কে সেই গারজেন, যাঁর একটি অদৃশ্য তর্জনী শরৎচন্দ্রের ইচ্ছা ও সাহিত্যকে নিঃশব্দে নিয়ন্ত্রণ করত

কে সেই গারজেন, যাঁর একটি অদৃশ্য তর্জনী শরৎচন্দ্রের ইচ্ছা ও সাহিত্যকে নিঃশব্দে নিয়ন্ত্রণ করত

শরৎচন্দ্রের গারজেন
 

শরৎচন্দ্র এক চিঠিতে রাধারাণী দেবীকে লিখেছিলেন, “আমার একজন ‘গারজেন’ ছিলেন। এর পরিচয় জানতে চেয়ো না। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, তার মত কড়া তাগাদাদার পৃথিবীতে বিরল। এবং তিনিই ছিলেন আমার লেখার সব চেয়ে কঠোর সমালোচক। তাঁর তীক্ষ্ণ তিরস্কারে না ছিল আমার আলস্যের অবকাশ, না ছিল লেখার মধ্যে গোঁজমিলের সাহায্যে ফাঁকি দেবার সুযোগ। এলো-মেলো একটা ছত্রও তার কখনো দৃষ্টি এড়াতো না”।

কে সেই গারজেন? রাধারাণী দেবীর মতে যাঁর একটি অদৃশ্য তর্জনী শরৎচন্দ্রের ইচ্ছা ও সাহিত্যকে নিঃশব্দে নিয়ন্ত্রণ করত, যে নিয়ন্ত্রণ কে শরৎচন্দ্রের হৃদয় কোন দিন অস্বীকার করতে পারে নি।

“এখন তিনি সব ছেড়ে ধৰ্ম্ম-কৰ্ম্ম নিয়েই ব্যস্ত। গীতা-উপনিষদ ছাড়া কিছুই আর তার চোখে পড়ে না। কখনো খোঁজও করেন না এবং আমিও বকুনি ও তাড়া খাওয়া থেকে এজন্মের মত নিস্তার পেয়ে বেঁচে গেছি। মাঝে মাঝে বাইরের ধাক্কায় প্রকৃতিগত জড়তা যদি ক্ষণকালের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠে, তখনি আবার মনে হয়—ঢের ত লিখেচি—আর কেন? এ জীবনের ছুটিটা যদি এইদিক থেকে এমনি করেই দেখা দিলে তখন মিয়াদের বাকী দু-চারটে বছর ভোগ করেই নিই না কেন? কি বল রাধু? এই কি ঠিক নয়? অথচ লেখবাৱ কত বড় বৃহৎ অংশই না অলিখিত রয়ে গেল। পরলোকে বাণীর দেবতা যদি এই ক্রটির জন্য কৈফিয়ৎ তলব করেন তো তখন আর একজনকে দেখিয়ে দিতে পারবো এই আমার সান্ত্বনা”।

ADVERTISEMENT

অথচ আশ্চর্য এই চিঠির মাত্র তিনদিন পরে ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ২৩শে বৈশাখ তারিখে রাধারাণী দেবীকেই অন্য একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন শরৎচন্দ্র যে ক্রমশ বার্ধক্যের দিকে এগোচ্ছেন, ‘গারজেন’ নাকি তা স্বীকার করতে চান না। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ৬ জ্যৈষ্ঠ তারিখে রাধারাণী দেবীকে লেখা শেষ চিঠিতেও শরৎচন্দ্রের অভিমানাহত হৃদয় থেকে প্রগাঢ় বেদনা যেন ঝরে পড়েছে যখন তিনি বলছেন, তার আসন্ন উপস্থিতিকে উদাসীনভাবে গ্রহণ করে তাঁর জীবিতকালে “আরও তো কেউ (অর্থাৎ ‘গারজেন’) একেবারে নিরুদ্দেশের আড়ালে মিলিয়ে গেছেন”।

আমরা ধরে নিতে পারি, দেবদাস পড়েছিলেন ‘গারজেন’। তাঁর প্রতিক্রিয়া কি ছিল তা জানার কোনও উপায় নেই। হয়ত সেই প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে দেবদাস প্রকাশ না করার রহস্য।

