মর্যাদাপুরুষোত্তম
এ এক রাজপুত্রের গল্প। গুণ, মান, শিক্ষা, পিতামাতার প্রতি ভক্তি, এক আদর্শ রাজপুরুষ হওয়ার প্রত্যেকটি গুণ যাঁর মধ্যে পরিপূর্ণ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অদম্য সাহসিকতা এবং সমাজব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করে তোলার প্রতিজ্ঞা। সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য মাঝে মধ্যে ছোটো ভাইগুলোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ভয়ঙ্কর সব রাক্ষস কে বধ করার জন্য। মুনি ঋষিরা এই চার ভাই, বিশেষত বড় ভাইটির ওপর খুবই প্রসন্ন। বৃদ্ধ রাজা দশরথ একজন যোগ্য উত্তরসূরীর হাতে দেশের ভার তুলে দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত। এর মধ্যে আবার চার ছেলের বিবাহও সুসম্পন্ন হয়েছে, মিথিলার রাজা জনক এবং তাঁর ভাই কুশধ্বজের চার কন্যার সাথে। মোটের ওপর সরযুতীরের রাজপরিবারে খুশির হাওয়া।
কিন্তু ভগবান যখন স্বয়ং অবতরিত হন, তখন সুখের শয়ন তাঁর জন্য কোনোকালেই হয় না। শুধু ভগবান কেনো, যাঁরা মানুষের সেবার জন্য কাজ করেন, তাঁদের প্রত্যেককে ভীষণ কঠিন সময়ের পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এবারেও তাঁর ব্যতিক্রম হলো না। হঠাৎ করে শ্রীরামচন্দ্রের মেজোমার খেয়াল হলো, তাঁর নিজের ছেলে ভরতকে রাজা করতে হবে, এবং রামকে চোদ্দ বছরের জন্য বনে যেতে হবে। রামচন্দ্র তাই মেনে নিয়ে পিতৃসত্য পালনের জন্য বনে গেলেন। কিন্তু ভরত কি সেরকম ভাই নাকি? স্বয়ং বিষ্ণুপার্ষদ তিনি, দেহ ধরে এসেছেন। শ্রীরামচন্দ্রের পাদুকা মাথায় নিয়ে সেই পাদুকা সিংহাসনে বসিয়ে রামচন্দ্রের নামে দেশ শাসন করতে লাগলেন। লক্ষণ তো দাদার সাথেই বনে গেলেন, আরেক ভাই শত্রুঘ্ন সন্ন্যাসীর মত জীবনযাপন করতে লাগলেন।
ADVERTISEMENT
এ কি শুধু সমাপতন? না, বরং এ এক শিক্ষা। রাজার ছেলে, যাঁদের কোনো অভাব থাকার কথা নয়, তাঁরা স্বেচ্ছায় সন্ন্যাসীর মত জীবনযাপন করতে লাগলেন। এর কি দরকার ছিল? দরকার ছিল। ত্যাগের সনাতন ভারতীয় আদর্শ মানুষকে শেখানোর তাগিদ ছিল। এই তো আমাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। হ্যাঁ, আমরা সগর্বে এই 'পুরাণ' কে 'ইতিহাস' বলবো, কারণ ইতিহাস আমাদের যা কিছু মহান, তাকেই অনুসরণ করে চলতে শেখায়। আমাদের মহান যা কিছু, সব এই মহাকাব্যগুলি থেকেই পাওয়া।
অতঃপর বনবাসের শেষ বছরে মা সীতার এক রাক্ষস কর্তৃক অপহরণ এবং রামচন্দ্র কর্তৃক সেই দুষ্টের বধ আমাদের বার্তা দেয় যে মহিলাদের প্রতি যারা লোলুপ দৃষ্টি রাখে, তাদের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কোনো ছল, কোনো নীতিই সেই দুষ্কৃতকারীকে বাঁচাতে পারে না। একবার ভেবে দেখা উচিৎ, এই অভিযানে অবতারপুরুষকে যে বানরসেনা সাহায্য করেছিল, তাদের বুদ্ধি এবং বিক্রম কতোটা। সেই যুগে দাঁড়িয়ে রামচন্দ্র তো এক বিপ্লব করলেন! মানুষের সাহায্য না নিয়ে পিছিয়ে পড়া বর্গের সাহায্য নিলেন। সাম্যবাদের শ্রেষ্ঠ আদর্শ! আজ আমরা কথায় কথায় 'বানর' বলে কোনো বিশেষ সম্প্রদায়কে অপমান করি, আসলে আমাদের নিজেদের জ্ঞানের অভাব। তলিয়ে দেখলে বুঝব সেযুগে দাঁড়িয়ে সমাজব্যবস্থার মধ্যে সাম্যবাদকে রামচন্দ্রই প্রথম প্রতিষ্ঠা করলেন।
তাঁর স্ত্রী মা সীতা ছিলেন মহাসতী।কিন্তু তাঁকেও অপবাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারা গেলো না, এ এক এমনই সমাজ। রামচন্দ্র কিন্তু সহজেই পারতেন নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে সমাজের মুখ চাপা দিতে, কিন্তু তা তিনি করেন নি। একজন সাধারণ মহিলার জন্য যা প্রতিবিধান এক শাসক আইন অনুযায়ী দিতে পারেন, সেই একই প্রতিবিধান মহারানীর জন্যও। আজকালকার দিনে ভাবা যায়? তাহলে এঁকে সাম্যবাদী বলবো না তো কাকে বলবো? বৈকুন্ঠের মহালক্ষীরও বা কি দরকার ছিল সারাজীবন এতো কষ্ট সহ্য করার? তিনি তো রাজরাজেশ্বরী! কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় এ দন্ড মাথা পেতে নিলেন। এ আর কিছুই নয়, তাঁরা যুগলে দেখালেন যে তাঁরাও সমাজব্যবস্থার উর্ধে নন, সমাজের মাপকাঠিতে সবাই এক ও অভিন্ন। সাম্যবাদ একেই বলে, পরম্পরা রক্ষা একেই বলে, সনাতন ঐতিহ্যকে ধারণ করে রাখা একেই বলে।
এমনি এমনিই এই মহান ভুখন্ডে হাজার হাজার বছর ধরে রামচন্দ্র অবতার হিসাবে পূজা পেয়ে আসছেন না। তাঁর এবং মা সীতার ত্যাগের আদর্শ ব্রহ্মান্ডের শেষ দিন পর্যন্ত জ্বলজ্বল করে জ্বলবে, যে কুকথা বলার সে তো বলবেই। তাতে কি মহামানবের প্রতি আস্থা ক্ষুন্ন হয়? আজও ভাতৃত্রের আদর্শ হিসাবে লক্ষন, ভরত এবং শত্রুঘ্নর নামই নেওয়া হয়, আদর্শ পুত্র হিসাবে রামচন্দ্রের কথাই মনে পরে,আর আদর্শ স্ত্রী হিসাবে মা সীতাই আমাদের পূজনীয়া। এই ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কোনো অশুভ শক্তির নেই।
আজ রামনবমীর পবিত্র দিনে সেই মর্যাদাপুরুষোত্তম এবং মায়ের পায়ে কোটি কোটি প্রণাম জানাই!
জয় শ্রী রাম! জয় সিয়ারাম।
ছবি সৌজন্য : Yuga Parivartan
0 comments