শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ
“অফলাকাঙ্খিতভির্যজ্ঞো বিধিদিষ্ট য ইজ্যতে।
ষষ্টব্যমেবেতি মনঃ সমাধায় স সাত্ত্বিকঃ”।। (শ্রীমদ্ভগবতগীতা, সপ্তদশ অধ্যায়, শ্লোকঃ১১)
অর্থাৎ ফলকামনাবিহীন ব্যক্তিগণ অবশ্য কর্তব্য বোধে মনকে একাগ্র করে যে শাস্ত্র বিহিত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন তাহাকে সাত্ত্বিক যজ্ঞ নামে অভিহিত করা হয়।
মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বে গীতার এই মহাবাণীর এক যথার্থ উদাহরণ রয়েছে। যজ্ঞ যে শুধু সাধুমহাত্মারাই করেন তা নয়, দেবতাদের হবি প্রদান করে তুষ্ট যে তাঁরাই করেন তা নয়, গৃহীরাও যে কোনও অংশে সাত্ত্বিক যজ্ঞে কম পারদর্শী নন তার উল্লেখ আছে এই পর্বে। সে যজ্ঞে নাই বা থাকল হবি, থাকে অন্তরের সর্বশ্রেষ্ঠ আহূতি – সেবা। এই সেবা ধর্মই ভারতবর্ষের আদি ও শাশ্বত সত্য।
মহর্ষী বৈশ্বম্পায়ন মহারাজ জনমেজয়কে সেই মহাযজ্ঞের বৃত্তান্ত শুনিয়েছিলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞের পর সম্রাট যুধিষ্ঠিরের যখন দিকে দিকে ব্যাপ্তি লাভ করল তখন তিনি ঠিক করলেন এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করবেন। যজ্ঞসভার ঋত্বিকগণ প্রভূত ধন উপহার পেলেন। সমাগত রাজন্যবর্গকে মহামূল্যবান রত্ন, হস্তী, সোনা ইত্যাদি উপহার দেওয়া হল। এছাড়াও দরিদ্র আতুর নির্বিশেষে প্রজাগণও যথেষ্ট পরিমাণে ধনসম্পত্তি লাভ করলেন। এই উপহার সামগ্রীর সঠিক মূল্যায়ণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। চারিদিকে রাজচক্রবর্ত্তী যুধিষ্ঠিরের নামে ধন্য ধন্য রব উঠল। তখন ঐ যজ্ঞসভায় এক নকুল(নেউল) এসে উপস্থিত হল। তার চোখ নীলবর্ণ এবং তার শরীরের এক অংশ সোনার বর্ণে রঞ্জিত। অন্য অংশ সাধারণ।
ADVERTISEMENT
সে কিছুক্ষণ ঐ পরিত্যক্ত যজ্ঞভূমিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল এবং নিরাশ হয়ে উপস্থিত রাজন্যবর্গ ও ব্রাহ্মণবর্গকে বলল – “আপনারা এই যজ্ঞের ও তার হোতাকে ধন্য ধন্য করছেন, কিন্তু এ যজ্ঞ আমার মতে শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ নয়। কুরুক্ষেত্র নিবাসী এক ব্রাহ্মণ যে দান করেছিলেন তার সাথে এই যজ্ঞের তুলনা হয় না”। নকুলের এই কথা শুনে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ হাসাহাসি করতে লাগলেন এবং নকুলের এই প্রলাপের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। নকুল হেসে বলল – “আমি মিথ্যা বলি নি। আমার অভিজ্ঞতা শুনলে আপনারা আমার উক্তির যাথার্থ বুঝতে পারবেন”।
নকুল তার গল্প শুরু করল – “কুরুক্ষেত্রে এক ব্রাহ্মণ ভিক্ষার দ্বারা দিনাতিপাত করতেন। দূর্ভিক্ষের ফলে চারিদিকে তখন খুব অনটন। অনেক দিন অনাহারের পরে একদিন তিনি ভিক্ষার দ্বারা কিছু যব সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে এসে তা দিয়ে ছাতু তৈরি করলেন। সপরিবারে ভোজনের উপক্রম করেছেন, সেই সময় তাঁর দরজায় এক ক্ষূধার্ত ব্রাহ্মণ এসে কিছু খাদ্য ভিক্ষা চাইলেন। গৃহস্থ সেই ব্রাহ্মণকে নিজের ভাগের ছাতু নিবেদন করলেন। তাতে ব্রাহ্মণের ক্ষূধা না মেটায় গৃহস্থের গৃহীণী তাঁর ভাগের ছাতু ব্রাহ্মণকে নিবেদন করলেন। কিন্তু তাতেও ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হল না। এরপর একে একে গৃহস্থের পুত্র ও তার সাধ্বী স্ত্রী তাঁদের অংশ ব্রাহ্মণকে নিবেদন করলেন। গৃহস্থ স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূকে নিবৃত্ত করতে চাইলেও তাঁরা তা শুনলেন না। বরং বললেন অতিথি সেবাই দেব সেবা। প্রাণ যায় যাক কিন্তু অতিথি সেবার পূণ্য থেকে তাঁরা নিরস্ত হতে চান না”।
তখন অতিথি ব্রাহ্মণ রূপী ধর্ম বললেন – “হে গৃহীশ্রেষ্ঠ! তোমার সেবা অতি শুদ্ধ ও নিঃস্বার্থ। দেব-দানব-গন্ধর্ব-যক্ষ সবাই তোমার এই অতিথি পরায়ণতা দেখে বিস্মিত। ক্ষূধায় ধৈর্য নষ্ট হয়, কিন্তু তুমি ও তোমার পরিবার নিজের ক্ষূধার অন্ন দান করে এক লোকাতীত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছ। ধর্মে স্থিত থাকার ফলে তূমি অনন্ত ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হলে। স্ত্রী -পুত্রাদির সাথে অনন্ত কাল তা ভোগ কর”।
নকুল আরও বলল – “দিব্যযানে করে সেই গৃহস্থ ও তার পরিবার স্বর্গে গেলেন। আমি তখন গর্ত থেকে বেড়িয়ে ঐ ভুক্তাবশেষের ওপর গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। তখন গৃহস্থের সেবা ধর্ম জনিত তপঃ প্রভাবে আমার শরীরের এক অংশ কাঞ্চনময় হল। সেই থেকে আমি বিবিধ যজ্ঞস্থলে গড়াগড়ি দিয়েছি। কিন্তু আমার শরীরের অপর অংশ এক ই রকম হয়ে রয়ে গেছে। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে এসেও আমি বিফল মনোরথ হলাম। তাই বলছি সেই গৃহস্থ যা দান করেছিলেন তা আমার কাছে এ পর্যন্ত দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ দান”। – এ কথা বলে নকুল চলে গেল।
নিঃস্বার্থ দান ভারতবর্ষের ঐতিহ্য, শিক্ষা এবং তা কর্তব্য রূপে বিবেচিত হয়। শিক্ষা দান শ্রেষ্ঠ দান, কিন্তু অন্ন দান শ্রেষ্ঠতর। ক্ষূধার্ত, আর্ত জীবের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার চাইতে পবিত্র কর্তব্য আর কিছুই হতে পারে না।
মহাভারতের এই রকম উপদেশ সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই উপদেশ গুলি নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
0 comments