তবে একটা চিঠিতে প্রমথনাথকে লিখেছিলেন— “দেবদাস’ নিয়ো না, নেবার চেষ্টাও করে না। … ওটার জন্য আমি নিজেও লজ্জিত। ওটা immoral, বেশ্যা চরিত্র ত আছেই, তাছাড়া আরও কি কি আছে বলে মনে হয় যেন”।

‘গারজেন’ শরৎচন্দ্রের মনোজগতে আরাধ্যা হয়ে থেকেছেন, বাস্তবে থেকেছেন বহুদূরে। শরৎচন্দ্রের সান্নিধ্য থেকে দূরে উদাসিনী-যোগিনীর জীবন কাটিয়ে গেছেন।

আর শরৎচন্দ্র? নিজের প্রতি বীতরাগ হয়ে, দেশ ছেড়ে, সাহিত্য সাধনা ছেড়ে, সুদূরপ্রবাসে ছন্নছাড়া হয়ে জীবনে নতুন পথ খুঁজে বেড়িয়েছেন। চোখে সন্ধানী আলো নিয়ে মানুষ খুঁজেছেন। কোথায় আছে জীবনের সার্থকতা? অপূর্ণতার মধ্যে পূর্ণতা।

একসময়, এই শরৎচন্দ্র বিভূতিভূষণ ভট্টদের বাড়িতে মিশে সেখানে নিজের একটা আস্তানা করেছিলেন এবং সেই আস্তানায় বসে দিন-রাত অজস্র গল্প-উপন্যাস লিখতেন এবং পড়তেন। শরৎচন্দ্র এই সময় মাতুল সুরেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রনাথ (মাতামহের তৃতীয় ভ্রাতার পুত্র), এঁদের বন্ধু যোগেশচন্দ্র মজুমদার এবং প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্ট ও তাঁর ছোট বোন নিরুপমা দেবী প্রভৃতিকে নিয়ে একটা সাহিত্য সভাও গঠন করেছিলেন। সপ্তাহে একদিন করে সাহিত্য সভার অধিবেশন হত। সেদিন সভায় সভ্যরা যে যাঁর লেখা পড়তেন। নিরুপমা দেবী সভায় যেতেন না। তিনি তাঁর দাদা বিভূতিবাবুর হাত দিয়ে লেখা পাঠিয়ে দিতেন।

যোগমায়া ও নফরচন্দ্র ভট্টর কন্যা নিরুপমা ছেলেবেলায় ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত। তার সুন্দর কচি মুখে পাকা পাকা কথা শুনে সকলে তাকে ডাকত ‘বুড়ি’ বলে। সে কালের রীতি অনুযায়ী ১৮৯৩ সালে মাত্র দশ বছর বয়সে নিরুপমার বিয়ে হয় নদিয়া জেলার সাহারবাড়ির নবগোপাল ভট্টর সঙ্গে। বিয়ের চার বছরের মাথায় যক্ষ্মা রোগে নবগোপাল মারা যান ১৮৯৭ সালে। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে বালবিধবা হয়ে নিরুপমা ফিরে আসেন ভাগলপুরে তাঁর পিতৃগৃহে। নফরচন্দ্র তখন কর্মসূত্রে ভাগলপুরবাসী। বিধবা নিরুপমা যখন ভাগলপুরে এলেন, তিনি তখন একেবারে অন্য মানুষ। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। আগের সেই ছটফটে ভাবটাও উধাও। এই বদলে যাওয়া বাল্যসখীকে দেখে সাহিত্যিক অনুরূপাদেবী অবাক হয়ে যান। একটা চিঠি লেখেন নিরুপমাকে। তাঁকে নতুন করে জীবনবৃত্তে ফিরিয়ে আনতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা একটি কবিতাও পাঠান। নিরুপমা দেবীর জীবনীকার চিত্ররেখা গুপ্ত পারিবারিক সূত্র ঘেঁটে জানিয়েছেন, ওই চিঠির হদিশ পাওয়া যায়নি বটে, কিন্তু এর পরেই নাকি নিরুপমা তাঁর নীরবতা ভাঙেন। তিনিও কবিতাতেই সেই চিঠির উত্তর দিয়ে লেখেন, “জন্ম যে দেয় মৃত্যু দেবে/ কাজ কি তবে এত ভেবে/ সুখের সাথে মাথায় তোল দুখ।”

তিনি অবশ্য বেছে নিয়েছিলেন মধ্যপন্থাকে। হিন্দু বিধবার আচারসর্বস্ব জীবনকে তিনি বর্জন করেননি কোনও দিন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যকে আঁকড়ে ধরে মনের জানালাগুলো খুলে দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন অনন্য এক সাহিত্যসাধিকা। তাঁর এই ‘হয়ে ওঠা’ সম্ভব হয়েছিল এক দিকে নিজের শিক্ষাদীক্ষার হাত ধরে, অন্য দিকে দাদা বিভূতিভূষণ ও কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রেরণায়।

শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নিরুপমার পরিচয় ঘটেছিল এক আবেগবিহ্বল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। নিরুপমা তখন ভাগলপুরে। ‘এখনকার খঞ্জরপুরের বাঙালিটোলায়’। দাদা বিভূতিভূষণ ও তাঁর বন্ধুরা তখন সেখানে উদীয়মান সাহিত্যিক যুবক শরৎচন্দ্রের সান্নিধ্যে মুগ্ধ। রাতের অন্ধকারে ‘যামুনিয়া নদীর তীর থেকে ভেসে আসে বেপরোয়া, স্বেচ্ছাচারী অমৃত গরলে মেশা রোমান্টিক যুবক ‘ন্যাড়া’ ওরফে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গান, কখনো বা বাঁশির সুর’।

শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নিরুপমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল এক আকস্মিক ও নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে। নিজেই তা লিখে গিয়েছেন তিনি, “শ্রাদ্ধান্তে যখন... ভ্রাতৃজায়ার সঙ্গে বাড়ী ফিরিতেছি, দেখি শরৎ দাদা আমাদের বাড়ীর দিক হইতে পুঁটুলির মত কি লইয়া আসিয়া ছোট্‌দার হাতে দিলেন। ছোট্‌দা তাহা ভ্রাতৃজায়ার হাতে দিলে দেখি একখান পাড়ওয়ালা কাপড় ও হাতের গহনা – শ্রাদ্ধের পূর্বে যাহা বাড়ীতে খুলিয়া রাখা হইয়াছে। মনের উত্তেজনায় বোধহয় সে সময় আবার সেগুলা লইতে অনিচ্ছা প্রকাশই হইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু সে জিদ সেদিন জয়ী হইতে পারে নাই। মাতৃসমা ভ্রাতৃজায়া তো কাঁদিতেই ছিলেন— ছোট্‌দা মুখ ফিরাইয়া চোখ মুছিতেছে এবং একজন বাহিরের লোক— তিনিও তাহাদের সঙ্গে কাঁদিতেছেন।”

নিরুপমার বৈধব্যকে শরৎচন্দ্র মেনে নিতে পারেননি। তিনি লিখেছেন, “আমার সত্যকার শিষ্যা, এবং সহোদরার অধিক একজন আছে, তাহার নাম নিরুপমা। ...এই মেয়েটি যখন তাহার ষোল বৎসর বয়সে অকস্মাৎ বিধবা হইয়া একেবারে কাঠ হইয়া গেল, তখন আমি তাহাকে বার বার এই কথাটিই বুঝাইয়াছিলাম, ‘বুড়ি, বিধবা হওয়াটাই যে নারী জন্মের চরম দুর্গতি এবং সধবা থাকাটাই সর্বোত্তম সার্থকতা ইহার কোনটাই সত্য নয়’। তখন হইতে সমস্ত চিত্ত তাহার সাহিত্যে নিযুক্ত করিয়া দিই।”

নিরুপমাকে চিরকাল ভালবেসেছেন শরৎচন্দ্র। তাঁর সাহিত্য সাধনায় প্রেরণা জুগিয়েছেন নানা ভাবে। বিভূতিভূষণ ও তাঁর বন্ধুদের শরৎচন্দ্র বলতেন, ‘কুঁড়ি সাহিত্যিক’-এর দল। কারণ তখন তাঁরা নাকি ‘ফুটি’ ‘ফুটি’ করছেন। এই দলের ‘গুরু’ ছিলেন শরৎচন্দ্র। তাঁরই পরামর্শে একটি হাতে লেখা কাগজ প্রকাশ করা হত। সেই কাগজে বিভূতিভূষণ ও তাঁর সাহিত্যিক বন্ধুদের লেখা ছাপা হত। লেখা নিয়ে হত আলোচনাও। কাগজটির নাম ছিল ‘ছায়া’। এই আলোচনায় সভ্যদের লেখা পাঠ করা হত। সঙ্গে এক জন অন্তঃপুরচারিণীর লেখাও তাঁর ‘ছোট্‌দা’র মারফত এসে পড়ত সভ্যদের হাতে। বিভূতিভূষণ লিখেছেন, ‘ইনি আমাদের বন্ধুদের দৃষ্টিপথের অন্তরালে থাকিয়াও আমাদের বন্ধুবর্গের একান্ত আপনার ছোট বোনটিই হইয়াছিলেন।”

এই ছোট বোন নিরুপমা তখন অজস্র কবিতা আর গল্প লিখে চলেছেন। যার কিছু কিছু ছাপাও হয়েছিল ‘ছায়া’ পত্রিকায়। শরৎচন্দ্রের ‘পরামর্শ’ দাদা বিভূতিভূষণের হাত ঘুরে আসত নিরুপমার কাছে, “আরো যাও— আরো যাও— দূরে— থামিও না আপনার সুরে।” আর এই ভাবেই কবিতা লিখতে লিখতে এক দিন নিরুপমা লিখে ফেলেছিলেন ‘উচ্ছৃঙ্খল’ গল্পটি।

দুর্গাদাস ভট্টর লেখা থেকে জানা যায়, শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের সম্পর্কে নিজের মতামত নিরুপমা দেবী লিখে রাখতেন তাঁর ডায়েরিতে। নায়িকারা সকলেই বিধবা। তাদের যে ছবি শরৎচন্দ্র তুলে ধরছেন তাঁর লেখায়, তার সঙ্গে নিরুপমা কি মিলিয়ে নিতে চাইতেন নিজের জীবন এবং ভাবনাকে? আজ তা জানা অসম্ভব। তবে চিত্ররেখা গুপ্তর মতে, ‘বড়দিদি’র মাধবী, ‘পথ-নির্দেশ’-এর হেম, ‘মন্দির’-এর অপর্ণা, ‘পল্লীসমাজ’-এর রমা, ‘চরিত্রহীন’-এর কিরণময়ী সবাই বিধবা। এই সব বিধবা চরিত্র চিত্রণের নেপথ্যে শরৎচন্দ্রের বিশেষ কোনও মানসিকতা কাজ করেছিল কি না এ প্রশ্ন মনে জেগে থাকতে পারে। নিরুপমাও বিব্রত হয়ে থাকতে পারেন।”

কিন্তু যখন দেখা যায় নিরুপমা নিজে কলম ধরছেন এবং নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার উপরে ভিত্তি করে আঁকছেন হিন্দু বাঙালি বাড়ির বিধবাদের দুর্দশা, হতাশা, যন্ত্রণার কথা। আর শরৎবাবু তার প্রশংসা করছেন, সোনার কলম উপহার দিচ্ছেন, পত্রিকার সম্পাদকদের অনুরোধ করছেন নিরুপমার লেখা ছাপাতে, তখন মনে হয় শরৎচন্দ্র ও নিরুপমার মধ্যে নিশ্চয়ই এক আশ্চর্য সুন্দর ‘সাহিত্য-বন্ধন’ গড়ে উঠেছিল। যার স্বীকৃতি সে যুগে সম্ভব ছিল না। বরং জুটেছিল নিন্দা ও কুৎসা। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিরুপমার মধ্যে জন্ম হয়েছিল এক মরমী সাহিত্যিকের। যিনি নিজে বাংলার সকল বিধবার হয়ে কথা বলছেন। কাটাছেঁড়া করে বুঝিয়ে দিতে চাইছেন তাঁদের মনন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, যন্ত্রণা ও সীমাবদ্ধতা। আর ‘সাহিত্যদূত’ হয়ে তা পৌঁছে যাচ্ছে ‘প্রিয়তম’র কাছে। বর্মায় বসেও একাকী শরৎচন্দ্র নিরুপমার লেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতেন। তিনি লিখেছেন, “সে যাহা লেখে, একটুখানি অংশ আমি মনে মনে আদায় করিয়া নদীর ধারে জেটির উপর বসিয়া পরিপাক করি এবং কামনা করি যেন বাঁচিয়া থাকিয়া বিশেষ একটু ভাল জিনিষের স্বাদগ্রহণ করিতে পারি”।

তৎকালীন বাংলার সাহিত্য মহলে এই দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। নিরুপমার ব্যক্তিজীবন এতই বিষিয়ে উঠেছিল যে, শেষে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন শরৎচন্দ্রকে চিঠি লিখে জানাতে, “আর এখানে আসিবেন না। আমাকে এ’ভাবে নষ্ট করিবেন না।” নবনীতা দেবসেনের মা সাহিত্যিক রাধারাণীদেবী উল্লিখিত নিরুপমার এই চিঠি নাকি আজীবন তাড়িয়ে বেরিয়েছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। এরই প্রকাশ ঘটেছে দু’জনের সাহিত্যে। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত নিরুপমার ‘দিদি’ উপন্যাসের উমা বলে ওঠে, “যাও, তুমি যাও, কেন এসব বল্লে, কেন এসেছিলে? আমি শুনব না, তুমি যাও।” আর পরের বছর ১৯১৬ সালে প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’-এর রমার উক্তি, ‘আমি মিনতি করছি রমেশদা, আমাকে সব দিকে নষ্ট করো না। তুমি যাও।’ শরৎ ও নিরুপমার সাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হলে

হয়তো সম্পর্কের এক সুপ্ত দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

নিরুপমা দেবী বিখ্যাত লেখিকা অনুরূপা দেবীর বান্ধবী ছিলেন। অনুরূপা দেবী তাঁর মাসতুতো ভাই সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের কাছে এই গল্পটি বলেছিলেন। সৌরিনবাবু বলেন: দিদির বান্ধবীটি ছেলেবেলা থেকেই একটু আধটু ধর্ম-কর্ম করতেন। কিন্তু প্রথম যৌবনেই অকস্মাৎ বিধবা হয়ে যাওয়ায়, তার এই ধর্মকর্মের মাত্রাটা আরও অনেকগুণ বেড়ে যায়। তখন তিনি ভাগলপুরে তাঁর পিতার কাছে শরৎচন্দ্রদের পল্লীতেই থাকতেন। একদিন তিনি ঘরের দাওয়ায় বসে বঁটিতে পূজার ফল কাটছেন। বাড়ির সকলে কোথায় যেন গেছেন। কেবল তিনিই একা বাড়িতে আছেন। এমন সময় হঠাৎ শরৎচন্দ্র কোথা থেকে এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। এসেই বললেন, এই যে কেমন আছ?

বাড়িতে কেউ নেই, এই অবস্থায় শরৎচন্দ্রকে সামনে দেখে দিদির বান্ধবী অত্যন্ত সঙ্কুচিতা হয়ে পড়লেন এবং তখনই তিনি শরৎচন্দ্রকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বললেন। আর একটু রূঢ়ভাবেই বললেন।

শরৎচন্দ্র অগত্যা আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন। শরৎচন্দ্র দিদির বান্ধবীর দাদাদের বন্ধু ছিলেন। শরৎচন্দ্রের ওই ভাবে একাকি বাড়ির মধ্যে যাওয়ায় এবং তাঁর সাথে কথা বলার চেষ্ঠা করাকে তিনি আদৌ ক্ষমা করতে পারলেন না। দাদারা বাড়ি ফিরে এলে, তিনি দাদাদের কাছে নালিশ করে বললেন – তোমাদের বন্ধুটি কি রকম লোক বলত? বাড়িতে কেউ নেই তবু বাড়ির ভিতরে ঢুকে আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন।

জপতপপরায়ণা, কঠোর ব্রহ্মচারিণী, বালবিধবা ওই ভদ্রমহিলা সেদিন শরৎচন্দ্রকে এমনি ভাবই সরিয়ে দিয়েছিলেন।

শরৎচন্দ্র তাঁর ‘গারজেন’ সম্বন্ধে বলেছেন – “তিনি অত্যন্ত ধর্ম-কর্ম পরায়ণা ছিলেন, সেকথা খুবই সত্য। ঐ ভদ্রমহিলা জীবন ভোরই বার-ব্রত ও ধর্ম-কর্ম নিয়েই ছিলেন। একথা রাধারাণী দেবী অনুরূপা দেবী ছাড়াও শরৎচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও বলে থাকেন।

উক্ত ভদ্রমহিলার আচারনিষ্ঠা সম্বন্ধে শরৎচন্দ্রের বন্ধু এবং অনুরূপা দেবীর মাসতুতো ভাই সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় বলেন –

অনুরূপা দিদির বান্ধবী বলে আমি তাঁকে দিদি বলতাম। সেই দিদি একবার আমাদের কলকাতার বাড়ীতে এসেছিলেন। আমার যদিও ব্রাহ্মণের আচার-নিষ্ঠা এবং বাচ-বিচার যথাসম্ভব মেনে চলি, তবুও তিনি আমাদের বাড়িতে এসে, ধোয়া রান্নাঘর আবার নিজের হাতে গোবর দিয়ে নিকিয়ে নিলেন। বাসন-কোসনও নিজের হাতে ধুয়ে, তাতে রান্না করে, তবে খেলেন।

কঠোর ব্রহ্মচর্যপরায়ণা, ধর্মশীলা, বালবিধবা এই ভদ্রমহিলার প্রতি শরৎচন্দ্রের একতরফা এই হৃদয় দৌর্বল্যের কথা, তিনি হয়ত তেমন জানতেনই না।

যাই হোক্, তবুও এই ভদ্রমহিলার জন্য শরৎচন্দ্রের একটি মস্ত বড় ত্যাগের কাহিনী যা আমরা জানি, সেটিও মোটে উপেক্ষার নয়:

শরৎচন্দ্র উক্ত মহিলা সাহিত্যিক মহোদয়ার দাদাদের বন্ধু ছিলেন। ঐ ভদ্রমহিলা ছেলেবেলায় তাঁর দাদাদের মারফৎ শরৎচন্দ্রের ‘শুভদা’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি একবার পড়েছিলেন। ফলে শুভদার প্রভাব তাঁর প্রথম বয়সের লেখা একটি উপন্যাসে বিশেষভাবে পড়ে। পরে ঐ উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে, শরৎচন্দ্র পড়ে দেখেন যে, তাতে তাঁর শুভদা উপন্যাসের কাহিনীর যথেষ্ঠ প্রভাব রয়েছে।

শুভদা প্রকাশিত হলে, পাছে ওই মহিলা লেখিকা হেয় হয়ে পড়েন, এই ভেবে শরৎচন্দ্র তাঁর শুভদা উপন্যাসটি আর ছাপালেনই না। তবে পাণ্ডুলিপিটি নষ্ট না করে রেখে দিলেন এই আশায় যে, অবসর পেলে পরে গল্পটিকে বদলে আবার নতুন করে লিখবেন। শুভদার পাণ্ডুলিপি দীর্ঘকাল পড়ে রইল। শরৎচন্দ্রের অবসর আর হয়ে উঠল না। তখন শরৎচন্দ্র শেষ বয়সে একদিন ওটিকে আর না রেখে পুড়িয়ে ফেলাই ঠিক বলে মনস্থ করলেন। শরৎচন্দ্র ওই সময়ে তাঁর হাওড়া জেলার সামতাবেড়ের বাড়িতে থাকতেন। একদিন তিনি তাঁর সম্পর্কীয় ভাগ্নে রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়কে বহু পুরন কাগজপত্রের সাথে শুভদার পাণ্ডুলিপিটিও পোড়াতে দিলেন। শুভদা বইটি একটি সুন্দর বাঁধানো মোটা খাতায় লেখা ছিল। ওরকম একটা সুন্দর খাতায় লেখা পাণ্ডুলিপি দেখে রামকৃষ্ণবাবু শরৎচন্দ্রকে বললেন – এটা কেন পোড়াতে দিচ্ছেন?

উত্তরে শরৎচন্দ্র বললেন – ওটাকে পুড়িয়ে ফেলতেই হবে। আমার ওই বই বেরুলে, একজন অত্যন্ত হেয় হয়ে পড়বেন। রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কিন্তু শুভদার পাণ্ডুলিপিটা না পুড়িয়ে কাগজ পোড়াবার সময় এক ফাঁকে সেটাকে সরিয়ে রাখলেন এবং পরে সেটা এনে শরৎচন্দ্রেরই একটি আলমারীর বইয়ের পিছনে লুকিয়ে রাখলেন।

শরৎচন্দ্র এর কিছুই জানতে পারলেন না। তিনি বরং রামকৃষ্ণবাবুকে কাগজ পুড়িয়ে ফিরলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন – ‘কি রে সেই মোটা খাতাটা পুড়িয়েছিস তো?

উত্তরে রামকৃষ্ণবাবু বলেছিলেন – আজ্ঞে হ্যাঁ।

শরৎচন্দ্রের কাছে যে তাঁর বাল্য-রচনা শুভদা নামে একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আছে, একথা তাঁর বন্ধুদের কেউ কেউ জানতেন। শরৎচন্দ্রের বন্ধুরা শুভদার পাণ্ডুলিপিটি পড়বার জন্য শরৎচন্দ্রকে খুবই পীড়াপীড়ি করতেন। শরৎচন্দ্র কিন্তু কাউকেই পাণ্ডুলিপিটি দেখাননি। শরৎচন্দ্রের স্নেহভাজন বন্ধু বাতায়ন-সম্পাদক অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় এইসময় শুভদা পাণ্ডুলিপিটি পড়বার জন্য একবার খুব জেদ করেন। শরৎচন্দ্র তখন তাঁকে খানিকটা পোড়া ছাই দেখিয়েছিলেন।

এই ঘটনার কিছুদিন পরেই কিন্তু শরৎচন্দ্র একদিন সামতাবেড়ের বাড়িতে আলমারির বই ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ ‘শুভদা’র পাণ্ডুলিপি দেখতে পেলেন। দেখে বুঝলেন, রামকৃষ্ণবাবু সেদিন তাঁর কাছে মিথ্যা কথা বলেছিলেন এবং পাণ্ডুলিপিটি না পুড়িয়ে এইখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

শুভদা’র পাণ্ডুলিপি পোড়ানোর ব্যাপারে রামকৃষ্ণবাবুর মিথ্যে কথাটা যে শরৎচন্দ্র একদিন আলমারীর যে জায়গায় পাণ্ডুলিপিটি লুকানো ছিল, সেইখান থেকে খানকতক বই রামকৃষ্ণবাবুকে নামিয়ে আনতে বললেন।

রামকৃষ্ণবাবু বলেন – মামা হঠাৎ ওখান থেকে খান কতক বই আনতে বলায় আমি বুঝতে পারলাম, তিনি নিশ্চয়ই ‘শুভদা’র পাণ্ডুলিপি খানা ওখানে দেখেছেন, এবং আমি যে মিথ্যা কথা বলেছি, সে বিষয়ে আমাকে শিক্ষা দেবার জন্যেই এরকম বলেছেন। মামার কথা শুনে ভয়ে আমার বুক কাঁপতে লাগল। যাই হোক, বই নামিয়ে দিয়েই আমি সেখান থেকে সরে পড়লাম।

শরৎচন্দ্র কি ভেবে পাণ্ডুলিপিটি আর পোড়ালেন না, বা নষ্ট করলেন না। রেখেই দিলেন। হয়ত ভেবেছিলেন, যখন পাণ্ডুলিপিটা রক্ষা পেয়েই গেল, তখন থাক, পরে পারি তো নতুন কিছু লিখব। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। তাঁর মৃত্যুর পরে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স এই বইটি প্রকাশ করেন।

শরৎচন্দ্র শেষ বয়সে কলকাতায় বালীগঞ্জে বাড়ি করেছিলেন। তাঁর বাড়ির অদূরের ছিল কবি-দম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণী দেবীর বাড়ি। কলকাতায় থাকার সময় শরৎচন্দ্র প্রায়ই এঁদের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। রাধারাণী দেবী বলেন যে, তাঁদের বাড়িতে কখনও কথা প্রসঙ্গে পূর্বোক্ত ওই মহিলা সাহিত্যিক মহোদয়ার কথা উঠলে, শরৎচন্দ্র চুপ করে থাকতেন। আর যদিও তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলতেন, তো অত্যন্ত শ্রদ্ধার সহিতই তাঁর নাম উচ্চারণ ককরতেন। ধর্মভাবা, পবিত্র চরিত্রবলসম্পন্না, ওই মহীয়সী মহিলার প্রতি শরৎচন্দ্র শ্রদ্ধা না জানিয়ে থাকতে পারেন নি।

 

ঋণঃ- শরৎ রচনাবলী। শরৎচন্দ্রের প্রণয় কাহিনী – শ্রীগোপাল চন্দ্র রায়।

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait