তারায় তারায় যেত আকাশ ভ’রে, ….

শাঙন গগনে ঘোর ঘন ঘটা নিশীথ যামিনীরে।
কুঞ্জ পথে সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।


প্রথম প্রকাশ; শরৎ ১৮৭৭
১৮২৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা ভারতী পত্রিকায় ষোড়শবর্ষিয় রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি গান একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল, এটি তার মধ্যে একটি।
জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “…রবিবারে রবিবারে জ্যোতিদাদা দলবল লইয়া শিকার করিতে বাহির হইতেন। রবাহূত অনাহূত যাহারা আমাদের দলে আসিয়া জুটিত তাহাদের অধিকাংশকেই আমরা চিনিতাম না। তাহাদের মধ্যে ছুতার কামার প্রভৃতি সকল শ্রেণীর লোকছিল। এই শিকারে রক্তপাতটাই সবচেয়ে নগণ্য ছিল, অন্তত সেরূপ ঘটনা আমার তো মনে পড়ে না। শিকারের অন্য সমস্ত অনুষ্ঠানই বেশ ভরপুর মাত্রায় ছিল– আমরা হত-আহত পশু পাক্ষীর অতিতুচ্ছ অভাব কিছু মাত্র অনুভব করিতাম না। প্রাতঃকালেই বাহির হইতাম। বউঠাকুরানী রাশীকৃত লুচি তরকারী প্রস্তুত করিয়া আমাদের সঙ্গে দিতেন 

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখছেন, “…কোনো এক ব্রাহ্মণ জমিদার -সভ্যের [জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘শিকার’-এর দল ] গঙ্গার ধারের একটি বাগান বাড়ীতে একবার আমাদের একটা প্রীতি-ভোজ হয়। … খাওয়া-দাওয়া হইয়া গেলে খুব এক ঝড় উঠিল।রাজনারায়ণ বাবু সেই সময় গঙ্গার ঘাটে দাঁড়াইয়া, চিৎকার করিয়া “আজি উন্মদ পবনে…” [শাঙন গগনে ঘোর ঘন ঘটা] বলিয়া রবীন্দ্রনাথের নব রচিত একটি গান আরম্ভ করিয়া দিলেন।ক্রমে ক্রমে সকল সভ্যই তাঁহার সঙ্গে বিচিত্র অঙ্গ ভঙ্গী-সহকারে, দারুণ উৎসাহ ভরে সেই গানে যোগ দিলেন।জল ঝড়ের মাতামাতির চেয়ে আমাদের মাতামাতিই তখন বেশী ছিল 

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো ,
আকুল নয়ন জলে ঢালো গো কিরণ ধারা॥
প্রথম প্রকাশ; হেমন্ত ১৮৮০

রবীন্দ্রনাথের ভগ্নহৃদয় গীতিকাব্যটি গ্রন্থাকারে বেরোয় ১৮৮১ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে। এটি তাঁর চতূর্থ প্রকাশিত গ্রন্থ। কবির বয়স এখন উনিশ। এইগ্রন্থেই আমরা প্রথম উৎসর্গপত্রে দেখতে পাচ্ছি তার আগের বইগুলি উৎসর্গ ছাড়াই প্রকাশিত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথের বইতে উৎসর্গপত্রের ব্যবহার খুবই কম – তাঁর জীবিতকালে প্রকাশিত ২০৮টি বাংলা গ্রন্থের মাত্র ৬৪টিতে উৎসর্গপত্র দেখা যায়, এবং তার মধ্যে সাতটি গ্রন্থই কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করা। তাদের মধ্যে প্রথমটি এই ‘ভগ্নহৃদয়’। (এর দুদিন পরে বেরোয় রুদ্রচন্ড, সে বইটি উপহার দেওয়া হয়েছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে)। উপহারপৃষ্টায় এই গানটি মুদ্রিত রয়েছে, তার উপরে লেখা আছে, ‘শ্রীমতি হে-কে’। এই ‘শ্রীমতি হে’-র পরিচয় নিয়ে এককালে প্রভূত গবেষণা হয়েছে, তব উনি যে কাদম্বরী দেবী তাতে এখন আর কোনও সন্দেহ নেই। ম্যাকবেথ নাটকের প্রধানা ডাইনির নাম ছিল হেকেটি, রবীন্দ্রনাথ রঙ্গ করে কাদম্বরীকে এই নামে ডাকতেন।

গানটি ব্রহ্মসংগীত হিসেবে গাওয়া হলেও গীতবিতান-এ স্থান পেয়েছে ‘প্রেম’ পর্যায়ে। গানটি স্বামী বিবেকানন্দের খুব প্রিয় ছিল। অন্তত দু-বার তিনি গানটি রামকৃষ্ণদেবকে গেয়ে শুনিয়েছেন বলে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণকথামৃত-তে উল্লেখ পাওয়া যায়।

একবার রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীর সাথে চন্দননগরের তেলেনিপাড়ার এক বাগানবাড়িতে, গঙ্গার ধারে, সেখানেই এই পদটিতে তিনি সুর দেন। ‘ছেলেবেলা’-য় লিখছেন, –

“… গঙ্গার ধারের প্রথম যে বাসা আমার মনে পড়ে, ছোটো সে দোতলা বাড়ি। নতুন বর্ষা নেমেছে। মেঘের ছায়া ভেসে চলেছে স্রোতের উপর ঢেউ খেলিয়ে, মেঘের ছায়া কালো হয়ে ঘনিয়ে রয়েছে ও বনের মাথায়। অনেকবার এইরকম দিনে নিজে গান তৈরি করেছি, সেদিন তা হল না। বিদ্যাপতির পদটি জেগে উঠল আমার মনে,

“এ ভরা বাদর মাহ ভাদর,
শূন্য মন্দির মোর।’


(কথা বিদ্যাপতি। সুর রচনা রবীন্দ্রনাথ ১৮৮১)
নিজের সুর দিয়ে ঢালাই করে রাগিণীর ছাপ মেরে তাকে নিজের করে নিলুম। গঙ্গার ধারে সেই সুর দিয়ে মিনে-করা এই বাদল-দিন আজও রয়ে গেছে আমার বর্ষাগানের সিন্ধুকটাতে। মনে পড়ে, থেকে থেকে বাতাসের ঝাপটা লাগছে গাছগুলোর মাথার উপর, ঝুটোপুটি বেধে গেছে ডালে-পালায়, ডিঙি নৌকা গুলো সাদা পাল তুলে হাওয়ার মুখে ঝুঁকে পড়ে ছুটেছে, ঢেউগুলো ঝাঁপ দিয়ে দিয়ে ঝপ ঝপ শব্দে পড়ছে ঘাটের উপর। বৌঠাকরুন ফিরে এলেন; গান শোনালুম তাঁকে; ভালো লাগল বলেন নি, চুপ করে শুনলেন।

হ্যাদে গো নন্দরানী
প্রথম প্রকাশ; গ্রীস্ম ১৮৮৪
জীবনস্মৃতিতে এই গানটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিচারণ করেছেন; “… কারোয়ার হইতে ফিরিবার সময় জাহাজে প্রকৃতির প্রতিশোধ -এর কয়েকটি গান লিখিয়াছিলাম। বড়ো একটি আনন্দের সঙ্গে প্রথম গানটি জাহাজের ডেকে বসিয়া সুর দিয়া-দিয়া গাহিতে-গাহিতে রচনা করিয়াছিলাম–
হ্যাদে গো নন্দরানী–
আমাদের শ্যামকে ছেড়ে দাও
আমরা রাখাল বালক গোষ্ঠে যাব,
আমাদের শ্যামকে দিয়ে যাও।


কারোয়ার থেকে বোম্বাই হয়ে রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী রেলপথে কলকাতায় ফিরে আসেন নভেম্বরের শেষ দিকে – সুতরাং গানটি ১৮৮৩ সালের নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে রচিত হয়েছিল এরকম অনুমান করা যেতে পারে। এ গানটির সুরের পরিবর্তন করা হয়েছিল বলে মনে হয় –প্রথম প্রকাশিত হয় রবিচ্ছায়া গ্রন্থে, সেখানে সুরনির্দেশ ছিল ঝিঁঝিট খাম্বাজ, কিন্তু পরে গীতবিতানে তা বদলে হয়েছিল ভৈরবী খেমটা।

কেহ কারো মন বুঝে না, কাছে এসে সরে যায়।
সোহাগের হাসিটি কেন চোখের জলে মরে যায়॥
রচনা ১৮৮৪
নলিনী নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে নবীনের গান হিসেবে ব্যবহৃত হলেও গানটির প্রথম দেখা পাওয়া যায় কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে রচিত পুস্পাঞ্জলি নামের গদ্যরচনাটিতে। সেখানে গানটির আগে এই অনুচ্ছেদটি আছে;
“… তুমি যে-ঘরটিতে রোজ সকালে বসিতে, তাহারই দ্বারে স্বহস্তে যে-রজনীগন্ধার গাছ রোপণ করিয়াছিলে তাহাকে কি আর তোমার মনে আছে। তুমি যখন ছিলে, তখন তাহাতে এত ফুল ফুটিত না, আজ সে কত ফুল ফুটাইয়া প্রতিদিন প্রভাতে তোমার সেই শূন্য ঘরের দিকে চাহিয়া থাকে। সে যেন মনে করে বুঝি তাহারই ‘পরে অভিমান করিয়া তুমি কোথায় চলিয়া গিয়াছ! তাই সে আজ বেশি করিয়া ফুল ফুটাইতেছে। তোমাকে বলিতেছে– তুমি এসো, তোমাকে রোজ ফুল দিব। হায় হায়, যখন সে দেখিতে চায় তখন সে ভালো করিয়া দেখিতে পায় না– আর যখন সে শূন্য হৃদয়ে চলিয়া যায়, এ জন্মের মতো দেখা ফুরাইয়া যায়– তখন আর তাহাকে ফিরিয়া ডাকিলে কী হইবে! সমস্ত হৃদয় তাহার সমস্ত ভালোবাসার ডালাটি সাজাইয়া তাহাকে ডাকিতে থাকে। আমিও তোমার গৃহের শূন্যদ্বারে বসিয়া প্রতিদিন সকালে একটি একটি করিয়া রজনীগন্ধা ফুটাইতেছি– কে দেখিবে! ঝরিয়া পড়িবার সময় কাহার সদয় চরণের তলে ঝরিয়া পড়িবে! আর-সকলেই ইচ্ছা করিলে এ ফুল ছিঁড়িয়া লইয়া মালা গাঁথিতে পারে, ফেলিয়া দিতে পারে– কেবল তোমারই স্নেহের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও ইহাদের উপরে আর পড়িবে না ”!…

চলিয়াছি গৃহপানে, খেলা ধুলা অবসান।
ডেকে লও,ডেকে লও, বড়ো শ্রান্ত মন প্রাণ।
প্রথম প্রকাশ; ভাদ্র ১২৯১ (শরৎ ১৮৮৪)
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু হয় ১৮৮৪ সালের এপ্রিল মাসে; গীতবিতানে কালানুক্রমিক সূচিতে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অনুমান করেছেন, এই ঘটনার পরপরই গানটি রচিত হয়ে থাকবে। প্রশান্তকুমার পালও তাঁর অনুমানের সমর্থন করে লিখেছেন, ‘আমাদেরও মনে হয় কাদম্বরী দেবী বা হেমেন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধবাসরে হয়তো গানটি গীত হয়।

দীর্ঘ জীবনপথকত দুঃখতাপকত শোকদহন–
গেয়ে চলি তবু তাঁর করুণার গান॥
প্রথম প্রকাশ; গ্রীস্ম ১৮৮৫
৮ বৈশাখ ১২৯১ তারিখে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুদিন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অনুমান করেছেন, সম্ভবত এই দিনটির বর্ষপূর্তির স্মরণে গানটি রচিত হয়েছিল।

ওহে জীবনবল্লভওহে সাধনদুর্লভ,
আমি মর্মের কথা অন্তরব্যথা কিছুই নাহি কব–
শুধু জীবন মন চরণে দিনু বুঝিয়া লহো সব।
রচনা; ২২. ৪. ১৮৯৪। কলকাতা।

এই দিনটিতে কাদম্বরী দেবীর দশ বছর পূর্ণ হল। সেই স্মৃতিতে কয়েক দিন ধরেই তাঁর মন ভারাতুর হয়ে ছিল। দীর্ঘ দুমাস কাল পাতিসরের জমিদারিতে কাটিয়ে কলকাতায় ফিরেছেন চৈত্র মাসের শেষে, এসে উঠেছেন সেই ঘরটিতেই যেখানে কাদম্বরী দেবী থাকতেন। তাঁর শোচনীয় মৃত্যুর পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়ি ত্যাগ করে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কাছে পার্ক স্ট্রীটে থাকতে আরম্ভ করেন, এই ঘরটি রবীন্দ্রনাথের অধিকারে আসি। সেই ঘরে ফিরে পরপর রচনা করলেন কয়েকটি কবিতা, সেগুলো পরে তাঁর চিত্রা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে –
‘স্নেহস্মৃতি’(বর্ষশেষ ১৩০০), ‘নববর্ষ’(নববর্ষ ১৩০১), ‘দুঃসময়’(৫বৈশাখ ১৩০১), ‘মৃত্যুর পরে’ (৫বৈশাখ ১৩০১)—প্রতিটি কবিতার মধ্যেই স্মরণ বেদনার ছাপ রয়েছে। স্মৃতিমেদুর সপ্তাহটি চূড়া স্পর্শ করল দশ বছর পূর্তির দিনটিতে – সেদিন সুরাটি কীর্তনের সুরে রচিত হল এই গানখানি। ১৯১৪ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে রবীন্দ্রনাথ সপ্তাহ তিনেকের জন্য ছিলেন এলাহাবাদে – ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের জামাতা প্যারিলাল বন্দোপাধ্যায়ের বাগানঘেরা বাড়িতে। এই সময়ে সহসা এই বাড়িতে একটি ছবি চোখে পড়ল – বহুদিন আগেকার কোনও প্রিয়জনের ছবি।  তিনি কি বউ ঠাকুরাণীর একটা বাঁধানো ছবি দেখেছিলেন? ‘এই ছবি কবিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল লিখতে, সেই রাত্রেই রচনা করলেন এই কবিতাটি,

“তুমি কি কেবল ছবিশুধু পটে লিখা
ওই যে সুদূর নীহারিকা”

কার ছবি ছিল সেটি? এই নিয়ে বহুকাল ধরে বহু তর্ক চলছে। ক্ষিতিমোহন সেন ও চারু বন্দোপাধ্যায়ের মতে এ ছবি মৃণালিনী দেবীর। প্রশান্তচন্দ্র মহালনাবিশের মতে কাদম্বরী দেবীর। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ইঙ্গিত করেছেন এই কবিতা লেখার ক’দিন পর যেমন আগ্রায় না গিয়েই ‘সাজাহান’ কবিতা লিখেছিলেন, এমনও হতে পারে এ কবিতাও তেমনি কারও সত্যিকার ছবি দেখার অভিঘাতে নয়। আবার মৈত্রেয়ী দেবী লিখছেন;

“… মনে পড়ে একদিন একটি ছোটো মেয়েকে ‘ছবি’ কবিতাটা বোঝাচ্ছিলেন। বোঝাতে বোঝাতে বললেন –- একবার এলাহাবাদে সত্যর ঘরে পুরানো জিনিসপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে ছবি খানি পেলুম, হঠাৎ ছবি খানা দেখে মনে হল, কী আশ্চর্য! এই কিছুদিন আগে যে আমাদের মাঝখানে এত সত্য হয়ে, জীবনে এতখানি হয়েছিল, আজ সে কত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের জীবন ছুটে চলেছে, কিন্তু সে থেমে গেছেঐ খানে। কত টুকুই বা আর তাঁকে মনে পড়ে? কিন্তু তবু – তোমারে কি গিয়েছিনু ভুলে? ভুলেছি বটে, কিন্তু সে ভোলা কি রকম? তুমি আমার জীবনের মধ্যে অত্যন্ত বেশি হয়ে আছ বলেই সর্বদা তোমাকে মনে করতে হয়না। যেমন আমাদের যে চোখ আছে, সে কথা কি আমরা সর্বদা মনে করি – যে আমাদের চোখ আছে, চোখ আছে? তবু চোখ আছে বলেই তো আমরা দেখতে পাই।তেমনি সর্বদা মনে করিনে বটে যে তুমি ছিলে তুমি ছিলে – কিন্তু জীবনের মূলে তুমি আছ বলেই, তুমি একদিন এসেছিলে বলেই আমার ভুবন এত আনন্দ ময়, আমার জীবনে এত মাধুর্য।…

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ লিখেছেন;
“… ১৩২১সালে কার্তিক মাসে কিছুদিন এলাহাবাদে তাঁর ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ গাঙ্গুলির বাস করেছিলেন। কবির কাছে শুনেছি এই বাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী, কবির নতুন বৌঠানের একখানা পুরানো ফটো তাঁর চোখে পড়ে, আর এই ছবি দেখেই বলাকার-ছবি ‘ছবি’ নামে কবিতাটি লেখেন ”…

গানটিতে অবশ্য সুর দেন কথা রচনার পনের বছর পরে, তাঁর সপ্ততিতম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে। প্রথম গাওয়া হয় ‘শাপমোচন’এর গান হিসেবে, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৩১ তারিখে।

ADVERTISEMENT

 

ঋণ: রবীজীবনী – প্রশান্তকুমার পাল / রবীন্দ্ররচনাবলী / গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ – সমীর সেনগুপ্ত

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait